প্রাণহন্ত্রী পর্ব-০২

0
288

প্রাণহন্ত্রী (২)
গ্রামের মাতব্বর ভিলায় বিচার চেপেছে। পুরো গ্রামে খবরটা যেন হৈ হুল্লর করে ছড়িয়েছে। কিংবা কেউ ইচ্ছে করে রটিয়েছে। দীপ্তির শরীরটা ভালো নেই খুব একটা। ভীষন অসুস্থ মেয়েটা। কয়েক দিন যাবত খাবারের প্রতি ভীষন অনিহা। এ দিকে মানুষের কটূক্তি যেন আরো ভেঙে দিয়েছে ওকে। স্কুলে গেলে ও মানুষ ইচ্ছে মতো কথা শোনায়। গ্রামের মানুষ থু থু ছিটায়। রাস্তার ধার ধরে হাঁটছিলো দীপ্তি। তখনি ঘটে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। কোথা থেকে যেন রহিজের চেলা জহির এসে ছু/ড়ি মে/রে দেয় দীপ্তিকে। চেঁচিয়ে উঠে রুমানা। পাশ থেকে দীপ্তি বলে ” কি হইছে আম্মা। ”

দীপ্তির গাঁয়ে হাত বুলাতে থাকে রুমানা। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে দীপ্তি। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ করেই এভাবে চেঁচানোর বিষয় টা ঠিক ঠাওর করতে পারে না ওহ। ধীর কন্ঠে বলে ” কি হইছে আম্মা। তুমি এমন করো কেন? আর এই অসময়েই কেন ঘুমাইলা। তুমি তো এখন ঘুমাও না। ”

” তুই ঠিক আছিস দীপ্তি? ”

” হ আম্মা। ”

বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নেয় রুমানা। দুঃস্বপ্ন হলে ও এখনো ভয়টা কাঁটে নি ওনার। রহিজকে বিশ্বাস নেই। বিচার চাপালে অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে। ধাক্কা পরতেই সচকিত হয় রুমানা। বলেন ” কিছু হয় নি রে। আসলে কাল সারা রাত ঘুমাই নি না। সকাল থেকেই কেমন ঝিমুনি হচ্ছিলো। কিন্তু কোনো ভাবেই দু চোখের পাতা এক করার সুযোগ হয় নি। তাই রান্না সেড়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ”

” সে তো বুঝলাম। তুমি তো কিছুই খাও নি। ”

” সন্ধ্যার আজান পরবে এখনি। নামাজ পরে খাবো। তুই পড়তে বস। ”

মাথা ঝাঁকায় দীপ্তি। মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে ও কিছু বলে না। অকারনে চিন্তা করার মানুষ নয় রুমানা। তবে কিসের জন্য এতো চিন্তা।

হ্যারিকেনে আলো নেই বললেই চলে। তেল ফুরিয়ে গেছে একদম। নিভু নিভু আলোতে পড়ছে দীপ্তি। আজকাল বিদ্যুৎ এর খরচ অনেক। বিল আটকে যাওয়ায় বিদ্যুত অফিস থেকে লাইন কেঁটে দিয়েছে। হাতে তখন একটা টাকা ও ছিলো না। তাই কোনো ভাবেই লাইন কাঁটা বন্ধ করতে পারেন নি। খাবার নিয়ে রুমানা পরেছেন দো টানায়। বহু শখ করেছে ট্যাংরা মাছের ঝাল রেধেছেন। দীপ্তির প্রিয় খাবারের একটি। দুপুরে পুকুর ঘাটে গোসল করার সময় খান পাঁচেক ট্যাংরা মাছ পেয়েছিলেন। ঘুমিয়ে পরাতে সন্ধ্যায় রান্না করেছেন। কিন্তু হ্যারিকেন এর নিভু আলো তে ভাত খাওয়া দুষ্কর হয়ে পরেছে। দীপ্তির পড়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে যে তা ও উপলব্ধি করেছেন রুমানা।

মেয়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন তিনি। হঠাৎ করেই মনে পরে বড় সড়কের মাথায় বিশাল বড় দুটো ল্যাম্পপোস্ট এর কথা। ছোট সময়ে পড়েছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ল্যাম্পপোস্ট এর আলোতে পড়াশোনা করে কতো জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাহলে দীপ্তি কেন পারবে না?

