প্রণয়প্রেমিকের নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব-০২

0
406

#প্রণয়প্রেমিকের নেশাক্ত প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০২

আরভীক ফাওয়াজ তার ফার্মহাউজের সিংহাসনে বসে রইল। আজ থেকে এ সিংহাসনে অধিকারত্ব ফলাবে তার প্রথম সন্তান আশফি। যেহেতু সে আঠারো বছরের বালক সেহেতু তার হক ও রাজত্ব শুরু। আজীবকেও তার প্রাপ্য রাজত্ব দেওয়া হবে তখন। যখন তার যোগ্য বয়স আঠারো হবে! সে এখনো আঠারোর কৌঠায় পৌঁছায়নি। আরভীক সাহেব দাঁড়িয়ে তার গার্ড’সকে ইশারা করে। তারা ফুলের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আশফির জীবনের প্রথম মিশন ছিল আজকে। যা সে সুষ্ঠুভাবে,বুদ্ধিমত্তার ন্যায় সম্পন্ন করেছে। সাইকেল পার্ক করে ফার্মহাউজের ভেতর প্রবেশ করে আশফি। তার আগমনে গার্ড’স এগিয়ে এসে ফুল মেলে স্বাগত করা আরম্ভ করে। আরভীক সাহেব চওড়া হেসে ছেলের পিঠে বারদুয়েক আদুরীয় আঘাত দিয়ে বলে,

‘মাই সান ইজ অলরাউন্ডার।’

আশফি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’জাস্ট লাইক ইউ!’ তিনি বরাবরের মত উৎফুল্লতার ন্যায় বলে,

‘জানিস বাপ তোর মাঝে আমি আছি। তুই হলি আয়েশা ও আজীবের মতই আমার আরেক প্রাণ। যার চারবছর অব্দি শৈশবটা দেখা হয়নি। তোর জম্মের পরপর কানে আযান দেওয়ার মত সুভাগ্যও হয়নি কপালে। যেদিন তোকে দেখেছিলাম সেদিন মনপ্রান্তে প্রার্থনা করে ছিলাম। আল্লাহ যেন তোকে সেই সব শক্তি দেয় যেগুলো আমার মধ্যে বিরাজিত।’

বাবার আকস্মিক কথাগুলোতে খটকা লাগে আশফির। আশ্চর্যের দৃষ্টিতে তাকায়। ছেলের দৃষ্টিকোণে থতমত খায় আরভীক সাহেব। আমতা ভাব নিয়ে বলে,

‘ছেলে এখনো এইচএসসি পার্স করিসনি অথচ বউবাচ্চার প্ল্যানিং শুরু করে দিলি বাহ্! তুই দেখি আমার চেয়েও ফাস্ট। তোর সময় তো খালি নাকে দুধ খেতাম।’

আশফি ব্লাশিং চেহারায় লাজুক কণ্ঠে বলে,

‘বাবা আমিও ভাবছি তোমার মত উনিশ বছর হলেই বিয়েটা সেরে ফেলব। তাহলে তিনমাসের মধ্যে তুমি দাদা হয়ে যাবে।’

কথাগুলো শুনে কাশি উঠে যায় আরভীক সাহেবের। বেচারা বুড়ো বয়সে ছেলের কথায় তার নিজের যৌবনকালীন সময়ের স্মৃতি মস্তিষ্কে চলে এসেছিল। সে ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলে,

‘তা হবে না বাপ!’

