প্রণয়প্রেমিকের নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব-০৩

0
295

#প্রণয়প্রেমিকের নেশাক্ত প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৩

মেডিক্যালের বেডে নিবিড়ভাবে শুয়ে আছে আশফি। মুখে অক্সিজেন,হাতে,পায়ে স্যালাইন দেওয়া। আহিফা অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে চাইনি কখনো তার ক্ষতি হোক! কেমনে কি হলো সবটা যেন দূর্ঘটনার সামিল। ইতঃপূর্বে ফাহাদ সাহেব সেই ট্রাক ড্রাইভারকে অসাবধানতা ও বেকায়দায় ড্রাইভিং করার দায়ে পাঁচবছরের কারাদন্ড দেয়। সেই সঙ্গে তার নাগরিকত্ব ও ড্রাইভিং লাইসেন্স বহিষ্কার করা হয়। মিসেস আনজুমা পরপর কেবিনের ছোট আকৃতির থাই গ্লাস দিয়ে তার ছেলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। আজীব ও আয়েশা একে অপরের হাত ধরে প্রে করছে। ছেলের দূর্দশা যেন অসহনীয় ঠেকছে মিসেস আনজুমার কাছে। আহিফার পাশে তার মা মিসেস নাইফা রূগ্ন মনে দাঁড়িয়ে আছে। আহিফাকে শান্ত্বনা দিচ্ছে শুদ্ধ নেত্রপল্লবে। তবে এই শান্ত্বনা কিঞ্চিৎ পর ক্ষোভে পরিণত হতে পারে! যার ভয় তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আরভীক সাহেব তার স্ত্রীর নিকট গিয়ে দাঁড়ায়। মিসেস আনজুমা করুণ গলায় বলে,

‘দেখো না আমাদের আশফি চোখ খুলছে না এখনো। তাকে বলো না চোখ খুলতে। ওগো আমার না বুকে ব্যথা করছে।’

আহিফা ফুঁপিয়ে তার বড় চাচীকে দেখছে। তার বাবা এখনো অপারেশন রুমের ভেতরে। তার অধীনে চিকিৎসা চলছে আশফির। আহিফা ছোট পায়ে হেঁটে তার আনজুমা চাচীর নিকটস্থ হয়। কাঁপা হাতে চাচীকে জড়িয়ে ধরে ব্যথিত কণ্ঠে বলে,

‘চাচীমা আ আমাকে মাফ করে দাও। আ আমি বুঝিনী এমন কিছু ঘ ঘটে যাবে। ও চাচীমা কথা বলো আমার সঙ্গে।’

নিশ্চুপ রইল মিসেস আনজুমা। পূর্বে আহিফাকে পেলে তিনি খুশিতে আপ্লুত হয়ে উঠতো। কিন্তু আজ আহিফার অস্তিত্বও যেন বিলীন তার কাছে। মুখে কাঠিন্যতার কোনো চাপ নেই, আছে একরাশ বেদনাভরা অপেক্ষা। মিসেস আনজুমা নিবিড়ে আহিফার হাত তার পিঠ থেকে সরিয়ে নেয়। কথ্যহীন তিনি ছেলের কেবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। আহিফার কষ্টে হৃদয় ভেঙ্গে পড়ছে। তার চাচীমার নিশ্চুপতা বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। আরভীক সাহেব স্ত্রীর দিকে আড়চোখে চেয়ে আহিফার নিকট গিয়ে তার মাথায় হাত বুলায়। আহিফা ছলছল দৃষ্টিতে তার বড় চাচ্চুর দিকে তাকায়। আহিফার অশ্রুসিক্ততা দেখে আরভীক সাহেব নিজেকে অসহায়বোধ করল। কারণ সে এ মুহুর্তে তার প্রণয়োণীকে বোঝাতে অক্ষম! তাদের প্রথম সন্তানের করুণ দশা আহিফার ভুলে হলেও সে তো অবুঝ! বিধেয় পরিস্থিতির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তারা। তপ্ত শ্বাস ফেলে আহিফাকে আদুরীয় গলায় শুধায়।

