প্রাণহন্ত্রী পর্ব-০১

0
603

#প্রাণহন্ত্রী
পর্ব-০১
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

” মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই আমার বিয়ে ঠিক হয়। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। জানি না আব্বা কেন রাজি হয়েছিলো। বোধহয় ধার দেনা বেড়ে যাওয়ায় পথ খুঁজে পায় নি আর। তাই বলে গ্রামের মাতব্বর সম্প্রদায়ের ডান হাত মাঝ বয়সী একটা লোকের সাথে? সেদিন আমি খুব কেঁদে ছিলাম। আব্বা যেন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো। বুঝতে পারছিলাম ভেতরে ভেতরে সে ও কষ্ট পাচ্ছে। আম্মা সেদিন আমার জন্য যা করেছিলেন আমি কখনোই ভুলবো না। কারো সৎ মা এমন ভাবে আগলে নিতে পারে আমি বুঝতে পারি নি। আম্মা কেন সেদিন এতো পরিবর্তন হয়েছিলো আমার জানা নেই। আজ একবছর হয়ে গেল। তবে সেদিনের পর থেকে আম্মা কখনো আমার উপর অন্যায় হতে দেন নি। ভাগ্য বোধহয় এটাকেই বলে। ”

” আচ্ছা।তোমার আব্বা কতো দিন হলো মা*রা গেছেন?”

” ছয় মাস। ”

” হুমম বুঝলাম। দীপ্তি আমি জানি না কতো টুকু সাহায্য করতে পারবো তোমায়। তবে আমি চেষ্টা করবো। ”

” ধন্যবাদ ম্যাম। ”

” আচ্ছা শোনো , তোমার জন্য একটা অফার আছে। যদি তুমি এস এস সি তে উপজেলা ভিত্তিক প্রথম হতে পারো তাহলে শহরে পড়ার জন্য সমস্ত খরচ একটা সংস্থা দিবে। আশা করি তুমি এই চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম ও ইচ্ছুক। ”

মিনতির কথাতে চোখ চকচক করে উঠে দীপ্তির। এতো বড় সুযোগ কিছুতেই মিস করা যাবে না। চোখ মুছে বলে ” ওকে ম্যাম। ইনশাআল্লাহ আমি পারবো।”

” সৃষ্টিকর্তা তোমার সহায় হোক। ”

” ধন্যবাদ। ”

অফিস থেকে বেরিয়ে আসে দীপ্তি। মিনতির সাথে দেখা করার একটাই উদ্দেশ্যে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ছোট্ট প্রতিবেদন তৈরি করা। কল্প কাহিনী কিংবা বাস্তব ভিত্তিক গল্প থেকে ম্যাগাজিনে সিলেকশন করে নেওয়া হবে। যাঁর প্রকাশে সাহিত্যচর্চাকে আরো বেশি উন্নত করবে বলেই মিনতির ধারনা। দীপ্তির জীবন ভিত্তিক গল্প শুনে মিনতির মনে ভীষণ মায়া হয়।ছোট্ট মেয়েটাকে সাহায্য করার ইচ্ছে জাগে। তাই দীপ্তির জন্য অফারটা রাখে। গেটের কাছে এসে রুমানাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে দীপ্তি। মেয়ের মাথায় হাত রেখে রুমানা বলেন ” কি হয়েছে তোর? ম্যাডাম কি বললেন। তোর দেওয়া কবিতা প্রকাশ হবে না। ”

” ম্যাডাম অনেক কিছু বলেছেন আম্মা। আমার কবিতা ও সিলেক্ট হয়েছে। তুমি জানো আম্মা ম্যাডাম বলেছেন এস এস সি তে আমি যদি উপজেলা ভিত্তিক প্রথম হতে পারি তাহলে আমার পড়ার খরচ একটা সংস্থা দিবে। ”

রুমানা অবাক হয়ে বলেন ” তুই সত্যি বলতাছোস? ”

” হ আম্মা। আমি একটা ও মিথ্যে বলতেছি না। ”

আঁচলে মুখ গুজেন রুমানা। দীপ্তির চোখে নোনা জলের ফোয়ারা। ডুকরে কেঁদে উঠে মা মেয়ে। দীপ্তির চোখে মুখে চুমু খেয়ে রুমানা বলেন ” তুই অনেক বড় অফিসার হবি মা। সমস্ত অন্যায় কে রুখে দিবি। আর আমি মঞ্চে দাঁড়ায় বলুম পুলিশ অফিসার দীপ্তি আমার মাইয়া। অরে এই দুই হাতে আগলে রাখছি আমি । আমার মাইয়া দীপ্তি। ”