দীপ্তির হাত ধরে বেরিয়ে আসেন রুমানা। হ্যারিকেনের আলো থাকা না থাকা সমান কথা। চাঁদের আলো তে পথ দেখা যাচ্ছে। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে এগিয়ে যায় দুজনে। এখনো কিছুই বুঝতে পারে নি দীপ্তি। তাই বলে
” এই রাতের বেলায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আম্মা। ”

” গেলেই বুঝতে পারবি।”

” আমার অনেক পড়া বাকি। ”

” হ্যারিকেনের নিভু আলোতে পড়তে পারছিলি না তো। তাই তো পড়াশোনার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেই ব্যবস্থাই করছি। ”

” আম্মা কোথায় যাচ্ছো তুমি। ভালো লাগছে না আর।”

মৃদু হাসে রুমানা। মেয়ের এমন বিরক্তি মাখা মুখ বেশ উপভোগ করেন তিনি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রীরা বোধহয় এমনি হয়।পড়াশোনা তে একটু ব্যাঘাত ঘটলেই চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটিয়ে তুলে। পুরনো দিনের কথা মনে পরে যায় রুমানা। রঙিন কিছু স্বপ্ন হাতরে বেঁচে আছেন তিনি। বড় রাস্তার কাছে এসে ল্যাম্পপোস্ট এর আলো দেখে চমকায়িত হয় দীপ্তি। রুমানার দিকে তাকিয়ে বলে
” আম্মা। ”

” ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর পারলে তুই কেন পারবি না। এগিয়ে যাহ মা। ”

হাসি হাসি মুখে ছুটে যায় দীপ্তি।যেন কোনো প্রজাপতির সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা। পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যায় মেয়েটা। ল্যাম্পপোস্ট এর কাছে এসে বসে পরে। বই নিয়ে গভীর মনোযোগী হয়। পাশে বসেন রুমানা। ভাতের প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে ডিম ওয়ালা ট্যাংরা মাঝের ঝালের সাথে ভাত মাখায়। দীপ্তির মুখের সামনে খাবার তুলতেই গপগপ করে খেয়ে নেয়।
.

অনেক রাত অব্দি পড়াশোনা করে দীপ্তি। ল্যাম্পপোস্ট এর আলো তে এতো ভালো করে পড়াশোনা করতে পেরে ভীষন খুশি সে। পাশেই বসে আছেন রুমানা। বই গুছিয়ে দীপ্তি বলে ” ঘরে ফেরা যাক আম্মা। ”

” পড়া শেষ? ”

” হুমম। ”

” আচ্ছা চল। ”

দেশলাই দিয়ে হ্যারিকেনের আলো জ্বালায় রুমানা। গুটি গুটি পায়ে মা মেয়ে এগিয়ে যায়। সড়ক পেরিয়ে ধান ক্ষেতের কাছে আসতেই শুনতে পায় কিছু লোকের কথা বার্তা। সম্ভবত নেশা করে কোনো গোপন বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। কান পেতে শুনেন রুমানা। মায়ের সতর্কতা যেন আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে দীপ্তিকে। সে নিজে ও সচেতন হয়। শুনতে পায় মাতব্বরের বিরোধী দলের কথা। কেউ একজন বলছে ” এভাবে চলতে থাকলে আর হইবো না। এহনি যা করার করতে হইবো। সামনেই নির্বাচন।এবার মাতব্বর রে সরাইতেই হইবো। ”

” হ হ যদি না সরাই তে পারি তাহলে ভাই আমাগো কল্লা রাখবো না। ”

” হ ঠিক কইছোস। ঐ মন্টু ম/দের গ্লাস দে। সব ম/দ কি একাই খাবি নি। ”

দীপ্তিকে নিয়ে সরে আসেন রুমানা।অন্য পথ দিয়ে হাঁটা লাগায়। দীপ্তি বলে ” আম্মা। ওরা কি নিয়ে আলোচনা করছিলো। নির্বাচনে কি করবো আম্মা। ”

” কিছু না মা। এখন তাড়াতাড়ি পথ বাড়া, আমাগো বাসায় ফিরতে হইবো। ”

” কিন্তু আম্মা। ”

” কোনো কথা নয় দীপ্তি। ”

চুপ করে যায় দীপ্তি। হঠাৎ করেই মায়ের কঠোরতা যেন মেনে নিতে পারে না। থমথমে মুখে এগিয়ে যায় রুমানা। বি/ষাক্ত থাবা পরতে চলেছে। যাঁর হিং/স্রতা মাতব্বরের প্রাণ সং/শয় করে তুলবে।
.

সাঁঝ সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে দীপ্তি। রাত দিন পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন রুমানা। কড়াই এর নিচ থেকে একটু খানি কালি তুলে লাগিয়ে দেন দীপ্তির কানের পিঠে। ভ্যাগা কন্ঠে বলে উঠে দীপ্তি ” আম্মা এটা আমার পছন্দ নয়। ”

” একদম চুপ। কালো টিকা পরানোর একটাই কারন। যাতে আমার আম্মার দিকে কারো নজর না লাগে। এই যে আমার দীপ্তির চোখে মুখে কেমন দ্যুতি। এসব দেখে তো মানুষের হিং/সা হয়। ”

” তুমি ও না আম্মা। ”

” একটা কথা কি জানিস দীপ্তি তুই একদম আমার মতো হইছিস। তোর মায়ের ছিটে ফোঁটা নেই তোর মাঝে। ”

