পরিণয় পর্ব-০৬

0
1501

#পরিণয়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬

পল্লবী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অধরা কল দিয়েছে। অধরার কলটা ধরেই পল্লবী জোরে চিল্লাতে লাগল আনায়না আনায়না বলে। পল্লবীকে এত অস্থির দেখে অধরা জিজ্ঞেস করল

– কী হয়েছে পল্লবী এভাবে চিল্লাছিস কেন? আনায়নার কী হয়েছে? আমি তো ভেবেছি তোরা গতকালকে গেলি আমাকে একটা কল ও দিলি না তাই খোঁজ নিতে কল দিলাম। আনায়না কী অসুস্থ?

পল্লবী কান্নাটা আরও জোরাল করে জবাব দিল

– আনায়নাকে সাহিল নিয়ে গেছে রে। আমার আনায়নাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে চাই অধরা। কীভাবে আনব আমাকে বল। আমার কাছে তো টাকাও নেই এত।

– পল্লবী তুই কান্না থামা আগে। নিজেকে শান্ত কর। শোন আমার একটা বান্ধবী আছে এডভোকেট। আমি তার সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি তোকে। ওকে এত টাকা দেওয়া লাগবে না। এসব কেস গুলো ও এমনিতেই লড়ে।

পল্লবী অধরার কথা শোনে মুহুর্তের মধ্যে কান্নাটা থামিয়ে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল

– তার নাম কী? আমাকে ঠিকানা বল। আমি আজকে গিয়েই দেখা করব। দরকার হলে আমি আমার গহনা সব বিক্রি করে টাকা জোগাড় করব। তাও আমার মেয়েকে আমার বুকে ফিরে পেতে চাই।

বলেই পল্লবী কাঁদতে লাগল। পাশে বসে পল্লবীর মা নির্বাক হয়ে দেখতে লাগল। অপরদিকে অধরা ওপাশ থেকে বলল

– আমার বান্ধবীর নাম হলো জান্নাত জেসি। আমি তোকে ঠিকানা দিচ্ছি তুই সে ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে বললেই হবে এডভোকেট জান্নাত জেসির সাথে দেখা করতে চাই। তাহলে কেউ না কেউ তোকে নিয়ে যাবে। আমি ঠিকানাটা এস এম এস করে দিচ্ছি।

বলেই অধরা কলটা কেটে দিল। পল্লবী কলটা রেখে মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে রইল এস এম এস আসার জন্য। মিনেট দুয়েকের মধ্যেই এস এম এস টা চলে আসলো। পল্লবী এস এম এস আসার সাথে সাথে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে নিল। পল্লবীর মা পেছন থেকে বলতে লাগল

– তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিস রে মা?

– মা এখন কথা বলার সময় নেই। আমি একজন উকিলের কাছে যাচ্ছি।

– যাচ্ছিস ভালো কথা কিন্তু খালি হাতে কেন যাচ্ছিস?

নুরজাহান বেগমের কথা শোনে পল্লবীর মনে পড়ল সে তো টাকা ছাড়াই বের হয়ে যাচ্ছে। তাই আবারও ফেরত আসলো ঘরে।ব্যাগ ঘেটে দেখল ব্যাগে মাত্র ৪০০ টাকা আছে। মনে মনে ভাবল এ টাকাটা যেতে আসতেই খরচ হয়ে যাবে। তাই পল্লবী তার গহনা থেকে একটা বড় লকেট নিয়ে বাকি গহনা গুলো মাকে গুছিয়ে রাখতে বলল। নুরজাহান বেগম ও বাকি গহনা গুলো গুছিয়ে রাখল। এদিকে পল্লবী আর সময় নষ্ট না করে ঘর থেকে বের হলো এডভোকেট জান্নাত জেসির খুঁজে। ঘর থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগুতেই একটা স্বর্ণকারের দোকান পেল। সেখানে বড় লকেটটা বিক্রি করে সাত হাজার টাকা পেল। টাকাটা নিয়ে একটা সি এন জি ভাড়া করে চলে গেল গন্তব্যে। সেখানে গিয়ে খুঁজতে লাগল এডভোকেট জান্নাত জেসির রুম কোনটা। অনেকটা খুঁজার পর রুমটা পেল। পল্লবী রুমটার সামনে গিয়ে দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে কেউ একজন বলল