” আম্মা। ”

চাঁপা কান্নায় ভেঙে পরে দুজনেই। রুমনার কাঁধে মুখ গুঁজে বলে ” হ আম্মা আমি তোমার মাইয়া। আমি তোমার ই মাইয়া। তুমি ই আমার মা। আমার আম্মা। ”

বাড়ি ফিরতেই চোখে পরে উঠানে মানুষ। বুকের ভেতর ছ্যঁত করে উঠে রুমানার। অজনা ভয়ে শরীর কাঁপে। খপ করে হাত ধরে দীপ্তির। বলে ” কোনো কথা বলবি না দীপ্তি। যা বলার আমি ই বলুম। তুই চুপ। ”

” কিন্তু আম্মা ওরা তোমারে আবার অপমান করবো। আমি চুপ করে থাকতে পারুম না। এবার আমি কথা বলবোই। ”

” একদম নয়। চার পাশের নোংরা বাতাস থাকবেই। আমাদের গাঁয়ে যেন না লাগে সেটাই দেখতে হবে। ”

থম মেরে যায় দীপ্তি। সুশ্রী মুখের অধিকারিনী মায়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। কে বলবে এই রূপসী নারী ই ওর সৎ মা। চোখে পানি চিক চিক করে উঠে। রুমানা আগে এমন ছিলেন না। হঠাৎ করেই কেমন করে যেন পরিবর্তন ঘটে যায়। মাকে জড়িয়ে দীপ্তি বলে
” তুমি অনেক ভালো আম্মা। ওরা খারাপ কথা বললে আমার খুব কষ্ট হয়। ”

” কিছু হবে না। আয় আমার সাথে। ”

রুমানার সাথে উঠানে প্রবেশ করে দীপ্তি। সঙ্গে সঙ্গে ঈগলের মতো লোলুপ দৃষ্টি পরে ওদের উপর। ভয়ে জড়োসড়ো হয় দীপ্তি। মেয়েকে আড়াল করেন রুমানা। চেঁচিয়ে বলেন ” কি হচ্ছে টা কি? আমার বাসাতে লোক সমাগম কেন? কি চাই আপনাদের। ”

পানের পিক ফেলে রহিজ। বসা থেকে উঠে এসে সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা থেকে পা অব্দি দেখে বলে ” ভর দুপুর বেলা কই থেকে আসলা রুমানা বেগম। যুবতি মাইয়া, সাথে তুমি ও যুবতি। এই সব কিন্তু ভালা না গো রুমানা সুন্দরী। ”

গাঁ ঘিন ঘিন করে উঠে রুমানার। একটু দূরেই হেসে যাচ্ছে রহিজের দুই চেলা। ইচ্ছে হচ্ছে মাথা নামিয়ে দিতে। আঁচল টেনে ধরে দীপ্তি। পেছন ফিরে রুমানা বলে ” একদম নয় আম্মা। স্কুলে পড়িস নি কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়ে তাই বলে কুকুর কে কামড়ানো মানুষের সোভায় পায়? ”

” রুমানা সুন্দরী। তোমার পাখা কিন্তু লম্বা হইছে। এতো ডানা ঝাপটা দিও না। ঘরের মাইয়ার কথা ভাইবা কথা কও। ”

” আমার বাসা থেকে এখনি বের হয়ে যান। আপনাদের মুখ দর্শন ও পাপ। বিচার চাপাতে বাধ্য করবেন না। ”

রাগে টগবগ করে রহিজ। রুমানার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলে ” আয় রে তোরা। সময় গেলে কপাল চাপড়াইবো। এই মহিলারে সুযোগ দিছিলাম।কোনো সুযোগ এর যোগ্য না হেতে।পরে দেখে নিমু। ”

বাসা থেকে বেরিয়ে যায় রহিজ ও তাঁর চেলারা। দীপ্তির হাত পা কাঁপছে বেশ। রুমানার শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে। রহিজের গলাটা নামাতে পারলে শান্তি মিলতো হৃদয়ে। আগের রূপ ধারন করতে চায় না সে। দীপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ” ভয় পাবি না মা। ঘরে আয় , রান্না চাপাতে হবে। ”