‘আহুমা তোমার চাচীমার ব্যবহারে কষ্ট পেও না।কিছু দিনের জন্য সহ্য করে নিও। আশফি আমাদের বড্ড আদরের। সবচেয়ে বেশি তোমার চাচীমার। কারণ সে মাতৃস্বাদ আশফিকে দিয়ে পেয়েছে। সেই মাতৃস্বাদের মাঝে ক্ষণিকের চোটও যেন মরণপ্রায় তার জন্য।’

আহিফা ফুঁপিয়ে কেঁদে তার আরভীক চাচ্চুকে জড়িয়ে ধরে। ব্যথিত গলায় ক্ষমা চাইতে লাগল। আরভীক সাহেব ঠোঁট কামড়ে আহিফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘সব ঠিক হয়ে যাবে মা ইন শা আল্লাহ্।’

‘ইন শা আল্লাহ্।’

মিসেস নাইফা ও সাইবা দুজনে আনজুমার পাশে বসে আছে। নাইফার সঙ্গে স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলছে আনজুমা। তবে তার মেয়ের সঙ্গে কোনো রুপ কথা বলছে না। নাইফা মেয়ের কথা বলতে চেয়েও পারছে না। কারণ আশফির দূর্ঘটনার প্রেক্ষিতে আহিফা জড়িত। অতঃপর আনজুমার হেলা যেন আহিফার কাছে শত বছরের কষ্ট এক নিমিত্তে পাচ্ছে। তার ভুলের মাশুল দেওয়ার সুযোগ সে আজও পাবে কিনা জানা নেই তার! আকস্মিক দরজা খোলার শব্দে সকলে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে উৎসাহী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মিসেস আনজুমা কেবিনের দরজা বরাবর এসে দাঁড়ায়। আরভীক সাহেবের বাহু ধরে ঢোক গিলছে। আদাফাত মাস্ক খুলে কপালের ঘাম মুছল। উৎসাহী দর্শকদের দেখে মৃদু ঢোক গিলে। চোখ বুলিয়ে তার মেয়েকে খোঁজে। এককোণায় ফুঁপাচ্ছে আর কেবিনের দিকে চেয়ে আছে। মেয়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আহিফা দৃষ্টি নামিয়ে নাক টানতে লাগে। আদাফাত তপ্ত শ্বাস নিয়ে প্রশান্তির গলায় আওড়ায়।

‘চিন্তামুক্ত হোন আপনারা। আশফি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার।’

কথাটি শুনে মিসেস আনজুমা উৎফুল্ল হয়ে বলে,

‘আ আমি আশফিকে দেখতে চাই ভাইয়া।’

আদাফাত তার ভাবীর অবস্থা দেখে বলে,

‘ভাবী একঘণ্টা অপেক্ষা করো। আশফিকে ঠিক একঘণ্টা পরে কেবিনে শিফ্ট করা হবে। আপাতত তার পরণের জামা পরিবর্তন করে রক্তপাত মুছে পরিষ্কার করতে সময় প্রয়োজন।’

সকলে সায় দেয়। আরভীক সাহেব আহিফার দিকে আড়চোখে চেয়ে তার স্ত্রীর কাঁধ ধরে আগলে নিয়ে বলে,

‘চলো ক্যান্টিনে কিছু খাওয়ে দেয়। সেই কবে থেকে না খেয়ে আছো, পেটে কিছু না গেলে মোটা হবে কেমনে!’

আজ আরভীক সাহেবে কথায় হাসি ফুটল না তার স্ত্রীর মুখে। ছেলেকে ফিরে পেলেও এখনো তার কানে সেসময়ের ঘটা দূর্ঘটনার কথাটি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তিনি স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝে তাকে আগলে নিয়ে গেল। তার মূল কারণ হলো এক স্ত্রীর মন ভুলানো দুই আহিফাকে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য আশফির সঙ্গে একা ছাড়া। ইতঃপূর্বে আশফির জ্ঞান ফিরেছে জানা হয়েছে সকলের মাঝে। তবে তার সঙ্গে একঘণ্টার পূর্বে দেখা করা নিষেধ। কেবিনের সামনে কাউকে না দেখে আহিফা একদৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আশফিকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখে ধীরস্থির পায়ে এগোয় সে। কারো আহাট নিজের পাশে অনুভব করায় চট করে চোখ খুলে তাকায় আশফি! পুচকিকে নিজের কাছাকাছি পেয়ে ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটে উঠে তার। ক্লান্ত,দূর্বল দৃষ্টিতে নিজের শরীরের বেগতিক দশা ব্যক্ত করল। হাতের ছোঁয়া দিতে চেয়েও পারছে না। বৃথা সে চোখ দ্বারাই তার যত ইচ্ছে ক্ষেপন করে গেল। আহিফা স্বেচ্ছায় আশফির হাতে তার ছোট হাত পেঁচিয়ে ধরে। আহিফা করুণ কণ্ঠে বলে,

