প্রজাপতি উৎসব পর্ব-০৪

0
264

প্রজাপতি উৎসব

#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব

পর্ব ৪

পরদিন জ্যাকসন পয়েন্টে বসে টিটু ভাইকে আমি বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম।

টিটু ভাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বাকের ভাইয়ের মত দেখতে এরকম বিশিষ্ট একজন ছাত্রনেতা শিশুর মত কাঁদছে দেখে সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকালো। টিটু ভাইয়ের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। টিটু ভাই কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা গলায় বললেন উনি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে গভীরভাবে ভালোবাসেন। কিন্তু উনি বলতে চেয়েও বলতে পারেননি। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বড় বড় বিপ্লবী বিপ্লবের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, তাদের জীবনে আলাদা কোন স্থায়ী নারী ছিল না। এ কারণে বিপ্লব নাকি নারী-প্রেম এই দুই-এর দ্বন্দ্বে টিটু ভাই দ্বিধান্বিত ছিলেন। ইদানীং টিটু ভাইয়ের উপব্ধি হয়েছে এ রকম কোন হার্ড অ্যান্ড ফাস্ট রুল নেই। প্রেম আর বিপ্লব এক সঙ্গেই করা যায়, স্বয়ং লেনিন করেছেন। এখন তিনি বুঝেছেন প্রেম আর যুদ্ধের ময়দানে সামান্য দ্বিধা মানেই পরাজিত হওয়া।

-তুমি কি আর কাউকে ভালোবাসো রূপা?

টিটু ভাইয়ের এই প্রশ্নের আমি কোন জবাব দিলাম না। টিটু ভাই আমার নীরবতাকে কী ভেবে নিলেন কে জানে, আবার হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। কী একটা বিব্রতকর অবস্থা। একজন মেধাবী ছাত্র, নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক আর ভালো মানুষ হিসেবে টিটু ভাইকে আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু টিটু ভাইকে আমি প্রেমিক হিসেবে কখনোই কল্পনা করতে পারি না। আবার টিটু ভাইয়ের জন্য আমার খুব কষ্টও লাগছে । জানি না কীভাবে ওনাকে এই অবস্থায় সাহায্য করতে পারি। একই সঙ্গে সাপ আর ওঝার ভুমিকা কীভাবে নিই? টিটু ভাইয়ের রক্তাভ চোখেরর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-এত মন খারাপ করবেন না টিটু ভাই। আমি একটা অতি সামান্য মেয়ে। আপনি একজন বড় মাপের মানুষ। আপনার যোগ্য আমি নই। আমার চেয়ে অনেক সুন্দর আর ভালো মেয়ে আপনার জীবনে আসবে। দেখবেন মস্কো গেলে রাশিয়ান ললনারা আপনাকে লুফে নেবে। তখন আমার কথা মনে করে আপনি মনে মনে হাসবেন আর ভাববেন কী ছেলেমানুষিই না করেছিলেন।

টিটু ভাই টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
-অনেক সুন্দর মেয়ে, ভালো মেয়ে, রাশিয়ান ললনা আমি চাই না। আমি তোমাকেই চাই রূপা। তোমাকে না পেলে আমি কোনদিন আর কাউকে বিয়ে করবো না।

টিটু ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখে আমার নিজেরই কান্না চলে এলো। ভাগ্যিস মিতি এসে আমাকে উদ্ধার করলো। ফেরার সময় মিতি বললো,
-এত যে নাটক হচ্ছে, রঞ্জন জানে?
-না, রঞ্জনকে এর ভেতর জাড়াইনি।
-ওকে জানিয়ে রাখো। পরে অন্যের মুখে শুনে ভুল বুঝবে। মারামারি বাঁধিয়ে দেবে।

সে দিন রাতে আমরা প্রীতিলতার সেকেন্ড ফ্লোরের লনে উঠেছি। হুহু করে মাতাল হাওয়া বইছে। অনেকদিন পর অতন্দ্রিলা এসেছে। অতন্দ্রিলা একটা অদ্ভুত মেয়ে। বয়কাট করা চুল, সব সময় কালো জামা পরে, ঠোঁটে কালো লিপস্টিক দেয়, নাকে বড় নথ। অতন্দ্রিলা ছ মাস পরপর প্রেমিক পাল্টায়। তারপরও ছেলেরা ওর ভেতর কী পায় কে জানে, ওর দিকে পতঙ্গের মত ধায়। এ কারণে অতন্দ্রিলার সামনে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আসতে অনেক মেয়ে অস্বস্তি বোধ করে। ঢাকায় অতন্দ্রিলাদের নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি আছে। তারপরও কদিন পরপর মেয়েটা প্রীতিলতা হলে এসে থাকে। অতন্দ্রিলা অনেকের চেয়ে ভালো নজরুলগীতি গায়। কিন্তু তার এই প্রতিভার ব্যাপারে সে ভীষণ উদাস। কোন অনুষ্ঠানেই ওকে দিয়ে গান গাওয়ানো যায় না। শুধুমাত্র জ্যোৎস্না রাতে আমাদেরকে গান শোনাবার লোভ দেখিয়ে অতন্দ্রিলা প্রীতিলতার ছাদে ডেকে নেয়। ওর শর্ত হলো আমরা ওর সিগারেটে একটা করে টান দিলে সে গান করবে।

