প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
381

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২৯+৩০+৩১
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
হোস্টেলে ফিরে শ্রাবণী বাথরুমে ঢুকে পড়লো। রুমে তিথি ওরা আছে। ওদের সামনে কাঁদতে লজ্জা লাগবে। বাথরুমে বসে কাঁদলো। এই সম্পর্কটা থেকে মুক্তি পেতে শ্রাবণীও তো অস্থির, মরিয়া হয়ে ওঠেছিল। প্রতিনিয়ত ছটফট করেছে। তবে আজ কেন মন কাঁদছে? এ প্রশ্নের উত্তর নেই শ্রাবণীর কাছে। জীবনে না পাওয়া আর দুঃখের পাল্লা দিন দিন ভারি হয়ে চলেছে সেই ভেবে বোধ হয় আজ আবেগ নাড়া দিয়েছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখে ওকে উদভ্রান্তের মতন লাগছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়। শ্রাবণীকে দেখেই তিথি চমকানো গলায় বলে,
–‘এই শ্রাবণী তোমায় অমন দেখাচ্ছে কেন? কেঁদেছো কেন?’

তিথি মেয়েটার গলার স্বর অসম্ভব মিষ্টি, রিনরিনে। কথা বলার ভঙ্গিও চমৎকার। বড্ড বাচ্চাসুলভ আচরণ। শ্রাবণী বলে,
–‘কেমন দেখাচ্ছে? না তো, কাঁদিনি।’

–‘মিথ্যে বলছো। তোমার চোখ ফুলে গেছে, লালচে দেখাচ্ছে। যা-ই বলো সুন্দরী মেয়েরা কাঁদলে অসম্ভব ভালো দেখায়। নাকের ডগা লালচে হয়ে যায়।’

বলেই হাসলো তিথি। হেসে আবার বলল,
–‘আমি তোমার মত অমন সুন্দরী হলে রোজ নিয়ম করে পাঁচবার কাঁদতাম। কেঁদে কেঁদে মুখ লাল করে আয়নায় নিজেকে দেখতাম। কান্না করার পর আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে দারুণ লাগে তাই না?’

এভাবে আগড়ম-বাগড়ম বকা তিথির খারাপ স্বভাব। মেয়েটা সহজ-সরল ধাঁচের। শ্রাবণীর ভালো লাগে। সেজন্য ওর এই অনর্থক কথাবার্তাও আগ্রহ নিয়ে শোনে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। শ্রাবণী বলে,
–‘তিথি আমার মন ভালো নেই। মন খারাপ হলে আমি একা থাকতে পছন্দ করি।’

তিথি চলে গেল। শ্রাবণী একা একা বসে রইল। সেলিম হোসেনকে জানানো দরকার পাবেল এসেছিল। শ্রাবণী ফোন করে জানালো তাকে। সব শুনে সেলিম হোসেন চুপ করে রইলেন। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর বলে,
–‘পাবেল তোকে বলেছে বাসায় থেকে পড়ার কথা?’

–‘বলেছে বাবা। কিন্তু আমি তার কথা বিশ্বাস করিনা।’

–‘একবার বিশ্বাস করে যেয়ে দেখতি।’

–‘না, বাবা। আমি আর বিশ্বাস করতে পারবো না।’

–‘ডিভোর্সের পর জীবনটা কিন্তু খুব বেশি কঠিন শ্রাবণী। মানুষ নানান রকম কটুক্তি করবে। অনেক লাঞ্ছনা, তিরস্কার, অপমান সহ্য করতে হবে।’

শ্রাবণী একটা নিঃশ্বাস ফেলে মলিন মুখে বলল,
–‘তুমি কি আমায় ও বাড়িতে যেতে বলছো আবার?’

