পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-০৫

0
200

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৫
অপরাজিতা অপু

অঘোষিত এক তীব্র শীতের দাপট খাটিয়ে আবার হুট করেই কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রকৃতি। আজ সকাল থেকেই বেশ কড়া রোদ পড়েছে। এতো তীব্র রোদ দেখেই আমি ছাদে চলে গেলাম। কড়া রোদ হলেও শীতের এই সময়টাতে রোদ মানেই মিষ্টি একটা ব্যাপার। শীতল পাটি বিছিয়ে ছাদে বেশ আয়োজন করে বসেছি আমি আর আমার ছোট খালার মেয়ে। কয়েকদিন হলো খালামণি এসেছে বেড়াতে। এই তীব্র শীতে ঘুরাঘুরির কোন সুযোগ পাইনি। ঘরবন্দী অবস্থাতেই কেটে গেলো কয়েকটা দিন। আমরা যখন ছাদে বসে দাবার বোর্ড সাজাচ্ছি ঠিক তখনই ভাইয়া ছাদে এলো। আজ ছুটির দিন বলেই বাড়িতে আছে। আমাদেরকে দাবার বোর্ড সাজাতে দেখে বলল
” তোরা দুজন একদিকে আর আমি একদিকে।”

মাহী হেসে ফেললো। বলল
” আমরা দুজন একসাথে খেললে কি তুমি পারবে ভাইয়া?”

ওর কথা শুনে ভাইয়া ওর দিকে এমনভাবে তাকাল যেনো বড়ো কোন অপরাধ করে ফেলেছে। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। ভাইয়াকে ওভাবে তাকাতে দেখে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
” আমি ভুল কি বলেছি? তুমি একাই দুজনের সাথে কিভাবে পারবে?”

আমি এবার হেসে ফেলে বললাম
” ভাইয়া দাবায় উপজেলা চ্যাম্পিয়ন। আমাদের মতো আনাড়ি খেলোয়াড়কে হারাতে বেশি সময় লাগবে না।”

আমার কথা শুনে মাহী উঠে দাড়িয়ে বলল
” আমি খেলবো না। দাবা মোটামুটি পারি তবে এসব চ্যাম্পিয়নের সাথে খেলে নিজের ইমেজ নষ্ট করার ইচ্ছা নেই।”

আমি নিজের হাসি থামাতে পারলাম না। ভাইয়া আর মাহীর পাল্টা যুক্তি তর্কে খেলাটা শেষ পর্যন্ত হলো না। সাজানো দাবার বোর্ড অমনি থেকে গেলো। এর মাঝেই ভাবীও উপরে এলো। আমার কাছে বসে বলল
” অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আমার তো কেমন এক ঘেয়েমি লাগছে। কোথাও একটু ঘুরতে গেলে ভালো লাগতো।”

ভাইয়া ভাবীর কথায় সায় দিয়ে বলল
” কোথায় যাবে বলো?”

” কক্সবাজার গেলে কেমন হয়?”

ভাবীর কথা শুনে মাহী লাফিয়ে উঠে বলল
” ভেরি গুড আইডিয়া। কক্সবাজার এই সময় বেড়াতে যাওয়ার জন্য বেস্ট প্লেস। কবে যাবে বলো না।”

ভাইয়া ফোনটা নিয়ে কিছু একটা চেক করে বলল
” পরশু যাওয়া যায়। এ বছরে ছুটি কাটানো হয়নি। পুরো ছুটি বাকি আছে। চাইলেই নিতে পারবো।”

সবাই একসাথে উচ্ছাসে ফেটে পড়লাম আমরা। অনেকদিন কোথাও একসাথে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। গেলে বোধহয় ভালই লাগবে। নিচে এসে সবাইকে কথাটা জানানো হলো। বাবা অবশ্য যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তার শরীর তেমন ভালো নেই। তবে ছোট খালার কাছে আপত্তি টিকলো না। তিনি এক প্রকার জোর করে রাজি করালেন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো আমরা পরশু যাচ্ছি। ভাইয়া হোটেল বুকিং থেকে টিকেট কাটার ব্যবস্থা করে ফেলবে আজই। নয়তো ঝামেলায় পড়তে হবে। এতো কথার মাঝে মাহী বলল
” আমার তো কিছু শপিং করতে হবে। আমি তো বেড়াতে যাওয়ার উদেশ্যে সেরকম কিছুই আনিনি। আর এখন তো কক্সবাজারে অনেক শীত।”

ওর অসহায় চেহারা দেখে আমি বললাম
” ব্যাপার না। আমরা বিকেলে যাবো। ভাবী তুমিও আমাদের সাথে যাবে।”

ভাবীও রাজি হয়ে গেলো। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। মাহীর তাড়া দেখে আমি আর ভাবী দুপুরে খাওয়ার পরই রেডি হতে বাধ্য হলাম। মেয়েটা খুব অস্থির। এক কথা মুখ দিয়ে বের করলে সেটা না করা পর্যন্ত থামবে না। আমরা তিনজন বের হয়ে গেলাম শপিং করতে। আমাদের শহরে ছোট একটা শপিং মল আছে। যা কিছু ভালো মানের জিনিসপত্র ওখানেই পাওয়া যায়। তাই আমরা সেখানেই গেলাম। মাহী পুরো শপিং মল ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু পছন্দসই কোন জিনিসপত্র খুজে পাচ্ছে না। আমি টুকটাক কিছু দেখছি। কেনাকাটার উদ্দেশ্য নেই তবে পছন্দ মতো কিছু পেলে ছেড়ে যাবো না। হঠাৎ করেই দোকানের এক কোনায় একটা শাল চোখে পড়লো। আমি এগিয়ে গেলাম সেদিকে। এক দেখাতেই পছন্দ হওয়ার মতো। শালটা হাতে ধরে দেখছি।

” কেনাকাটা করছেন বুঝি?”

