পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-০৬

0
202

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৬
অপরাজিতা অপু

নির্ঘুম মধ্যরাতের আকাশে পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘের বিচরণ। আর সাথে সাগর থেকে ভেসে আসা হুহু বাতাস। আমি চাদর জড়িয়ে সাগর পাড়ে হাঁটছি। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবে সমুদ্রের শা শা বাতাস কানে আসতেই মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। এমন একটা মুহূর্তের খুব করে দরকার ছিলো। এতদিনের টানাপোড়েন পেরিয়ে এমন মুক্ত পরিবেশে কিছুটা সময় কাটানো আমার জীবনে খুব দরকার ছিলো। ভাইয়া ভাবীকে মন ভরে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। তাদের জন্যই এমন একটা মুহূর্ত পেলাম। মনটা বেশ ভালো লাগছে। এতটা ভালো লাগবে জানলে আগেই চলে আসতাম। আমাদের হোটেলটা সাগরের একদম কাছে। হোটেল থেকে বেরিয়েই সাগর দেখা যায়। হোটেলের সামনে সাগর তীরে বসে থাকা যায় অনায়াসে। আজ বিকেলেই আমরা কক্সবাজার পৌঁছেছি। লম্বা এক বাস জার্নির পর এসে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পুরো বিকেলটা ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। সন্ধ্যায় সবাই ডুবন্ত সূর্য দেখতে বেরিয়েছিল। আমাকে কয়েকবার ডেকেছে। আমি উঠতে পারিনি। তাই ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়েছি সমুদ্র সৈকতের দর্শনে। রাতের সমুদ্রের দর্শন সত্যিই অসাধারণ। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। মাহীর আওয়াজ শুনে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। সে হাত দিয়ে আমাকে ইশারা করে ডাকলো। ওখানে টেবিলে সবাই বসেছে। উদ্দেশ্য রাতের খাবার সমুদ্রের তীরে বসে খাবে। আমি ধির পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। খাওয়ার কোন রুচি নেই। তাছাড়া এসব রিচফুড আমার এমনিতেই হজম হয়না। এসব খেলে আমি রাতের ভেতরেই অসুস্থ হয়ে যাবো নিশ্চিত। পরে দেখা যাবে পুরো ঘোরাঘুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমি সাভাবিক খাবার অর্ডার করলাম। খাওয়া শেষে যথারীতি রুমে এসে সবাই শুয়ে পড়লো। কারণ সবাই খুব টায়ার্ড। আমি নাহয় ঘুমিয়েছি। কিন্তু বাকি সবাই তো আর ঘুমায়নি। সবাই সময় মতো ঘুমিয়ে গেলেও আমার ঘুম আসছে না। পুরো বিকেলটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়া একটা কারণ আর একটা কারণ হলো এক্সাইটমেন্ট। কাল সকালে সূর্য ওঠার আগেই উঠতে হবে। কুয়াশার কারণে সূর্যোদয় দেখা যাবে কিনা সেটা সঠিক জানিনা। তবুও ভেতরে ভয়ঙ্কর রকমের একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে সবে যখন ঘুম চোখে ভীড় করেছে ঠিক তখনি খালামণি ডেকে তুললো। সবাই নাকি রেডি শুধু আমি ছাড়া। কোন উপায় না দেখে চোখে একরাশ ঘুম নিয়েই রেডি হয়ে গেলাম। আমাদের হোটেল থেকেও সূর্যোদয় দেখা গেলেও ভাইয়া সবাইকে বীচের একদম ধারেই নিয়ে যাবে। যাতে খুব ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। অগত্যা হেঁটে ঠান্ডায় কেপে কেপে বীচের ধারে গিয়ে দাড়ালাম। সাগরের অস্থির শব্দ আর হিমেল হাওয়ায় আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না। বারবার কেপে উঠছি। তবে মজার ব্যাপার হলো আজ আকাশ একদম পরিষ্কার। কুয়াশা নেই। সূর্যের দেখা মিলবে তাহলে। ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। আমি বাবা মাকে পেছনে ফেলে আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। আমাদের খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। সূর্য তার প্রথম আলো পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে উদারচিত্তে দাড়িয়ে আছে। সে এক অন্য রকম দৃশ্য। আমি সেদিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। মাহী ভাইয়া ভাবী সবাই সূর্যের সাথে ছবি তুলতেই ব্যস্ত। হুট করেই বাতাস বেড়ে যাওয়ায় বাবা মা খালামণি হোটেলে ফিরে গেলেন। বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেলো মুহূর্তেই। আমি এক জায়গাতেই দাড়িয়ে আছি। এই মনোরম পরিবেশ ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। সূর্যকে ঘিরে আশে পাশে বেশ ভিড় জমেছে। সবাই নিজেদের মতো ছবি তুলতেই ব্যস্ত। আমার পাশেই কিছু বাচ্চা ছোটাছুটি করছে। আমি তাদের দিকে ফিরে তাকালাম। ছেলেটা এক দৌড় দিতেই আছড়ে পড়ে গেলো বালির মাঝে। আমি এক দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম। ব্যথায় কেঁদে উঠলো। তেমন বেশি ব্যাথা লাগেনি তবুও শীতে একটু ব্যথাতেই অনেক বেশি অনুভূত হয়। একজন এসে আমার কাছ থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে কোলে তুলে আদর করে বলল
” কিছু হয়নি বাবা। একদম কাদেনা।”