‘আমায় মাফ করে দাও আশফি ভাইয়ু। তোমাকে জ্বালাতে গিয়ে তোমার ক্ষতি করে ফেলব ভাবিনী কখনো। তুমি চিন্তে করো না খুব জলদি সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি থাকলে তুমি কখনো সুস্থ হতে পারবে না। তাই আমার বিদায় জানানো খুব জরুরি।’

শেষের কথাগুলো বিরবিরিয়ে বলল আহিফা। যা কর্ণগোচর হলো না আশফির ক্ষেত্রে। সে একধ্যানে তার পুচকি বউয়ের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু সে তো জানে না! সামনে কি হারাতে চলেছে সে!
আহিফাকে ছেলের পাশে দেখে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে মিসেস আনজুমার মাথায়। তিনি দিগিদ্বিক হারিয়ে নিরবে ছেলের সামনে দাঁড়ায়। মাকে দেখেও দূর্বল কণ্ঠে কিছু আওড়াতে নিলে মিসেস আনজুমা হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়। মায়ের অনুমতির ফলে আশফি চুপ রইল। মিসেস আনজুমা অগ্নিশর্মার ন্যায় আহিফার হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে ছেলের দৃষ্টি অগোচরে। মুচকি হেসে বলে,

‘বাবা তুই রেস্ট কর। পরে সবার সঙ্গে দেখা করতে বলছে তোর আদাফাত চাচ্চু।’

মায়ের প্রত্যত্তর জবাবে আশফি মনের উৎকণ্ঠা থেকে বলতে চেয়ে ছিল, ‘মা আহিফাকে রেখে যাও। তাকে মনভরে দেখতে মন চাইছে’। তবে তার মনের কথা মনে রয়ে গেল। আহিফা ‘আহ্’ করে আর্তনাদময় শব্দ বের করে। এতে বেশ উত্তেজিত হয়ে গেল আশফি। উঠতে নিলে আহিফা ও আনজুমা একত্রে বলে, ‘উঠতে হবে না’। আশফি থতমত খেয়ে শুয়ে যায়। দূর্বল গলায় আহিফাকে জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি ব্যথা পেয়েছো কোথাও! ব্যথার শব্দ বের করলে যে।’

মিসেস আনজুমা শুনে স্তদ্ধ হলো। হাতটা হালকা করে আহিফাকে ধরে রাখে। সেও মুচকি হেসে বলে,

‘এমনি মনে হচ্ছে কষ্ট তোমার নয় আমার বুকে হচ্ছে।’

‘বাহ্ ফিল্মি স্যাড ডায়লগ শিখলি দেখি।’

বিনিময়ে মৃদু হাসে আহিফা। মিসেস আনজুমা তাড়া দিয়ে তার সঙ্গে আহিফাকে নিয়ে যেতে নেয়। আশফির মন মানছে না আহিফাকে ছাড়তে। আহিফা ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে বিদায় জানায়, ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বলে যা দেখে বুঝতে পারল না আশফি। শুধু আহিফার ছলছল করে তাকানোর নেত্রপল্লব তার হৃদয় ছন্নছাড়া করে দিতে লাগে। কি হয়েছে তার আহুর! বুঝতে পারছে না। শরীর দূর্বল হওয়ায় ঝড়ের বেগে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর সাধ্য নেই তার! যদি হতো তবে এক নিমিষে বুকের মাঝে আবদ্ধ থাকতো তার আহিফা।

