পুনর্জন্ম পর্ব-০২

0
297

#পুনর্জন্ম🤍
#পর্ব_০২
#আফিয়া_আফরিন

সমস্যা হলো লাশ দাফন করা নিয়ে। জমিদার সাহেব একেবারে নিষেধ করে দিয়েছে, অপঘাতে মারা যাওয়া কোন লাশ এই গ্রামে দাফন করা হবে না। লাশ যেন পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

এইবার ক্ষেপে গেল অনুপম। তার রাগ জেদ বরাবরই বেশি।
জমিদার সাহেবের সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘কি শুরু করছেন কি আপনারা? মানুষকে বাঁচতে দেবেন না। এই গ্রামের একটা ভালো পদে আছেন বলে, কি মানুষের মাথা কিনে খাইছেন? লাশ দাফন করতে গোরস্থানে নেওয়া হবে। সেটাও কি আপনার বাপের সম্পত্তি?’

‘এই ছেলে মুখ সামলে কথা বলো। কার সাথে কি বলছো হিসাব আছে?’

‘হিসেব চাইছেন কোন আক্কেলে? নিজের ছেলের দিকে একবার তাকান, ছেলের কু কর্মের কথা তো জানেনই। পারলে তার বিচার করেন। আরেকজনের বেলায় আপনারা ঠিকই ভালো বিচারক হতে পারেন। আর নিজের বেলায়?’

অনুপমের কথার সাথে সায় ও গ্রামের মানুষজন। চেয়ারম্যান সাহেবও পথে। তিনি এখনো এসে পৌঁছাতে পারে নাই।
তাকে ফোন করা হলো। তিনিও জমিদার সাহেবের বিপক্ষে কথা বললেন।
বললেন, ‘লাশ দাফনে তো কোনো সমস্যা নেই।’

জমিদার ভিতরে ভিতরে ক্ষেপে গেলেন। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে বলে কিছুই বললেন না। তাওহীদ কে ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

তাওহীদ ঘরে ঢুকেই, চুপচাপ বসে পড়লো। বাবা যে ক্ষেপে আছে এটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে। জমিদার আলী আকবর কোন কথা বলছেন না। এটা তার রাগের পূর্ব লক্ষণ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, তারপর রাগ ঝাড়া শুরু করবেন।
এইবারও তাই হবে।

গলা খাকারি দিয়ে তাওহীদকে ডাক দিলেন। তাওহীদ বাবার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।

‘ওরকম মাথা নিচু করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমাদের কে কি আমি মাথা নিচু করতে শিখিয়েছি?’

তাওহীদ প্রত্যুত্তর করলো না।
‘অন্যায়টা যে তুমি করেছো, এটা সবারই জানা আছে। যদি তোমার নামে ময়ূরীর মা বাবা কোন কেস করে, তা ঠেকাবে কি করে? ভেবে দেখেছো কিছু?’

‘আমি বুঝতে পারি নাই বাবা, যে ময়ূরী আত্মহত্যা করবে।’

‘তা তুমি তো কাজের আগে কোনদিনও কোন কিছু বুঝতে পারো না। গ্রামের মানুষজন এখন প্রচন্ড মেজাজে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব আগামীকাল আসলে, তার কাছে হয়তো বিচার নিয়ে বসবে। তখন তুমি কি করবা? প্রমাণ তো সবার কাছেই আছে।’

‘মুখের কথা দিয়ে কি হয়? কেউ তো উপস্থিত কোন প্রমাণ দেখাতে পারবে না।’

‘আচ্ছা যাও ভিতরে যাও। আমি এসপির সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি।’
.
.
শোকের ভীষণ কালো ছায়া পড়েছে আজ মৃন্ময়ীদের বাসায়। দাফনের কার্যক্রম শেষে, অনুপম বিদায় নিয়েছে এইমাত্র।
রাগ, হ্যাঁ রাগে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। একবার রাগ হচ্ছে মা-বাবার উপর, তো একবার রাগ হচ্ছে ময়ূরীর উপর, আর তাওহীদের উপর তো আছেই। রাগ মিটানোর জন্য কোন উপায় পাচ্ছি না। সারা শরীর ঝিম মেরে আসছে। যাকে নিয়ে সারাটা জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিল, সে এইভাবে চলে গেলে? তবে কি ময়ূরীর ভালোবাসাটা ছলনা ছিলো?

অনুপম বাড়ি আসতেই তার মা জিজ্ঞেস করলো, ‘ময়ূরীদের বাসা থেকে আসলি?’