পরিতুষ্ট আনন্দ নিমিশেষে মিইয়ে যায় আশফির। মুখ ফুলিয়ে বলে, ‘কেন আমিও বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়!’
আরভীক সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘বাপ আমি উনিশ বছরে বিয়ে করে ছিলাম কারণ তোর নানুর বাড়িতে ফোর্স করছিল তোর মাকে। তোর মা একা শহরে বসবাস করতেই পারতো না। কারণ রাতবিরাতে হায়েনার দল হাজির হতো। তাই আমি ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহিত জীবন পাড় করি তুই না হওয়া অব্দি। যখন এলি তখন….। যাই হোক তোর চারবছর বয়সে পেয়ে এখন অব্দি আমি আর তোর মা বেঁচে আছি। ইউ নিড টু বি হাই কোয়ালিফিকেশন। তোকে নিয়ে স্বপ্ন আছে আমার। যে তুই তোর মনের স্বপ্ন পূরণ করবি। আমি জানিনা তোর ইচ্ছে কি ভবিষ্যতে! তবে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছি তোকে গভীর সম্মানী পদকে উত্তীর্ণ হয়েছিস সে পর্যায় দেখার।’

বাবার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনল আশফি। তার বাবায় যে পরিমাণ আকুতি ছিল তাতে আশফি বাধ্য তার জীবন উপযুক্ত করার জন্য ! মাথা নুয়ে বলে,

‘আব্বু আমি যদি তোমার কাছে আবদার রাখি, তুমি রাখবে!’

‘আরে তুই বল হাজারো আবদার রাখতে রাজি।’

‘আব্বু আমি মাফিয়া হতে চাই।’

থমকে যায় আরভীক সাহেব। যে উৎফুল্ল সানন্দ কিঞ্চিৎ পূর্বেও তার মাঝে বিরাজ করছিল সে উল্লাস যেন নিমিশেষে সমাপ্ত হলো। তিনি উঠে দুহাত পকেটে গুজে গার্ড’সের দিকে তাকিয়ে উচ্চ আওয়াজে বলে, ‘এসেম্বেল’। গার্ড’স সব একত্রিত হয় সারি অনুযায়ী। আশফি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। আরভীক সাহেব রাশভারী চেহারা নিয়ে আড়চোখে ছেলের চুপছে যাওয়া মুখখানি দেখল। পুনরায় গার্ড’সের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এভরিওয়ান বি রিমেম্বার ইউর নিউ কিং ইজ আশফি। আইম রিটায়ার্ড বাট নট ফর অলওয়েজ।’

শেষাক্ত কথাটি শুনে গার্ড’স আপনমনে ঢোক গিলে। আশফি ভ্রু কুঁচকে অবুঝ নয়নে জিজ্ঞেস করে।

‘আব্বু তুমি রিটায়ার্ড হয়েও সবসময়ের জন্য না এর মানে কি!’

আরভীক সাহেব ছেলের অগোচরে বাঁকা হেসে তার সামনে শান্ত দৃষ্টিতে মুখ ফেরায়। তার মুখোমুখি হয়ে বলে,

‘আমার বলায় কি উদ্দেশ্য বা অর্থ আছে সেটা না হয় পরে বুঝবি! আপাতত তুই তোর এইচএসসির দিকে ধ্যান দেয়। আর কয়েকমাস পরই তোর বোর্ড এক্সাম। আমি চাই আমার তিন ছেলেমেয়ে এডুকেটেড হোক। ইউর ড্রিম ইজ ইউর! ইট উইল বি হ্যাপেন্ডে সুন ইন শা আল্লাহ্।’

আশফিও ‘ইন শা আল্লাহ’ বলে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আরভীক সাহেব ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে আনমনে ভাবে।

‘আমায় মাফ করিস বাপ! বুড়ো বয়স হলেও বুদ্ধিসত্তা বেড়েছে। আমি তোদের ছায়া হয়ে কতদিন আছি সেটা শুধু আল্লাহ জানেন। যতদিন আছি ততদিনে তোদের কর্মঠ,অধ্যাবসায় ও কোনোদিন আল্লাহ ব্যতীত নিজেকে অন্যকারো দিকে মাথা নুয়ে পড়ার মত সাধ্যতা না দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেব।’

