পুষ্প কন্যার প্রেম পাবক পর্ব-০৫

0
181

#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব৫
#রাউফুন

তীর্থ এখানে আসার পর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো। সে পড়াশোনায় ভীষণ সিরিয়াস। কিন্তু ইদানীং মনে হয় ঝুমুরের হাবভাব সুবিধার না। ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়ের ওমন চাহনীর মানে সে বুঝে উঠে না৷ সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া মেয়েটাকে সে বুঝে না। বুঝে না কেন এই মেয়েটা তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সময়ে অসময়ে। আসলে সে বুঝতেই চাই না, ঝুমুরকে। বুঝলেই যদি সে বাঁধা পরে সেই দৃষ্টিতে। ভয় হয় তার। সে এই বাড়িতে এসেছে পড়াশোনা টা ভালো ভাবে করতে। কোনো ভাবেই এ-সব এড়িয়ে চলতে পারলেই হলো। তবে এমনো হয়, ঝুমুর তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ চোখ পরে, সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেও ঝুমুরের দৃষ্টি থাকে অটল। কেমন ধারালো চাহনী উফফ! মেয়েটা এমন নির্লোজ্জ, বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে সুযোগ পেলেই।

সেদিন সন্ধ্যায় তীর্থ সবে প্রাইভেট থেকে বাড়ি ফিরেছে। রুমে যাওয়ার আগে সে খেয়াল করলো, ঝুমুর তার ঘর থেকে খুব সাবধানী পায়ে বেরিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছে। সে দেখলো তার রুম পুরোটা এলোমেলো করা। বিছানার চাদর উঠানো, আলমারি খোলা, তার টিশার্ট নিচে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শার্ট একেকটা একেক জায়গায় ছড়ানো, বাথরুমের দরজা খোলা দেখে সেখানে একবার উঁকি দিলো তীর্থ। গিয়ে যা দেখলো তার মাথা গরম হয়ে গেলো। নিজেকে কোনো রকম সামলে সে রুমে এসে টেবিলের অবস্থা দেখলো। বই-খাতা সব কিছু গোছানো ছিলো, এখন সব এলোমেলো। সে সব কিছু সহ্য করে গোছাতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেলো তার খাতার একটা লেখায়৷ এলোমেলো, কি বাজে হাতের লেখা, ইশ!সে লেখাটা পড়ে কতক্ষন থমকে, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এরপরই গগন বিদারী চিৎকারে ডাকলো ঝুমুরকে। তীর্থর চিৎকারে ছুটে এলেন সুফিয়া। উৎকন্ঠা নিয়ে তীর্থকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে বাপ, এমন চিল্লাইতাছস ক্যা?’

‘জেঠিমা, তোমার মেয়েকে বলবা আমার ঘরে আর না আসতে। দেখেছো, কি করেছে আমার রুমটা। ওঁকে আজকে আমার থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। ওঁকে ডাকো।’

সুফিয়া কিয়ৎক্ষন হতভম্ব হয়ে তীর্থর রেগে যাওয়া মুখটা দেখলেন। তীর্থ তো এমন রাগ করে না, ঝুমুর তো মাঝে মধ্যেই এমন এসব কার্যক্রম করে থাকে তবে আজকে এতো রাগ কেন ছেলেটার চোখে মুখে। করার কথায় তো, রোজ, রোজ এরকম অশান্তি কার ভালো লাগে। সুফিয়া চলে যেতে যেতে তীর্থর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ঝুম অন্যায় করছে তোর সাথে, তুই যা শাস্তি দেওনের দে৷ আমি এসবের মধ্যে নাই। গেলাম, রাতের খাওন খাইতে আসিস ঠিক সুময়ে।’