আমি মানুষটাকে দেখেই চমকে উঠলাম। পরিচিত এক চেহারা। অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকতেই আমার দিকে সেও তাকাল। তারও অবস্থা আমার মতই। আমাকে দেখেও ঠিক সেভাবেই অবাক হয়েছে। বাচ্চার মা এসে তাকে কোলে নিয়ে গেলো। রুপম এগিয়ে এসে অবাক কণ্ঠে বললো
” আপনি?”

আমি তার প্রশ্নের জবাবে বললাম
” আমিও যদি একই প্রশ্ন করি?”

রুপম বিরক্ত হলো। সে আগে প্রশ্ন করেছে। তাই উত্তর পাওয়ার অধিকার তার আছে। আমার এভাবে পাল্টা প্রশ্ন করার ব্যাপারটা তার ভালো লাগেনি। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল
” সরি! আমার এভাবে প্রশ্ন করা উচিৎ হয়নি। এখানে যে কেউই আসতে পারে। কারো জন্য তো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আমি এসেছি বলে যে আপনি আসবেন না সেটা তো নয়।”

আমি তার বিরক্তির কারন বুঝেই বললাম
” আমি আসলে মজা করে বলেছিলাম।”

“আমিও মজা করেই বললাম।”

“বুঝেছি। যাই হোক কবে এসেছেন এখানে?”

” গত পরশু। মানে দুইদিন আগে। আর আপনি?”

” গতকাল।”

” একা নাকি বন্ধুদের সাথে?”

” না না। ফ্যামিলির সবার সাথে। ভাইয়া, ভাবী, আব্বু, আম্মু, খালামণি, খালাতো বোন সবাই মিলে এসেছি। অনেকদিন একসাথে ছুটি কাটানো হয়না। তাই ভাবলাম সবাই মিলে ঘুরে আসা যাক।”

” ভালই হয়েছে। আমিও ফ্যামিলির সাথেই এসেছি। আসলে ফ্যামিলির সাথে সময় কাটানোর সুযোগ সবসময় হয়না। তাই সুযোগ পেলে ছাড়ি না।”

দুজনেই আবার নিরব হয়ে গেলাম। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ কর্ণ ভেদ করছে না। সামনেই জোয়ারের চাপে সমুদ্রের পানি আছড়ে পড়ছে। আমরা দুজনেই সেদিকে তাকিয়ে আছি। এক পর্যায়ে রুপম বলল
” চলুন পানিতে পা ভিজিয়ে আসি।”

ঠিক সেই সময় দমকা হাওয়া এসে শরীরে কাপন ধরিয়ে দিলো। আমি কোন রকমে সামলে নিয়ে বললাম
” মাথা খারাপ। এই সকালে?”

