পদ্মফুল পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
268

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৫|

শীত শেষে এবার বসন্তের ডানা মেলার পালা। পুরো দমে সে প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতিতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। শীতের দাপটে নেতিয়ে পড়া গাছগুলো এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ডালে ডালে নতুন পাতা জন্মাচ্ছে। সেই সাথে জন্মাচ্ছে রঙ বেরঙের ফুল। তাদের সৌন্দর্য প্রকৃতি মুগ্ধ হচ্ছে। চোখ জুড়াচ্ছে শহরের মানুষগুলোর। আর তারই ধারায় শহর জুড়ে প্রস্তুতি চলছে বসন্ত বরণের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণগুলো নতুন রঙে সেজে উঠছে। ছাত্র ছাত্রীগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের সাজগোজ আর সাংস্কৃতিক কাজগুলো নিয়ে। আর সেই সুরেই টং এর দোকানের হালিম চাচার ভাঙ্গাচুরা রেডিও তে বাজছিল, ” বসন্ত এসে গেছে…বসন্ত এসে গেছে..”

.

৪’ঠা বসন্ত, ১৪২৯। সুন্দর একটা সকাল। বাইরে মিষ্টি রোদ। অন্যদিন গুলোর মতোই সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও আজকের দিনটা একটু বেশিই সুন্দর। মায়া আশ্রমের মানুষগুলো আজ সকাল থেকে একটু বেশিই ব্যস্ত। কেউ রান্না নিয়ে দৌড়া দৌড়’ই করছে তো কেউ আবার ঘর দোর পরিষ্কার করতে নেমেছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই পদ্ম দেখতে পেল সকলের ব্যস্ততা। কিছুটা অবাক হলো সে। বড়ো বড়ো হাই তুলে সে বড়ো লিভিং রুম’টা তে গেল। তার রুমমেটরা সবাই এখানে। পদ্ম সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী ব্যাপার আপু, সবাই আজ সকাল থেকে এত কাজ করছে কেন? আজ কিছু আছে নাকি?’

মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে একজন বললো,

‘সেকি তুমি জানো না?’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘না তো। কী আজকে?’

‘আজকে অভি ভাইয়ের জন্মদিন।’

‘ওমা তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। প্রতি বছর উনার বার্থ ডে তে আমরা অনেক আনন্দ করি। এবার ও তাই সকাল থেকে সব প্রস্তুতি চলছে।’

পদ্ম খুশি খুশি গলায় বললো,

‘ঠিক আছে তাহলে, আমি এক্ষুণি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাদের কাজে হেল্প করছি।’
.

পদ্ম সহ বাকি সব মেয়েরা বাগানে গেল। সেখান থেকে তাজা ফুল নিয়ে তারা রুম সাজাবে। অভির আর্টিফিসিয়াল ফুল একদমই পছন্দ না। তাই তাকে খুশি করতে এত আয়োজন। বসন্তের শুরু। ফুলে ফুলে ভরে গেছে বাগান। কী নিদারুণ তাদের সৌন্দর্য। বেশ ফুরফুরে মেজাজে মেয়েগুলো ফুল তুলছে। হঠাৎ তার মধ্যে থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল,

‘এই সবাই দেখো, অভি ভাইয়ের হ্যান্ডসাম ডাক্তার বন্ধু চলে এসেছে। চল উনাকে ফুল দিয়ে স্বাগতম জানাই।’

তার জবাবে আরেকটা মেয়ে ধমক দিয়ে বললো,

‘মাথা খারাপ হয়েছে তোর? দেখছিস না আপা আছে সাথে। তোর জন্য সবাইকে বকা খেতে হবে।’

