পরাণ দিয়ে ছুঁই পর্ব-০১ (২য় পরিচ্ছেদ)

0
222

#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ১
#Jhorna_Islam

দুই দিন আগে বিয়ে করা বর এক্সাম হলে নকল করার অপরাধে খাতা এক্সপেল করে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দৃশ্য মনে হয় খুব কমই ঘটেছে অথবা আদৌ ঘটেছে কিনা সন্দেহ আছে। কিছু সময়ের জন্য সবকিছু যেনো থমকে গেছে।

ইয়ানূর মাথা নিচু করে আছে। এমন ভাবে মাথা নিচু করে রেখেছে পিছন থেকে দেখলে মনে হবে মাথাটা বুঝি শরীরে নেই।মরমে মরছে ইয়ানূর। লজ্জা অপমানে নিজের দুই কপোল লাল হয়ে আছে। মাথার ভিতরের সবকিছু যেনো এই মুহুর্তে ফাঁকা হয়ে গেছে। সারাজীবনের অর্জিত সম্মান পরিশ্রম সব যেনো বৃথা।

স্যার একের পর এক ভয়ংকর সব বুলি ছুড়ে মারছে নূরের দিকে। নূর তা নিজের কান দিয়ে শ্রবণ করছে ঠিকই কিন্তু বুকের ভিতর কোনো তীরের মতো বিঁধছে যেটা শুধু নূরই অনুভব করতে পারছে।

নূরের চোখে মনে হচ্ছে শ্রাবনের প্লাবন নেমেছে। কয়েক বেঞ্চ দূরত্বে বসা ইসরাতের চোখ জোড়া ও ছলছল করছে।প্রিয় বান্ধবীর এতো অপমান সহ্য হচ্ছে না। নিজের বান্ধবীর হয়ে একটা কথা ও বলতে পারছে না। স্যার কে বলতে গিয়েছিল নূর এসব করবে না কখনো না।কিন্তু স্যারের এক ধমকেই চুপ হয়ে যায়।

আজ নূরের এক্সামের জন্য গতকাল রাতে নূরের ভালো মতো ঘুম হয়নি।হবে কি করে ঘুমানোর চেষ্টা ও করেনি পড়াশোনা নিয়েই বিজি ছিলো নূর। কয়েকবার রিভিশন দিয়েছে। যদিও বা সব পড়া আগে থেকেই কাভার করা ছিলো তবুও কয়েকবার রিভিশন দেওয়া বাদ রাখেনি নূর। পড়াশোনা তার জান প্রান। গত দুই দিন যেই পরিমাণ ঝড় গিয়েছে নূরের উপর দিয়ে নূরের ভাবতেই গায়ে কাটা দেয়। পুরো জীবন টা মুহূর্তের মাঝে বদলে দিয়েছে। নিজের সাথে অন্য একজন লোককে সারাজীবনের জন্য বেঁধে দিয়েছে । এই নিয়ে বাবার সাথে খুব অভিমান নূরের। যেই বাবার সাথে কথা না বললে সব অন্ধকার মনে হয়,নিজেকে অসহায় লাগে অথচ আজ দুই দিন হয়ে যাচ্ছে বাবার সাথে একটা কথা ও বলেনি নূর।নূরের বাবা অনেকবার চেষ্টা করেছে কথা বলার কিন্তু নূর নিজের ভিতর নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে।

সবকিছু ভুলে এক সাথে নূর আর ইসরাত এক্সাম দিতে আসে। এক্সাম শুরু হওয়ার বিশ মিনিট আগেই দুই বান্ধবী হলে এসে উপস্থিত হয়।

ইসরাত নূরকে নানা ধরনের কথা বলে হাসানোর চেষ্টা করে চলেছে নয়তো বান্ধবীর পরীক্ষায় প্রভাব পরবে।লিখতে গেলে যদি বান্ধবীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের কথা মাথায় আসে তাহলে সমস্যা। মেয়েটা ভালো করে লিখতে পারবে না পরে পরীক্ষা খারাপ হবে।ঐটার টেনশনে তার বান্ধবীকে হয়তো খুজে পাওয়া যাবে না। পরাণের বান্ধবীর জন্য কতো টেনশন ইসরাতের। কতো দূর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে।