রুপম আমার দিকে তাকালো। রুষ্ট কণ্ঠে বললো
” আপনি বেশ আনরোমান্টিক।”

রুপম এর কথাটা আমার কাছে সূক্ষ্ম অপমানের মতো মনে হলো। আমি অসন্তোষজনক কণ্ঠে বললাম
” এই ঠান্ডায় পানিতে পা ভেজানোর মধ্যে কোন রোমান্টিকতা নেই মিস্টার। আর আপনি যখন এতই রোমান্টিক তাহলে আপনার কোন গার্ল ফ্রেন্ড নেই কেনো?”

রুপম স্থির দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
” গার্ল ফ্রেন্ড রাখিনি তাই নেই। রাখলে ঠিকই থাকতো। আর আমি কতটা রোমান্টিক সেটা তো বিয়ে করলেই বুঝতে পারতেন। বিয়ে যখন করতে চান নি এখন আর বোঝার মত চান্স নেই।”

” এক্সকিউজ মি? আমি বিয়ে করতে চাইনি মানে। আপনিই তো আমাকে রিজেক্ট করে দিলেন।”

” আমার কি মাথা খারাপ? এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে রিজেক্ট করে দেবো মানে? আমি এমন কিছুই করিনি। শুধু বাসায় বলেছি আমার ভাবতে আরো সময় দরকার।”

আমি হাত দুটো ভাজ করে চাদরের তলায় লুকিয়ে বললাম
” যদি সময় দরকার বলেন তাহলে আপনার বাবা কেনো আমার বাবাকে বলেছে এখন আপাতত বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কোন আলোচনা করতে চাইছে না। আপনি নাকি বিয়েতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আমার বাসায় সবাই তো ধরেই নিয়েছে যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। এটা আমার জন্য কতটা অপমান জানেন? আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ রিজেক্ট করেনি। আর আপনার কাছ থেকে রিজেক্ট হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা আমিও মানতে পারছি না।”

রুপম ঠোঁট চেপে হেসে বলল
” তাহলে বিষয়টা আপনার ইগো তে লেগেছে। এতটা ইগো নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবেন কিভাবে? তাছাড়া আমি একবারও বলিনি আপনাকে আমার ভালো লাগেনি। হ্যা তবে সত্যি কথা বলতে ভালোলাগা আর ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য টা বিস্তর।”

থেমে গেলো রুপম। আমার দিকে ফিরে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল
” ভালো লাগলেও আপনাকে ভালোবাসাটা এখনো বাকি ম্যাডাম!”

সমুদ্রের ঢেউ তীরের সাথে সাথে আমার বুকের মধ্যখানে কোথাও আছড়ে পড়ছে। এলোমেলো বিধ্বস্ত আমি এই প্রথম লজ্জায় লাল হয়ে উঠছি। কান দুটো গরম হয়ে গেলো আমার। ততক্ষণে জোয়ারের তোড়ে পানি অনেক টা আমাদের কাছাকাছি এসে পড়েছে। রুপম প্যান্ট গুটিয়ে পানিতে গিয়ে দাড়ালো। পকেটে হাত গুজে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল
” ঠাণ্ডা কে কঠিন না ভেবে প্রকৃতির সাথে সন্ধি করুন। দেখবেন সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে সময়টা উপভোগ করতে পারছেন। পরিস্থিতি জতটা ভয় পাবেন যন্ত্রণা ততটাই বেশী হবে। এই ঠাণ্ডা পানিতে একবার পা ভিজিয়ে দেখুন সবকিছু শীতল মনে হবে। একবার নাহয় আমাকে বিশ্বাস করেই দেখলেন। ক্ষতি নেই কিন্তু।”

চলবে