আশফিকে ছেড়ে মুচকি হেসে বলে, ‘এক্সাম শেষে তোকে তোর বেস্ট ড্রিম সেন্টারে ভর্তি করাবো। জানিস আমি কোন সেন্টারের কথা বলছি! মার্শাল সেন্টার। যেখানে তুই ক্যারাটি থেকে শুরু করে টিপসও শিখতে পারবি,প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজের দাপট দেখাতে পারবি।’

মার্শালের কথা শুনে আশফি খুশি হয়ে তার বাবার গালে বড়জোড় চুমু দিয়ে ‘থ্যাংকস আব্বু ইউ দ্যা বেস্ট ইন মাই ওয়াল্ড।’ আরভীক সাহেব হেসে আশফির গালেও চুমু একেঁ বলে, ‘ইউ টু মাই সান নাউ ইউ ক্যান গো।’
আশফি তৎক্ষণাৎ আবেশে প্রস্থান করে। কিছুক্ষণ পর তার প্রাইভেট আছে বিধেয় সে সাইকেল নিয়ে সোজা প্রাইভেট পড়তে যায়।

_____

রাত দশটা….

চোখজোড়া খুলে আহিফা নিজেকে তার বেডরুমে পেল। আকস্মিক হতদন্ত হয়ে ঢুকে পড়ে রুবা ও রুহিয়া। খালাতো বোনদের নাজেহাল ভীতি চেহারা দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো আহিফার। দুজন একসঙ্গে বসে একই কণ্ঠে আওড়ায়।

‘আপামনি তুমি ঠিক আছো!’

জবাবে শুধু মাথা নাড়ে আহিফা। দুজন একে অপরের দিকে অবুঝ নয়নে চেয়ে তাৎক্ষণিক লজ্জাশীল হাসি দেয়। জমজ হওয়ায় উভয়ের হাসির বহিঃপ্রকাশের কারণ খোঁজে পেল না আহিফা। সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘কি হলো রে চামচীদের! এত ব্লাশিং কোন হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখার পর থেকে হচ্ছিস!’

দুজনে একই গলায় একটি নাম উচ্চারণ করে, ‘আশফি’। আশফির নাম জমজ বোনদের কণ্ঠে শুনে চোখ বড় হয়ে গেল আহিফার। সেই সঙ্গে দুজনের ব্লাশিং হওয়া দেখে গা জ্বলছে উঠে তার। চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘চামচীপোকা তোরা ব্লাশিংয়েই থেমে যাহ্। এর বাড়তি কিছু করার চিন্তা করলে নাহ্। হাত-পা ভেঙ্গে লাঙরু বানিয়ে ছাড়ব। গুজব রে বোন তোরা, তোদের ভাবছিলাম সুইট কিন্তু বের হলি ফাজিল! তোরা সুবিধার না বুঝতে পারছি। জলদি খালামনিকে বলব তোদের নিয়ে যেতে।’

কাঁদো কাঁদো মুখ করে উভয়ে বলে,

‘সরি আপামনি আর কখনো আশফি কি টাস্কিও খাবো না আশফি নামের উপর।’

‘শুধু নাম!’

সূক্ষ্ম নয়নে ঝাঁজ দেখিয়ে প্রশ্ন করে আহিফা। ফলে দুজনে হতাশার ন্যায় ফোঁস করে বলে,’নামও,দেহও।’
ব্যস চিন্তামুক্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে গোসল করতে গেল আহিফা। পুরু দিন মিলিয়ে শরীরটা ঘেমেটেমে একাকার তার! সুতরাং গোসল ফরজ।
খাবার টেবিলে গম্ভীর হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে আছে আদাফাত সাহেব। মিসেস নাইফা কাচুমাচু মুখ নিয়ে প্লেটে খাবার বাড়ছে। মেয়ে তাদের ভাবলেশনহীন কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে যাচ্ছে। আদাফাত চোখের ইশারায় নাইফাকে ঝাড়ি দেয় মেয়েকে সিধা করার করার জন্য। বিনিময়ে করুণ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায় তিনি। আদাফাত সাহেব নাছোড়বান্দা এমুর্হুতে হাল ছাড়বে না তিনি। গলা ঝেড়ে মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আহিফা পিটপিটিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। আদাফাত সাহেব শার্টের হাতের ফোল্ড করে হাত ধুতে নিয়ে বলে,

‘আশফির সঙ্গে তুমি কথা কেনো বলো না আহু মা!’

