#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব৬
#রাউফুন
তীর্থর কথা শেষ হতেই হুট করেই তীর্থকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরলো ঝুমুর৷ ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল তীর্থ৷ বুঝলো না কি হচ্ছে। একটা হেচকা টানে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে ঝুমুরকে। তীর্থর রাগে ক্ষোভে শরীর ফেটে যাচ্ছে। তার ঘৃণা হচ্ছে ঝুমুরের উপর৷ এই বয়সেই মাথায় এসব বাজে চিন্তা নিয়ে ঘুরে ছিঃ! সে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে ঝুমুর দৌড়ে তাকে আবার জাপটে ধরে বলে,
‘প্লিজ, তীর্থ ভাই আমারে এইভাবে প্রত্যাহার করিও না। আমি তোমারে অনেক ভালোবাসি!’
‘ঝুমুর!’ চিৎকার করে রক্ত লাল চোখে তাকালো তীর্থ৷ ঝুমুরকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে আলাদা করে দিয়ে সপাটে গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। হতভম্ব ঝুমুর ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
‘তোর স্পর্ধা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। ছিঃ নিজের চাচাতো ভাইকে এসব কি করে বলিস? লজ্জা করলো না তোর? আমি ভেবেছিলাম তুই ছোট, তোকে বুঝিয়ে বললে তুই বুঝবি। এতো বোঝানোর পরেও তুই এরকম একটা নোং’রা কাজ করলি কিভাবে? আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে তুই আমার জেঠাতো বোন।’
‘যা খুশি কইয়া নেও। আমি তোমার পিছু ছাড়ুম না৷ আমি হাজার বার কমু আমি তোমারে ভালোবাসি তীর্থ ভাই।’ কাঁদতে কাঁদতে ঝুমুর বললো।
আরেকটা গালে থাপ্পড় বসালো তীর্থ। তার কাঁধ ঝাকিয়ে বললো, ‘কি বুঝিস তুই ভালোবাসার? এই তো এটুকুনি বয়েস। সেদিন আমার চোখের সামনে বড় হলি, আর এখনি এসব কথা! তোর এভাবে হবে না আমি জেঠিমা, জেঠোকে বলছি তোর এই অধঃপতন আর নেওয়া যাচ্ছে না।’
‘যাও যাও বলো গিয়ে, আমি ভয় পাই না কাউরে৷’
তীর্থ হনহনিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললো,’তুই আমার ত্রিসীমানায় আসবি না৷ আমি তোর মুখও দেখতে চাই না।’
ঝুমুর কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরলো। কারোর আসার শব্দে ওয়াশরুমে ঢুকলো জলদি করে৷ তীব্র জেদ আর কষ্টে নিজের হাত আয়নাতে আঘাত করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচ ভে’ঙ্গে হাত কে’টে বেরিয়ে এলো টকটকে র’ক্ত বিন্দু। র’ক্ত গড়িয়ে কনুই অব্দি এসে জামার হাতায় ঠেকলো। ভেতর থেকে আওয়াজ পেয়ে ঋতু আওয়াজ দিলো,’ভেতরে ঝুমুর আছিস তো? কিসের শব্দ হলো? মনে হলো কিছু ভা’ঙ’লো!’
এতো র’ক্ত বেরোতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ঝুমুর গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো। ঋতু দেখতেই তার কলিজা শুকিয়ে গেলো। চেচিয়ে মাকে ডাকলো সে।
‘ওহ আম্মা, ওহ আব্বা, এই তীর্থ দেখ না ঝুমুর কতটা হাত কে’টে ফেলেছে। এই ঝুমুর কি করে কা’ট’লি!’
সবাই ছুটে এলো। তুষার সবে মাত্র বাইরে থেকে ফিরেছে, ঋতুর চিৎকারে সে ছুটে উপরে এলো।
‘কি হয়েছে ঋতু?’