–‘না, ও বাড়িতে যেতে বলছি না। একটা ডিভোর্সি মেয়েকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয় সেটা বললাম।’

–‘আমার ধৈর্য অনেক বাবা। সবই পারবো।’

শ্রাবণীর ফোনে চার্জ নেই। কথা বলার মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। ডিভোর্সের কথা যখন ওঠেছে, শ্রাবণী ভেবেছিল পরদিন আবার হয়ত পাবেল আসবে এই ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু পাবেল আসলো না। জয়নাল সাহেব ডিভোর্সের পক্ষে না। তার কথা হলো, থাকুক শ্রাবণী হোস্টেলে। দেখি এভাবে কত দিন চলে। তাছাড়া দশ লাখ টাকার কাবিন। দশ লাখ টাকা কি এখানের কথা?

পনেরো দিন কাটে। এর ভিতর পাবেল আর আসেনি। এই পনেরো দিনে শ্রাবণী নিজেকে প্রায় স্বাভাবিক করে তুলেছে। রাত জেগে লেখাপড়া করছে। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছে। রুমের সবার সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ক্লাসেও দুই-চারটা বান্ধবী হয়েছে। আজ তিথির জন্মদিন। তিথি সবাইকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াবে। শ্রাবণীর যেতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু তিথি একদম নাছোড়বান্দা। হোস্টেলে ওঠার পর শ্রাবণী একদিন শুধু বাইরে বের হয়েছিল যেদিন পাবেল এসেছিল। এরপর আর বাইরে বের হওয়া হয়নি। বন্দি, নিয়মমাফিক একটা জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে। বিকাল বেলা তিথির সাথে বের হয়। শ্রাবণী, তিথি সাথে আরো দুজন। মারিয়া, হিয়া। কলেজ থেকে একটু দূরেই একটা রেস্টুরেন্ট। পায়ে হেঁটে গেলে পাঁচ-সাত মিনিট লাগে। বিকেল হয়ে গেছে। তবুও রোদের তেজ কমেনি এখনো। কড়া রোদ। ওরা রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটছে। একটা ছেলে ওদের ফলো করা শুরু করেছে। ওদের একটু পিছনেই হাঁটছে। হিয়া ভীষণ নির্ভীক। ও হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে ঘুরে তাকায় পিছনে। অকপটে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে,
–‘আমাদের ভিতর কাকে ভালো লেগেছে আপনার?’

ছেলেটাও বোধ হয় হিয়ার মতন। সেও কোনো ভনিতা না করে শ্রাবণীকে দেখিয়ে দেয়। শ্রাবণী চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। হিয়া বলে,
–‘তো এখন কি আপনি আমাদের পিছনে পিছনে যাবেন?’

–‘জি যাবো।’

–‘আমরা রেস্টুরেন্টে যাবো। আপনিও কি আমাদের সাথে রেস্টুরেন্টে যাবেন?’

–‘হ্যাঁ যাবো। আমার পকেটে যথেষ্ট টাকা আছে। আপনারা চাইলে আমি আপনাদের খাবার বিলও দিবো।’

শ্রাবণী চাপা গলায় হিয়াকে বলল,
–‘হিয়া ছাড়ো তো এসব। উদ্ভট লোক একদম।’

–‘উদ্ভট না। ভীষণ সাহসী। আমার বেশ ভালো লেগেছে।’

তিথি বলল,
–‘তোমার ভালো লাগলে হবে না তো হিয়া। লোকটা শ্রাবণীকে পছন্দ করেছে।’

–‘ভালোলাগা মানেই প্রেমে পড়া না তিথি।’

হিয়া শেষমেশ ছেলেটাকে ওদের পিছনে আসতে শক্ত গলায় নিষেধ করে দিলো। ছেলেটাও আসলো না। কিন্তু রেস্টুরেন্টের সামনে যেতেই দেখলো সেই ছেলেটা হাজির। ওদের দেখে হেসে বলল,
–‘রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছি। আপনাদের পিছনে পিছনে আসিনি। রেস্টুরেন্টে যে কেউই খেতে আসতে পারে।’

