প্রজাপতি উৎসব পর্ব-০৯

0
206

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৯
আজ মিলির বিয়ে।
কুদ্দুস স্যার লেকচারের সময় মিলির গায়ে পারলে প্রায় ঢলে পড়তেন। আমরা সেটা নিয়ে কত হাসাহাসি করেছি। মিলিকে ক্ষেপিয়েছি, কুদ্দুস স্যারের সঙ্গে ঠাট্টা করেছি।
কিন্তু কুদ্দুস স্যার যে সত্যি সত্যি মিলির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন তা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি।
অতন্দ্রিলা ঠিকই বলেছে, কুদ্দুস স্যারের প্রতি মিলিরও একটা গোপন দুর্বলতা আছে। তা না হলে মিলি কেন কুদ্দুস স্যারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে আনন্দে কেঁদে ফেললো? মিলির বাবা মা প্রথমে কুদ্দুস স্যারের সঙ্গে মিলির বিয়ে দিতে রাজি হননি। একে তো একমাত্র মেয়ে, তার উপর ওদের দুজনের বয়সের ব্যবধানটা একটু বেশী হয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিলি আমরণ অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করলো। শেষ পর্যন্ত মিলির বাবা মা নতি স্বীকার করেছেন, বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন।
বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে। আমরা একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে এসেছি। রঞ্জনের পরদিন কী নাকি পরীক্ষা আছে বলে আসতে পারেনি। মিলির বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো রাওয়া ক্লাব রংবেরং-এর আলোর মালায় সজ্জিত। ভেতরে গিয়ে দেখি পুরো হল ঘর অতিথিতে গমগম করছে। কভিড রুল কি এত লোক অ্যালাউ করে? কে জানে।
আমার অনেক বান্ধবীকে দেখেছি নিজেদের বিয়ের সময় ফ্যাশন করে ইণ্ডিয়ান সিল্ক কিংবা ভেলভেটের লেহেঙ্গা চোলি পরে। দিলশাদ ঠাট্টা করে বলে লেহেঙ্গা হলো নক্সা করা পেটিকোট আর ব্লাউজ, ভুল করে শাড়ি মিসিং। মিলি লেহেঙ্গা পরেনি, ট্রাডিশনাল বউদের মত জড়ির কাজ করা লাল বেনারসি কাতান শাড়ি পরেছে। মিলির খালাতো বোন রিয়া ওর হাতে কী সুন্দর করে মেহেদি এঁকে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি আর নিজের বাড়ি মিলিয়ে ওর শরীরে কয়েক ভরি সোনার গহনা ঝলমল ঝলমল করছে। আহা, আমাদের লাজুক মিলিকে আজ বসরার গোলাপের মত মিষ্টি আর জুঁই ফুলের মত স্নিগ্ধ লাগছে। দিলশাদ মিলির কানের কাছে গিয়ে বললো,
-সুন্দ্রী, আজ রাতে কুদ্দুস স্যার তোকে নানাভাবে পাঠ করবেন। দর্শনের ভাষায় কী যেন বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে, তোকে নিয়ে ডিকন্সট্রাকশন খেলবেন, হি হি হি।
দিলশাদের কথায় মিলির হলুদে ধোয়া মুখ লজ্জাভ লাল হয়ে গেলো কিন্তু মিলি কোন জবাব দিলো না। দিলশাদ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-অ্যাই তোরা সবাই কুদ্দুস দুলাভাইকে দ্যাখ, কেমন দাঁত বের করে হাসছে। খুশীর কোন সীমা নাই। ইস, কেমন অসভ্য লোক, পারলে এখুনি মিলিকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে।
আমি তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই তা। কুদ্দুর স্যার ঘিয়ে রঙের প্রিন্স কোটে সুন্দর করে হাসছেন, ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়িতে আজ আর ওনাকে বয়স্ক লাগছে না।
অতন্দ্রিলা বিয়ের অনুষ্ঠানে সিগারেটের বদলে ভেইপ নিয়ে এসেছে। হাতে লুকিয়ে ভেইপ একটু টান মেরে অতন্দ্রিলা বললো,
-আমি লাল্টুকে ছেড়ে দেয়ার পর থেকে মিলি ইনসিকুইরিটিতে ভুগছে। তাই না মিলি? তুই ভেবেছিস আমি এবার কুদ্দুস স্যারকে ভাগিয়ে নেবো।
মিলি বললো,
-হুম, তুই যে রকম দুষ্টু, ভয় তো পাবোই।
-এ জন্যই তুই এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি হয়েছিস। দা ক্রেডিট গোজ টু মি।
অতন্দ্রিলা কাট আপ করবার পর লাল্টু ভাই আমাকে বলেছিলেন তন্দ্রা ফিরে না এলে উনি ব্রীজ থকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন। আমি ওনার কথা পাত্তা দিইনি। এরকম অনেকেই বলে। কিন্তু দুদিন পর শুনলাম লাল্টু ভাই সত্যি সত্যি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন। তবে যমুনা ব্রীজ না, কাঁচপুর ব্রীজ থেকে। লাল্টু ভাই নদীতে পড়ে একটা মাছ ধরার জালে আটকে নাকানিচুবানি খাচ্ছিলেন। মাঝিরা ওনাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে দিয়ে আসে। লাল্টু ভাই এখন বেশ ভালো আছেন। ওনার স্পর্শকাতর মন, চড়ুই পাখীর বুকের মত নরম। বেশীদিন একলা থাকলে লাল্টু ভাই নাকি ডিপ্রেসড হয়ে যান। কে বললো বদরুন্নেসা কলেজের কঙ্কা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে লাল্টু ভাই এখন ঝুলে পড়েছেন।