‘আশফি’ নামটা শুনে ফোঁস করে বিরক্তির শ্বাস ফেলে সে। যেখানেই যায় ‘আশফি আশফি’ এই নামটাই বেশি উচ্চারিত হয় বা কান ফেটে গেলেও শুনতে হয়। বুঝে না কেউ যে তার কান পেকে গেছে এক নাম শুনতে থেকে! আদাফাত সাহেব মেয়ের থেকে উত্তর না পেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে আওড়ায়।

‘মা তুমি এখনো টেন এ পড়ো অথচ অবুঝ রয়ে গেলে। তোমার অবর্তমানে আশফি কিরুপ ছেলে ছিল সেটা শুধু আমি আর তোমার মা’ই ভালো জানি। জানি তোমার কাছে এসব শুনা বিরক্তির সামিল। তবুও বলব ছেলেটাকে বাজে না ভেবে ভালোর দৃষ্টিতে দেখো। দেখতে পাবে বাজে স্বভাবের মাঝেও সুপ্ত এক ভালো স্বভাব ও অনুভূতি লুকায়িত আছে।’

‘উফ ড্যাড জাস্ট স্টপ। আশফি নাম শুনলে আমার এলার্জি হয়। কেনো এই নামটা বারংবার নাও। আশফির নামের পেছনের কাহিনী সম্পর্কে আমি জানতেও ইচ্ছুক নয়। আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট হিম! জাস্ট হেইট দ্যাট বয়।’

‘আহিফা’ গর্জনের ন্যায় ধমকে উঠে আদাফাত সাহেব। আহিফা ঈষৎ কেঁপে উঠে। মিসেস নাইফা বরাবরের মত নিশ্চুপ,অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আহিফা কান্নারত চোখে একপলক তার মা ও বাবার দিকে চেয়ে বলে,

‘তোমরা কেউ আমায় বুঝো না। খালি আশফিকে প্রাধান্য দাও। যেন আমি তোমাদের সন্তানই না।’

চোখ থেকে অশ্রু ঝরাতে থেকে চলে যায় নিজের রুমে। মিসেস নাইফা ফোঁস করে হতাশার গ্লানি নিয়ে বলে,

‘কেনো বলতে গেলেন! মেয়েটা না খেয়ে চলে গেল।’

‘বেয়াদব হচ্ছে দেখছো! এই মেয়েকে নিয়ে একসময় গর্ব হতো। অথচ দেখো এই মেয়েটাই আমার মুখে কালি মেখে দিলো।’

‘আপনার আরো এক সন্তান আছে। সে কি ভাব্বে বলুন!’

আদাফাত সাহেব নিজেও রুদ্ধের ন্যায় হতাশ হলো। আদরের দুই ছেলেমেয়ে নাঈম ও আহিফা। নাঈম সদ্য সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে, তথাপি অবুঝ নয় সে বালক। সে তার বেডরুম থেকে খাওয়ার রুমে ঘটা প্রতিটা কথ্য শ্রবণ করেছেঞ। অন্যথায় মনঃক্ষুণ্ণ হলো তার। কেননা সে আশফি ভাইকে খুব পছন্দ করে। শুধু বোনের বিরক্তিতার কারণে সে পছন্দের কথা উল্লেখ করতে ভয় পায়। যদি প্রকাশ করে তবে তার প্রতি বোনের পক্ষ থেকে খালি রাগ ও ঝাড়ি মিলবে কপালে! সেই ভয়ে গোপনে আশফিকে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেই সে। কাবার্ড থেকে তার ট্যাব বের করে হোয়াইটসআপে ঢুকে। সেখানে তার বাবার আইডি ওপেনড। বিধেয় সে বাবার আইডি থেকে আশফি ভাইয়ের নাম্বার কালেক্ট করে তার নিজের আইডিতে লগইন করে। সেখানে আশফিকে এড করে মেসেজ পাঠায়।