‘হু।’ ছোট্ট করে জবাব দিলো।

‘ও ভালো। মেয়েটা মারা যাওয়াতে খারাপই লাগছে।’

‘তোমাদের জন্যই তো সব হলো মা। কেন ওকে বিয়ে করতে আটকালে আমায়? ওকে সেদিন অন্তত বিয়ে করলে তোর জীবনটা বাঁচতো। ও কষ্ট পেয়ে এভাবে মরতে যেত না মা।’

‘তুই আমাদের কি দোষ দিচ্ছিস? ওকে বিয়ে করলে আমাদের মান-সম্মান থাকতো? সবাই বলতো, ধ’র্ষি’তা একটা মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসছে। আর তুই তো ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি, ও তো দেমাগ দেখিয়ে মুখের উপর না করে দিল।’

‘সেটা তো তোমাদের জন্য না বলেছে। তোমরা বিয়েতে রাজি ছিলে না। তোমরা রাজি ছিলে না তাই, ও আমাকে গোপনে বিয়ে করতে চায় নাই।’

‘এখন কি ময়ূরীর মৃত্যুর পিছনে তুই আমাদের দায়ী করবি?’

‘সেভাবে দেখতে গেলে তোমরাও দায়ী।’

‘বেয়াদবের মত কথা বলিস না মা-বাবার সাথে। এক হাতে তালি বাজে না। সমাজ বলেও একটা কথা আছে। সব সময় নিজের কথা ভাবি? যে মা-বাবা জন্ম দিলো, ছোট থেকে বড় করলো; তাদের দিকটা একবারও ভাবিস না।’

‘এত গভীরে কেন যাচ্ছো মা? আমি তো এমন কিছু বলি নাই।’

অনুপমের মা আর কথা বললেন না। উঠে ভিতরে চলে গেলেন।

অনুপম সিঁড়ির উপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসে ছিলো। ময়ূরী একদিন বলেছিলো, ‘মৃত্যু ছাড়া কেউ কখনো আমাদের আলাদা করতে পারবে না!’

আসলেই তো, মৃত্যু এসে কি সুন্দর আলাদা করে দিয়ে চলে গেল।
ছেলেমানুষের কাঁদতে মানা। কিন্তু তারা অধিক শোকে নাকি পাথর হয়ে যায়। অনুপমের ও হয়েছে ঠিক সেই অবস্থা। ভালো-মন্দ কিছুই ভাবতে পারছে না। ময়ূরীকে নিয়ে সুখকর স্মৃতিগুলো, বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে। স্মৃতিগুলো ও বড্ড স্বার্থপর, যখন মনের আঙিনায় তাদের স্থান দিতে চায় না; তখন ই সব ডাকঢোল বাজিয়ে চলে আসে।
অনুপম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

মনে মনে বললো, ‘তোমার মত করে আমায় আর কে ভালবাসবে ময়ূরী? কে আমার সাথে, চুপি চুপি দেখা করতে আসবে রাতের বেলা। সব তো হারিয়ে ফেললাম। কষ্ট পেলে কে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? তোমার মত কি কেউ কখনো হবে?’

এমন সময় শিশির এলো। অনুপম এর সামনে বসে বললো, ‘মৃন্ময়ী চাচ্ছিলো পুলিশের কাছে যাবে। তুমি কি যাবা একবার?’

‘কাকা কাকিমা কোথায়? তারা যাবে না?’

‘ওরা কি আর যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে। নিজের মেয়ের শোকে কাহিল হয়ে গেছে। কাকিমা তো অনেকবার জ্ঞান হারিয়েছে। মৃন্ময়ী আর আশেপাশের কয়েকজন বহু কষ্টে সামাল দিয়েছে।’

‘ও ও আচ্ছা। পুলিশের কাছে কে কে যাবে?’

‘আমি আর মৃন্ময়ী যেতে চাচ্ছিলাম। তুমি যদি যাও আমাদের সাথে, তাহলে ভালো হয়। আমরা একটু সাপোর্ট পাইতাম।’

‘আচ্ছা চল।’

অনুপম আর শিশির যাওয়ার পথে মৃন্ময়ীকে বাড়ি থেকে নিয়ে চললো।
কান্নাকাটি করে তার ও চোখ মুখ ফোলা। কেমন জানি অদ্ভুত লাগতেছে দেখতে!
.
.
পুলিশ স্টেশনে গিয়ে, এসআইকে পাওয়া গেল না। একজন কনস্টেবল তাদের থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি চাই আপনাদের?’

‘একটা কেস লেখাতে চাচ্ছি।’

‘কিসের কেস?’

‘ধ’র্ষ’ণ!’

‘প্রমাণ আছে কোনো? আর ভিকটিম কে? ভিকটিমকে ছাড়া কিন্তু কোন কেস লেখা হবে না।’

অনুপম অবাক হয়ে বললো, ‘কেন? এমন নিয়ম তো কোথাও লেখা নেই।’

‘আপনি ভিকটিমকে নিয়ে আসেন।’

‘সে আত্মহত্যা করেছে।’

কনস্টেবল হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, ‘হায় হায়! মরা মানুষের জন্য প্রতিবাদ করতে আসছেন। যান যান, বাড়ি গিয়ে আরামসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। আসছে যত্তসব আজাইরা আলাপ নিয়ে। ভাই আমরা পুলিশ, আমাদের আপনাদের সাথে এসব গাল গল্প করার সময় নাই।’

‘আপনার সাথে আমরা গাল গল্প করতে আসি নাই। একটা কেস লেখাতে আসছি।’

‘প্রমাণ নাই, যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে সে মারা গেছে, কিসের ভিত্তিতে আমরা আপনাদের কেস নিব?’

