প্রজাপতি উৎসব পর্ব-০৫

0
243

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৫

এক সপ্তাহে ক্যাম্পাসে দু দুটো মেয়ে রেপ্‌ড্‌ হয়েছে।

এদের একজনকে আমি চেহারায় চিনি। ওর নাম উপমা। উপমা প্রীতিলতা হলেই থাকে। সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখে কোভিড মাস্ক পরা আক্রমণকারীদের চেহারা মেয়ে দুটো চিনতে পারেনি। পিশাচগুলো যাবার আগে নোংরা ভাষায় হুমকি দিয়েছে মুখ খুললে আরও ক্ষতি করবে। মেয়ে দুটোও চায় না বেশী জানাজানি হোক, লোকলজ্জা আর অপবাদের ভয় আছে, পারিবারিক সম্মানের ব্যাপার আছে। উপমা আর অন্য মেয়েটি ভীষণ উৎকন্ঠায় ঘরের ভেতর গুটিয়ে আছে। তারপরও একজন দুজন বান্ধবীকে ওরা না বলে পারেনি। একজন দুজন থেকে মেয়েদের হোস্টেলে কথাটা ছাইচাপা আগুনের মত ছড়িয়ে গেছে।

কিন্তু মেয়ে দুটোর অনুরোধে ধর্ষণের ব্যাপারটা কেউ প্রকাশ্যে আনতে পারছে না। মেয়েদের হলে ঢুকলেই থমথমে উত্তেজনা আর আতঙ্ক টের পাওয়া যায়। ছেলে বন্ধু ছাড়া সন্ধ্যার পর মেয়েরা হল থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। অনেকে ছেলে বন্ধুদেরকেও সন্দেহ করছে। আমাকে দিলশাদ বললো, ও লাবণি নামের একজন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরকে গোপনে রেপের ঘটনা জানিয়ে রেখেছে। ইন্সপেক্টর লাবণি বলেছে ওরা কদিনের ভেতর কোভার্ট অপারেশন চালাবে। দেখা যাক এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়।

আমি বুঝতে পারছি না এই ঘটনা রঞ্জনকে বিতং করে বলবো নাকি বলবো না।

এই মুহূর্তে রঞ্জনের দুইশ পঞ্চাশ সিসির মোটর সাইকেল ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে দিয়ে সা করে ছুটছে। কালো টিশার্ট, কালো জিন্স আর কালো হেলমেটে রঞ্জনকে কোন থ্রিলার মুভির নায়কের মত লাগছে। আমি পেছেনে বসে মোটর সাইকেলের সিট শক্ত করে ধরে আছি। প্রবল বাতাসে আমার চুল কালো ওড়নার মত উড়ছে। একপাশে দু পা ঝুলিয়ে পটের বিবির মত বাইকে বসতে আমার ভালো লাগে না। এ কারণে আজ নীল জিন্স আর সুতোর কাজ করা সাদা রঙের শর্ট কামিজ পড়েছি।

পথে স্পিড ব্রেকার পড়লে কিংবা ট্রাফিক জ্যাম বাঁধলে রঞ্জন মোটর সাইকেলের গতি হঠাৎ কমিয়ে দিচ্ছে। আমি গতি জড়তায় সামনে ঝুঁকে রঞ্জনের পিঠের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। রঞ্জনের শরীরে লেপটে যাওয়ার আগেই ওর পিঠে হাত দিয়ে কোন রকমে নিজেকে সামলে নিচ্ছি।

