পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-০৪

0
200

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৪
অপরাজিতা অপু

রুপমের কথায় আমি একটু অবাক হলাম। মাথায় এলো আমার নাম্বার পেলো কোথায়। তার কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম
” নাম্বার কোথায় পেলেন আপনি?”

” যার যাকে প্রয়োজন সে ঠিকই খুজে নেয়। বলতে পারেন এই মুহূর্তে আপনাকে আমার প্রয়োজন। তাই খুজেঁ নিলাম।”

তার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না। অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
” আমাকে কেনো প্রয়োজন আপনার?”

” আপনার বাবা ফোন করেছিলেন। জানালেন আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন। সে বিষয়েই একটু কথা ছিলো।”

তার অকপটে বলা কথার উত্তরে আমি বললাম
” জি বলুন।”

উনি কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বললেন
” এভাবে না বলে যদি দেখা করতে চাই? সুযোগ দেবেন আমাকে?”

আমি না ভেবেই হ্যা বলে দিলাম। উনি আমাকে আবার সেই নার্সারীতে যেতে বললেন। তবে একা না বিকেলে নিজেই নাকি আমাকে নিতে আসবেন। আমি আপত্তি করিনি। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলো না। আমার মনে হলো উনি হয়তো সুযোগ নিতে চাইছেন। কিন্তু কেনো এমন করবেন? কি উদ্দেশ্য ওনার। মাথায় নানা রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাকে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। তার আগে কিছুই বলতে পারবো না। তবে এই কথাটা তো বাসায় জানাতেই হবে। ভাবীকে সবটা জানিয়ে দিলাম। বাকিটা এখন ভাবীই ম্যানেজ করবে। পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়তেই আমার ফোনে মেসেজ এলো
” রেডি? আসবো আমি?”

নাম্বার টা দেখেই বুঝে গেলাম এটা রুপম। আমিও ছোট্ট করে একটা জবাব দিয়ে দিলাম ” আসুন।”
তারপর রেডি হয়ে নিলাম ঝটপট। রুপম আসতে খুব বেশি দেরি হলো না। বাড়ির সামনে এসে ফোন দিলো আমাকে। আমি ফোনটা ধরতেই বলল
” আমি বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছি।”

” আসছি।”

বলেই আমি বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির মেইন গেট পেরিয়ে দেখি রুপম রিক্সায় বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে। আমি ধির পায়ে রিক্সার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। তার সাথে একই রিক্সায় বসতে আমার অসস্তি হচ্ছিলো। তাই দাড়িয়ে ভাবছিলাম। তিনি হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। রিক্সার অপর পাশে চেপে বসে বললেন
” রিক্সায় উঠতে কি খুব বেশি সমস্যা?”

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না খুব সমস্যা কিনা। তবে অসস্তি হচ্ছে। তবুও মনস্থির করে রিক্সায় উঠে বসলাম। রুপম কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে। আমার বাড়ি থেকে সেই নার্সারীর দূরত্ব খুব বেশি না। কিছুদূর যেতেই রুপম বলল
” জানতে ইচ্ছা করছে না কেনো আমি নিজেই নিতে আসলাম?”

অসস্তিতে বিষয়টা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো। সে নিজে থেকেই যখন জানাতে চাইছে তাই আমিও আগ্রহ দেখিয়ে বললাম
” কেনো এলেন?”

রুপম খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল
” দায়িত্ব তো নিতেই হতো তাই আগে থেকেই বুঝে নিতে চাইছিলাম। প্রথমবার দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো। তখনো দায়িত্বটা ঠিক আমাকেই নিতে হবে কিনা সেটা সিওর ছিলাম না। তাই আগ বাড়িয়ে কিছুই বলতে চাইনি। কিন্তু এখন তো পুরোটাই আমার। আমি কি করে অবহেলা করি।”

রুপম থেমে গেলো। সাথে আমিও। বাকি রাস্তাটা আর কোন কথা হলো না। আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। রিক্সা থেকে নেমে নার্সারীর ভেতরে প্রবেশ করতেই আমার নাকে ভেসে এলো বেলী ফুলের সুবাস। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। কি অদ্ভুত ব্যাপার! প্রকৃতির কি অসীম শক্তি। আমরা সেই বসার জায়গাতেই গিয়ে বসলাম। সেদিনের মতই রুপম চা দিতে বলল। আমি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সেদিনের টকটকে রঙের গোলাপটা খুঁজলাম। কিন্তু কোনদিকে দেখতে পেলাম না। রুপম বলল
” কি খুঁজছেন?”

আমি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললাম
” সেদিনের গোলাপটা কোথাও দেখছি না।”

“ওহ! ওটাতো ঝরে পড়ে গেছে।”

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এতো সুন্দর একটা গোলাপ ঝরে পড়ে গেলো। রুপম আবার বলল
” নতুন কলি এসেছে। আবার ফুল ফুটবে। মন খারাপ করার কিছু নেই।”

আমি এক পলক রুপমের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। বিয়েতে মত দিলেও এখনো সহজ হতে পারিনি। অনেক সময় লাগবে আমার এই সম্পর্কটা কে মেনে নিতে। কিন্তু আমি কি এতো সময় পাবো?
“আজরা?”