বিয়ের আসর এই মাত্র গরম হতে আরম্ভ করেছে। হলের মাঝের ফাঁকা যায়গায় এক দিকে ছেলেরা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী পরে , অন্যদিকে মেয়েরা লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পরে সারি বেঁধে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এরা কারা কে জানে, বরপক্ষ আর কণে পক্ষের আত্মীয়দের মিশ্রন হবে। হঠাৎ করেই স্পিকারে একটা বিয়ের গান আরম্ভ হলো, আইলারে নয়া দামান। ছেলে মেয়েরা বেধড়ক নাচা আরম্ভ করলো। আমরা হাততালি দিলাম।
কুদ্দুস স্যার ইউভার্সিটির ভেতরে মাত্রই দুই রুমের কোয়ার্টার পেয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে বরের গাড়ি ঔ ক্যাম্পাসেই ফিরে গেলো। যাবার আগে মিলি ওর বাবামাকে সালাম করলো। তারপর মিলি ওর বাবাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করলো, মিলির বাবাও অনেক কাঁদলেন। মেয়ের একটা নতুন জীবন, অনিশ্চয়তা তো থাকেই।
যাক শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্লাসের টেনশন বন্ধ হলো। সারারাত মিলির সাথে কাটিয়ে কুদ্দুস স্যার নিশ্চয় ভোরবেলা লেকচার রুমে এসে আবার মিলির উপর ঢলে পড়বেন না।
রাতে হলে ফিরে কম্পিউটার অন করলাম। টিটু ভাইয়ের ইমেইল এসেছে। টিটু ভাই লিখেছেন,
প্রিয় রূপা,
কেমন আছো? সম্প্রতি দু একজন বন্ধু বললো রঞ্জন নামের কোন এক যুবকের সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তুমি কখনো এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলোনি। হয়তো ভেবেছে শুনলে আমি আরো আহত হবো। সেই কষ্টটা তুমি আমাকে দিতে চাওনি। তাই ওই ছেলেটি সম্পর্কে জানতে চেয়ে তোমাকেও বিব্রত করবো না।
ভালোবাসা মানে প্রিয়জনের ভালো চাওয়া। যত দূরেই থাকি আমি সব সময় তোমার ভালো চাই। তুমি অন্য কাউকে নিয়ে সুখী জানলে আমার নিজের জন্য কষ্ট পাই বটে কিন্তু তোমার জন্য আনন্দ হয়। অনুভুতিটা অনেকেটা সেই গানের কলির মত, যদি আর কারে ভালবাসো, যদি আর ফিরে নাহি আসো, তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুঃখ পাই গো।
এখন আমার নিজের কথা কথা বলি। একটা পেপার পাব্লিশ করা নিয়ে কাজ করছি, তাই আপাতত চাপের ভেতর আছি। লুদমিলা প্রায়ই লাইব্রেরীতে আমার পাশে এসে বসে, কিন্তু পড়ালেখা ছাড়া অন্য কোন আলাপ ওর সাথে হয় না।
মস্কোতে হঠাৎ তুষার পড়ছে। এখানে তুষার নিয়ে একটা শব্দ অনেকের মুখে শুনেছি। শব্দটা হলো,
স্নোড্রপ।
তুষার-ফোঁটা।
কী সুন্দর শব্দ, তাই না? কিন্তু মস্কোতে এর অর্থ ভিন্ন।
শীতকালে যখন জোরেশোরে তুষার পড়ে, মাফিয়ারা মানুষ মেরে পথে প্রান্তরে ফেলে দেয়। ওরা জানে পনেরো ইঞ্চি পুরু বরফের নীচে লাশ চাপা পড়ে যাবে। চোখের আড়ালে থাকবে বহুদিন। স্বামী, স্ত্রী, প্রেমিক, প্রেমিকা, বাবা, মা উৎকণ্ঠায় অতন্দ্র হবে কিন্তু প্রিয়জনকে কোথাও খুঁজে পাবে না।
দু তিন মাস পর যখন বরফ গলা আরম্ভ করে তখন হতভাগ্য মানুষগুলোকে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। অনেকগুলো পরিবারের মন ভেঙ্গে যায়।
আজ মনে হয় তোমাকে হারিয়ে আমার মনও বরফে ঢেকে গেছে। বাসনা কামনাকে হত্যা করে মনের হিমে কতদিন চাপা রাখা যায় বলো তো? যখন বসন্ত আসে, হুহু করে হাওয়া বয়, মনের বরফ গলে, মৃত বাসনাগুলো আবার মনের তল থেকে ভেসে ওঠে।
থেকে থেকে তোমার কথাই মনে পড়ে রূপা, ভেতরটা ফাঁপা লাগে।
ইতি
টিটু
টিটু ভাইয়ের চিঠি পেলে একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটে। মনটা আনন্দে নেচে ওঠে না ঠিকই কিন্তু কী এক গোপন গহন ব্যথায় টনটন করে। নিজেকে বোঝালাম, রূপা, এখন তো আর মন ভারী হলে চলবে না, তুমি রঞ্জনে সমর্পিত। তোমার সকল ভালোবাসা এখন রঞ্জনের প্রতি।
আজ রঞ্জন বিয়েতে এলো না। পরীক্ষার পড়ার চাপে বেচারা চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। একবার খোঁজও নিতে পারিনি। আমি রঞ্জনের মোবাইলে কল করলাম।
অনেকবার রিং বাজলো কিন্তু রঞ্জন ফোন ধরলো না। রঞ্জন ফোন ধরছে না কেন? ও ঠিক আছে তো?
(চলবে)