‘আচ্ছা! আজ তোমার মেয়েকে ছাড়বো না আমি।’ তীর্থ শেষ কথাটা ঝাঝালো কন্ঠে বললো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঝুমুর চুপিচুপি তীর্থর রুমের দিকে রওনা হলো। সে এখন বুঝতে পারছে হটকারিতায় নেওয়া সিদ্ধান্ত টা সম্পুর্ন ভুল। ওইভাবে আসলে তার তীর্থর খাতায় ওসব লেখা উচিত হয়নি। সে তাই এখন খাতাটা থেকে ওই কথাটা ছিড়ে ফেলবে।

‘ নিশ্চয়ই তীর্থ ভাই লেখাটা পড়ে নাই, পড়লে নিশ্চিয়ই কিছু কইতো আমারে। তীর্থ ভাই দেখার আগেই আমারে লেখাটা ছিড়ে ফেলতে হইবো!’ ঝুমুর বিড়বিড় করছিলো আর তীর্থর খাতাটাই লেখাটা খুঁজছিলো। কিন্তু হায় খাতায় লেখাটা নেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো ঝুমুরের। সে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলো না লেখাটা।

‘কি খুঁজছিস তুই?’

ঘাবড়ে গিয়ে সে ভীত চোখেমুখে পিছনে তাকালো। তীর্থকে দেখতেই তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কোনো রকমে বললো,

‘ক-কিছু না তীর্থ ভাই।’

‘কোন ক্লাসে পড়িস তুই?’

তীর্থর ওমন বোকা বোকা কথায় সে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। তীর্থ ভাই জেনেও তাকে এমন প্রশ্ন কেন করছে তার বোধগম্য হয়নি।

‘কি হলো বল!’

‘ক্লাস এইটে!’ কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলো ঝুমুর।

‘এখন বয়স কত যেনো তোর?’

‘চোদ্দ!’ বলতে বলতে কেঁদে দিলো ঝুমুর।

‘এই বয়সেই তোর মাথায় এসব কে ঢোকায়? তুই যে আমার খাতায় এসব লিখছিস বাসায় বলবো? কথাটা যদি তোর বাবার কানে যায় তোর কি হবে ভেবেছিস?’

ঝুমুর কাঁদতে কাঁদতে তীর্থর পায়ে পরলো। পা দুটো জাপ্টে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,’আমার ভুল হইয়ে গেছে তীর্থ ভাই! আমি আর এমন করমু না। ক্ষমা করে দেও!’

পা সরিয়ে হেলে দুলে চেয়ারে আরাম করে বসলো তীর্থ! হাতের কাগজটা ছুড়ে ফেললো ঝুমুরের সামনে। কড়া কন্ঠে বললো,’যা লিখেছিস তা পড়ে শোনা!’

‘হ’হ্যাঁ?’

‘যা বললাম তাই কর!’

ঝুমুর ফ্লোর থেকে কাগজটা উঠিয়ে চেয়ারে বসে থাকা তীর্থর দিকে তাকালো। তীর্থ সাবলীলভাবে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ করা তার। সে চোখ বন্ধ অবস্থায় তাঁকে ধমক দিলো কাগজের লেখাটা পড়ার জন্য! ঝুমুর পড়লো ভয়ে ভয়ে,

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি,তা কি তুমি বুঝো না তীর্থ ভাই? আচ্ছা আমি তাকালে তুমিও তো তাকাও, তাইলে তুমিও আমারে ভালোবাসো তাই না? তয় বলো না ক্যান? তুমি না বললেও আজ আমিই বইলা গেলাম।’

‘তুই কি চাস এসব বড় আপা, জেঠিমা, জেঠার কানে যাক?’

‘নাহ!’

‘তাহলে শোন, আমি কাউকে বলবো না। তার বিনিময়ে আমি যা যা বলবো তোকে শুনতে হবে!’

‘কিহ!’

‘কিহ আবার কিরে? আমি যা বলবো তাই তোকে শুনতে হবে। আমার কথার অনর্থ হলে বুঝবি কি করি!’

‘আইচ্ছা!’