‘দেখেন না তুষার, ঝুম হাত কে’টে ফেলেছে কিভাবে জেনো।’
‘দাঁড়াও আমি ফাস্ট এইড বক্স টা আনছি।’ ব্যস্ত পায়ে ছুটলো তুষার নিজের ঘরে। যাওয়ার সময় তীর্থর দিকে একবার তাকালো সে। কিছু একটা আন্দাজ করলো মনে হয়। কিন্তু এখন সেদিকে খেয়াল না দিয়ে চলে গেলো ফাস্ট এইড বক্স আনতে। ঝুমুর নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। সুফিয়া আর আজিজ সাহেব ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
‘আম্মা, তোমার হাত খানা কা’ট’লো কেমনে?’
‘কিরে ঝুম কতা কস না ক্যা? কেমনে চুপ কইরা আছে দেহো তো তাইলে!’
‘আহা সুফিয়া দেখো না মাইয়াটা কেমন কাঁপতাছে।।ভয় পাইছে এমনেই। যাও ঠান্ডা পানি আনো।’
‘আমি আনতাছি এক্ষনি। কি যে করে আপনের মাইয়ারা, আমার জান ভেজে ছাড়খাড় কইরা ছাড়বো!’
সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। তুষার ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। হাতে তুলো নিয়ে প্যানিসিমলে ছোঁয়াতে যাবে তখনই ঝুমুর ভগ্ন গলায় বলল,’তুষার ভাইয়া,আমি চাই যার জন্য আমার হাত কে’টে’ছে সেই আমারে ব্যান্ডেজ করে দিক!’
তুষার ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলো, ‘কার জন্য কে’টে’ছে?’
তুষার ইতোমধ্যে রুমে চলে এসেছিলো। ঝুমুরের কথায় কেঁপে উঠলো৷ উত্তরের আশায় ঝুমুরের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঋতু আর তুষার। বড় করে দম ছেড়ে বললো, ‘তুষার ভাইয়ের জন্য আমার হাত কে’টে’ছে!’
‘কিহ!’ সমস্বরে বলে উঠে ঋতু, তুষার আর আজিজ সাহেব। তার কথায় বড় বড় চোখে তাকালো তীর্থ।
‘কি বলছিস এসব তুই?’
‘আমি তো ঠিকই বলেছি তীর্থ ভাই!তুমিই তো ওয়াশরুমে সাবান ফালাই রাখছো। আমি তোমার রুম এলোমেলো করে আইছিলাম জন্য। তাইতো আমি বাথরুমে যেতেই পিছলে পরে যায় আয়নার উপর। তখনই আমার হাত কা’টে।’
বড়সড় একটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো তীর্থ।
‘দেন তুষার ভাই আমিই ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। এই কালি আমারে হাড় মাংস জ্বালিয়ে দিলো!’
‘এএইই তুষার, তুই আমার আম্মারে কালি কস কে?’
‘হেহে জেঠো, আপনার মাইয়া তো পুষ্প, কালি না। এমনি ফাজলামো করছি!’
সুফিয়া এসে ঝুমুরকে পানি খাওয়ালেন। তীর্থ ঝুমুরের হাত ধরতেই বুঝলো ঝুমুরের হাত কাঁপছে। ভয় পেয়েছে এতো র’ক্ত দেখে সে বুঝলো। এরকম একটা কাজ ঝুমুর করে বসবে আন্দাজও করতে পারেনি সে।
ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হতেই তীর্থ চলে গেলো। তুষার ও ঋতুর সঙ্গে নিজেদের রুমে গেলো। তুষার এই বাড়িতে ঘর জামাই থাকে। যদিও এটা তার ফ্যামিলির স্বভাবের বাইরে। কিন্তু নিজের মান-ইজ্জত খুইয়ে একমাত্র ঋতুর জন্য এই বাড়িতে পরে আছে।
রাতে খাওয়ার সময় বাঁধলো আরেক বিপত্তি। ঝুমুরের ডান হাত কে’টেছে তাই সে হাত দিয়ে খেতে পারছে না। এমন কি হাত ব্যথায় নাড়াতে পারছে না পর্যন্ত। আজিজ সাহেব তা খেয়াল করে বললেন,
‘সুফিয়া আমি পরে খামু আগে আম্মাকে খাইয়ে দেই!’