এরমধ্যে ঘন্টা বারি দিয়ে দেয়।সকলেই যে যার আসনে বসে পরে। ইসরাত কয়েক বেঞ্চ পরে বসেছে।

স্যার ম্যামরা খাতা নিয়ে হলে উপস্থিত হয়। সকলকে খাতা দেওয়া হয়। ঘন্টা বারি দেওয়ার সাথে সাথে প্রশ্ন দেওয়া হয়। নূর হাতে প্রশ্ন পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। সব প্রশ্ন নূরের জানা এখন শুধু উত্তর লিখার পালা। ঠান্ডা মাথায় একের পর এক প্রশ্নের উত্তর লিখতে থাকে নূর। একঘন্টা যাওয়ার পর নূর ওয়াশরুম যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে।ম্যাম কে বলে নূর নিজের খাতা আর প্রশ্ন ভাজ করে রেখে যায়।
ইতিমধ্যে পিওন এসে খবর দিয়ে যায় মিনিট দশেকের জন্য এই হলের স্যার ম্যাম যেনো দেখা করে আসে অফিস রুমে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে।খুবই জরুরি কথা আছে। হলে এখন একজন স্যার অবস্থান করছে।

নূর আবার হলে এসে লিখা শুরু করে। এরমধ্যে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারে না। হুট করে এসে স্যার এতো জোড়ে খাতা টান দেওয়ায় হাতের কলম ছিটকে গিয়ে দুই হাত দূরে মেঝেতে অবস্থান করছে।
স্যার খাতা নাড়া দেওয়ার সাথে সাথে ঝড়ঝড় করে কয়েক পৃষ্ঠা আলাদা লিখা কাগজ বেরিয়ে আসে। নূর বুঝতে পারছে না এসব তার খাতার ভিতরে কোথা থেকে আসলো, সেতো এখন অবদি এক্সট্রা কোনো পেপারই নেয় নি।

এএসব কি-কি স-স্যার? কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে ইয়ানূর।

বাহ্ বাহ্ বাহ্ চুরি তো চুরি তারউপর সি’নাজুড়ি। এতোগুলা টিচারের চোখে ফাঁকি দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে এসব পেপার থেকে ছাপাচ্ছেন।

মা-মানে?

মানে? এখন আপনি মানে জিগ্যেস করছেন? সহজ বাংলায় বলতে হবে? কপি করছেন।আরো যদি সহজ করে বলি নকল করছেন।

স্যারের কথায় নূরের মাথায় যেনো বা’জ পরছে।এসব স্যার কি বলছে, নকল আর নূর? এসব তো সে দুঃস্বপ্নেও কোনো দিন ভাবেনি। স্যারের কথায় ক্লাসের সকলেই যেনো ছোট খাটো একটা ঝটকা খায়।এতো ভালো স্টুডেন্ট,, ক্লাসের টপার কিনা নকল করছে? অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু ইসরাত কে দেওয়া স্যারের ধমক আর স্যারের মুখের বুলি শুনে কেউই কিছু বলার সাহস পায় না।

এইসবই করে বেরান? মুখ দেখলে তো মনে হয় ভাজা মাছটা ও উল্টে খেতে জানেন না। বড় হলে তো দেখা যায় ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনাল হবেন।

স-স্যার আ-আমার কথা টা এ-একবার শুনুন।

চুপপ একদম চুপপ!!

স্যারের এমন বাজখাঁই স্বরের ধমকে একদম চুপ হয়ে যায় নূর।মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ ও বের হচ্ছে না।চোখ দিয়ে শুধু অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝড়ছে।মন শুধু একটা কথাই বলছে তোর সব শেষ নূর।তোর সব শেষ। তোর ক্যারিয়ার,,স্বপ্ন সব শেষ।

এরমধ্যে ছাত্র ছাত্রীদের কানাঘোষা শুরু হয়ে গেছে। নিজের সাথে এতোসব অন্যায়, অপবাদ মেনে নিতে পারছে না।

কি হচ্ছে কি এখানে? এটা কি এক্সাম হল নাকি মাছের বাজার?