‘এবার আয় দেখি, আমার চুল গুলো আস্তে আস্তে টেনে দিবি। রোজ হেটে গিয়ে পা ব্যথা হয়েছে, পা টিপে দে!’

‘অসম্ভব আমি পারমু না।’

‘তাহলে আমিও যাচ্ছি!’

‘যাও!’

‘ঠিক তো? আগে তাহলে জেঠাকেই বলি তোর ওমন অধঃপতন হয়েছে শুনলে তোর পিঠে যা পরবে না? আহ আমি শান্তি পাবো দেখলে!’

‘না না তীর্থ ভাই যাবা না, আমি দিতাছি!’

তীর্থ সুন্দর করে হাসলো৷ যাক লাইনে এসেছে তবে। সে আরাম করে বিছানায় শুয়ে পরলো। ঝুমুর গজগজ করতে করতে তীর্থর পা টেপা শুরু করলো৷ কি কুক্ষণে যে সে তীর্থর খাতায় ওসব লিখতে গেলো কে জানে? মাথায় শয়তান চাপলে যা হয় আর কি!

‘হইছে পা টেপা, এখন মাথাটা ধরেছে। আস্তে করে চুল টেনে দে দেখি! আর শুন, ওসব প্রেম ভালোবাসা ছোট মানুষের জন্য না! ভালো মেয়েরা এসব করে না।’

ঝুমুর তীর্থকে ভেঙালো। ”উম ভালো মেয়েরা ওসব করে না৷ যত্তসব!” কাছে বসে আস্তে আস্তে চুল টানলো। সুযোগ বুঝে জোরে জোরে চুল টেনে দিয়ে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তীর্থ বোকা বনে কতক্ষণ বসে রইলো৷ পরক্ষণেই হেসে উঠলো আনমনে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঝুমুর রুমে গেলো। ঋতু তাকে পর্যবেক্ষণ করে বললো, ‘হাপাচ্ছিস কেন ঝুমুর?’

‘তীর্থ ভাই খালি, হাত পা টিপে নেই। আমারে খুব খাটাই! জোরে চুল টাইনা দৌড়াইয়া পালাই আসছি! উফফ আমার হাত ব্যথা করতাছে!’

হো হো করে হেসে উঠলো ঋতু।

‘আপা তুমি হাসতাছো?’

‘হাসবো না তো কি করবো।

‘তোমার আদরের বোনরে খাটাইতাছে আর তোমার হাসি পাইতাছে। তোমার সঙ্গে আড়ি আপা!’

‘ওলে ওলে আমার বোনটা রে। আচ্ছা আর হাসবো না। তীর্থকে বলবো, তোকে যেনো আর না খাটাই!’


বছর ঘুরতেই ঝুমুর ক্লাস নাইনে উঠলো৷ সময়ের সাথে সাথে ঝুমুর দূর্বল হয়ে পরে তীর্থর প্রতি। তীর্থর যখন পরীক্ষা থাকে, তখন সে ভোরে উঠে, কাজ করে মায়ের সঙ্গে! রাতে তীর্থর কাছে পড়াশোনা করে ঝুমুর৷ কিন্তু পড়ার চাইতে তার তীর্থকে দেখাই বেশি হয়। আগে নির্লজ্জ হয়ে তাকিয়ে থাকতো, কিন্তু এখন আড়ালে আবডালে সে তীর্থকে চোখে হারাই। তীর্থ ভেবেই নিয়েছে ঝুমুরের মাথা থেকে এখন তার ভুত নেমে গেছে। কিন্তু সে তো জানে না সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীর্থ নামক ভুতটা আরও বেশিই চেপে বসেছে।

‘তীর্থ ভাই দিন দিন তুমি এমন সুন্দর হইতাছো কেন?’

‘কালি তোর মাথায় আবার এসব ভু’ত চাপছে? তোর এবারে শিক্ষা হওয়া দরকার আছে!’

#চলবে