‘আব্বা, আইজকা আমি আপনের হাতে তো খামু না।’ বললো ঝুমুর।
অবাক হলেন আজিজ সাহেব। যে মেয়ে সব সময় বলে, ‘আব্বা আপনের হাতে না খাইলে আমার পেট ভরে না! ‘সে কি বলছে খাবে না তার হাতে।
আড় চোখে তাকালো তীর্থ ঝুমুরের দিকে। মনে মনে ভাবলো, এই মেয়ে না আবার সবার সামনে বলে বসে, ‘তীর্থ ভাইয়ের জন্য হাত কে’টেছে তীর্থ ভাই খাইয়ে দিবে।’
সে ভাবতে দেরি কিন্তু তার কথা ফলতে দেরি হয়নি।
ঝুমুর বললো, ‘আমার হাত কা’টা’র জন্য কে দায়ী আব্বা?’
‘তীর্থ! কিন্তু তীর্থ কি করে!’
‘আব্বা আমার হাত ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তীর্থ ভাই আমারে খাওয়াই দিবো। আমারে ব্যথা দেওয়ার এটাই তীর্থ ভাইয়ের জন্য শাস্তি!’
তীর্থ না পারছে কিছু বলতে না পারছে সইতে। সে জানে এখন তার কোনো অজুহাত বা কোনো কথায় শুনবে না কেউই। অগত্যা তাকে ঝুমুরকে খাইয়ে দিতেই হলো। খাইয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে তীর্থ বললো, ‘খাটিয়ে নে, একদিন আমারও সময় আসবে। আজ বাড়িতে তোর কথা বলি নি তো কি হয়েছে পরে বলবো।’
ঝুমুর দাঁত বসিয়ে দিলো তীর্থর হাতে। আর্তনাদ করে উঠলো সে।
‘কি হলো রে?’ বললো ঋতু।
‘বি’ল্লি কা’ম’রে’ছে।’
‘এই ঝুমুর দাঁত বসাবি না। তীর্থ না তোর বড় ভাই।’ ধমক দিলেন সুফিয়া।
‘আমার খাওয়া হয়েছে! আমি উঠি, ঋতু তোমার হলে আসো দরকার আছে!’ বললো তুষার।
ঋতু খাওয়া শেষ হলে রুমে গেলো। তার ভীষণ ভাবে মনক্ষুন্ন হলো এটা ভেবে যে তার বাবা এখনো তীর্থর সঙ্গে কথা বলেন না।
‘তুষার, আব্বা আপনার সঙ্গে কথা বলে না তো কি হয়েছে? আপনি তো বলতে পারেন নাকি?’
‘কেন বলবো? তোমার বাপের ইচ্ছেই এখানে পরে আছি, আমি এখন সরকারি চাকুরীজীবি। আমি তো তোমাকে অসুখী রাখবো না, তাহলে উনি কেন যেতে দিচ্ছেন না এখান থেকে? আমার কি মান-সম্মান নেই? তোমার চেয়ারম্যান বাপকে বলবা আমরা কাল ই চলে যাবো!’
‘আহ তুষার, আবার আপনি এভাবে কথা বলছেন? উনি আপনার শশুর মশাই, বাবা বলুন!’
‘তোমাকে বলেছিলাম না, আমাকে যতদিন উনি না মেনে নেবেন জামাই হিসেবে ততদিন বাবা ডাকবো না!’
‘আপনারও ঘাড়ের রগ একটা ত্যাড়া আমার বাপেরও।’
‘আমার তো একটা রগ ত্যাড়া আর তোমার বাপের সব গুলা রগ ই ত্যাড়া! জন্মের সময় বোধহয় উনার মুখে টক দেওয়া হয়েছিলো, মুখটা দেখো না কেমন চ্যাপ্টা করে রাখেন!’
বলতে বলতে দরজায় চোখ যেতেই ঘাবড়ে গেলো তুষার। দরজায় আজিজ সাহেব দাঁড়িয়ে। তুষারের হাটু কাঁপুনি শুরু হলো আজিজ সাহেবের অগ্নি মূর্তি দেখে।
#চলবে