‘ভাইয়া আমি নাঈম আহিফা আপুর ছোট ভাই।’

রাতে আশফি পড়া শেষে আহিফার গুলুমুলু মুখখানি স্মরণে নিয়ে খাতার মধ্যে পেন্সিল কলম দিয়ে আকাঁর চিন্তাধারা এটেঁ ছিল। অতঃপর আকাঁর পূর্বেই হোয়াইটসআপে মেসেজ আসায় থেমে যায়। নাঈমের মেসেজ দেখে উল্লাসী হলো। মনে মনে ভাবে, যাক ছোট ভাইকে পটিয়ে রাখলে বড় বোন কোনোক্রমেও না পটে রয়বে না। নাঈমের সঙ্গে মাঝরাত পুরুটা কাটিয়ে দেয় কথা-কৌশলে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

____

পরের দিন সকালে স্কুল ড্রেসের সঙ্গে দুই বেনী করে আহিফা ঢ্যাং ঢ্যাং করে হেলে দুলে স্কুলের পথে রওনা হয়। আশফি তখন টংবাজারে তার ক্লাসমেটের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আজীবও ছিল তবে বইয়ে মুখ গুজে। তাকে দেখে আশফি বলে,

‘ভাই খালি বইয়ে মুখ গুজে লাভ কি! যদি একটু আধটু এপাশ ওপাশ না থাকাস। বুঝছি ডক্টর হওয়ার স্বপ্ন তোর। তাই বলে মাথায় যে মগজটা আছে সেটারে কেন অবিরাম নষ্ট করছিস। একটু তো শান্তি দেয় সেই বেচারাকে।’

আজীব ফোঁস করে বইটা বন্ধ করে বলে,’কি করব ভাই ! বই দেখলেই খালি মন চাই পড়ি আর পড়ি। না হলে হুটহাট রাগ চলে আসে।’

আশফি মাথা নেড়ে ‘ছুহ্ ছুহ’ করে বলে, ‘ঘোর তান্ডব রে! তোর এহেন সমস্যার কারণে ভবিষ্যৎ এ তোর বউ বেশ মা’ই’র খাবে তোর হাতে। তুই মা’রবি সেই তুই পরে আদর দিবি।’

আজীব বেকুবের মত হা করে রইল। তার ভাই কোথার থেকে কোথায় চলে গেল ভেবে সে নিজেই তব্দা খেল। হ্যাবলার মত হেসে বলে,

‘ভাই সেসব দূরের কথা! আমি প্রেমট্রেম করব না।’

‘হে ভাই তুমি তো সাধু সেজে বসে থাকবা যেন। তোদের মত গম্ভীর ছেলেদের নিয়ে আমি পিএইচডি করে রাখছি। তোরা বাহিরে গম্ভীর ভেতরে ফাজিলের ডিব্বা। আর এই ফাজিলের লুতুপুতুগিরি কবে বের হয় জানস!’

আজীব উৎসাহী দৃষ্টিতে মাথা ডানে-বামে নেড়ে না বোঝায়। তার কৌতূহলী চেহারা বলে দিচ্ছে, সেও জানতে চাই এর আসল রহস্য কি! আশফি ‘বলবে বলবে’ এরুপ ভাব করে শিষ বাজিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আজীব ভেবাচ্যাকা খেয়ে বলে,

‘ঐ ভাই দাঁড়ালি কেন বল কখন বের হয়!’

আশফি নিজের কলেজের নীল রঙের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে থেকে বলে,

‘তোর ফিউচার ভাবী আসতেছে, যাই একদুখান রাগিয়ে আছি তারে।’

‘কিহ্ ভাবী, কোন ভাবী, পাশের বাসার আন্টির মেয়ে নাকি!’