কেবিনের বাহিরে এনে চট করে মেঝের মধ্যে ছুঁড়ে দেয় আহিফাকে। চাচীমার আকস্মিক ধাক্কায় চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম তার। মেয়েকে চোট পেতে দেখে মিসেস নাইফা এগিয়ে আসতে নিলে আদাফাত সাহেব থামিয়ে দেয়। সে কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে স্ত্রীকে ধরে রেখেছে। যার অর্থ যা হচ্ছে হতে দাও! দোষ আমাদের মেয়ের। মিসেস নাইফা করুণ চোখে স্বামীর কাছ থেকে ছুটে যেতে চাইল। তবে আদাফাত তাকে ধরে একস্থানে দাঁড়িয়ে রইল। মিসেস আনজুমা আহিফার গাল চেপে ধরে শান্ত গলায় তার বয়ান রাখে।

‘একদিন সময় আছে তোমার হাতে। যত তাড়াতাড়ি পারো ব্যাগবস্তা বেঁধে ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাও। তোমার জেএসসির সার্টিফিকেট, নবম-দশম শ্রেণির যে রেজিস্ট্রেশন দেশে হয়েছে তা ট্রান্সলেট এন্ড টিসির মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডে তোমার সুশিক্ষার ব্যবস্থা করে দেবে তোমার বাবা ও বড় চাচা। এসব কেনো জানো! আজ তোমার কারণে আমার ছেলের এমন হাল। কি করেনি বলো তোমার জন্য! ছোট থেকে তোমায় কতটা স্নেহ-আদর করেছে মনে আছে। তোমার শরীরে ছোট আঘাতও সে সহ্য করতে পারতো না। তোমার আঘাত সে নিজে পেয়ে যেতো বা পেয়ে নিতো। কিন্তু তুমি প্রতিবার তাকে জ্বালিয়ে আঘাত দিয়ে মজা পেতে। আমি মা হয়ে তার মরণ দেখতে পারব না। মা যেমন আগলে রাখতে জানে তেমন জীবন বাঁচাতে স্বার্থপরও হতে পারে।’

কথাগুলো বলে সে আহিফার গাল ছেড়ে দেয়। আদাফাত ও তার স্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে বলে,

‘মাফ করবেন ভাইয়া ও ভাবী। আহিফাকে নিয়ে যান বা পাঠিয়ে দেন। আপনারা থাকেন যেন আশফি ভাবে আহিফা স্বেচ্ছায় দূরে গিয়েছে।’

শেষের কথায় আহিফা উচ্চস্বরে গলা ফাটিয়ে কেঁদে দেয়। আদাফাত ও তার স্ত্রী মেয়ের নিকটস্থ হলে আরভীক সাহেব এসে তার স্ত্রী আনজুমাকে বলে,

‘তুমি কি সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছো না! অতীত যেমন আমাদের আছে তেমন বাচ্চাদের মাঝেও কেন গড়তে চাইছো। তারা সুখে থাকুক সেটাই তো আমরা চাই।’

মিসেস আনজুমা স্বামীর কথায় গলা চওড়া করে বলে,

‘আমি আশফির ক্ষতি চাইব না আরভীক। তুমি যদি আর একবার আহিফার হয়ে সাফাই দাও। মনে করবে আমি তোমার জীবনে নেই।’

স্ত্রীর শেষের কথায় আরভীক সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে সজোড়ে চড় লাগাতে গিয়েও লাগাল না। হাত নামিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে হতাশময় কণ্ঠে ব্যক্ত করে।

‘আনজুমা একটু বুঝো আহিফাকে না দেখলে আশফি পাগলাটে স্বভাবের হয়ে যাবে।’

‘না কোনো হবে না। তাকে উচ্চপদে যোগ্য ছেলে করে তবেই ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দেব।’

আরভীক সাহেব মুখ খুলতে গিয়েও খুলল না। কারণ আনজুমা এমুর্হুতে নিজের সত্তায় নেই। বুঝালেও সে বুঝবে না। আহিফা চাচীমার কথা শুনে ভাঙ্গা মন নিয়ে চলে যায়। তার বাবা-মাকে আশ্বস্ত গলায় মেডিক্যালে থাকতে বলে। রিকশায় বসে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয়। ভাবতে থাকে দূর্ঘটনার সময়টি।

দূর্ঘটনায় সময়…..