– আসতে পারেন।

পল্লবী রুমে ঢুকে খেয়াল করল একটা সুন্দর মেয়ে বসে আছে চেয়ারে। বয়স আনুমানিক ২৬-২৭ হবে।পল্লবীর বুঝতে অসুবিধা হলো না ইনিই এডভোকেট জান্নাত জেসি। পল্লবী উনার সামনে যেতেই এডভোকেট জান্নাত জেসি বলল

– বসুন। আপনার পরিচয় দিয়ে সমস্যা বলুন।

পল্লবী চেয়ারটা টেনে বসে বলল

– আমি পল্লবী।

– ওহ আচ্ছা। অধরার কাজিন রাইট?

– হ্যাঁ।

– অধরা আমাকে কল দিয়ে বলেছিল আপনি আসতে পারেন। আপনার পুরো বিষয়টা আমি তার মুখে শোনেছি। এখন আপনি বলুন।

পল্লবী এডভোকেট জান্নাত জেসির কথায় যেন একটু ভরসা পেল। প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা বলতে লাগল।সমস্ত ঘটনা শোনার পর এডভোকেট জান্নাত জেসি বলল

– আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আপনাকে আপনার বাচ্চা ফিরিয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব।একটু সময় প্রয়োজন একদিনে সেটা সম্ভব না।আনুমানিক ১-৩ মাস লাগতে পারে।

– এতদিন আনায়নাকে ছেড়ে আমি কী করে থাকব?

– নিজেকে শক্ত করুন। বাচ্চা ফিরিয়ে আনতে যা করা লাগে আমি করব।আর বচ্চার বয়স কম। সেই সাথে সাহিল পরকিয়ায় আসক্ত। সুতরাং বাচ্চা ফিরিয়ে আনতে তেমন বেগ পোহাতে হবে না। এখন শুধু আপনি ধৈর্য ধরুন। এর মধ্যে একটা চাকুরি জোগাড় করার চেষ্টা করুন। নিজের পায়ে দাঁড়ান। তাহলে আত্নবিশ্বাস ফিরে পাবেন।

পল্লবীর মনটা একটু প্রশান্ত হলো জান্নাত জেসির কথা শোনে। হালকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল

– আপনার ফি কত?

জান্নাত জেসি হালকা হেসে বলল

– আমি অধরার মুখে আপনার আর্থিক অবস্থার কথা জেনেছি। আপাতত আমাকে কিছুই দিতে হবে না। কখনও যদি নিজের পায়ে দাঁড়ান তখন না হয় খুশি মনে কিছু দিয়েন। আপাতত আমাকে যে টাকাটা দিতে চেয়েছিলেন সেটা রেখে দিন কাজে দিবে।

জান্নাত জেসির কথাটা শোনে পল্লবীর চোখের জল পড়তে লাগল। তবে এ জলটা পড়ছে খুশিতে। চোখের জলটা মুছে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে বাসায় আসার জন্য রওনা দিল। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বসায় ফেরার পর মনে হলো মাথাটা বেশ ঘুরছে। সেই সাথে বমি বমি ভাব ও হচ্ছে। বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে বাথরুমে চলে গেল বমি করতে। বমি শেষে রুমে এসে বসল। নুরজাহান বেগম পল্লবীর দিকে ভাতের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল

– সারাদিন কিছু খাসনি। এখন কিছু খেয়ে নে। শরীরে শক্তি না থাকলে তো কিছুই করতে পারবি না।