‘ধুর ঐ আন্ডাবাচ্চা কেন তোর ভাবী হবে! তোর ভাবী তো ঐ যে পুচকি মেয়ে আসতেছে সে।’

ঘাড় ঘুরিয়ে আজীব রাস্তার ফুটপাতে দৃষ্টি ফেলে। লক্ষ করল দুই বেনী করা এক স্কুল ড্রেস পরিহিত মেয়ে ধেই ধেই করে হেঁটে আসছে। তাকে দেখে ভিখারী মনে হলো আজীবের। সে আকস্মিক প্রশ্ন করে!

‘ভাই ভাবী হিসেবে শেষমেষ এই ভিখারীকে পেলি।’

আশফি শুনে ভোঁতা মুখ নিয়ে বলে, ‘তোর আক্কেল যেদিন হবে সেদিনই তোকে প্রথম প্রশ্নের জবাব দেব। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হলো হ্যা এই স্টাইলিশ ভিখারীই তোর ভাবী।’

কথা সম্পূর্ণ করে আশফি তৎক্ষণাৎ রাস্তা গমন করে মোড়কের সামনে দাঁড়ায়। যেখান দিয়ে কিঞ্চিৎ সময় পর আহিফা গমন করবে। সে গুন গুন করে গান গেয়ে চলছে,
‘ধীরে ধীরে সে মেরি জিন্দেগী আনা, ধীরে ধীরে সে মেরি ডিল কো চুরানা!’
আহিফার কণ্ঠের সুরেলা গান শুনে আশফি বাঁকা হেসে বলে,’ওকে আসার জন্য দরজা খুলা রেখো সুইটহার্ট!’ আশফির কণ্ঠ পেয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আহিফার। তবে রাস্তাঘাটে হওয়ায় গলা ঝেড়ে আশফিকে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় গেয়ে উঠে।

‘তুমচে পেয়ার হামেয়ে হে কিতনা জানেহ্ জানাহ্,তুমচে মিলকার তুমকো হেয়ে বাতানা।’

আহিফা আড়চোখে পিছু মোড়ে দেখে আশফির স্থান শূন্য। ভ্যাবলাকান্ত বনে যায় ক্ষণিকের মধ্যে ছেলেটা কোথায় উধাও হলো ভেবে যেই মুখ সামনে ফেরায় সে। তৎপর হয়ে ভীতিগ্রস্থ হলো। কেননা আশফি তার সফেদ দাঁতের চকচকানি দেখিয়ে শয়তানি হাসি পরিতুষ্টের ন্যায় প্রকট হয় আহিফার সম্মুখে। ভীতু দৃষ্টিকোণে চেয়ে বুকের মধ্যে বারদুয়েক থুথু মেরে বলে,

‘আপনি ভূতের মত যখন তখন প্রকট হোন কেন!’

আশফি চোখের ইশারায় দুষ্টুমি ভাব নিয়ে বলে,

‘এখন থেকেই তুমি আমায় চোখে চোখে হারাচ্ছো, আর ভালোবাসা তো অসীম ! গানের মধ্যে ব্যক্ত করার আইডিয়াটা চমৎকার! তবে চিন্তে করো না আমার কাছে নিশ্চিতে বলে দাও ভালোবাসী! ব্যস আকদ করে দুবছর পর চাকরি বাকরি পেয়ে গেলে তোমায় ঘরে উঠিয়ে নেবো।’

শেষের কথায় লাজুক হেসে আশফি তার বাঁহাতের বাহু দিয়ে আহিফার ডান হাতের বাহুতে মৃদু ধাক্কা দেয়। আহিফা ধাক্কা খেয়ে এককদম পিছিয়ে যায়। বাহুতে হাত বুলিয়ে সে মুখ ভেটকিয়ে বলে,

‘আপনি কি মুখে সবসময় মধু দেন! এত ফটরফটর কথা বের হয় কেমনে। মৌমাছি এসে ভ্যান ভ্যান করে না!’