আজ সে রকম দিন। নক্ষত্রভরা আকাশের নীচে সবাই মাদুর পেতে বসেছি, শুধু অতন্দ্রিলা রেলিঙে বসে পা দুলাচ্ছে। অতন্দ্রিলা মার্লবোরো লাইটে একটা সুখ টান দিলো। তারপর নাক আর মুখ দিয়ে ধোঁয়ার ডবল রিং ছেড়ের গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-সময় একটা বিভ্রম। মানুষের বয়স থাকতে পারে কিন্তু বুড়ো হওয়া বলে কিছু নাই।

মিলি বললো,
-হঠাৎ মানুষের বয়স এবং বুড়ো হওয়ার প্রসঙ্গ আসলো কেন, অতন্দ্রিলা?

-মিলিমণি, তোর জন্যই এই প্রসঙ্গ এলো।

-আমার জন্য?

-একটা কথা বল্‌, কুদ্দুস স্যারকে কী তোর চোখে মধ্যবয়সী লাগে?

-কুদ্দুস স্যারকে দেখলে ত্রিশ বত্রিশ মনে হয়। নিশ্চয় নিয়ম করে ব্যায়াম করেন। ওনার আসল বয়স চুয়াল্লিশ। উনি ৯৪ ব্যাচের ফেসবুক গ্রুপে আছেন।

-ওনাকে মধ্যবয়সী লাগে না, মানে উনি আসলে মধ্যবয়স্ক হন নাই। চুয়াল্লিশ নম্বরটা জোর করে বলছে, হে কুদ্দুস তুমি বিগতযৌবন।

-হুম, ভাববার মত কথা। বয়সের সঙ্গে বৃদ্ধ হবার সম্পর্ক নাই। কিন্তু কুদ্দুস স্যারের বয়স নিয়ে লাগলি কেন?

-লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কুদ্দুস স্যার যেভাবে শুধু তোর পেছনে ছোকছোক করে, তুই একটু পাত্তা দিতে পারিস। ভালো না লাগলে ছেড়ে দিবি। ব্যাপারটা কেমন এক যায়গায় অস্থিরভাবে আটকে আছে। ভাঙ্গা রেকর্ডের মত বাজছে। এই টাইপের লোকের সাথে আমার এক্সপেরিয়েন্স আছে, ইউ উইল হ্যাভ গুড টাইম উইথ হিম।
-অতন্দ্রিলা, সবার কাছে ভালোবাসা এত খেলো না। কারো কারো কাছে ভালোবাসা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। খামোখা ওনাকে গাছে তুলে মই কেড়ে নিতে যাবো কেন?

-ভালোবাসা অবশ্যই সিরিয়াস ব্যাপার। কিন্তু কাকে ভালোবাসবি সেটা অত গুরুত্ব দিতে হয় না রে সোনামণি।

-কী বলিস উল্টাপাল্টা?

-ভালোবাসা যদি দার্জিলিং টি হয়, প্রেমিক হলো জাস্ট একটা কাপ। তুই কী একই কাপে প্রতিদিন দার্জিলিং টি খাস? বেশী ময়লা হয়ে গেলে কিংবা কোণা ভেঙ্গে গেলে কাপ পাল্টাস না? ?

-দূর, তুই কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে আমাকে কনফিউজ করে ফেলছিস।

-এত সুন্দর উপমা দেয়ার পরেও বুঝলি না।

-যুক্তি যেখানে দুর্বল সেখানেই মানুষ উপমা ব্যবহার করে। তোর এই চা আর কাপের উপমাও তাই। তাছাড়া তোর উপমা ভুল।

-কীভাবে?

