পূর্ণতা পর্ব-১৯

0
425

#পূর্ণতা❤️
#Writer_তানজিলা_তাবাচ্ছুম❤️

১৯.

ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে এসে আলোক তার মায়ের রুমে যায়। চাঁদ কে দেখতে।তার মা আশা নামাজ পড়ে বাহিরে হাঁটতে যায়।নামাজ থেকে ফেরার পথে দেখা হয়েছিল আশার সাথে আলোকের। আশা আলোক কে জানালো, চাঁদ এখনো ঘুমে। কালকে রাতে চাঁদের জ্বর এসেছে।আলোক ঘরের দরজা খুলল। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে চাঁদ ,গায়ে একটা কম্বল দেওয়া।আলোক আস্তে আস্তে এগোলো।তারপর হাঁটু ভেঙ্গে ফ্লোরে বসলো। চাঁদের কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরের মাত্রা অনেক বেশি।আলোক আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’হঠাৎ তোমার কি হলো চাঁদ?’। বলে কপালে একটা কিস করলো আলোক।চাঁদ আসতে আসতে চোখ মেলতে লাগলো। চাঁদ চোখ খুলতেই আলোক বলল, ‘ আমাকে ভয় পেয়ো না।’ চাঁদ ধীরে ধীরে উঠার চেষ্টা করলো।আলোক তাকে বারন করলো কিন্তু শুনলো না।তারপর আশা এসে চাঁদ কে শাসালো। চাঁদ আশার উপরে কোনো কিছু করতে পারলো না।

___________

সকাল সাড়ে নয়টার মত বাজতে চললো। চাঁদ এখনো উঠে নি। উঠতে চেয়েছিল কিন্তু আশা মানা করে দিয়েছে সাথে আলোক ও।আশা কিচেনে কাজ করছে এমন সময় বাহির থেকে দু’জন মহিলা এসে ডাকতে শুরু করলো,

‘ভাবি ও ভাবি।’

আশা বের হলো।বাড়ির গেট আলগা ভাবে লাগানো থাকে।আশা বের হয়ে তাদের কে দেখতেই হেসে বলে উঠলো,

‘তাসলিমা তুমি।’

তারপর সেই মহিলার সাথে কোলাকুলি করলো আশা। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘হঠাৎ এভাবে আসলে তাসলিমা?’

‘আপনারে তো কইছিলাম ভাবি একদিন আসবো। কাইল ভাবলাম লইলাম আইজ আসবো। তাই আইলাম।’

আশা হাসল।তারপর আরেক জন মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘রাহেলা____?

আশা বলার আগেই উনি বলে উঠলো,

‘উনি আপনাদের বাড়ি চিনে না। আমারে রাস্তায় জিগাই ছিল।তাই এই বাহানায় ভাবলাম আমিও আসি।আর মেলা দিন ধ্ইরাও আসা হয়না।’

আশা স্বাভাবিক ভাবে বলল,

‘আচ্ছা বসো তোমরা দুজন।’

আর তাসলিমা কে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘তুমি তো অনেক দূর থেকে এসেছো তাসলিমা।গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

‘হ ভাবি।আগে ঠান্ডা হইয়া লই।তারপর যাই গা।’

বলে চেয়ার টেনে বসলো তাসলিমা সাথে রাহেলা ও বসলো।আশা তাসলিমা কে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘তুমি এতদূর একাই এলে?নাহিদ বা রিদওয়ান এদের কাউকে সাথে নিয়ে আসতে।’

‘ভাবি ওরা বাপ,ব্যাটা এক সাথে আইবো।ব্যাটা টা পুরা বাপের কাবুতে হইয়া গেছে।’

আশা হাসলো। তারপর চোখ দুটো উঁচু করে বলল,

‘অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছো।আমি শরবত বানিয়ে আনছি।’

বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আশা।রাহেলা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কেন?বউয়ের কি হইছে?কি জান নাম!’

আশা থেমে গিয়ে বলল,

‘ চাঁদ ।ও ঘুমোচ্ছে।’

বলে চলে গেল।যেতেই রাহেলা ভেঙ্গছি কেটে বলল,

‘এ আবার কেমন বউ শাশুড়ি কাজ করে আর সে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ঘুমায় থাকে।’

তারপর তাসলিমা কে ফিসফিস করে বলল,

‘আচ্ছা বিয়ার তো মেলা দিন হইলো।এহনো বাচ্চা নাই কেন?’