আহিফার কথায় যেন মন খুলে হেসে দেয় আশফি। সে গড়গড় করে হেসে বলে,

‘বুঝবে না তুমি মধুহীন জিহ্বা নারী। একটা টিপস দেয় শুনো রাতে প্রতিদিনি ফেসিয়াল করে ঘুমানোর সময় ঠোঁটে মধু মেখে নিও কেমন! দেখবে কয়েকদিনের মধ্যে ঠোঁট ও জিহ্বায় মধু ছাড়া কথা বের হতে চাইবে না।’

‘আপনার ফাউল টিপস ডাস্টে ফেলেন। আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আপনার টিপস ফলো করব হাহ্!’

আশফি ঠোঁট চওড়া করে শিষ বাজিয়ে হেঁটে যেতে আরম্ভ করে। কিন্তু পিছু না ফেরে সে আহিফাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগে।

‘ট্রাই করতে মন্দ নেই বালিকা। তোমার ভালো না লাগলে টিপস তোমার কাজিন সিসদের দিতে পারো। তারা তো আবার আমি ভক্ত। অথচ আমাকে দেখো কত বড় গরু যে তার ভক্ত গাই ছেড়ে অভক্ত গাইয়ের কাছে গিয়ে টিপস দিয়ে যাচ্ছি। এমন ছেলেকে স্বামী হিসেবে আর কোথাও পাবে নাকি হে! নূন্যতম সেন্সলেস হলে যা হয় আরকি।’

আহিফা ঠোঁট চেপে বিক্ষোভ অগ্নিদৃষ্টিতে ফুটপাতের চর্তুপাশ্ব নজর বুলিয়ে কিছুর খোঁজ লাগায়। আশফি আড়চোখে বিষয়টি খেয়াল করে ভাবে, ‘কি খোঁজছে আহিফা! যেয়ে জিজ্ঞেস করি।’ যেই ভাবনা নিয়ে সে পিছু মোড়তে নিয়ে ছিল সেই ভাবনাকে এক ধাক্কায় মন থেকে দূরে ঠেলে সে পালানো শুরু করে। আহিফা ফুটপাতে পড়ে থাকা ইটের পাথর নিয়ে ছুটে আসছে আশফির নিকট। বেচারা মাথা ফাটার ভয়ে দৌড় লাগায়। কিন্তু এই ফুটপাতের রাস্তা শেষ হতেই প্রধান সড়কের রাস্তা পড়ে। আশফি তৎক্ষণাৎ থেমে যায়। তবে আহিফা ইটের পাথরটি নিয়ে মগ্ন থাকায় আশফি যাতায়াতকারী যানবাহন দেখে চিৎকার করে আহিফাকে আসতে বারণ করে। কিন্তু আশফির কোনো কথাই আহিফা শুনতে পেল না কারণ যানবাহনের ‘পিপ পুপ’ উচ্চ শব্দের ফলে আহিফা ইটের পাথর নিয়ে দৌড়ে আসতে থাকে। আশফির কলিজা আতঙ্কে শিউরে উঠল। কেননা তার দৃষ্টিকোণে দেখা যাচ্ছে এক সিমেন্টের ট্রাক বেকায়দায় ধেয়ে আসছে। আশফি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আহিফাকে ‘না না এসো না আহু ওখানেই থাক তুই প্লিজ!’
চিৎকার করে বলছে। তবে আহিফা আকস্মিক থামলেও তার শরীরের ভারের কারণে সে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রাস্তার কোণায়। অন্যত্রে সিমেন্টের ট্রাক তার নিকটস্থ হতে থাকে। আশফির চোখে ভয়ানক কিছু ঘটার শঙ্কায় সে দিশা হারিয়ে ফেলে। পা ফেলে দৌড়ে এগায় আহিফার নিকট।

চলবে…..