তিন কুড়ি সহজ কথা নয় ষাট কেজি ওজনের শরীর আহিফার। ইটের পাথর নিয়ে হঠাৎ থেমে যাওয়ায় অন্য পাথরে তার পা লেগে মুখ থুবড়ে যায়। রাস্তার এককোণায় পড়ার সহিতে সিমেন্টের ট্রাকটিও বেকায়দায় কোণা বেয়ে আসছে ছিল। আশফির দিকে সে শেষবারের মত তাকায়। কিন্তু আশফি সে সুযোগ দেয়নি। দৌড়ে এসে তাকে ঠেলে নিজে ট্রাকের চাকার সামনে এসে যায়। তবু সে নিজেকে ব্যালেন্স করে দ্রুত সরে যেতে নিয়ে ছিল। অন্যথায় সরে যেতে পারেনী ট্রাকটি এসে জোরালো ধাক্কা দেয় আশফিকে।
আকস্মিক রিকশা কাকার ডাকে বাস্তবে ফিরে আহিফা। চোখের জল মুছে কাকার হাতে একশ টাকার নোট ধরিয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। সেখানে পূর্ব থেকে অস্থিরচিত্তে অপেক্ষা করছিল নাঈম। বোনকে দেখে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘আপু তুমি কাঁদছো কেন ভাইয়া ঠিক আছে!’

আহিফা মাথা নেড়ে না বোঝায়। তার কারণে যে এক্সিডেন্টটা হয়েছে তা নাঈম বেশ বুঝতে পেরেছে। বিধেয় সে ঘটনাটি আওড়াচ্ছে না। বরং সাহস দিচ্ছে তার বোনকে। আহিফাকে ধরে সোফায় বসিয়ে একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। আহিফা একচুমুকে পুরু গ্লাস খালি করে দেয়। গলা থেকে তখনো ফুপাঁনোর শব্দ কমেনি তার। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
নাঈম ধীরস্থির গলায় পুরু ঘটনার প্রেক্ষাপট জানার আবেগতায় জিজ্ঞেস করে। আহিফা ফুঁপিয়ে পুরু ঘটনা শুনায়। এতে বেশ বুঝতে পেরেছে তার আপুর ফাজলামী, জ্বালানোর কারণে দূর্ঘটনাটি ঘটেছে। যার মূলে তাদের চাচীমা আনজুমা দায়ি করছে তার আহিফা আপুকে। সে শান্ত্বনার বাণী মুখে নেওয়ার পূর্বেই দেখে আহিফা ছুটে তার রুমে গেল। নাঈমও ভুলবশত কিছু করবে ভেবে দৌড়ে গিয়ে দেখে তার আপু পাগলের মত লাগেজ বাঁধছে। কাপড়চোপড় যা আছে সব খালি করে ফেলে আলমারি থেকে। দুইব্যাগ ভর্তি করে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নেয়। সেই সঙ্গে নিজের বিকাশ একাউন্টে তার বাবার পাঠানো টাকা কত আছে চেক করে নেয় আহিফা। টাকা ন্যায্য ধারের কাছে হওয়ায় সমস্যা হলো না তার। তার বাবা আদাফাত ইংল্যাণ্ডের টিকেট পূর্বেই বুক করে দিয়ে ছিল বিকেলের। এখন বিকেল হতে বেশি সময় নেই। সে আজকের মধ্যে ইংল্যাণ্ডে চলে যাবে। আর কখনো তার প্রণয়প্রেমিককে দেখা হবে না! এক ভুল চিরঞ্জীব বয়ে বেড়াতে হয়। আহিফার করা অবহেলা ও অভিমানে কোনো ভুল ছিল না! তবে তা তার প্রণয়প্রেমিককে বলার পূর্বেই দূর্ঘটনা ঘটে যাত। সে কখনো চাইনি প্রণয়প্রেমিকের ক্ষতি। নাঈমকে জড়িয়ে ধরে আদুরীয় গলায় বলে,

‘ভাই কখনো যদি ইংল্যাণ্ডে আসতে মন চাই আছিস। মম,ড্যাড তো আশফির কাছে থাকবে। তুইও বাসায় থেকে কি করবি মেডিক্যালে যাহ্। ড্রাইভার বাহিরে আছে আমি চলে যাচ্ছি।’