-আমরা চা বানাতে প্রতিবার নতুন পাতা ব্যবহার করি, কাপ প্রায় সময় একই থাকে। সে রকম ভালবাসাকে নতুন নতুন রূপে নিবেদন করতে হয়, প্রেমিক একই থাকে। কেবল ভালোবাসার শক্তি না থাকলেই কেউ তোর মত বারবার প্রেমিক পাল্টাতে পারে।

-উহু, হলো না। ভালবাসাটা হলো আনন্দ। বিশুদ্ধ এবং নিরাকার। নিরাকার ভালোবাসাকে আঁকার দেবার জন্য আমরা জাস্ট একটা পাত্র খুঁজি। হাতের কাছে যে কটা পাত্র দেখি তার থেকে সুবিধামত একটাতে আমরা ভালোবাসা ঢেলে দিই। আমাদের বাবামারাও হন্যে হয়ে আমাদের জন্য পাত্র খোঁজে, ওই লিমিটেড সার্কেলের ভেতর। পরে যখন আমাদের অভিজ্ঞতা আর পরিসর বাড়ে, আরও অনেক রংঢং-এর পাত্র দেখি, তখন হতাশ ভাবি হায় হায় কী একটা ফালতু পাত্রকে ভেবেছিলাম আমার সোলমেট। হি হি হি।

-তোর মাথা আর মুন্ডু। তুই একটা ক্রেইজি পেসিমিস্ট।

-তাহলে কুদ্দুস স্যারের সঙ্গে তুই প্রেম করবি না?

-আমার খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই।

-ফাইন, তোর যখন কোন আগ্রহ নাই আমি তাহলে কুদ্দুস স্যারকে নিয়ে নিচ্ছি।

-কুদ্দুস স্যারকে নিয়ে নিচ্ছিস মানে? চাইলেই হবে নাকি? কুদ্দুস স্যার কি এতই ফেলনা? কেউ বললেই কুদ্দুস স্যার তার সঙ্গে ঘুরবে? আর লাল্টু ভাইয়ার তখন কী হবে?

লাল্টু হলো অতন্দ্রিলার লেটেস্ট প্রেমিক। অতি ভদ্র, বিনীত, রুচিবান, গোবেচারা ছেলে। অতন্দ্রিলার সঙ্গে কাঁঠালের আঠার মত লেগে থাকে। অতন্দ্রিলা ইদানীং দাবী করছে লাল্টু একটা হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে লাল্টু একটা লাড্ডু, একশ’তে গোল্লা। প্রেমিকদের ছেড়ে যাবার সময় অতন্দ্রিলা কোন না কোন বাহানা বের করবেই। উদাস কন্ঠে অতন্দ্রিলা বললো,

-উইথ অল ডিউ রেস্পেক্ট, তোমাদের লাল্টু ভাইয়া অতিরিক্ত ডোমেস্টিক। একটা পোষমানা পাঙ্গাস। অমন বোরিং-এর সঙ্গে ফড়িঙ থাকতে পারে? পারে না। ফড়িং তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে উড়ে যায়। লাল্টু’জ ডেজ আর নাম্বার্ড। আপাতত ওকে সাগুফতার হাতে তুলে দেবো। আরও কিছু প্রেম করার পরে বিয়ের সময় হলে লাল্টুকে নিয়ে আবার ভাববো। আই নো লাল্টু উইল ওয়েট ফর মি। আর মিলি তুই হঠাৎ করে এখন কুদ্দুস স্যারের ব্যাপারে রিজার্ভড হয়ে গেলি কেন?

-কারণ তুই স্যারকে কয়েকদিন ঘুরিয়ে ছেড়ে দিবি সেটা আমি চাই না। স্যারের অত মনের জোর নাই। স্যার ভেঙ্গে পড়বেন।

-হুম, কুদ্দুস স্যারের মনের জোর নিয়ে তুই বেশ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। স্যারকে তুই কেয়ার করিস বুঝি?

মিলি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
-আমি বলি নাই আমি কেয়ার করি। আমি চাই না তোর পাল্লায় পড়ে আরেকটা ছেলের জীবন নষ্ট হোক।

-বুইড়া কুদ্দুস এখন ছেলে হয়ে গেলো?

-উনি এখনো বিয়ে করেননি, এলিজেবল ব্যাচেলর। সেই অর্থে তো ছেলেই।

অতন্দ্রিলা এবার সবার সামনে মাথা নুইয়ে বললো,
-মাননীয় আদালত, মিলির সওয়াল জবাবের পর আমার আর কিছু বলার নাই। আমি যা বুঝার বুঝে নিয়েছি। শুধু অভাগিনীর একটা বিনীত প্রশ্ন।

-কী প্রশ্ন?

-তোরা কেউ গাঁজা টেস্ট করতে চাস? আমার ব্যাগে আছে।

(চলবে)