প্রজাপতি উৎসব পর্ব-০৮

0
202

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৮
ক্যাম্পাসে আরেকটা রেপ হয়েছে।
সোসিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফজিলাতুন্নেসা হল দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এই পথটা সুরাইয়া একা হাঁটছিল না, ওর সঙ্গে আসাদও ছিল। সুরাইয়াকে ফজিলাতুন্নেসা হল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসাদ টিচার্স কোয়ার্টারে যাবে।
সমাজবিজ্ঞান বনভুমির মাঝ বরাবর সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সুরাইয়ার বিরক্ত লাগলো। পথের দুদিকের একটা বাতিও জ্বলছে না। তার উপর এইমাত্র সুরুত করে একটা সাপ না বেজি ওদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হলো। সুরাইয়া আসাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কর্তৃপক্ষের কী কোন কান্ডজ্ঞান নেই? স্ট্রিট লাইট নষ্ট হয়ে আছে দুদিন ধরে, ঠিক করবে না? এমনিতেই সময়টা খারাপ।
আসাদ সাহস দিয়ে বললো,
-আরে ধুর, আমি আছি না? উল্টাপাল্টা গুজব শুনে খামোখা ভয় পাচ্ছিস। ভিতুর ডিম একটা।
আসাদ আর কী বলতে গেলো, কিন্তু তার আগেই কোভিড মাস্ক পরা চারটা কালো অবয়ব হাওয়া থেকে এসে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। কিছু বোঝার আগেই দুজন অশরীরী আসাদকে জাপ্টে ধরে চড় থাপ্পর মারতে মারতে বললো, অয়, রাতবিরেতে মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াস কেন? অন্য দুজন সুরাইয়ার মুখে হাত চেপে ওকে টানতে টানতে ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলো। আসাদ বেধড়ক মার খাচ্ছিল আর সুরাইয়ার গোঙানি শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু ওই অবস্থায় ও কী করতে পারে?
একটু পর দুজনকেই হাতপা মুখ বেঁধে ওরা ঝোপের পেছনে ফেলে গেলো।
আজ বিকেলে ইন্সপেক্টর লাবণি বারবার জিগেস করার পরেও সুরাইয়ার কাছে থেকে কোন নতুন তথ্য বের করতে পারছে না। ঠিক কী হয়েছে সেটা সুরাইয়া স্পষ্ট করে বলার আগেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। ইন্সপেক্টর লাবণি বললো,
-সুরাইয়া, এখন পর্যন্ত তুমি থানায় জিডি করোনি। যতদূর বুঝলাম তোমার জিডি করার ইচ্ছেও নেই। বুঝতেই পারছো আমার ইনভেস্টিগেশন অফিসিয়াল না। তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারো। আমি কথা দিচ্ছি তোমার আইডেন্টিটি কেউ জানবে না। কোথাও কোন রেকর্ড থাকবে না।
সুরাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-আমার খুব ভয় লাগছে। কিছু বললে আসাদকে ওরা হাসপাতালে গিয়ে মেরে ফেলবে।
লাবণি সুরাইয়ার পিঠে হাত দিয়ে বললো,
-কাঁদলে কিংবা ভয় পেলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। জন্তুগুলোর একটাকেও সামান্য চিনে থাকলে আমাকে বলো। ওদেরকে ধরতে না পারলে আরও অনেক মেয়ের সাথে ওরা একই কাজ করবে।
লাবণি জানে অন্ধকার আর আতঙ্কের ভেতর কোভিড মাস্ক পরা কাউকে চেনা কঠিন ব্যাপার। তবু সে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লো। সুরাইয়া বললো,
-একটা লোক আমার উপর…
এটুকু বলে সুরাইয়া চুপ করে আছে, লাবণি বললো,
-প্লিজ বাকিটা বলো।
-লোকটার ঝাকড়া চুল, চওড়া কাঁধ।
– জানি এ রকম ট্রমার ভেতর সবকিছু মনে করা কঠিন, তবু চিন্তা করো আর কিছু মনে পড়ে কিনা।
সুরাইয়া আর কিছু বলতে পারলো না। আমি আর দিলশাদ পাশে বসে আছি। দিলশাদ ইন্সপেক্টর লাবণিকে অনেক বলে কয়ে এনেছে। আমার সঙ্গে ইন্সপেক্টর লাবণির সামান্য আলাপ হয়েছে। তাতেই বুঝেছি ইনি প্রচন্ড সাহসী মহিলা। সুরাইয়ার বর্ননার সাথে আমি কাছের একজন মানুষের অবয়বের আবছা মিলে পাচ্ছি, আমার ভয় করছে।