ছেলেটা ওদের আগেই টুপ করে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে। এ কোন উটকো ঝামেলা আবার! শ্রাবণী ভ্রু কুঁচকে রেস্টুরেন্টে ঢুকে। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই চমকে যায়। রেস্টুরেন্টের ডান দিকের একদম প্রথম টেবিলটায়ই পাবেল বসা। চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। শ্রাবণী দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। ওদের পিছনে পিছনে যে ছেলেটা এসেছিল সেও পাবেলের সাথে বসা। হিয়া, তিথি গিয়ে পাবেল যে টেবিলে বসেছে তার পরের টেবিলেই বসলো। অগত্যা শ্রাবণীকেও সেখানে বসতো হলো। ওরা কেউই জানে না শ্রাবণী বিবাহিত। বিষয়টা যে শ্রাবণী লুকিয়ে রেখেছে তাও না। বলার মত প্রসঙ্গ আসেনি তাই বলা হয়নি। শ্রাবণীর এখন সামান্য চিন্তা হচ্ছে ওদের পিছনে আসা সেই উদ্ভট লোকটা কি কাণ্ড করে বসে! আবার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পাবেলের সাথেও দেখা হয়ে গেল। মানুষটা ওর স্বামী। তবুও কতশত দূরত্ব। পাবেল শ্রাবণীর দিকে বেশ কয়েকবার তাকালো। তিথি খাবার অর্ডার করেছে। খাবার আসতে একটু সময় লাগবে‌। ওরা অপেক্ষা করছে। পাবেল ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল,
–‘রবি তুই তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছিস? ঢাকা এসেছিস কবে?’

–‘হ্যাঁ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছি। ঢাকা এসেছি দিন দশেক হলো।’

–‘তো কোন মেয়ের পিছনে পিছনে রেস্টুরেন্টে এসেছিস?’

–‘পিছনের টেবিলে মেরুন রঙের হিজাব পরা মেয়েটা।’

মেরুন রঙের হিজাব শ্রাবণী পরেছে। পাবেল হো হো করে হেসে ওঠল। হাসি থামিয়ে বললো,
–‘তা কতদিন ধরে চিনিস? কথা হয়েছে মেয়েটার সাথে? নাম জানিস?’

–‘সেদিন আমার ছোট বোনকে নিয়ে কলেজে গিয়েছিলাম তখন দেখেছি। কলেজ হোস্টেলে থাকে। কথা হয়নি। নামও জানি না। আজ রাস্তায় বসে কথা বলার চেষ্টা করলাম, তা পাত্তাই দিলো না।’

পাবেল রবির কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে হাসতে হাসতে বলল,
–‘আচ্ছা চেষ্টা চালিয়ে যা। প্রেম হলে জানাস।’

রবি অনুরোধ রাখে,
–‘আপনি একটু সাহায্য করেন ভাই। আপনি একটু হুমকি দিলেই ভয় পেয়ে রাজি হয়ে যাবে। আপনাকে তো সবাই ভয়…।’

–‘গলায় ছুরিও ঠেকিয়েছি তাও ভয় পায়নি আর হুমকি।’

–‘মানে?’

পাবেল টেবিল ছেড়ে ওঠতে ওঠতে বলে,
–‘মানে কিছু না। আমার বিলটা দিয়ে দিস। ওদের টাও দিবি। শুধু পিছনে পিছনে ঘুরলেই হবে না। খরচাদিও করতে হবে।’

রবির পকেট পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল তার। ওর সত্যি সত্যি বিল দিতে হলো। এত টাকা একসাথে শেষ কবে খরচা করেছে মনে নেই। পাবেল রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে শ্রাবণীর ফোনে ম্যাসেজ করল,
‘আমি রেস্টুরেন্টের ডান দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে দেখা করে যেয়ো। দেখা না করে গেলে হোস্টেল থেকে তুলে নিয়ে আসবো আর একা এসো।’

কেন ডেকেছে পাবেল? ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু বলবে? শ্রাবণী ভালো করেই চিনে পাবেলকে। ও যদি দেখা না করে যায় তাহলে সত্যি সত্যি হোস্টেলে গিয়ে ঝামেলা করবে। শ্রাবণী ঝামেলা বাড়াতে চাইলো না। ও তিথি ওদের কাছে বলে একাই গেল। রবি ছেলেটা এখনো ওকে ফলো করছে। কি অদ্ভুত! পাবেল রবিকে ডেকে বলল,
–‘এখনো তুই ঘুরঘুর করছিস? মেয়েটা বিরক্ত হচ্ছে। পেছন ছাড়।’

রবি চলে গেল। পাবেল শ্রাবণীকে নিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–‘রবি আমার বন্ধুর ছোট ভাই। আমায় খুব ভয় পায়, সমীহ করে চলে।’

–‘কেন ডেকেছেন? আমার একটু দ্রুত ফিরতে হবে।’

–‘না ফিরলে কি হবে?’