রুমানার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে দীপ্তি। সিক্ত নয়নে আম্মা বলে রুমানাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভেতর মোচর দিতেই রুমানার বোধগম্য হয় মেয়েটার শরীর গরম। দীপ্তি কে ঘরে নিয়ে যায় রুমানা। চৌকিতে গুটিয়ে রাখা মলিন বিছানায় শুইয়ে দেয়। পিছু ডাকে দীপ্তি। বলে ” আম্মা। ওরা খুব খারাপ আম্মা। তোমার দিকে বাজে দৃষ্টি দেয়। আমার খুব ভয় লাগছে আম্মা। আমার খুব ভয় লাগছে। ”

” ভয় পাবি না মা। আমি আছি তো। দুষ্টু কে বিনাস করাই প্রকৃত মানবের কাজ। তুই কেন ভয় পাস। আমি আছি তো তোর সাথে। ”

ছলছল নয়নে তাকায় দীপ্তি। নিজ কাজে ব্যস্ত হোন রুমানা। টিনের বালতি হাতে নিয়ে কলপাড়ে আসে। মনের ভেতর শান্তি নেই। রহিজের দৃষ্টি প্রচন্ড ঘৃন্য। নিজের জন্য ভয় না হলে ও দীপ্তির জন্য ভয় হচ্ছে। মেয়েটা একা একা স্কুলে যায়। তাঁর উপর এতো টাই ভীতু প্রকৃতির যে, যে কেউ কিছু বললে ও কিছু করতে পারবে না। মুখে বললে ও দু পা এগোনোর সাহস নেই দীপ্তির।

চৌকিতে শুইয়ে শুইয়ে ভাবছে দীপ্তি। চিন্তায় পাগল হওয়ার উপক্রম। নিজেকে কিছু তেই সাহস দিতে পারে না। ভেতর থেকে কেমন ভেঙে গুঁড়িয়ে আছে। মগ দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দেয় রুমানা। চুলের গোড়ায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ বুজে নেয় দীপ্তি। মায়ের হাত যেন একটা জান্নাতের ঘর। মায়ের হাতের পানি যেন অম্রিত তুল্য।

মাঝ রাতে হাড় কাঁপুনি দিয়ে এলো জ্বর। রুমানা বুঝতে পেরেছেন ভয়েই জ্বর এসেছে দীপ্তির। বেশ চিন্তায় পরে গেলেন ওনি। মেয়েটা এমন ভীতু প্রকৃতির হলে চলবে না।ভবিষ্যত ই বা কি হবে? অদ্ভুত সকল চিন্তা ভাবনায় জর্জরিত রুমানা। দীপ্তির মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। দাঁতে দাঁত লেগে যায় দীপ্তির। পানি এনে মাথায় পট্টি দেয় রুমানা। সারা রাত আম্মা আম্মা বলে গোঙালো মেয়েটা। পুরো রাত্রিটা যেন রুমানার গাঁয়ে কাঁটার মতো বিঁধে যায়। দীপ্তির চিন্তায় দু চোখের ঘুম উবে গেছে বহু পূর্বে। শেষ রাতের দিকে একটু চোখ লাগে ঠিক তখনি টিনের বেড়ায় আওয়াজ হয়। আচমকা আওয়াজ কানে যেতেই হতচকিয়ে যান রুমানা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যে দীপ্তি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে লাঠি বের করেন ওনি। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে আসেন দরজার কাছে। কান পেতে আওয়াজ শোনার চেষ্টা চালায়। ততক্ষনে দীপ্তির ঘুম ভেঙে গেছে। হালকা আর্তনাদ করে আম্মা বলে ডাকে দীপ্তি। ছুটে যায় রুমানা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ” কিছু হয় নি মা। তুই ঘুমা , একদম চিন্তা করিস না। ”

” আম্মা , আম্মা , আমারে রাইখা যাইয়ো না তুমি। মায়ের মতো তুমি ও চলে যাইয়ো না আম্মা। আমি তোমারে খুব ভালোবাসি আম্মা। খুব ভালোবাসি। ”

দীপ্তির কথায় চোখ ফেঁটে জল গড়ায়। ছোট করে চুমু খায় কপালে। টিনের বেড়ায় আওয়াজ হতেই ভাঙা গলায় বলে
” কে? ”

ঘরের বাহিরে থাকা ব্যক্তি সাবধান হয়ে যায়। বুঝতে পারে এখানে থেকে লাভ নেই। রুমানা শুনতে পায় ওপাশে থাকা ব্যক্তির পায়ের ধপ ধপ আওয়াজ। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। বিচার না চাপালে এরা মানুষ হবে না।

চলবে।