আমি চমকে পেছনে ঘুরে তাকালাম। রুপম কে দেখে অবাক হলাম বেশ। রুপম মুচকি হেসে বলল
” কেমন আছেন মিস আজরা?”

আমি হেসে বললাম
” ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালোই তো আছি। কি কেনাকাটা করছেন?”

” তেমন কিছু না। এমনি দেখছিলাম।”

“আপনারা মেয়েরা মার্কেটে আসলে তেমন কিছুই কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে আসেন না। সব সময় এমনি দেখতেই আসেন। কিন্তু দেখা যায় দেখতে এসে হাত ভর্তি করে নিয়ে যান। কি অদ্ভুত!”

রুপম এর বলার ভঙ্গি দেখে আমি হেসে ফেললাম। আমার হাসি দেখে সে খুব বিরক্ত হলো। কিছুটা বিরক্তভাব নিয়ে বলল
” এতো হাসির কোন কথা আমি বলিনি। আপনিই ভেবে বলুন তো ব্যাপারটা কতটা বিরক্তিকর। আসলে আপনারা কোন ব্যাপারেই সিরিয়াস নন। তাই এমন হয়। বাসা থেকেই ভেবে আসা উচিত ছিলো কি কিনবেন। সেটা না করে পুরো মার্কেটে ঘুরে বলেন দেখতে এসেছেন।”

আমি আবারো হাসলাম। হাসি থামিয়ে বললাম
” আচ্ছা? আমরা মেয়েরা নাহয় এমনই। তবে আপনি মনে হয় ঠিক করে এসেছেন কি কিনবেন তাই না? তো কি কিনছেন জানতে পারি?”

রুপম বেশ দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
” আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা খুব দুর্বল। আমার এতক্ষণের কথা শুনেই বোঝা উচিত ছিলো যে আমি নিজের জন্য শপিং করতে আসিনি। কোন মেয়েকে সাথে নিয়ে এসেছি। এ জন্য এতো বিরক্ত।”

আমি একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম
” কাকে সাথে এনেছেন? গার্লফ্রেন্ড?”

রুপম অদ্ভুতভাবে তাকাল। তারপর মৃদু হেসে বলল
” সে সুযোগ আর কই পেলাম। আপাতত কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। তাই বোনকেই সাথে নিয়ে এসেছি। তবে একটা ছিলো এক সময়। তাকে নিয়ে এভাবে ঘোরাফেরা করার আগেই ব্রেকআপ হয়ে গেছে। বলতে পারেন মেয়ে ভাগ্য আমার খুব খারাপ।”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কত সহজে নিজের অতীতটা বর্ণনা করলো। যেনো কিছুই হয়নি। আর যা হয়েছে খুব ভালোই হয়েছে। কিন্তু আমি কেনো পারছি না। আমার সাথে যা হয়েছে সেটা যে ভালো হয়েছে তা ভাবতেই আমার জতো কার্পণ্য। মাঝে মাঝেই মনে পড়লে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমার ফ্যাকাশে মুখ দেখে রুপম বলল
” আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কি বলবেন? মাঝে মাঝেই এমন চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায় কেনো? সদ্য ব্রেকআপ হয়েছে নাকি? মেনে নিতে পারছেন না?”

আমি কোন উত্তর দিলাম না। ছেলেটা যে আমাকে এত ভালোভাবে খেয়াল করে সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি ভর করল হৃদয় জুড়ে। এমন অনুভূতির নাম কি হতে পারে? ঠিক তখনি পেছন থেকে ভাবীর ডাক শুনতে পেলাম। আমি পেছনে একবার ঘুরে রুপমের দিকে আবার তাকিয়ে বললাম
” আসছি। আবার কথা হবে।”

বলেই আমি ঘুরে দাড়ালাম। রুপম বলল
” আমাদের মাঝে আবার দেখা হওয়ার কোন কারণ নেই। কথা হওয়ারও না।”

আমি কোন প্রস্তুতি ছাড়াই নিজের অজান্তে পেছন ঘুরে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললাম
” আপনি আগেও বলেছিলেন। কিন্তু দেখা তো হয়েই গেলো। ঠিক এভাবেই হবে। আসলে আমাদের মাঝে দেখা হওয়ার কোন বিশেষ কারণের দরকার নেই। এমনিতেই দেখা হবে। আসছি।”

বলেই আমি সেখান থেকে চলে এলাম। শেষ পর্যন্ত একবার পেছন ফিরে তাকালাম। রুপম এখনো সেখানে দাড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। আমি এক গলি পেরিয়ে আরেক গলিতে ঢুকে পড়লাম। নিজেদের প্রয়োজনীয় কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে এলাম। রাতের মধ্যেই ভাইয়া হোটেল বুকিং করে ফেললো। সেই অনুযায়ী এখন টিকেট কাটবে। কাল সারাদিন আমরা গোছগাছ করবো। তারপর রওনা হবো সমুদ্রের উদ্দেশ্যে। উথাল পাথাল ঢেউ। খোলা আকাশ। অজস্র সামুদ্রিক জীবের সাথে কেটে যাবে কয়েকটা দিন। হয়তো এটাই জীবনের স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মন বলছে ঘটবে কিছু ঘটনা যা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।

চলবে