ওদের কথা শুনে ব্যাপারটা দেখার জন্য পদ্ম গেইটের দিকে তাকাল। দেখল আদিদ এখানকার আপার সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকছে। এতগুলো দিন পর আদিদকে দেখে পদ্ম বিস্মিত হলো। নিষ্প্রভ হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। এই পাঁচ মাসে মানুষটা অনেকটাই বদলেছে। নিজের হয়তো আর তেমন যত্ন নেয় না। চোখগুলো কেমন বসে গেছে। চুল দাঁড়ি যে বড়ো হয়েছে সেদিকেও হয়তো তার খেয়াল নেই। মুখটাও খুব ফ্যাকাশে লাগছে। হয়তো ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করছে না।

আদিদ বাগানের পাশ দিয়েই যাওয়ার সময় হঠাৎ থামল। ঘাড়া ঘুরিয়ে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল সে। নরম গলায় সুধাল,

‘কেমন আছেন, পদ্ম?’

পদ্ম হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও ভালো আছি।’

‘আচ্ছা। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন।’

‘ঠিক আছে।’

তারপর ওরা ভেতরে চলে গেল। তখন সেই মেয়েটা বললো,

‘খালি পদ্ম আপুকেই জিজ্ঞেস করলো। আমাদেরও একটু ভালো খারাপ জিজ্ঞেস করলে কী হতো?’

আবার তার পাশের মেয়েটা তাকে ধমক দিল। বললো,

‘উনি পদ্ম-কে চেনে তাই ওর সাথে কথা বলেছে। আমাদের কি চেনে যে আমাদের সাথে কথা বলবে? এত বেশি পকপক না করে এখন তাড়াতাড়ি ফুল তুল।’

মেয়েটা মন খারাপ করে আবার ফুল তুলতে লাগল।
বেশ অনেক ফুল তুলেছে তারা। অনেকগুলো ঝুড়ি হয়েছে। সেগুলো নিয়ে একে একে সবাই ভেতরে গেল। লিভিং রুমেই আদিদ বসা ছিল। আর তার সাথে বসে কথা বলছিল এই আশ্রমের মহিলা পরিচালিকা দুজন। ডিস্টার্ব হবে ভেবে কেউ কোনোরূপ শব্দ না করে ভেতরে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মাঝেই আবার ঐ মেয়েটি বলে উঠল,

‘ডাক্তার সাহেব, দেখুন আমরা অনেক ফুল তুলেছি। আপনার কি কোনো ফুল লাগবে?’

ওর কথায় বাকি মেয়েগুলো থমকে গেল। তারা জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পদ্ম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। ষোল বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে, চোখ পড়েছে তার উনত্রিশ বছরের এক পুরুষের উপর। এই বয়সে চোখে সবাইকেই সুন্দর লাগে, আকর্ষণীয় লাগে। এই মেয়েটার কাছেও হয়তো আদিদ-কে তেমনি লাগছে। সেখানকার আপা দু’জন বিরক্ত হয়ে তাকালে অন্য মেয়েগুলো বলে উঠল,

‘এই রাণী চলতো।’

মেয়েটা তো গেলই না। উল্টো সে আরো আদিদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। উদ্বেগ নিয়ে বললো,

‘কী হলো, আপনি কিছু বলছেন না কেন? আপনার কি ফুল পছন্দ না?’

আদিদ মুচকি হেসে বললো,

‘পছন্দ।’

মেয়েটা খুশি হলো খুব। উত্তেজিত গলায় বললো,

‘কোন ফুল প্রিয় আপনার?’

আপা খানিকটা রাগি গলায় বললেন,

‘উনাকে বিরক্ত কেন করছো রাণী। অভি শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে।’

মেয়েটা মুখ কালো করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিদ বললো,

‘না না, আমি বিরক্ত হচ্ছি না।’

সে আবার মেয়েটার দিকে তাকাল। বললো,

‘আমার পদ্ম ফুল পছন্দ।’

কথাটা শুনে পদ্ম বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। আদিদেরও হঠাৎ মনে হলো, এখানে পদ্ম ফুল বলাটা হয়তো তার ঠিক হয়নি। পদ্ম সামনে আছে বলে সে অস্বস্তিতে পড়ে গেল খুব। রাণী হেসে বললো,

‘আমার কাছে তো এখন পদ্ম ফুল নেই তবে গোলাপ ফুল আছে। নিবেন?’