ভীষণ শান্ত কণ্ঠ আমার ভেতরটা কাপিয়ে তুললো। আমি বাধ্য হলাম রুপমের চোখে চোখ রাখতে। কিছুক্ষণ আগের হাসিমাখা চেহারাটা দেখতে পেলাম না। চোখের ভাষা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি পুরো চেহারায় চোখ বুলিয়ে আবারো সেই শীতল দৃষ্টির দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করলাম। রুপম ভীষণ শান্ত ভাবে বলল
” আপনার বিয়ে অথচ সেই আমেজটা কোথাও নেই। চেহারায় হতাশা ছাড়া কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। কেনো?”

আমার সমস্ত ভাষা কোথায় হারিয়ে গেলো। মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোচ্ছে না। রুপম এর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। রুপম এখনো আগের মতই তাকিয়ে আছে। আমি বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে বললাম
” সেরকম কিছুই না। আমি আগে এভাবে কারো সাথে কথা বলিনি তাই একটু হেজিটেশন হচ্ছে।”

“কোনটা হেজিটেশন আর কোনটা ডিপ্রেশন সেটা আমি বুঝি। না বলতে চাইলে আলাদা কথা। জোর করার মত অধিকার আমার এখনো হয়নি। আর হলেও আমি সেটা করবো না। ব্যাপারটা যেহেতু সেনসিটিভ তাই জানতে চাওয়ার জন্য প্রশ্নটা করা। হয়তো এভাবে প্রশ্নটা করা এক রকম অনধিকার চর্চা। আমি জাস্ট জানতে চাই বিয়েতে কি সত্যিই আপনার মত আছে নাকি পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। যদি এমন টাই হয় তাহলে বলবো ভেবে দেখতে। যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হওয়ার জন্য সচ্ছতা প্রয়োজন। সমস্যা থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।”

রুপম থেমে গেলেও তার কথার রেশ কাটলো না। আমার কানে বাজছে এখনো। যা ভেবেছিলাম তাই। সম্পর্কটা মেনে নেয়ার মতো নিজেকে সময় দেয়ার কোন সুযোগ আমার নেই। একটা অনুভূতিহীন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি শেষ পর্যন্ত। রুপম সচ্ছতার কথা বলল। তাহলে কি আমার উচিৎ তাকে অতীত জানানো? আমার জীবনের পেরিয়ে আসা তিনটা বছরের স্মৃতি যা আমি ভুলতেই তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা জানার পর রুপমের রিয়াকশন কি হতে পারে আমার জানা নেই। এই বিষয়ে কথা বলা কতটুকু যুক্তি সঙ্গত। মাথায় যখন নানা প্রশ্নের জটলা পাকিয়ে গেছে ঠিক তখনই রুপম বলে উঠলো
” আমার মনে হয় আপনার সময় প্রয়োজন আজরা। আপনি এখনো বিয়ের মতো সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুত না। নিজেকে সময় দিন। আর একটা কথা বিশেষ ভাবে বলবো আপনি নিজের ব্যাপারে খুব উদাসীন। নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। নিজের জন্য বাঁচতে শিখুন। দেখবেন সব কিছু সহজ হয়ে গেছে।”

আমি আবারো রুপমের দিকে তাকালাম। এবার রুপমের কথাগুলো আমার ভেতরে ঝড় তুললো। এতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখার যে অভিনয়টা করছিলাম সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হলো না। অস্থির হয়ে উঠলো ভেতরটা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু আমি তো কাদতে চাইনা। আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। তাহলে কেনো আবার এমন হলো। আমার চোখের কোণে জমে থাকা পানি রুপম বোধহয় খেয়াল করলো। মৃদু হেসে বলল
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”

আমি কান্নাটা গিলে ফেলে নিস্তেজ কণ্ঠে বললাম
” আমি যেতে পারব। আপনাকে আর যেতে হবে না। আপনার কষ্ট হয়ে যাবে।”

রুপম হেসে ফেলে বলল
” বুঝেছি। আমি জানি আপনি একাই যেতে পারবেন। তবুও দায়িত্ববোধ থেকেই বললাম। আপনার মনের অবস্থা ভালো না। এই অবস্থায় আমি অন্তত আপনাকে একা ছাড়তে চাইছি না।”

আমি কিছু বলতে পারলাম না। নিরব সম্মতি জানালাম। দুজন সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম। পুরো রাস্তায় আর কেউ কোন কথা বলিনি। বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নেমে একবার পেছনে ঘুরে তাকালাম। রুপম মুচকি হেসে বলল
” নিজের খেয়াল রাখবেন। আর হ্যা বিয়ে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি আমার বাসায় বুঝিয়ে বলবো। আপনি সময় নিন। আর বাসায় একটু বুঝিয়ে বলবেন যে আপনার কিছুদিন সময় প্রয়োজন। মনে রাখবেন পরিবারের চেয়ে আপন কেউ নেই। ওনারা আপনাকে যেভাবে বুঝে সেভাবে আর কেউ বুঝবে না। ভালো থাকবেন। আপনার সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।”

চলবে