ইন্সপেক্টর লাবণি চলে যাবার পর আমরা প্রীতিলতা হলের সেকেন্ড ফ্লোরের টেরাসে এসেছি। অতন্দ্রিলা নাক দিয়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে গাইছে,
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অতন্দ্রিলার গান শুনছি। এই কণ্ঠ যে ছেলেই শুনবে সে আর মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। কেন যে অতন্দ্রিলা কোথাও গায় না, নিজের কন্ঠকে নিজেই অবহেলা করে।
অতন্দ্রিলা দুদিন আগে লাল্টু ভাইকে ডাম্প করেছে। আপাতত সে সিঙ্গেল। সেই উপলক্ষ্যেই অতন্দ্রিলা আবেগ মাখিয়ে ভাঙ্গা প্রেমের গান গাইছে। এখন সে আরেকটা গান ধরেছে, আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না, ফেরারী পাখিরা, কুলায় ফেরে না।
অতন্দ্রিলার দুদিন আগে প্রাক্তন হয়ে যাওয়া প্রেমিক লাল্টু ভাই কাল ক্যাফেতে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। লাল্টু ভাই বোধহয় সারারাত ঘুমোননি । গায়ের জামা কোচড়ানো-মোচড়ানো, চুল উস্কোখুস্কো, লাল লাল চোখ, কী একটা বিশ্রী অবস্থা। লাল্টু ভাই হাত পা নেড়ে অনেক কাকুতিমিনতি করলেন । বললেন,
-অতন্দ্রিলার সাথে আমার কোন দিন কোন ঝগড়া হয়নি। মান অভিমান, মনোমালিন্য কিছুই হয়নি। কত নির্ঝঞ্ঝাট ছিল আমাদের সম্পর্ক। যেই বিয়ের কথা তুললাম অমনি অতন্দ্রিলা আমাকে ছেঁড়ে চলে গেলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, ভুলটা কী করলাম।
আমি বললাম,
-আপনি বেশী নির্ভুল, সেটাই আপনার ভুল। দেখেন লাল্টু ভাই, অতন্দ্রিলা হচ্ছে একজন স্ট্রং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। তার উপর আনকনভেনশনাল টাইপের। গাঁজা সিগারেট খায়, ঠোঁটে কালো লিপস্টিক দিয়ে শহর ঘুরে বেড়ায়। প্রেম করার আগে বোঝা উচিত ছিল সে আপনার টাইপ কিনা।
লাল্টু ভাই উদাস কন্ঠে বললেন,
-আমি ভালোমতই জানি অতন্দ্রিলা কেমন। কালো জুতা, কালো জামা,, কালো লিপস্টিক, গাঁজাটাজাসহ আমার অতন্দ্রিলাকে আমি ফেরত চাই। বিশ্বাস করুন, অতন্দ্রিলাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না ।
-আমি অতন্দ্রিলাকে বলে দেখবো লাল্টু ভাই। কিন্তু আমি একশ ভাগ নিশ্চিত অতন্দ্রিলা আর আপনার কাছে ফিরবে না। যাক যা গেছে তা যাক।
লাল্টু মুখ কালো করে বললো,
-আপনি এত পেসিমিস্টিক কথা বলছেন কেন? আপনি আমার মন আরও ভেঙ্গে দিচ্ছেন।
-আমি খামোখা মিষ্টি কথা বলে আপনার মনে মিথ্যে আশা জাগিয়ে রাখতে চাই না। আমি অতন্দ্রিলাকে ভালোমত চিনি। অতন্দ্রিলা এক নদীতে দু বার পা ভেজায় না। অতন্দ্রিলা যতক্ষণ পা ডুবিয়ে রাখে ততক্ষণই প্রেম। তারপর ইটস ওভার।
-কিন্তু আমার অন্যায়টা কোথায়?
লাল্টু ভাই ঘুরিয়ে বললে কিছুই বোঝেন না। বলবো কি বলবো না ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম,
-অতন্দ্রিলা বলেছে আপনি এমন এক নদী যার না আছে ঢেউ, না আছে গতি।
-মানে কী?
-মানে আপনি খুবই বোরিং ক্যারেক্টার। এটা কিন্তু আমার কথা না, অতন্দ্রিলা যা বলেছে তাই বললাম। আমি আপনাকে কোনভাবে অ্যাসেস করছি না। উইথ অ্যল ডিউ রেস্পেক্ট লাল্টু ভাই, অতন্দ্রিলার লাইফ থেকে আপনি কিকড আউট হয়ে গেছেন। গেট ইউজড টু ইট।
লাল্টু ভাই কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে বসে রইলেন। টেবিলের উপর মাটির ভাঁড়ের চা ধোয়া উড়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে, একটা চুমুকও দেননি। মনে হলো লাল্টু ভাই এতক্ষণে কঠিন সত্যকে হজম করার চেষ্টা করছেন। তিন মিনিটের নীরবতা শেষে আমার দিকে সজল চোখে তাকিয়ে লাল্টু ভাই বললেন,
-আচ্ছা, তবে তাই হোক। আপনি অতন্দ্রিলাকে একটা কথা জানাতে পারবেন?
-জি, বলুন।
-কাল আমি যমুনা ব্রীজে যাবো।
-যমুনা ব্রীজ নাকি যমুনা ফিউচার পার্ক?