আদিদ হালকা হেসে জবাব দিল,

‘না, এগুলো সব অভির জন্য রেখে দাও। আমার এখন ফুল লাগবে না।’

রাণী ঠোঁট উল্টে বললো,

‘আচ্ছা।’

তারপর সে সেখান থেকে চলে গেল। রাণী রুমে ঢুকতেই সবগুলো মেয়ে তাকে ইচ্ছে মতো বকলো। কেবল পদ্ম’ই তাকে কিছু বললো না। তার তো ভালো লাগছে। যখন থেকে সে শুনেছে আদিদের পদ্ম ফুল পছন্দ তখন থেকেই কেন যেন মনটা তার খুশিতে লাফাচ্ছে। পদ্ম ফুল তো তারও পছন্দ। তার নামের সাথে নাম মিলে বলে না, এমনিতেই এই ফুলটা তার পছন্দ। আজকে রাণী না জিজ্ঞেস করলে সে কখনো জানতেই পারতো না যে ডাক্তারবাবুরও পদ্ম ফুল পছন্দ। ভাগ্যিস, রাণী জিজ্ঞেস করেছিল…

আজকে দুপুরে অনেক কিছু রান্না করা হলো। আদিদ পুরোটা সময় এখানেই ছিল। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সে পদ্ম-কে ডেকে আনল। পদ্ম এলো। বললো,

‘ডেকেছিলেন আমায়?’

আদিদের তাকাল তার দিকে বললো,

‘হ্যাঁ, বসুন।’

পদ্ম অন্য একটা সোফায় বসলো। আদিদ তারপর বললো,

‘আজকে যে অভির জন্মদিন, সেটা জানেন নিশ্চয়ই?’

পদ্ম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। আদিদ বলে,

‘ওর জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিব বলেই আমি এখানে এসেছি। ও জানে না আমি যে এখানে আছি। সন্ধ্যার দিকে ও হয়তো এখানে আসতে পারে। আমি এর মাঝেই ওর জন্য ছোট্ট একটা আয়োজন করতে চাইছি। এখন তার জন্য আমার আপনাদের সবার হেল্প লাগবে। কারণ আমার এসবের ব্যাপারে খুব একটা আইডিয়া নেই তো, তাই।’

পদ্ম উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,

‘সমস্যা নেই। আমরা সবাই আপনাকে সাহায্য করবো।’

‘আচ্ছা। আর আমার তার জন্য কিছু কেনাকাটাও করতে হবে, আসলে এইবার হয়তো লাস্ট বারের মতো আমি ওর বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে পারবো। কারণ কয়েক মাসের মধ্যেই আমি দেশের বাইরে চলে যাবো…একেবারের জন্য। আর সেখানের’ই একটা হসপিটালে আমি ডক্টর হিসেবে জয়েন করবো। তাই ভাবছি শেষ বারের মতো ওর বার্থ ডে টা আমি আমার নিজের মন মতো করে যাই। আর তাই চাই, যেন খুব গুছিয়ে সব কিছু হয়। আচ্ছা, আপনি কি এখন ফ্রি আছেন? যেতে পারবেন আমার সাথে?’

পদ্ম মাথা নিচু করে বললো,

‘জ্বি, পারবো।’

‘ঠিক আছে তাহলে, আপনি তৈরি হয়ে আসুন; আমি গাড়ি বের করছি।’

আদিদ উঠে বাইরে গেল। পদ্ম শুকনো মুখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো,

“ডাক্তারবাবু একেবারের জন্য চলে যাবেন…কেন?”