রুমানা কে জড়িয়ে ধরে দীপ্তি। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে
” তুমি ই আমার মা আম্মা। আমি জন্মের পর কয়দিন মায়ের ভালোবাসা পাইছি বলো তো। তুমি ই তো প্রথম থেকে আমারে বড় করেছো। ”

ভিজে চোখে দীপ্তি কে দেখেন রুমানা। আঁচলের কোনে চোখ মুছে বলেন ” গত দশ টা বছর তোর উপর অবহেলা করছি অনেক। হয়তো সৎ মায়েদের মতো তোর উপর কখনোই কোনো অত্যাচার করি নি তবে কখনো ভালোও তো বাসি নি। আমারে মাফ করে দিছ আম্মা। ”

” আম্মা! এমন কথা বলবা না তুমি। তুমি ই তো আমার আম্মা , আমার পৃথিবী তুমি। একটু আগেই তো বললা আমি তোমার মতো হইছি। তাহলে এখন কেন এমন বলতেছো। মেয়ের কাছে এমন করে কেউ? ”

কথা বলেন না রুমানা। সন্তপর্নে দীপ্তির কপালে চুমু খায় অনেক গুলো। অধর কোনে হাসি রেখে বলেন
” সাবধানে যাস। আর সাহস বাড়া মা , তোকে…”

থেমে যায় রুমানা। ভ্রু কুঁচকে ফেলে দীপ্তি। কিছু বলতে নিয়ে ও বলে না। চুপটি করে জড়িয়ে ধরে রুমানাকে। হাসি মুখে বলে ” আমি যাচ্ছি আম্মা। নিজের খেয়াল রেখো। ”

স্কুলে চলে যায় দীপ্তি। বুকের ভেতর ধক করে উঠে রুমানার। মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন তিনি। আজান পড়তেই লুটিয়ে পরে নামাজের পাটি তে। ওনার ভাবনায় একটাই কথা হঠাৎ করে এমন লাগছে কেন। দীপ্তির কোনো বিপদ হলো না তো?

স্কুলের কাছে এসে হঠাৎ করেই দীপ্তির মনে হলো ঝোঁপ থেকে কোনো আওয়াজ ভেসে আসছে। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। কেউ কি ওর পিছু নিচ্ছে? কৌতুলী মন টা আকুপাকু করছে। ফাঁকা ঢোক গিলে ঝোঁপের কাছে আসে ওহ। কিছু টা ঝুকতেই যে দৃশ্য দেখে তাঁতে ওর গা গুলিয়ে আসে। মাথায় র/ক্ত চরে যায়। হঠাৎ করেই যেন অশুরে শক্তি ভর করে ওর মাঝে। পাশে থাকা গাছের গুঁড়ি দিয়ে পর পর কয়েক বার আ/ঘা/ত করে লোকটাকে। নেশাক্ত অবস্থায় মন্টু নিজেকে সামাল দিতে পারে না। তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারায়। ছোট্ট শিশু বাচ্চার সাথে এমন অনৈতিক আচারণ যেন দীপ্তির আত্মা কে কাঁপিয়ে তুলেছে। শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। বাচ্চাটার বয়স বছর ছয়েক হবে। মুখে কাপড় বাঁধায় কোনো রকমের শব্দ করতে পারছে না। শুধু চোখ দিয়ে আসে নোনা জল। কিছুটা দূরে নিয়ে মুখের বাঁধন খুলে দেয় দীপ্তি। বাচ্চা মেয়েটি ভয় পেয়ে দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরে। বলে ” আপা ঐ লোকটা আমারে নিয়া আইছে। আমি বাসায় জামু। ”

” শান্ত হও তুমি। বাসা কোথায় তোমার? ”

” পাশের গ্রামে। ”

” তোমাকে কি করে নিয়ে আসলো? ”

” স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম আমি। রোজ আম্মা নিয়া যায়। অসুস্থ থাকায় আজ আহে নাই। নদীর ধার দিয়া যাওয়ার সময় ঐ লোক টারে দেহি। কি সব যেন খাইতেছিলো। ভয় পাইয়া যাই আমি। তখনি লোকটা আমার হাত খিচা ধরে। আর আমারে এইখানে নিয়া আসে। আমি বাসায় যামু। ”

ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নেয় দীপ্তি। অজানা ভয়ে বুক ভারী হয়। মন্টু কি দেখেছে ওকে?

পরমুহূর্তেই এক বুক সাহস জমিয়ে নেয়। কোনো অন্যায় তো করে নি ওহ। তাহলে কিসের ভয়?
ছোট্ট মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে যায় দীপ্তি। আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই।বরং সাবধানে বাচ্চা টাকে বাসায় পৌছে দিতে পারলেই শান্তি। একটা গভীর প্রশ্নে মত্ত হয় মেয়েটা। মানুষ রূপী জা/নো/য়ার গুলোর হিং/স্র থাবার থেকে মুক্তি কি কখনো মিলবে?

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