-যমুনা ব্রীজ। রেলিং-এ দাঁড়িয়ে সোজা নীচে লাফ দেবো। ফেসবুকে জানিয়ে যাবো অতন্দ্রিলার জন্য আমি আত্মহত্যা করছি।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই লাল্টু ভাই মুখ চুন করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেচারা লাল্টু ভাই, আমি জানি উনি ব্রীজ থেকে লাফ দিলেও অতন্দ্রিলা মন ফেরাবে না।
অতন্দ্রিলা আমার বন্ধু অথচ আমার থেকে কত ভিন্ন। আমি কোন কথা দিলে আজীবন সে কথা রাখি। এ কারণেই সেদিনের ঘটনা ভুলে রঞ্জনকে ক্ষমা করে দিয়েছি। বলেছি, ঠিক আছে আরেকটা সুযোগ দিলাম কিন্তু আমার সাথে কোন রকম ভালগার আটিচুড করবে না। রঞ্জন এরপর থেকে ভদ্রছেলে হয়ে গেছে। এখন আর আগের মত বুকের বোতাম খুলে রাখে না, বাইকে হুট করে স্পিড বাড়িয়ে দেয় না। সেদিন রঞ্জনের সাথে আবার ঢাকা গেলাম, শিল্পকলায় নাটক দেখলাম। দেড় ঘন্টা ধরে মঞ্চ গরম হলো, কিন্তু বেচারা রঞ্জন আমার আঙ্গুল ছোঁয়ারও সাহস করেনি। আসলে ছেলেদেরকে একটু বুঝিয়ে বলতে হয়ে, না হলে স্বভাবজাত বন্যতা ছাড়তে পারে না।
এদিকে মিলিকে নিয়ে কুদ্দুস স্যার বোধহয় আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না। সকালবেলা ক্লাসে এসে বললেন,
-একটা একজাম্পল দিয়ে আমি দর্শনের কুইজ আরম্ভ করবো। সবাই রেডি?
আমরা সবাই কুদ্দুস স্যারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। কুদ্দুস স্যার মিলির কাছে গিয়ে বললেন,
-এই যে মখমলের মত তুলতুলে মিলি। মিলিকে দেখলে কখনো মনে হয় ভোরের শেফালী ফুল, কখনো লাল ঠোঁটের টিয়া পাখী, কখনো পল্কা ডটের চঞ্চলা হরিনী। ব্যক্তিগতভাবে আমার চিন্তা একটু উচ্চমার্গীয়। আমি মনে করি মিলি একটা নন্দনবাসিনী উর্বশী। রূপা, ঠিক কিনা?
কুদ্দুস স্যারের উদাহরণ মানে মিলিকে প্রকাশ্যে গোপন প্রেম নিবেদন করা। আমি বললাম,
-জানি না স্যার। আমি তো আর মিলিকে রাতদিন পাঠ করি না।
কথাটা আমি সিরিয়াসলি বলেছি কিন্তু ক্লাসে হাসির ঢল পড়ে গেলো। কুদ্দুস স্যার অপ্রস্তুত না হয়ে বললেন,
– এটা জাস্ট একটা উদাহরণ, হাইপোথেটিকালি বলেছি। একজন মিলি বহুকোণিক হীরের ছটার মত কতভাবেই না আলো ছড়ায়। আমি যদি কোনদিন সুযোগ পাই মিলিকে নিবিড়ভাবে পাঠ করবার, তাহলে একেক দিন ওর একেকটা অর্থ খুঁজে পাবো। এখন বলো তোমরা, এটা কার ফিলোসফি?
স্যারের কথা শুনে দিলশাদ ফিসফিস করে বললো, উফ, এই দুজনের বিয়ে দিয়ে দেয়ার সময় হয়ে গেছে।
সালমা বললো,
-এটা গভীর প্রেমের ফিলোসফি স্যার। একমাত্র মিলির প্রেমিকই চাইবে মিলিকে বারবার পাঠ করতে।
সবাই আবার হেসে দিলো। স্যারের পোষা ছাত্রী শাপলা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বললো,
– স্যার আমি জানি,
-বলো তাহলে, কার ফিলোসফি?
-এক মিলি অথচ পাঠ ভিন্ন। একে মোটা দাগে বলা যায় জ্যাক দেরিদার ডিকন্সট্রাক্টিভিস্ট দর্শন। ঠিক না স্যার?
স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– একটা হিউম্যান কেইস স্টাডি দিয়ে আমি তোমাদের কাছে থেকে জ্যাক দেরিদার ডিকন্সট্রাকটিভিজম সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। আর কেউ পারলে না, শুধু শাপলা ঠিক ধরতে পেরেছে।
মিতি আস্তে আস্তে বললো, বাসর রাতে মিলিকে কাছে পেলে কুদ্দুস স্যার কতভাবে যে ডিকন্সট্রাকশন করবে কে জানে।
আমি ফ্যা ফ্যা করে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতেই আবার আমার মন ভারী হয়ে গেলো। কাল রাতের কথা মনে পড়লো।
রেপগুলো খুব চেনা কেউ করছে না তো?
(চলবে)