ভাইকে কোনোরুপ কথা বলতে না দিয়ে আহিফা চলে যায়। নাঈম হতাশার দৃঢ় শ্বাস ফেলল। তখন কল আসে তার ফোনে। ফোনটি কানে ধরে বলে,

‘হ্যা মম বলো।’

‘সোনা দেখ না তোর বোন কোথায়! আমার কল ধরছে না। ওকে থামতে বল আমরা আসতেছি।’

‘মম সে থামেনি চলে গেছে।’

‘কি বলিস বাবা!’
চিৎকার করে উঠে আদাফাতের কেবিনে থাকা অবস্থায়। আদাফাত সাহেব হাতে কিছু রোগীর ফাইল নিয়ে ঘাঁটছিল। স্ত্রীর আর্ত চিৎকার শুনে তার নিকট গিয়ে আতঙ্কভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘কি হয়েছে নাইফা!’

‘ওগো আমার মেয়েটা চলে গেল। আমার বুক শূন্য হয়ে গেল। এই ভরা দেশে আমি মেয়ে ছাড়া কেমনে থাকব গো। আমাকেও পাঠিয়ে দাও। আমি তার সঙ্গে থাকব।’

স্ত্রীর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলল আদাফাত সাহেব। তপ্ত শ্বাস ফেলে নাইফাকে বুকে জড়িয়ে চোখের অশ্রুবিসর্জন দিয়ে বলে,

‘একদিন সে ফিরে আসবে।’

কথাটি যেন তীরের মত আঘাত করল নাইফার বুকে। সে স্বামীর বুকে মুখ চেপে চিৎকার দিয়ে কেঁদে দেয়। আরভীক সাহেব এসে ছিল আদাফাতের কেবিনে জরুরি কথা বলতে। তবে গোপনে স্বামী-স্ত্রীর বলা কথা শুনে। নিরবে প্রস্থান করে। আনজুমার সামনে গিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,’সে চলে গেল এবার খুশি তুমি।’
স্বামীর বলা কথায় যেন অবাক সহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিসেস আনজুমা। সে অজানা ভাব নিয়ে বলে,

‘কে গেল না গেল তাতে আমার কি!’

আরভীক সাহেব অধৈর্য হয়ে আনজুমার বাহু চেপে ধরে বলে,

‘আর ইউ গোন ম্যাড! আমাদের ছেলে কৈশোরকাল থেকে আহিফাকে পছন্দ করে। মনে পড়ে সে দৃশ্যগুলো নাকি ভুলে খেয়ে ফেলেছো।’

মিসেস আনজুমা নিরর্থক। আরভীক এর হাত ছাড়িয়ে তার ফাহাদ ভাইয়ের বউ সাইবার সঙ্গে কথা বলতে এগোয়। ফাহাদের চার ছেলেমেয়ে প্রথম শ্রাবণী যে অনার্স কোর্স শেষ করবে, দ্বিতীয় জিসান অনার্সে ভর্তির পরীক্ষা দিবে, তৃতীয় কেয়া এইচএসসি কেন্ডিডেইটার ও চতুর্থ মিহান যে সবে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আনজুমা তার সন্তানদের গুণ সম্পর্কে পূর্ব অবগত। বিধেয় তারা সাবলীলভাবে কুশল আদায় করে। সায়াজ বউবাচ্চা নিয়ে নেপালে স্যাটেলেড, অঞ্জয় তার গ্রাম থেকে এখনো ফেরেনি। তবে জানা গেল সে নাকি দুই জমজ মেয়ের বাবা। দেখা যায়, অনেকে বাচ্চা তাড়াতাড়ি নিয়েছে আবার অনেকে সময় বিলম্ব করে নিচ্ছে বা নেবে। ফাহাদের পরিবার ভরপুর অথচ ফাহাদ কে দেখতে এখনো যুবক মনে হয়। অফিসারের বেশভূষায় আজও এক রকম। শুধু পদমর্যাদা পরিবর্তন হয়েছে।
স্ত্রীর উদগ্রীবতা যেন আরভীক সাহেবের মনে ভয়ের সৃষ্টি করছে। না জানে আশফির মধ্যে কিরুপ প্রভাব পড়ে আহিফার আকস্মিক চলে যাওয়ার কথা শুনে!
অথচ তারা কেউই অবগত নয় যে,একজোড়া চোখের অধিকারী বালক তার শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা পুরু ঘটনা শুনে ফেলেছে। ঘটনার সমাপ্তিতে তার দূর্বল চোখে ভেসে উঠে আহিফার মলিন মুখে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি। সে বালক অন্য কেউ নয় স্বয়ং আশফি। দূর্বল পায়ে দেওয়াল ধরে ধীরস্থিরভাবে বেডে এসে পুনরায় শুয়ে পড়ে। কাঙ্ক্ষিত সুখ পেয়েও হারিয়ে ফেলল। তবে সেও অধম নয়। চোখ বুজে বাঁকা হেসে বলে,