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৬|

একগাদা জিনিস পত্র নিয়ে আদিদ আর পদ্ম আশ্রমে ফিরে আসে। পদ্ম আদিদের উপর ভীষণ বিরক্ত। সে এত এত শপিং করেছে যেন এটা কোনো বাচ্চার বার্থডে। অদ্ভুত! অভির ত্রিশ বছর হবে বলে কি তাকে ত্রিশ’টা গিফ্টই দিতে হবে? এটা কোথাও লেখা আছে নাকি যত বছর হবে ততটা গিফ্ট।

এত এত জিনিস পত্র দেখে আশ্রমের সকলের চোখ চড়কগাছ। এর আগেও প্রতিবার আদিদ এখানে এসে অভির সাথে কেক কেটেছে। কিন্তু এত আয়োজন কোনো বেলায়’ই ছিল না।

আদিদ আশ্রমের সব মেয়েগুলোকে যার যার কাজ বুঝিয়ে দিল। আর সবাইকে খেয়াল রাখতে বললো, অভি যেন এসব ব্যাপারে কিছু বুঝতে না পারে।
বাগানের অপর পাশে বাঁশের ঝোপের মতো ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো হলো। ফুল আর বেলুনে ভর্তি সেই রুম। সবকিছু গুছিয়ে রুম থেকে একে একে মেয়েরা সব বেরিয়ে গেল। রাণী বের হওয়ার আগে একবার আদিদের কাছে গেল। তাকে লজ্জামাখা কন্ঠে বললো,

‘আপনার পছন্দ কিন্তু খুব সুন্দর, ডাক্তার সাহেব।’

তারপর সে হেসে সেখান থেকে চলে গেল। আদিদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। পদ্ম তখন আদিদের মুখ দেখে হেসে বললো,

‘কী হলো ডাক্তার সাহেব, মুখটা এমন করে রেখেছেন কেন?’

আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘মেয়েটা এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করে?’

‘হয়তো আপনার প্রেমে পড়েছে।’

কথাটা বলেই পদ্ম শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করে। পদ্ম’র হাসি দেখে আদিদ ব্রু যুগল আরো কুঁচকে যায়। সে তেতো মুখে বলে,

‘এসব আজাইরা কথা বলা বন্ধ করে আমাকে সাহায্য করুন।’

পদ্ম হাসি বন্ধ করে বললো,

‘সব কাজ না শেষ করলাম, আর কী করবো?’

আদিদ চোখের ইশারায় টেবিলের দিকে দেখিয়ে বললো,

‘এই গিফ্ট গুলো প্যাক করতে হবে না?’

পদ্ম মুখ কালো করে বললো,

‘এতগুলো গিফ্ট প্যাক করতে করতে তো দিনই শেষ হয়ে যাবে।’

‘শেষ হবে না। আমিও সাহায্য করবো। চলুন।’

পদ্ম সব নিয়ে ফ্লোরে বসলো। তারপর বললো,

‘বাকিদের ডেকে নিয়ে আসি?’

‘না না, ওদেরকে ডাকার দরকার নেই। ওরা আসলে ওদের সাথে রাণী ও আবার আসবে। আর এসে আমাকে জ্বালাবে। বাচ্চা মেয়ে বলে ধমকও দিতে পারিনা। একবার ছোট্ট একটা ধমক দিয়েছিলাম বলে কেঁদে কেটে দুনিয়া উদ্ধার করেছিল, আর না। আপনি আর আমিই পারবো করতে, ওদের প্রয়োজন নেই।’

পদ্ম মুচকি মুচকি হাসে। তা দেখে আদিদ বিরক্ত গলায় বলে,

‘হাসার মতো কিছু বলেনি। হাসি বন্ধ করে কাজে মনোযোগ দিন।’

আধ ঘন্টায় বিশ’টা গিফ্ট র‍্যাপিং করে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠল পদ্ম। তবে ভালোও লাগল খুব। আদিদ কাজটা খুব মনোযোগ দিয়ে করছিল। আর তাই তার র‍্যাপিং’টাও খুব সুন্দর হচ্ছিল। এই লোকটার সব কাজই এত নিঁখুত কেন? যেন এইটুকুও খাদ নেই কোনো কিছুর মাঝে। সবার শেষে একটাই জিনিস পড়ে রইল। পদ্ম দেখল একটা ছবি। কিন্তু আদিদ সেটাকে র‍্যাপ করেনি। সে সেটা তার পকেটে রেখে দিয়েছে। ছবিটাতে দুটো বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছিল। পদ্ম বললো,

‘ছবির ঐ বাচ্চাগুলো কারা?’