শ্রাবণী কিছু বলল না। পাবেল বলল,
–‘রবিকে বলে দিও তুমি বিবাহিতা।’

–‘সেটা আপনি বললেন না কেন? আর আমি কি বলবো সেটা আমার ব্যাপার। ডিভোর্সের কথা বলে তারপর একদম লাপাত্তা আপনি। সম্পর্কটাকে শুধু শুধু বাদুরের মত ঝুলিয়ে রেখে ক্লান্ত করছেন কেন?’

পাবেল ডিভোর্সের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলে,
–‘ঈর্ষা এক অদ্ভুত জিনিস শ্রাবণী। রবি ছেলেটা তোমায় পছন্দ করে; ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না, ঈর্ষা হচ্ছে।’

পাবেল থেমে আবার বলে,
–‘আজকাল আমি বোধ হয় তোমায় মিস করছি।’

–‘আমার দেরি হয়ে গেল।’

–‘আমি তোমায় পৌঁছে দিবো। নতুন বাইক কিনেছি।’

–‘কাছেই আছে। আমি হেঁটে যেতে পারবো।’

পাবেল এক প্রকার জোর করে শ্রাবণীকে বাইকে উঠালো। শ্রাবণীর এই দূরে চলে আসা পাবেলকে সত্যি কি শূণ্যতা অনুভব করাচ্ছে? সত্যি কিনা মিথ্যা সে নিয়ে শ্রাবণী ভাবে না। ও নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ; ভাববে না আর পাবেলকে নিয়ে।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩০)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_______________________
পাবেল বেপোরোয়া গতিতে বাইক চালাচ্ছে। ছোটবেলায় একবার বাইক থেকে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছিল শ্রাবণী। সেই থেকে আর বাইকে ওঠেনি। ওর মনে হচ্ছে আজ আবার বাইক থেকে উল্টে পড়ে পিচঢালা রাস্তায় পিষে যাবে। এই লোক বোধ হয় ওকে মেরে ফেলার জন্যই জোর করে বাইকে উঠিয়েছে। তারপর দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিবে। শ্রাবণী ভীতু গলায় বলে,
–‘আস্তে চালান। আমি পড়ে যাবো।’

শ্রাবণীর কথা বোধ হয় পাবেলের কর্ণপাত হলো না। সে গতি আরো বাড়ায়। সঙ্গে শ্রাবণীর ভয়ও বাড়ে। শ্রাবণী এবার প্রায় চিৎকার করে বলল,
–‘বাইক থামান বলছি। আমি নেমে যাবো। আপনি কি আমায় বাইক থেকে ফেলে মারতে চাচ্ছেন?’

–‘না, আমি তোমায় মারতে চাচ্ছি না। কিন্তু তুমি যেভাবে বসেছো তাতে আমি না চাইলেও পড়ে যাবে। আমায় শক্ত করে ধরে বসো। পড়বে না।’

শ্রাবণী জড়সড় হয়ে বসেছে। ও ধরবে না পাবেলকে। পাবেলের গায়েও গা লাগতে দিবে না। শ্রাবণী বলে,
–‘আপনার এই ঢং, আহ্লাদ আমার ভালো লাগছে না।‌ আমি আপনায় ধরে বসবো না। আপনি বাইক থামান। আমি এইটুকু রাস্তা হেঁটে যেতে পারবো।’

–‘আমার ঢং, আহ্লাদ করতে ভালো লাগছে। থামাবো না বাইক। এভাবেই চলবে।’

–‘আশ্চর্য আপনি এরকম জোর করছেন কেন আমায়?’