বসুন্ধরা কমপ্লেক্সে এসে দেখি ওখানে ভীষণ ভীড় আর উত্তেজনা। স্টার সিনেপ্লেক্সে আজ নতুন একটা সিনেমা চলছে, রজনী হলো উতলা। শুভ মহরৎ উপলক্ষ্যে আজ নাকি স্বয়ং নায়িকা হলে আসবেন। ছবিটা পত্রপত্রিকায় খুব ভালো রিভিউ পেয়েছে। হলের ভেতর গিয়ে দেখলাম সবচেয়ে পেছনের সারির দুটো সিট আমাদের জন্য বরাদ্দ। আমি রঞ্জনের ডান পাশে বসলাম। রঞ্জনকে পাশে পেয়ে অনেকদিন পর নিজেকে কেমন পূর্ণ পূর্ণ লাগছে। সিনেমা আরম্ভ হবার মিনিট দশেক পর রঞ্জনের আঙ্গুল আমার আঙ্গুল ছুঁলো। আমি বাঁধা দিলাম না। একটা মধুর আবেশ আর নির্ভরতায় আমার মন ভরে গেলো। রজনী হলো উতলা সিনেমা ধীরে ধীরে ক্লাইমেক্সের দিকে এগোচ্ছে। এই মাত্র নায়ক নায়িকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। ঠিক তখুনি রঞ্জন কাঁধে হাত দিয়ে আমার মাথা ওর দিকে টেনে নিলো। এখন রঞ্জর ওর ঠোঁট দিয়ে আমার ঠোঁট ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। আমি মুখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
-এটা কী হচ্ছে রঞ্জন?

আমি বাঁধা দেয়ায় রঞ্জন অবাক হলো। ফিসফিস করে আহত কন্ঠে বললো,
-কী হচ্ছে মানে? একটা চুমু খেতে পারবো না?

আমি হাত বাড়িয়ে বললাম,
-ঠোঁটে না, হাতে চুমু খাও।

রঞ্জন সামান্য তপ্ত হয়ে বললো,
-তাহলে আমার সঙ্গে সিনেমায় আসলে কেন?

ছেলেরা এরকম ফেউপনা করে শুনেছি। কিন্তু রঞ্জনও এদের দলে হবে সেটা আশা করিনি। আমি যতটা অবাক হলাম, তারচেয়ে বেশী কষ্ট পেলাম। ফিসফিস করে উত্তর দিলাম,
-তোমার সঙ্গে সিনেমায় এসেছি একসাথে কুয়ালিটি টাইম কাটাবার জন্য আর ভালো একটা সিনেমা দেখতে।

-তুমি জাস্ট সময় কাটাতে এসেছো, ইউ ডোন্ট লাভ মি।

রঞ্জনের কথায় অবাক হয়ে বললাম,
-এ কথা কেন বলছো? কীসের সাথে কী?

-তাহলে ঠোঁটে চুমু দিতে দিলে না কেন?

-্মেয়েদের ভালোবাস কি ঠোঁট সমর্পণ করে প্রমাণ করতে হয়? সিনেমা হলের অন্ধকারে চোরের মত চুমু দেয়ার জন্য কি তুমি আমাকে ভালোবেসেছ? এই জন্য কষ্টে করে হাতে লিখে চিঠি পাঠিয়েছে?

রঞ্জন এ কথার কোন উত্তর দিতে পারলো না। বাকিটা সময় কেমন গুম হয়ে বসে সিনেমা দেখলো। ও বোধহয় আগে বুঝতে পারেনি আমি রূপা একটু পুরনো ধাঁচের। খুব বেশী শরীরঘেঁষা কিছু আমি বিয়ের আগে ভাবতেই পারি না। আমার কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। রঞ্জনের জন্য হয়তো মিতি কিংবা অতন্দ্রিলার মত মেয়ে দরকার ছিল। মিতি ভালোবাসা ধরে রাখবার জন্য বাধ্য হয় অনেক কিছু মেনে নেয়, আর অতন্দ্রিলা তো ভালোবাসা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালায়।

কাল রাতে অতন্দ্রিলা যেমন ভবিষ্যতবাণী করেছিল রঞ্জন ঠিক সে রকম ব্যবহার করেছে। আমাদের অভিসারের কথা শুনে অতন্দ্রিলা বলেছিল,
-তুই ভাবছিস রঞ্জন তোকে সিনেমা দেখাতে নেবে?

-হ্যাঁ।

-মোটর সাইকেলে চড়িয়ে?