আদিদ তার দিকে তাকিয়ে জবাবে বললো,

‘আমি আর অভি।’

‘আপনারা কি খুব ছোট বেলার বন্ধু।’

‘হ্যাঁ, যবে থেকে আমরা বুঝতে শিখেছি তবে থেকেই আমরা একসাথে আছি।’

‘আচ্ছা, আপনাদের মাঝে কখনও ঝগড়া হয়নি?’

‘না হয়নি। তবে একবার আমি ওর সাথে খুব রাগ দেখিয়েছিলাম তাও বিনা কারণে। কিন্তু সেই রাগ আমার একদিনও টিকেনি। পর দিনই আবার সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ওর কাছে চলে যাই। জানেন, আজ যদি ও আমার পাশে না থাকত তবে হয়তো আমি নিঃস্ব হয়ে যেতাম। এই ছেলেটা যে আমার জন্য কী সেটা আমি কখনও কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না।’

আদিদ থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পদ্ম আলতো হেসে বললো,

‘আপনার মতো যদি একটা বেস্টফ্রেন্ড আমারও থাকতো!’

আদিদ তাকিয়ে রইল। পদ্ম চোখ নামিয়ে বললো,

‘চলুন বের হয়ে দেখি অভি ভাই এলো কিনা?’

পদ্ম উঠে দরজার কাছে যেতেই আদিদ তাকে ডাকল,

‘শুনুন পদ্ম..’

পদ্ম ঘুরে তাকিয়ে বললো,

‘কিছু বলবেন?’

আদিদ নরম গলায় বলে,

‘আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি? যদিও আমাদের বয়সের পার্থক্য’টা খানিক বেশি। বাট আই থিংক, বন্ধুত্বে কোনো বয়স মেটার করে না। আপনার কী অভিমত?’

পদ্ম যেন হতভম্ব হয়ে পড়ল। আদৌ সে ঠিক শুনছে তো? ডাক্তারবাবু কখনো তার সাথে এইভাবে কথা বলবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তার তখন আবার মনে হলো, হয়তো তিনি কিছুদিন পর চলে যাবেন তাই হয়তো পদ্ম’র উপর মায়া হচ্ছে উনার। তাতেও পদ্ম খুশি। হোক না কিছুদিনের ব্যাপার তাও তো সে ডাক্তারবাবুকে তার বন্ধু হিসেবে পাচ্ছে। এর থেকে বড়ো পাওয়া আর কী হতে পারে?

পদ্ম ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,

‘আপনি সত্যিই আমার বন্ধু হতে চান?’

‘হ্যাঁ, কেন না?’

পদ্ম শ্বাস টেনে বললো,

‘ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। আপনি খুব ভালো।’

‘আপনি ভালো বলেই আপনার চোখে সবাই ভালো। চলুন এবার, আর দাঁড়িয়ে থাকলে অভি চলে আসবে।’

‘ঠিক আছে, চলুন।’
.
.
সূর্য’টার প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো সেটা মেঘের আড়ালে তলিয়ে যাবে। দিনের আলো নিভে গিয়ে হয়তো রাতের অন্ধকার হানা দিবে। আর দিনের সেই অন্তিম সময়ে এসে, আশ্রমের সবাই উৎসুক হয়ে বসে আছে অভির অপেক্ষায়। তখনই বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল সবাই। আদিদ উৎফুল্ল গলায় বললো,

‘অভি চলে এসেছে। সবার মনে আছে তো কী কী করতে হবে?’