পাবেল কিছু বলল না। বাইকের ব্রেক কষলো হঠাৎ। শ্রাবণী পাবেলের গায়ের দিকে ঢলে পড়লো। গোধূলি লগ্ন। সূর্য হেলে পড়ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। শ্রাবণী আশেপাশে তাকায়। কলেজ ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছে। ও বিমূঢ় হয়ে বলে,
–‘এটা কোন জায়গা? কলেজ তো এখানে না।’

পাবেল বাইকের গতি বাড়িয়ে উত্তর দেয়,
–‘হ্যাঁ কলেজ এখানে না।’

শ্রাবণী বিচলিত হয়ে বলে,
–‘তো আপনি আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? আরে আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, আমার হোস্টেলে ফিরতে হবে।’

–‘লং ড্রাইভে যাবো তোমায় নিয়ে।’

শ্রাবণী বিহ্বল হয়ে রয় কিছুক্ষণ। বলে,
–‘আমায় হোস্টেল থেকে একদম বের করে দিবে। দয়া করে আমায় কলেজে দিয়ে আসুন। নয়ত বাইক থামান। আমি একা যেতে পারবো।’

–‘আমি হোস্টেলের ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিবো।’

শ্রাবণী পাবেলের সাথে লং ড্রাইভে যেতে নারাজ। পাবেল রেগে বলল,
–‘বলেছি তো হোস্টেলে কোনো সমস্যা হবে না।‌ তবুও তুমি এমন করছো কেন? বাইক থামাবো না। নামতে হলে চলন্ত বাইক থেকে লাফিয়ে নামো।’

শ্রাবণীর গলায় দ্বিগুণ রাগ,
–‘আপনি কেন এমন করছেন? আমি যাবো না আপনার সাথে লং ড্রাইভে। লং ড্রাইভে যাওয়ার মতন সম্পর্ক আপনার সাথে আমার আছে? আপনি আর আপনার পরিবার প্রতিনিয়ত আমার সাথে অন্যায় করেছেন, অত্যাচার করেছেন, অপমান-অপদস্থ করেছেন। আমি কিচ্ছু ভুলিনি। ওসব আমার জীবনে বিষাক্ত, যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি। কখনো ভুলতেও পারবো না। আপনার উপর আমার অনেক ঘৃণা। আপনি কি ভেবেছেন আপনার এই দুই-একটা মিষ্টি কথায় আমি গলে যাবো? আপনি আপনার মর্জিমাফিক আমায় ব্যবহার করবেন? এই ভালো, এই মন্দ।’

শ্রাবণীর এই কঠিন কথাগুলোয়ও যেন পাবেলের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে উল্টো রসিকতা করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,
–‘গলতে হবে না মিষ্টি কথায়। এভাবে রাগ করেই থাকো। রাগ করলে তোমায় ভালোলাগে।’

–‘আমি আপনার সাথে ইয়ার্কি করছি না। আপনি বাইক না থামালে আমি সত্যি ঝাঁপ দিবো।’

–‘পারবে না তুমি ঝাঁপ দিতে।’

সত্যিই ও ঝাঁপ দিতে পারবে না। ঝাঁপ দিলেই নিশ্চিত মৃত্যু। এই সামান্য কারণে মরতে যাবে কেন? পাবেল কিছুক্ষণ পর ব্যঙ্গ করে বলে,
–‘কি হলো শ্রাবণী। দিয়েছো ঝাঁপ?’

রাগে শ্রাবণীর গা জ্বলে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারদিকে আঁধার নামছে। রাস্তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট গুলো জ্বলে ওঠছে। শ্রাবণীর মেজাজ তিক্ত হচ্ছে ক্রমশ। পাবেল নাছোড়বান্দা। সে লং ড্রাইভে যাওয়ার কথা বলেছে তো যাবেই। প্রয়োজন হলে শ্রাবণীকে গাড়ির সাথে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে। শ্রাবণী কিংকত্র্তব্যবিমূঢ়। পাবেলের কি মনে হচ্ছে না সে শ্রাবণীর উপর অধিকারচর্চা করছে? ও হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করে,
–‘আপনার লং ড্রাইভ শেষ হবে কখন?’