‘পালাও আহুপাখি! যত দূর পালাবে পালিয়ে যাও। বিনিসুতো কখনো ছিঁড়ে না। যদি কখনো কারো নীড়ে ভুলবশত আঁটকা পড়ো। তবেই আমি সেই সুতো টেনে হিচড়ে নিজের সুতোর সঙ্গে লাল দিঘি মিলিয়ে আকঁড়ে দেব। তখন তুমি চাও বা না চাও আই ডোন্ট কেয়ার।’

আট বছর পর….

‘আশফি বেবি তুমি আমাকে পাত্তা দাও না কেন!’

আশফি একপলক মেয়েটির দিকে চেয়ে বিরক্ত সহিত কণ্ঠে বলে,

‘ময়লার ড্রামকে বুঝি কেউ পাত্তা দেয়!’

তার কথা শুনে কলিগদের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। মেয়েটি তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,’আই হেইট ইউ’। আশফি শুনে ভাবলেশনহীন শব্দের টানে বলে,’প্রপোজ কবে করলাম যে তুমি হেইট ইউ বলে নিজের দাম বোঝাতে এসেছো হুম! গেট লস।’

শেষের দু’শব্দ বেশ রুক্ষ কণ্ঠে বলায় কলিগদের মধ্যে নিরবতা ছেয়ে যায়। মেয়েটি ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালায়। আশফি মাথায় হেলমেট পড়ে সিমেন্ট বাধায় করতে লাগে। উক্ত মেয়ে ছিল তার কলিগ। তবে এতে ভ্রুক্ষেপহীন সে।

‘দোস্ত তুই একজন সুদর্শন যুবক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার। আদেশ দেওয়া যেখানে তোর কাজ সেখানে তুই স্বেচ্ছায় অহংকার বিহীন কাজে হাত লাগাইস। তোর গুণের তারিফ নেই বন্ধু। কিন্তু তোর গার্লফ্রেন্ড নেই শুনলেই মনে হয় তুই মিথ্যা বলিস আমাদের সঙ্গে।’

‘গার্লফ্রেন্ড নেই’ কথাটি শুনে যেন আশফি সাত আসমান থেকে টপকে পড়ল। তার বন্ধু রোদ্দুরের দিকে আহাম্মকের মত চাই। হতবাক কণ্ঠে বলে,

‘কে বলল তোদের যে আমার গার্লফ্রেন্ড নেই!’

রোদ্দুর ঝাঁজপূর্ণ গলায় বলে,

‘একটু আগে ঐ হেইট ইউওয়ালী গেল। সেই বলছে তোর গার্লফ্রেন্ড নেই অথচ ভাব বেশি।’

ফিক করে হেসে দেয় আশফি। রোদ্দুরের কাঁধে হাত রেখে বাঁকা হেসে বলে,

‘আমার গার্লফ্রেন্ড নেই সঠিক কথা তবে বউ অবশ্য আছে।’

কথাটি বেশ উচ্চস্বরে বলায়। তার সঙ্গে থাকা কলিগগণ থ হয়ে যায়। তাদের চাহনী দেখে আশফি হাত উচিঁয়ে বিশতলা বিল্ডিংয়ের কাজরত স্থান থেকে উচ্চস্বরে তার হৃদয়ের অনুভূতি বয়ান করে।

‘আইম আশফি ফাওয়াজ মাই লাভহার্ট নেইম ইজ আহিফা। সি ইজ দ্যা অনলি ওয়ান হু ইজ মাই সোল পার্টনার।’

চলবে…….