তাসলিমা শুরু কথা গুলো কপাল কুঁচকে শুনছে। তাসলিমা গ্রামের মেয়ে একজন। বিয়ে শহরে হওয়ায় শহরের মানুষের মতন কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।তাই শহর গ্রাম দুটো মিক্স করেই কথা বলে।আগে তাসলিমা এখানে থাকত । আশা সম্পর্কে তার জা হয়। কিন্তু তার স্বামীর কাজের জন্য তারা অন্য জায়গায় চলে যায়। তাসলিমার দুটো ছেলে মেয়ে। তাসলিমা রাহেলার কথার কোনো প্রতিউওর দেয়না।বিয়ের তারা আসে নি।আর ফোনে কথা বলার সময় অনেক বার আশা কে এই সম্পর্কিত কথা বলেছিল। কিন্তু আশা কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আলোক বলছিল,

‘মা চাঁদ এগুলো খাবে না।অন্য কি_______

তারপর তাসলিমা আর রাহেলা কে দেখে থেমে যায়।আলোক খুশি হয়ে বলে উঠে,

‘আরে চাচী। আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন চাচী!এতদিন পর?’

‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম বাবা‌।ভালা আছি বাবা।তুই কেমন আছিস?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রহমতে ভালো আছি।’

‘ কি হয়েছে আলোক? ডাকছিলি?’

কিচেন থেকে হাতে শরবত নিয়ে আসতে আসতে বলছিল আশা।টেবিলে রেখে দাড়ালো।আলোক তার হাতে থাকা প্লেট টা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘মা চাঁদ না এইসব খাবে না।’

আশা আলোকের হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে বললো,

‘তাহলে কি খাবে বল?রান্না করে দেই।’

‘ও কিছু খাবে না। ওর নাকি ইচ্ছে করছে না।’

‘এভাবে খালি পেটে থাকবে নাকি। দ্বারা আমি ভাত নিয়ে যাচ্ছি।তরকারি টা একটু বাকি।’

আলোক ছোট মুখে ‘আচ্ছা’ বললো। রাহেলা তীক্ষ্ম চোখে এতক্ষণ তাকিয়ে দেখছিল।আলোক যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাহেলা বলে উঠলো বললো,

‘বাপো।এহানে দেখি বউয়ের গোলামী করতেছে।বউডারে ভাবছিলাম ভালোই হইবো।কথা কবার পায়না। কিন্তু মাইডা দেখি ভালোই জানে।ছোয়াল ডারে নিজের আঁচলে তলায় রাখছে।কি যুগ আইলো________

‘বউয়ের খেদমত করলে সেটা গোলামী হয় না আন্টি।

আলোকের কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে উঠে রাহেলা।আলোক হেসে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

‘চাঁদের জ্বর।তাই আমি তার খেদমত করছি সেটা কখনোই গোলামী হয়না।আসলে আপনদের মন মানসিকতাই এইরকম‌ নিম্ন মানের।’

আলোকের শেষের কথাটা শুনে রাহেলা ক্ষেপে গেলো।মুখে রাগান্বিত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।সে বললো,

‘তো কি হইছে? আমাদের কি কহনো জ্বর টর হয় নাই নাকি? এর চেয়ে কতো কিছু লইয়া কাজ কইরা খাইছি।এইভাবে সারাদিন বাহানা দিয়া শুইয়া শুইয়া থাকলে কি সংসারের উন্নতি হইব?

আলোক হাসি মুখে বললো,

‘আমাদের সংসার আমরাই ভালো বুঝবো।আপনাদের আমাদের কথা ভেবে কষ্ট পেতে হবে না।’

বলে থামলো।তারপর ফিক মেরে হেসে বললো,

‘কি অদ্ভুত! স্বামীর সেবার সময় আপনারা বলেন এটা ফরজ। আর যেই বউয়ের সেবার কথা আসে তখন সেটাকে আপনারা বলেন গোলামী? অথচ আল কুরআনে বলা হয়ছে, ‘স্বামী স্ত্রীর একে উপরের উপর সমান অধিকার'[সূরা বাকারা]।

রাহেলা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

‘আরে স্বামীর সেবা তো করানই লাগব। স্বামীর পায়ে নিচে বেহেশত।’

রাহেলার কথা শুনে আলোক মুচকি হাসলো।তারপর বললো,

‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত!!কথাটা সমাজে খুব প্রচলিত।কিন্তু আদৌ কি কুরআন,হাদিসের কোথাও এটা বলা আছে?ভিত্তিহীন কথা এটা!মানুষের বানানো কথা অর্থাৎ জাল হাদিস।”মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত” [হাদীস:সুনানে আন নাসায়ী:৩১০৪](বায়ান ফাউন্ডেশন,২০২১)এ বলা হয়েছে।কিন্তু স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত এটা বানানো কথা। আর এটা কুরআন ,হাদিসের সমর্থন ও নয়।’

রাহেলা চলে যেতে যাবে আলোক তখন আবার বলে উঠে,

‘আর হ্যাঁ।আমি যেমন আমার বউয়ের খেদমত করি তেমনি মায়ের বেলাও করি।আর আমাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়েও আপনাকে ভাবতে হবে না।আমাদের ফ্যামিলি আমরাই বুঝবে।এবার আপনি আসতে পারেন।’