-হুম, ভালো একটা মুভি এসেছে। ক্রিটিক্যালি আক্লেইমড ফিল্ম।

অতন্দ্রিলা জোরে হেসে দিলো,

-হিহিহি, রঞ্জনের কাজ নাই তোকে নিয়ে ক্রিটিক্যালি আক্লেইমড ফিল্ম দেখবে।

-দেখবে তো। কাল আমরা সিনেপ্লেক্সে যাচ্ছি।

-শোন্‌ আমার কচি ঘাসের চিকন ডগা, রঞ্জন যদি সিনেমা হলে সবচেয়ে পেছনের রো’তে সিট নেয় তাহলে খুব সাবধান থাকবি।

-কেন? সাবধান থাকার কী আছে?

-ঘন আঁধারে ও তোকে নিয়ে লুটোপুটি খেলবে।

-লুটোপুটি খেলবে মানে?

-প্রথমে চেয়ারের হ্যান্ডেলে তোর হাতের উপর রঞ্জন তুলোর মত হাল্কা করে হাত রাখবে। মিষ্টি করে আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁবে। এটা রোমান্টিক পর্ব। তোর চম্পাকলি আঙ্গুল ওর সাঁড়াশির মত আঙ্গুলে পাল-ছেঁড়া নৌকার মত ভেঙ্গে ভেসে ডুবে যাবে।

-হ্যাঁ, আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁয়াটা আসলেই খুব রোমান্টিক। ওতে আমি কোন দোষ দেখি না।

-কিন্তু এর পরই আসবে গান্ডুশ পর্ব।

-সেটা কী?

-সিনেমা হলের অন্ধকারে রঞ্জন তোর মুখ ওর মানুষখেকো মুখের দিকে টেনে নেবে।

-কেন? চুমু দেবে?

-হুম। আঙ্গুলডুবির পর এবার তোর ওষ্ঠডুবি হবে। ভালোবাসায় ওটুকু মেনে নিতেই হয়। আমি তো চুমু আর কফি খুব পছন্দ করি। চুমু খেলে আমার প্রাণশক্তি বেড়ে যাও। তবে সমস্যা হবে এর পরের ধাপে।

-পরের ধাপ কী?

-আঙ্গুলডুবি, ওষ্ঠডুবির পর ভরাডুবি।

-উফ, এত প্যাঁচাস কেন?

-তুই যদি চুমু দিতে অ্যালাউ করিস তাহলে একট পর রঞ্জন আইসিং অন দা কেক চাইবে।

-আইসিং অন দা কেক মানে?

-হিহিহি, বলবো না। বিপদে পড়ে নিজেই শিখে নাও কচি ঘাদের চিকন ডগা ।

-অতন্দ্রিলা, প্লিজ, অর্ধেক কথা বলে বাকি অর্ধেক মুখের ভেতর রাখবি না।

-তুই তো কনজার্ভেটিভ টাইপের। তাই বলছি, আত্মরক্ষা করতে চাইলে তোর বক্ষবন্ধনীর উপর জাস্ট কামিজ পড়ে রঞ্জনের সঙ্গে চলে যাবি না। ডবল টেপ জামা পরবি, তার উপরে কামিজ। তাহলে আর রঞ্জনের হাত দিল্লীকা লাড্ডু অবধি পৌঁছুতে পারবে না, হি হি হি।

অতন্দ্রিলার বিশেষজ্ঞ মতামত ঠিকই ছিল। বেশী দূর এগোতে না পেরে রঞ্জন আহত বাঘের মত গুম মেরে আছে। সিনেমা শেষ হতে না হতেই ও হন হন করে হাঁটা দিলো। আমি ওর পেছন পেছন ধীর পায়ে এগোলাম। রঞ্জন বাইরে এসে আমাকে শুষ্কভাবে বিদায় দিয়ে ভটভট করে মোটর সাইকেল টেনে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো।