সবাই সমস্বরে বললো,

‘হ্যাঁ।’

অভি গাড়িটা সাইডে পার্কিং করে বের হয়ে এদিক ওদিক তাকাল। ভীষণ অবাক হলো সে। বাইরে কেউ নেই? সবাই কি ভুলে গেল তার যে আজকে জন্মদিন। অন্য সময় তো সবাই এসে তাকে একগাদা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় অথচ আজ তার কিছুই হচ্ছে না। আশ্চর্য!

অভি ভাবতে ভাবতে ভেতরে গেল। আশ্রমের মেইন বিল্ডিং’টাতে এসে আবার একবার থামল সে। এখানেও কেউ নেই। অভির ঠিক বিশ্বাস হলো না, সবাই এক সঙ্গে তার বার্থডে ভুলে গেল? এটা তো কখনো হয়নি।
অভি এবার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। লিভিং রুমে গিয়েই সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। আদিদ সোফায় বসা। আর বাকি সব মেয়েরা নিচে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে টি.ভি দেখছে। অভি ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। এটা কেমন কথা, সবাই তার বার্থডে ভুলে এইভাবে হা করে টি.ভি দেখছে কেন?

অভি চওড়া গলায় ডেকে উঠল,

‘আদিদ!’

আদিদ সহ বাকি সবাই তার দিকে তাকাল। সবাই খুব স্বাভাবিক। কেউ তাকে দেখে অবাক হলো না। কেউ তাকে শুভ কামনাও জানাচ্ছে না। অভি তো এবার রেগে গেল। সে গর্জে উঠে আদিদকে বললো,

‘তুই হঠাৎ এখানে কেন?’

আদিদ দায়সারা ভাবে বললো,

‘এমনি।’

‘এমনি মানে?’

‘আরে এমনি মানে এমনি। এদিকে এসে বস না। দেখ, আমরা একটা দারুণ সিনেমা দেখছি।’

অভি রাগে ফুঁসতে লাগল। সে কাউকে কিছু না বলে বড়ো বড়ো পা ফেলে উপরে উঠে গেল। আর সে চলে যেতেই সেখানে হাসির বন্যা বয়ে গেল।

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৭|

রাত এগারো’টার দিকে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। সময় গড়িয়ে চলছে, আর যত সময় যাচ্ছে অভির বিরক্তির মাত্রাটাও ততই বাড়ছে। আর কিছুক্ষণ পর বারো’টাও বেজে যাবে। তার জন্মদিন চলে যাবে। অথচ এই মানুষগুলো এখনও তাকে সামান্য উইশ পর্যন্ত করলো না। মানছে তার বয়স হয়েছে, সে আর ছোট নেই যে বাচ্চাদের মতো সবাই তার সাথে কেক কাটবে, হাত তালি দিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলবে কিন্তু তাই বলে কি তাকে সামান্য একটু শুভ কামনাও কেউ জানাতে পারে না? সবার কথা বাদই দিল, আদিদ…তারও কি মনে নেই?

অভি লিভিং রুমে বসে মোবাইল দেখছিল। আদিদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে তার পাশে বসলো। অভি সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘হসপিটালে যাবি না?’

আদিদ তার শার্টের দুটো বোতাম খুলে শার্টের কলার’টা একটু ঝেড়ে বললো,

‘না, ভাবছি আজকে এখানেই থাকবো।’

বিস্ময়ে যেন অভির কথা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। সে তীব্র গলায় বললো,

‘এখানে থাকবি মানে? তুই এখানে থাকতে যাবি কেন?’

‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’

অভির যেন সবকিছু কেমন আজগুবি লাগছে। কতক্ষণ সে ভাবল। আশ্রমের সবার ব্যাবহারই তার কাছে সন্দেহজনক লাগছে। এইভাবে একসাথে সবাই তার বার্থডে ভুলে যাওয়ার কথা না। নিশ্চয়ই ওদের পেটে পেটে কিছু একটা চলছে। আচ্ছা ওরা সবাই মিলে আবার তাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে না তো?

