পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-০৭

0
192

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৭
অপরাজিতা অপু

ঢেউ আর বাতাসের ছন্দ মিলেমিশে একাকার। অদূরে পানি পৃথিবীর সীমানা ছুঁয়ে আকাশে মিশে গেছে। নৌকাগুলো পানিতে ভেসে আকাশ ছুঁয়েছে। সূর্যটা ঠিক তাদের মাথার উপরে। এ যেনো শিল্পীর রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা একখানা শৈল্পিক ভাবনা। ভীষণ মুগ্ধকর দৃশ্য! যদিও একবার মন ভেংগে নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করার সাহস আমার ছিলোনা। তবুও জানিনা আমার মন কেনো জানি পুনরায় এই পাশের মানুষটিকে বিশ্বাস করার অনুমতি দিয়েছে। তাই নিজের মনের সমস্ত ভয় কাটিয়ে আমি বরফ শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে দাড়িয়ে আছি। প্রথমে ঠাণ্ডা অনুভূত হলেও ধীরে ধীরে আশ্চর্যজনক ভাবে ঠান্ডার অনুভূতিটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। আমি দাড়িয়ে দূরের সেই দৃশ্য দেখছি। কখন যেনো সেসবের মাঝে হারিয়ে গেছি তার কোন খেয়াল নেই। রুপম মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
” আপনি যে সেদিন বলেছিলেন আবার দেখা হবে। কিভাবে বুঝেছিলেন সেটা?”

ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। রুপম এর কথার উত্তর খুঁজতে কিছু সময় নিলাম। কারণ আমি তো নিজেই জানি না। সেদিন মনে হয়েছিল তাই বলেছিলাম। আমাকে ভাবতে দেখে রুপম বলল
” বলতে না চাইলে থাক। জোর নেই।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম
” আপনি জোর করে কখনো কথা বলেন না কেনো? মানে সবকিছু এতো সহজে মেনে নেন কিভাবে?”

রুপম হাসলো। তার হাসির শব্দ এই প্রথম আমার কানে লাগলো। ভীষণ মুগ্ধকর এক হাসি তার ঠোটে। আমি লাজ হারিয়ে সেদিকে তাকালাম। রুপম আমার চোখে চোখ রেখে বলল
” আগেই বলেছি আমি শান্তি প্রিয় মানুষ। শান্তি পছন্দ করি। তাই তর্কে জড়াতে চাইনা। মেনে নেয়ার মাঝেই জিত আছে ম্যাডাম। যুক্তিতর্কের মাঝে কোন জিত নেই।”

কয়েক মুহূর্ত থেমে আবার বলল
” এখনো ঠাণ্ডা লাগছে ?”

এবার আমি হেসে ফেললাম। ঠান্ডার অনুভূতিটা ভুলেই গিয়েছিলাম। রুপম বলল
” বলেছিলাম। একবার বিশ্বাস করেই দেখুন কোন ক্ষতি নেই।”

আমি হেসে ফেলে বললাম
” বুঝেছি মিস্টার। আর সেজন্যই তো বিশ্বাস করে এগিয়ে এলাম।”

” তাহলে এবার বিশ্বাস করে যদি নিজের কষ্টের কথা বলতে বলি খুব কি অন্যায় আবদার হয়ে যাবে?”

রুপম এর কথার প্রেক্ষিতে আমার কিছু বলার নেই। মানুষটা অদ্ভুত। তার সাথে আমার মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়। সে হিসেবে দেখতে গেলে আবদারটা সত্যিই অন্যায়। কিন্তু সেটা বলার উপায় নেই। এসব নিয়ে রুপম কেনো কারো সাথেই আমি আর কোন আলোচনা করতে চাই না। তাই এড়িয়ে গিয়ে বললাম
” মন খারাপের কথা বলে সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করতে চাইছি না। যেদিন সত্যিই মন খারাপ থাকবে সেদিন নাহয় বলবো।”

রুপম উত্তর দিলো না। তবে মেনে নিল আমার কথা। তার এই সহজে মেনে নেয়ার গুন টা আমার মনে ধরেছে। ভেবেছি আমিও আয়ত্ত করবো। এটাতে কিন্তু নিজেরই লাভ। আমার ফোন বেজে উঠলো। মাহীর নাম্বার দেখে পেছন ফিরে তাকালাম সে হাতের ইশারায় ডাকছে। আমি ফোনটা সাইলেন্ট করে রুপম কে বললাম
” আমাকে ডাকছে। আসছি।”
রুপম শুধু হাসলো। কোন কথা বলল না। আমি চলে এলাম। এসেই মাহী বলল
” কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? তোমার পরিচিত কেউ?”

আমি মাহীর আগ্রহ দেখে ঘাবড়ে গেলাম। রুপম এর সাথে এভাবে কথা বলা কতটুকু যুক্তি সঙ্গত সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার পরিবারের সবাই ধরেই নিয়েছে তারা না করে দিয়েছে। এরপর এভাবে কথা বলার অর্থ মোটেই ভালো হতে পারে না। তাই বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে বললাম
” তুই একা কেনো? সবাই কই?”