আগেই ঠিক করা ছিল আজ আমি কাঁঠালবাগানে খালামণির বাসায় থেকে যাবো। তা না হলে জাহাঙ্গিরনগর পর্যন্ত রঞ্জনের সঙ্গে মোটর সাইকেলে ফেরা ভীষণ অস্বস্তিকর হতো । পুরো পথ কোন অপরাধ না করেই অপরাধবোধে ভুগতাম। রঞ্জন এখন রেগে কত জোরে বাইক চালাচ্ছে কে জানে।

খালামণি মার একমাত্র বোন। আমার এস এস সি পরীক্ষা চলার সময় মা অসুস্থ হয়ে যায়। সবাইকে বিশেষ করে আব্বুকে খুব সন্দেহ করে। উল্টোপাল্টা শব্দ শুনে হঠাৎ ভয় পেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। কাউকে বিশ্বাস করে না। মা নিজেই নিজের মত করে একা হয়ে গিয়েছে। মা অসুস্থ হবার পর থেকে ছোট ভাই আনন্দকে আমিই বড় করেছি। আনন্দ এ বছরে আই আইটিতে চান্স পেয়ে খড়গপুর চলে গেছে। আমি আসবো শুনে খালামণি সাত আট রকমের পদ রেঁধেছে। আমি ঘরে ঢুকতেই জড়িয়ে ধরে বললো,
-ইস এতদিন পর আমার বড় মেয়ে এসেছে। হলে পানির মত পাতলা ডাল খেয়ে খেয়ে তোমার মুখ শুকনো আমসি হয়ে গেছে রূপা।

-সবাই কোথায়?

-তোমার খালু ট্যুরে গেছে, আর ইলোরা আজ বান্ধবীর বাসায় থাকবে, অনেক আগে থেকে ঠিক করা।

রাতের খাবার শেষে ড্রইংরুমে টিভি দেখছিলাম, এমন সময় রঞ্জনের ফোন এলো। পাশের ঘরে গিয়ে ফোন ধরতেই রঞ্জন বললো,
-কী করছো রূপা?

-খালার সঙ্গে টিভি দেখছি।

-আমি স্যরি, রূপা।

-স্যরি কেন?

-বিকেলে একটু রুড হয়ে গিয়েছিলাম।

-ইটস ওকে, তুমি কষ্ট পেয়েছ দেখে রাগ করেছো।

-সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে খামোখা এত রাগ দেখালাম।

আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। অভিমানে মন ভারী হয়ে আসছে। কোন রকমে ধরা গলায় বললাম,
-খামোখা কোথায়? তুমি যে রকম মেয়ে চেয়েছো আমি হয়তো সে রকম না। এ কারণেই তোমার রাগ হয়েছে। কিন্তু অত চিন্তা করো না, ওই টাইপের কথায় কথায় চুমু খাওয়া মেয়ে তুমি ক্যাম্পাসে খুঁজলে পেয়ে যাবে।

-এখন তো তুমিই উল্টো রাগ দেখাচ্ছো রূপা। আমি তো বলছি আই মেড এ মিস্টেক। তুমি যে ওসব ব্যাপারে এত স্ট্রিক্ট আমি বুঝিনি।

-একটা গানের দু কলি বলি?

-হ্যাঁ প্লিজ বলো।

-তোমাদের কত আছে, কত মন প্রাণ,
আমার হৃদয় নিয়ে ফেলো না বিপাকে

-মানে কী?

-আমি খুব সাধারণ টিপিকাল মেয়ে। আমি সব কিছু সিরিয়াসলি নিই। আমাকে নিয়ে না খেলে তুমি অন্য কাউকে দ্যাখো।

-আমি খেলছি কে বললো?

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলাম। মোবাইল সেট অফ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। খালামণি হঠাৎ ঘরে ঢুকে বললো,
– রূপা, কী হলো? কাঁদছো কেন মা?

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-জানি না খালামণি, হঠাৎ খুব কান্না আসছে। ভাল্লাগছে না কিছু।

খালা কী বুঝলো কে জানে, আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-এত চিন্তা করো না রূপা, সব ঠিক হয়ে যাবে।

(চলবে)
#এশরারলতিফ