হঠাৎ করে কারো গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে এরকম বুলি শুনে সকলের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর বন্ধ হয়ে যায়। সকলের দৃষ্টি এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাটে সুদর্শন যুবকের দিকে।

নাহিদ স্যার ও ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলে । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে নাহিদ স্যার চিনে উঠতে পারে না। মাসখানেক হয়েছে এই ভার্সিটিতে জয়েন হয়েছেন তিনি কিন্তু এইলোক কে তো একদিন ও দেখেনি। ইনিকি ভার্সিটির কেউ? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নাহিদ স্যার তারপর আবার নিজেই ভাবে নাহ ভার্সিটির হলেতো চিনতো।তাহলে কি বাইরে থেকে লোক এসেছে পরিদর্শন করার জন্য? নাহিদ স্যারের ভাবনার মাঝেই আবার সেই ঝাঁঝালো কণ্ঠের বুলি কানে এসে প্রতিদ্ধনিত হয়।

আই আস্ক ইউ সামথিং। আপনি থাকতেও এক্সাম হলে এতো নয়েস কিসের?

এরমধ্যে এক্সাম হলের অন্য টিচাররা ও এসে দাঁড়ায়। সব টিচারদের মনেই একই প্রশ্ন।

নাহিদ স্যার বুঝতে পারলো হয়তো কোনো টিচার আর নয়তো ভার্সিটির অনেক পাওয়ারফুল কেউ হবে লোকটা। অন্যথা একজন টিচারের সাথে এতোটা দা’পটের সাথে কিছুতেই কথা বলতে পারতো না। মনে মনে নিজেকে বলে উঠে,, সাব্বাস বেটা এবার তুই সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠবি।

এই মেয়েটা নকল করেছে স্যার। আমি তাকে প্রমাণ সহ হাতে নাতে ধরেছি।

নাহিদ স্যারের কথায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি হুংকার ছেড়ে বলে উঠে হোয়াট!!! বলেই ধপাধপ কদমে ক্লাসের ভিতরে এসে দাঁড়ায়। অন্যানয় স্যার ম্যাম ও এসে দাঁড়ায়।

নকল করার এতোবড় দুঃসাহস কে দেখিয়েছে? আপনি অফিসে ইনফর্ম না করে এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আমি এখনই ইনফর্ম করতাম স্যার। ওয়েট স্যার আমি এখনই করছি।

থাক আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আমি
দেখছি বিষয় টা । তার আগে সেই সাহসী মানুষটাকে দেখে নেই। বলেই চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। কিছু কি থমকালো? কিজানি। কিছু সময় ও যেনো অতিবাহিত হলো না।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে চোখ ঘুরিয়ে নাহিদ স্যারের দিকে দৃষ্টি দেয়। বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে দেখে স্যার ম্যামদের চোখ ও যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না।

নাহিদ স্যার খুব গর্বের সাথে বলে চলেছে,, এই সেই নকলবাজ মেয়ে স্যার আমি হাতে নাতে ধরেছি। দেখেন স্যার এমনভাবে আছে মনে হচ্ছে তার চেয়ে সাধু আর কেউ নেই।উপরে উপরে ভালো সেজে ভিতরে ভিতরে কার্য হাসিল।

নূর এখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ লাল হয়ে একাকার।চোখের পানিতে সব ভিজে যাচ্ছে।

নাহিদ স্যার আবার ও বলে উঠে,, স্যার এর কি শাস্তি দেওয়া যায়?

লোকটা নূরের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রয়। তারপর নাহিদ স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,, এর একটাই শাস্তি খাতা এক্সপেল করে দেওয়া আর বাকিটা কতৃপক্ষ দেখবে।

পৃথিবী কি থমকে গেছে? নাকি নূরের জীবন বুঝতে পারছে না নূর কিছু। ঘার ঘুরিয়ে সামনে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিজে না চাইতে ও ধপাস করে বেঞ্চের উপর বসে পরে।

#চলবে,,,,?