পল্লবী নুরজাহান বেগমের কথাটা শোনে ভাতের প্লেটটা হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে যখনই লোকমা মুখে দিতে যাবে ঠিক তখনই আনায়নার মুখটা পল্লবীর চোখে ভেসে উঠল। পল্লবী ভাবতে লাগল আনয়না খেয়েছে তো? এটা ভেবেই পল্লবী তার শ্বাশুড়ির নম্বরে কল দিল। কিন্তু কেউ কল ধরল না।পল্লবীর বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। তবুও জোর করে খেয়ে নিল। কারণ লড়াই করতে হলে তাকে আগে বাঁচতে হবে। খাওয়া শেষ করতেই আতিক আসলো পল্লবীর কাছে। আতিক এসেই পল্লবীর সম্মুখে বসে বলল

– নিরার গায়ে হাত তুলেছিস তুই?

পল্লবী বলিষ্ঠ গলায় জবাব দিল

– হ্যাঁ তুলেছি কেন?

– এত বড় সাহস তোকে কে দিল?

– নিজের বউকে আগে সাহসের মাত্রা ঠিক করতে বলো তারপর আমাকে জ্ঞান দিও। তোমার লজ্জা লাগে না বউয়ের কথায় উঠো আর বসো। স্বামী স্ত্রী এর সম্পর্ক মধুর হওয়া দরকার। তার মানে এই না বউয়ের জন্য মাকে অপমান করতে হবে। মায়ের জায়গায় মা কে সম্মান করতে হবে আর বউয়ের জায়গায় বউকে। কারও জন্য কাউকে ছেড়ে দিলে চলবে না। নিরার কথা শোনো তাতে কারও আপত্তি নেই। তবে তার অন্যায় আবদারে প্রশ্রয় দেওয়া তার গোলামি করার সমান। তুমি যেমন বাবার ছেলে আমিও তেমন বাবার মেয়ে আর মা তেমন বাবার স্ত্রী তাই এ বাড়িতে সবার অধিকার আছে। একা অধিকার ফলাতে যেও না। অনধিকার চর্চা বেশি করে ফেললে আমি বাধ্য হব সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করাতে। যার ভাগে যা জুটে। আশা করি এত কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করবে না।

পল্লবীর কথা শোনে আতিক চেঁচিয়ে বলল

– পল্লবী….

আতিকের চেঁচানো শোনে পল্লবী আরও জোরে চেঁচিয়ে বলল

– চেঁচিয়ে লাভ নেই। যা সত্যি তাই বলেছি।আমার সামনে থেকে গিয়ে বউকে সামলাও।

আতিক আর কিছু বলল না। রেগে মেগে চলে গেল। পল্লবীর এবার শান্তি লাগছে। আয়নার সামনে গেল পল্লবী, এবার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল
এ চোখের জল মুছে দেওয়ার মতো যেহেতু কেউ নেই সেহেতু আমি আর কাঁদব না। প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত লড়াই করে তার প্রাপ্যটা আদায়ে প্রতিবাদ করা। এ সমাজ কখনো নিজে থেকে কারও প্রাপ্যটা এগিয়ে দেবে না। বরং নিজের প্রাপ্যটা নিজেকেই ছিনিয়ে নিতে হবে।

এসব ভেবে ভেবে সারাটাদিন পার করে রাতে যখন শুয়ে পড়ল তখন পল্লবীর বুকটা বেশ খালি খালি লাগল। আনায়নার জন্য বুকটা ফেটে যেতে লাগল। আনায়না কেমন আছে? কী করছে এখন? এসব ভেবে ভেবে কষ্ট পেতে লাগল। আনায়নার মুখটা যেন পল্লবীর সামনে ভেসে আসতে লাগল। এর মধ্যেই পল্লবীর মাথাটা আবার ঘুরতে লাগল। সেই সাথে বমিও হতে লাগল। হালকা বমি ভাবটায় পল্লবীর মাথায় প্রশ্ন উঠে বসলো সে কী আবার কনসিভ করেছে? এটা ভেবেই যেন পল্লবী নিরাশ হয়ে গেল। কারণ এত ঝামেলার মধ্যে আবার কনসিভ করলে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে যাবে।দুটো চিন্তা পল্লবীর মাথায় ঘুরছে এখন