অভির মন আর মস্তিষ্ক তো তাই বলছে। অভি নিজের মন আর মস্তিষ্কের কথা বিশ্বাস করলো। সে হেলান দিয়ে সোফায় বসলো। বাঁকা চোখে আদিদের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তাহলে আজ আমিও এখানেই থাকবো, কী বলিস?’

আদিদ পাত্তা না দিয়ে বললো,

‘থাক, আমার তো কোনো আপত্তি নেই। তোর আশ্রম তুই থাকতেই পারিস।’

অভি মনে মনে হেসে তার ফোনের উপর আবার মনোযোগ দেয়। তখন সেখানে আবার রাণী আসে। ওকে দেখে আদিদ যেন বিষম খেল। লাল টকটকে এক শাড়ি পরে এসেছে সে। রাণীকে দেখা মাত্রই অভি হেসে বললো,

‘কী রে রাণী, রাত বিরেতে এমন পেত্নী সেজেছিস কেন?’

রাণী মুখ কালো করে বললো,

‘ডাক্তার সাহেব, আমাকে বুঝি পেত্নীর মতো লাগছে?’

আদিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। বললো,

‘কই না তো। সুন্দর লাগছে।’

রাণী মাথা নিচু করে মুচকি হাসল। ওর হাসি দেখে অভিও দাঁত কেলিয়ে হাসল। রাণী এবার মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,

‘আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আপনার কি লাল কালার পছন্দ? নাকি অন্য কোনো কালার?’

অভি ঠোঁট কামড়ে বললো,

‘তোর এত কিছু কেন জানতে হবে শুনি?’

রাণী কপাল কুঁচকে বললো,

‘তুমি কেন এত কথা বলছো? আমি তো ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলছি, উনাকে কথা বলতে দাও না। ডাক্তার সাহেব আপনি বলুন তো?’

রাণীর ব্যবহারে আদিদ বরাবরই অপ্রসন্ন। তাও সে হালকা হেসে জবাবে বললো,

‘আমার তেমন কোনো পছন্দের রং নেই।’

রাণী মন খারাপ করে বললো,

‘তাও এমন একটা রং তো আছে যেটা আপনার অন্য সবগুলো থেকে একটু বেশি ভালো লাগে?’

আদিদ ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘না বাবা, বললাম তো নেই।’

রাণী ঠোঁট উল্টে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আদিদ বিরক্ত গলায় বললো,

‘কী জ্বালায় পড়লাম, এখন যদি আমার পছন্দের রং না থাকে তাতেও তোমার মন খারাপ করতে হবে?’

রাণী জবাব দিল না। সে চলে যেতে নিলেই অভি তাকে ডাকে। বলে,

‘রাণী, এদিকে আয়।’

রাণী ধপ ধপ করে পা ফেলে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

‘কী?’

‘বস এখানে’

রাণী তার পাশে বসলো। অভি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘বয়স কত তোর?’

রাণী ব্রু কুঁচকে বললো,

‘কেন?’

‘এমনি, বল কত?’

‘ষোলো।’

‘আদিদের বয়স কত জানিস?’

‘ঊনত্রিশ।’

‘তোর থেকে তেরো বছরের বড়ো। ও যদি ঠিক বয়সে বিয়ে করতো তবে এতদিনে তোর বয়সী একটা মেয়েও থাকতো। আর তুই এসেছিস এই বয়সে এই বুড়োর সাথে প্রেম করতে?’