রাহেলা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো।আশা এতক্ষণ আড়াল থেকে সব দেখছিল। আশার সবসময় মনে একটা বিশ্বাস নিয়ে রাখে তার ছেলে কখনোই ভুল হবে না। এটা আশা নিজের মনে গেঁথে নিয়েছে।তাই চাঁদের প্রতি এতটা কেয়ারিং এ সে কিছু বলে না।উল্টা না করলে তাকে বোকা দেয়। তাসলিমা ও হনহন করে সিড়ি বেয়ে উপরের ঘিরে চলে গেলো।

_________

দুপুর হতে হতে চাঁদ নিজের ঘরে এসেছে।এখন প্রায় বিকেল।আলোক আসরের নামায পড়তে বাহিরে মসজিদে গেছে।আশা তার রুমে আর তাসলিমা তার। সিড়ি বেয়ে উঠেই প্রথমে মাঝ বরাবর আশার রুম ও চাঁদ আলোকের রুম।তারপর দুটো রুম ফাঁকা ছিল কিন্তু শেষের টায় তাসলিমা থাকছে। নাহিদ ঢুকলো।ঢুকেই কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না।নাহিদ আলোকের চাচাতো ভাই অর্থাৎ তাসলিমার ছেলে।নাহিদ ও তার বাবা এখন এসেছে।কিন্তু মাঝ রাস্তায় আলোকের আর রায়হানের সাথে দেখা হওয়ার নাহিদের বাবা রিদওয়ান আর বাড়িতে আসেন নি।নাহিদ তার মাকে খুঁজছে। সিড়ি বেয়ে উঠলো।প্রথম রুম টা খুলতেই দেখলো আশা নামাজ পড়ছে।সে দ্বিতীয় রুম টা খুলল।আজকে সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়েছে চাঁদ।গোসল করাও হয়নি।তাই ভাবলো বিকেলের নামাজ গোসল করেই পড়বে।এখন সে সুস্থ।তাই গোসল করলো।পরনে তার নীল কালারের শাড়ি। মাথা টাওয়াল দিয়ে পেঁচানো। নাহিদ ঘরে উঁকি মারতেই চাঁদকে দেখে থমকে যায়। চাঁদের মুখ চুল কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু পিছন থেকে শাড়ি পড়া একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে।নাহিদের চোখ আটকে গেছে।মনে মনে সে ভাবছে মেয়েটা কতটা সুন্দর হবে।কলার সহ ফুল হাতা নীল রংয়ের ব্লাউজ হওয়ার কারণে পিছন থেকে চাঁদের গায়ের রং ও বোঝা যাচ্ছে না। নাহিদ চাঁদের মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে।নাহিদ ভাবছে ভিতরে ঢুকবে কিনা! কারন এভাবে উঁকি মেরে দেখতে তার ভালো লাগছে না।নাহিদ ভিতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই

‘নাহিদ ওখানে কি করিস?এদিকে আয়।’

তাসলিমা তার রুমের সামন থেকে ডেকে উঠলো।নাহিদের মুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠলো।দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মায়ের ডাকে সে বিরক্ত।নাহিদ ভিতরে না ঢুকলো না।দরজা টা কিছুটা লাগিয়ে চললো তার মায়ের দিকে।এদিকে চাঁদ কথাটা শুনতেই ওভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। ‘নাহিদ’ নামটা শুনতেই কেমন আঁতকে উঠে সে।তারপর আস্তে আস্তে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখে কেউ নেই।চাঁদ একটা ঢোক গিলে।তারপর কাল রাতের কথা গুলো শুধু মাথায় বেজে উঠছে তার।বার বার কানে শুধু ‘নাহিদ’ আর কালকের আলোকের কথা ‘আগুন জ্বালাও’ কথা বাজছে।চাঁদ জোরে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে।আশেপাশের সব কিছুই তার ঝাঁপসা দেখাচ্ছে।

___________

কালকে রাতের চাঁদের ওমন ব্যবহার আর মাঝ রাতে জ্বর আসাটা কে কিছুতেই আলোক স্বাভাবিক নিতে পারছে না।আলোকের মাথায় খালি ঘুরপাক খাচ্ছে।আলোকের মনে প্রশ্ন জাগছে চাঁদ এতটাই ভয় পেল যে তার জ্বর এসে গেল?এমন কিছুই তো আলোক বলেনি বা করে নি যেটাতে চাঁদ এমন ব্যবহার করবে!আলোক এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়িতে আসছে। আলোকের মনে নতুন কিছু প্রশ্ন জেগেছে, চাঁদ বোবা কেন? চাঁদ কিভাবে অনাথ হলো? চাঁদ কি ছোট থেকেই বোবা? এইসব নতুন নতুন প্রশ্ন আলোকের কাছে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।আলোক বাড়িতে ঢুকে সোজা নিজের রুমে গেল।যেতেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।চোখ দুটো বড়সড় হয়ে গেল তার।

#চলবে….