১) আনায়না
২) সে কনসিভ করেছে কী না।

এসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে গেল। মধ্য রাতে ঘুম থেকে আচমকা উঠে কাঁদতে লাগল।কারণ আনায়নাকে ছাড়া তার বেশ শূন্য লাগছে। কিছুক্ষণ কেঁদে মনটাকে শক্ত করে আবার শুইয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আর হলো না। সারা রাত ছটফট করতে করতে গেল।

সকালে উঠে পল্লবীর মনে হলো প্র্যানেন্সি টেস্ট করতে হবে। মুখটা ধুয়ে না খেয়েই বের হয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করাল। হাসপাতাল থেকে বলা হলো কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট দিবে।পল্লবী চিন্তা করল এখন একটা মুহুর্ত নষ্ট করা যাবে না। যতটুকু সময় পাওয়া যায় চাকুরি খুঁজতে হবে। এটা ভেবেই বাইরে গিয়ে একটা শুকনো রুটি খেয়ে চাকুরি খুঁজতে লাগল। পল্লবী চাকুরি খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারল এ শহরে চাকুরি পেতে হলে হয় টাকার জোর, নাহয় মামার জোর লাগে।

সেদিন পল্লবী চাকুরি না পেয়ে নিরাশ হয়ে হাসপাতালে ফিরে রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে রিপোর্ট দেখে কাঁপতে লাগল।কারণ পল্লবী আবার মা হতে চলেছে। এটা দেখার পর পল্লবী বুঝতে পারছে না কী করবে? কারণ পল্লবী শোনেছে প্র্যাগনেন্ট অবস্থায় ডিভোর্স দিলে সেটা ধর্মীয় ভাবে কার্যকর হয় না। যদিও আইন অনুযায়ী সে ডিভোর্সি। তাই সাহিলের মতো নোংরা মানুষের কাছে এ বাচ্চার দাবি নিয়ে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা পল্লবীর নেই। তবে এ বাচ্চাটাকে এ দুনিয়ার আলো দেখাবে কী না সেটা নিয়ে পল্লবী সন্দিহান। অনেকটা নিরাশ হয়ে শুকনো মুখে বসায় ফিরল পল্লবী। পল্লবীকে বেশ চিন্তিত দেখে পল্লবীর মা নুরজাহান বেগম জিজ্ঞেস করল

– কী হয়েছে রে মা এত চিন্তিত কেন?

পল্লবীকে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– মা আমি আবার কনসিভ করেছি। সাহিল আমাকে ছেড়ে দিয়েও একটা স্মৃতি পেটে দিয়ে গেছে এখন আমি কী করব মা?

নুরজহান বেগম পল্লবীর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল

– এমনিতেই তোর জীবনে দুঃখের শেষ নেই।আনায়না নেই তোর কোলে।একদিকে আনায়না অন্যদিকে আয় করার মতো কিছু নেই। এর মধ্যে এ বাচ্চাটা আসলে তো অশান্তি ছাড়া কিছু হবে না। বলি কী কালকে গিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করে আয়। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।

পল্লবী মায়ের কথা শোনে চুপ হয়ে গেল।কী বলবে বা করবে বুঝতে পারছে না। সারা রাত চিন্তা করলো বাচ্চাটা নষ্ট করবে কী না? ভাবতে লাগল এ অনিশ্চিত জীবনে বাচ্চাটাকে আনলে বাচ্চাটার কষ্ট বাড়বে। তাই সব ভেবে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল বাচ্চাটা নষ্ট করে দিবে। পরদিন সকালে নিজের হাতে নিজের বাচ্চা খুন করতে রওনা দিয়েছে পল্লবী।