আদিদ দাঁতে দাঁত চেপে অভিকে বললো,

‘বেশি বলে ফেলছিস না? আরো দশ বছর আগে বিয়ে করলেও আমার এতদিনে ওর বয়সী কোনো মেয়ে থাকতো না।’

‘আরে মেয়ে তো থাকতো, তাই না? বয়স ডাস’ন্ট ম্যাটার। এই রাণী, বুঝেছিস কী বলছি? বাচ্চা একটা মেয়ে আর নজর পড়েছে বুড়ো এক বেটার উপর। তোর জন্য আমি আরো ভালো ছেলে নিয়ে আসবো। অযথা এই বুড়োর পিছে ঘুরে নিজের টাইম নষ্ট করিস না।’

রাণী কাঁচুমাচু করে বললো,

‘কিন্তু এই বুড়ো’টা তো অনেক ড্যাশিং।’

অভি হেসে ফেলল। আদিদ ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

‘উফফ, মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। এই বাচ্চা, আমার মাথা খারাপ না করে নিজের রুমে যাও। কী হলো যাও’

শেষের কথাটা বেশ জোরে বলায় রাণী ভয়ে ভয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আদিদ ক্ষুব্ধ চোখে অভির দিকে তাকিয়ে আছে। আর অভির হাসি থামছেই না। সে হাসতে হাসতেই বললো,

‘এই বুড়ো, তুই এত ড্যাশিং কেন রে?’

কথাটা বলে উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। আদিদ রাগে দাঁত পিষছে। সে তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাট কাট গলায় বললো,

‘চল, বাইরে চল।’

‘কেন, ড্যাশিং বুড়ো? বাইরে গিয়ে কী করবে?’

আদিদ রেগে গিয়ে বললো,

‘মেজাজ খারাপ না করে চলতো।’

আদিদ অভিকে নিয়ে বাইরে গেল। আর তারা বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকের সমস্ত লাইট অফ হয়ে গেল। অভি চমকে বললো,

‘কিরে লাইটের হঠাৎ কী হলো?’

আদিদ হেসে বললো,

‘ঐ তো লাইট।’

অভি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, সামনে অনেক মোমবাতি রাখা। সে সেটা দেখে মুচকি হাসল। আদিদ আবার বললো,

‘চল।’

আদিদের পেছন পেছন অভি সামনে যেতে লাগল। অভির আর বুঝতে বাকি রইল না এখানে কী হতে চলছে। আদিদ অভিকে সাথে নিয়ে সামনের বাঁশের ঘরের দরজাটা খুলতেই সব মেয়েগুলো এক সাথে “হ্যাপি বার্থডে” বলে চেঁচিয়ে উঠল। অভি বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে রইল। কত কী করেছে তারা। এত কিছু সে আশা করেনি। অভির তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তার বার্থডে’র জন্য এত কিছু? অভি আদিদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘শালা, অভিনয় তো ভালোই শিখেছিস।’

আদিদ হেসে বলে,

‘শুভ জন্মদিন, বন্ধু।’

তারপর সবাই তাকে একে একে উইশ করলো। উইশের পর্ব শেষে হতেই সবাই মিলে কেক কাটল। অভি সবাইকে কেক খাইয়ে দিল। তার মধ্যেই রাণী করলো আরেক কাজ, সে খুশির ঠেলায় গিয়ে আদিদের মুখে কেক মাখিয়ে দিল। আর সেটা নিয়ে আদিদ তো রেগে মেগে বোম্ব। আর যার ফলপ্রসূ সবার থেকে রাণীকে একগাদা বকা শুনতে হলো। যদিও আদিদ তাকে কিছু বলেনি কিন্তু বাকি সবার বকাবকি তে বেচারি শেষে কান্নায় করে ফেলে।
.

অনেকগুলো গিফ্টে অভির গাড়ি ভর্তি হয়ে যায়। অভি আর আদিদ দুজনেই এখন বেরিয়ে পড়বে। সব মেয়েরা একে একে তাদের বিদায় জানিয়ে ভেতরে চলে গেল। তবে দূরে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল পদ্ম। অভি গাড়ি নিয়ে আগে আগে বেরিয়ে যায়। আদিদ গাড়ি বের করে সাইডে এসে দাঁড়ায়। তখনই তার চোখ পড়ে পদ্ম’র উপর। মেয়েটা শুকনো মুখে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আদিদ কিছুটা অবাক হয়ে তার কাছে গেল। জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে পদ্ম, আপনি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

চলবে…