‘প্রমাণ নাই আপনাকে কে বলছে? গ্রামের মানুষজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, উত্তর পেয়ে যাবেন।’

‘আইন কখনো মুখের কথায় বিশ্বাস করে না। কাগজে কলমে প্রমাণ নিয়ে আসেন, আমরা দেখি তারপর কেস লিখব। এখন যান দয়া করে, কাজের মধ্যে ডিস্টার্ব করবেন না।’

কেউ আর কোন কথা বাড়ালো না। অনুপম জানতো, বিচার পাওয়া যাবে না। এরা সবাই জমিদারের বেতনভুক্ত কর্মচারী। দুই একজন অফিসার সৎ থাকলেও, অসৎ দের ভিড়ে তা হারিয়ে যায়। এর আগেও কখনো বিচার পাওয়া যায়নি, এবারেও বিচার পাওয়া যাবে না।

মৃনয়ী সামনে এগিয়ে বললো, ‘কি করবো আমরা এখন?’

শিশির বললো, ‘কিছু কি করার বাকি রাখছে এরা। চেয়ারম্যান আজকে আসুক, তার সাথে আমরা সরাসরি কথা বলবো।’

অনুপম বললো, ‘যেখানে পুলিশ ই কিছু করতে পারলো না, সেখানে তোর চেয়ারম্যান কি করবে? অরুনিমার ঘটনার কথা মনে নাই। ওর সাথে কি হয়েছিলো? মরতে মরতে বেঁচেছে মেয়েটা। সবাই কিন্তু ওর ক’ল’ঙ্কে’ই দাগ লাগাইছে। অথচ ওর কোন দোষই ছিল না। দোষের দোষ একটাই, ও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিলো।’

‘ময়ূরীর কি দোষ ছিল? ও কি করেছিল? ওর সাথে কেন এমন হলো?’

‘তাওহীদের মত ন’র’প’শু দের কিছু করার জন্য কোন কারণ লাগে না।’
.
.
বিষন্নতায় দুটো দিন কেটে গেলো। না, ময়ূরীর মৃত্যুর কোন বিচার হলো না। নির্দিষ্ট হাতে কলমে প্রমাণ ছাড়া কেউ সামনে আগাবে না।

নিজের বোনের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলো মৃন্ময়ী। কিন্তু সকল আশা ছেড়ে দিলো। মাঝেমধ্যে খুব করে হাকডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। অনুপম তো সেদিন সাহস করে, বেহা’য়ার মতো কেদেই ফেলেছিলো। ওই বেচারা, সবদিক থেকে অসহায় হয়ে পড়েছে।
.
.
তাওহিদ আর তার চার বন্ধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কোন বিচার নেই। নিজেদের কাজের জন্য তাদের কোন আক্ষেপ নেই। বরং তারা উপরন্তর খুব খুশি।
তাওহিদ এই ভেবেই খুশি যে, সে যেকোনোই আ’কা’ম করুক না কেন; বাবা নিশ্চয়ই এবারের মতো প্রতিবার তাকে বাঁচিয়ে দিবে।

কিন্তু তার এই নিশ্চয়তা বেশিদিন রইলো না। পরদিন একটা বেনামী চিঠি তার নামে এলো।
চিঠিটা পেয়ে সে বেশ অবাক হয়েছে। এমন ধরনের চিঠি তাকে কে লিখলো?

“তাওহীদ”
কি সম্বোধন করবো তোকে বলতো? প্রিয় তাওহিদ? না থাক, তোর মত মানুষ কিছুদিন আগেও আমার প্রিয় ছিলো। কিন্তু আজ থেকে আর না। তোর হায়াত প্রায় শেষের দিকে। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তৈরি হো।
গতকাল পর্যন্ত ভেবেছিলাম, তুই মানুষটা ভালো। কিন্তু আজকে জানলাম, তুই জা’নো’য়া’রে’র থেকেও নি’কৃ’ষ্ট! ময়ূরীর ব্যাপারটা তো আমি জানতাম না। কিন্তু আজকে জেনে অবাক হলাম, এর পিছনে তুই কেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অতীতের পাপের ফল গোনা শুরু করে দে এখন থেকেই। মনে করতে থাক, কি কি পাপ করেছিস?
একটা কথা জানিস তো, পাপ কিন্তু তার বাপকেও ছাড়ে না। ধরে নে তুই পাপ, আর আমি সেই পাপের বাপ। তোকেও ছেড়ে দেবো না। একেবারে শেষ করে দিবো। যেভাবে আমার প্রিয় মানুষগুলোকে তুই শেষ হয়ে যেতে বাধ্য করেছিস, ঠিক সেইভাবে তুইও শেষ হবি! মরণ অতি নিকটে। আজ থেকেই প্র’হ’র গোনা শুরু কর।

ইতি,
তোর য’ম!
.
.
.
.
.
চলবে…..