মাহী পেছনে হাত বাড়িয়ে দেখালো। বলল
” সবাই নাস্তা খেতে বসেছে। তোমাকে ডাকছে। তাই ডাকতে এসেছিলাম।”

আমি উত্তর না দিয়েই ওর সাথে চলে গেলাম। টেবিলে সবার সাথে বসে পড়লাম খেতে। রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় খাওয়ার তেমন রুচি নেই। খাবার দেখলেই গা গুলিয়ে উঠছে। শরীর টা বেশ খারাপ লাগছে। মুখের সামনে পড়ে থাকা খাবারটা কোন রকমে গিলে পানির গ্লাসটা মুখে ধরেছি ঠিক তখনি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পেছন থেকে বাবাকে দেখে বললেন
” আরে আজমল সাহেব যে। কেমন আছেন?”

বাবা ওনাকে দেখে অবাক হলেন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাড়িয়ে হাত মিলিয়ে বললেন
” ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

লোকটি সৌজন্য হেসে বলল “ভালো।”

আমার কাছে লোকটিকে বেশ পরিচিত মনে হলো কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না। হল ছেড়ে দিয়ে আবারো খাবারে মনোনিবেশ করলাম। এবার লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
” কেমন আছো মামনি?”

আমি অপ্রস্তুত হয়ে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে উত্তর দিলাম
” জি ভালো।”

বাবার সাথে তিনি আরো কথা বলছেন। এক পর্যায়ে আম্মুকে দেখে বলল
” ভাবী দেখছি সবাই মিলেই ঘুরতে এসেছেন। বাহ্ খুব ভালো লাগলো। আমরাও পরিবার সহ এসেছি। আসলে মাঝে মাঝে একসাথে ঘুরতে যাওয়া দরকার। এতে বন্ডিং ভালো হয়।”

বাবা কথাটাতে সম্মতি জানিয়ে বললেন
” এখানে বসেন। একসাথে নাস্তা করি।”

লোকটি আপত্তি জানালেও বাবার কথা ফেলতে পারলেন না। এক কাপ চা খাওয়ার জন্য বসে পড়লেন। এমন সময় পিছন থেকে ওনাকে একজন ডাকলো
” বাবা এখানে কি করছো? তোমাকে সবাই খুঁজছে।”

লোকটি পেছনে তাকিয়ে হেসে উঠে বললেন
” ওহ! এখানে চা খাচ্ছিলাম। এদিকে আসো।”

আমি রুপম কে দেখে চমকে উঠলাম। রুপম এরও একই অবস্থা। সে ধির পায়ে এগিয়ে আসলো তার বাবার কাছে। এবার আমার মনে পড়লো এটা রুপমের বাবা। আমাকে যেদিন দেখতে এসেছিল সেদিন তিনিও এসেছিলেন। আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলাম বলে এতো কিছু খেয়াল করিনি। একবার চোখ তুলে ওনাকে দেখেছিলাম। দ্বিতীয়বার দেখবো বলে আশা করিনি। তাই মনে রাখার প্রয়োজন হয়নি। রুপম এর বাবা বেশ উৎফুল্লতা নিয়ে আমার বাবাকে বলল
” আমার ছেলে। রুপম।”

বাবা রুপমের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর উঠে হাত বাড়াতেই রুপম অত্যন্ত ভদ্র ছেলের মতো সালাম জানালো। বাবা যেনো আরো মুগ্ধ হয়ে গেলো তার ব্যবহারে। বাবার সাথে হাত মেলাতেই বাবা রুপম কে আমাদের সাথে বসে চা খাওয়ার জন্য বললেন। সে ভদ্রতা রক্ষার্থে কোন প্রতিউত্তর না করেই বসে পড়লো ঠিক আমার সামনে। আমি এতক্ষণ সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে দেখছিলাম। বাবা রুপমের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। এবার সে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু বিষয়টা রুপমের বাবার চোখে পড়ে গেলো। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন
” তোমাদের তো মনে হয় কথা হয়েছে তাই না?”

রুপম নিচু স্বরে বলল
” জি বাবা।”

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। বাবা এই বিষয়ে কোনো কথা বলল না। রুপম আর ওর বাবা অনেকক্ষণ বসে ছিলো। রুপম চুপচাপ থাকলেও তার বাবা আমার বাবার সাথে অনেক্ষণ কথা বলল। এর মাঝে আমরা কেউ কারো দিকে তাকাইনি। কথা শেষ করে রুপম আর ওর বাবা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিষয়টা সাভাবিক হলেও আমার কাছে কেনো যেনো এতক্ষণের পরিবেশটা বেশ অস্থির লাগছিলো। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি খেয়াল করলাম বাবার মুখটা কেমন যেনো মলিন হয়ে গেলো। খালামণি নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। প্রশ্ন করে বসলো
” এদেরকে তো চিনলাম না দুলাভাই। কে ছিলো?”

বাবা মাথা নিচু করে খুব ধীরে উত্তর দিলো
” আমার কলিগের আত্মীয়। পরিচয় আছে একটু আধটু।”

আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম। বাবার এভাবে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা আমার দৃষ্টিগোচর হলো। রুপম কে বাবার অনেক পছন্দ হয়েছে। আর বাবা ধারণা করে থাকতে পারে যে আমার কোন আচরণেই রুপম না করে দিয়েছে। তাই হয়তো আমার উপরে কিছুটা মন খারাপ। আমি লুকিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললাম। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার মতো চলে গেলো। এখন রুমে গিয়ে এরপর কি করবে সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। যে যার মতো আলোচনা করতেই ব্যস্ত। আমি কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিলাম। এমন সময় মেসেজ টোন কানে এলো।
” একটু বীচের ধারে আসতে পারবেন? আমি অপেক্ষা করছি। আর্জেন্ট!”

চলবে

( রিচেক করার সময় হয়নি। কিছু ভুল থাকতে পারে। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।)