–‘ষোলো-সতেরো বছর বয়সী মেয়েরা নাকি রোমান্টিক হয় শ্রাবণী। তুমি এমন কেন? সময়টা উপভোগ করো।’

–‘আপনার সাথে কয়েক মাস সংসার করে এরকম হয়ে গেছি। আপনার উপস্থিতিই এখন আমার জন্য বিরক্তি; উপভোগ তো দূর।’

শ্রাবণী একটা দম ফেলে আবার বলে,
–‘রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক।’

–‘আটটা বাজে কেবল। আমি প্রায়ই রাতের বেলা এভাবে বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। কখনো কখনো ঢাকার বাইরেও চলে যাই। ঢাকার রাস্তায় যা জ্যাম। আজ তোমায় পেলাম তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।’

–‘আপনি কি আজও ঢাকার বাইরে যাবেন?’

–‘হ্যাঁ।’

শ্রাবণী প্রচণ্ড হতাশ‌। ও রাগে বিড়বিড় করতে লাগলো,
–‘আপনার সাথে দেখা হওয়াটাই আমার দূর্ভাগ্য ছিলো । সব দোষ ওই তিথিটার। আজ ওর জন্মদিন না হলে আমায় এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো না।’

তারায় তারায় ঝকঝকে আকাশটা মেঘে ছেয়ে যায় হঠাৎ। বিদ্যুৎ চমকায়। ঝড় আসবে। জোরালো বাতাস বইছে। শ্রাবণী বিরক্ত মুখে বলে,
–‘বৃষ্টি শুরু হবে। এখন কি করবেন? বৃষ্টির ভিতরেও আপনার লং ড্রাইভ চলবে?’

–‘মেয়েরা নাকি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ..।’

–‘আমি পছন্দ করি না। আমার পছন্দ নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার। এবার আমায় হোস্টেলে দিয়ে আসুন।’

–‘এত রাতে হোস্টেলে?’

–‘আপনিই তো বললেন ম্যানেজ করে দিবেন।’

–‘এখন বাসায় চলো। কাল সকালে যেয়ো।’

শ্রাবণী শক্ত গলায় বলে,
–‘আমি কিছুতেই যাবো না বাসায়। আর আপনি এত আদিখেত্যা শুধু শুধু কেন দেখাচ্ছেন?’

–‘বাসায় আটকে রাখবো না তোমায়।’

–‘আপনাদের দ্বারা আটকে রাখাও অসম্ভব না।’

বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। পাবেল বৃষ্টির ভিতরই বাসার দিকে ছুটে। দুজনেই ভিজে চুপচুপে। বৃষ্টি সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস। শ্রাবণী শীতে কাঁপছে। বাসায় পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যায়। শ্রাবণীর ইচ্ছে করছে না বাড়ির ভিতরে ঢুকতে। এবাড়িটার দিকে তাকালেই ওর যন্ত্রণাময় একটা অনুভূতি হয়। পাবেল পিছন ফিরে বলে,
–‘কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

শ্রাবণী পাবেলের পিছনে পিছনে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডোরবেল বাজায় পাবেল। বাসার একটা ডুপ্লিকেট চাবিও ওর কাছে ছিলো। কিন্তু এই মুহুর্তে নেই। বাসার কেউ জেগে নেই। জয়নাল সাহেব আর ফরিদা বেগম এগারোটার মধ্যেই শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ বেল বাজানোর পর কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। মেয়েটার নাম আসমা। বয়স দশ-এখানো। এবাসায়ই থাকে। ওকে বলা আছে রাতে পাবেল আসলে দরজা খুলতে। শ্রাবণী কাজের মেয়েটাকে দেখে তাচ্ছিল্য করে পাবেলকে বলে,
–‘আমি হোস্টেলে যাওয়ার পর কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে? তাহলে এবাড়িতে কাজের মেয়ের রিপ্লেসমেন্ট আমি ছিলাম?’

পাবেল কিছু না বলে রুমের দিকে যায়। শ্রাবণীও যায়। বাসায় এসেই যখন পড়েছে আর কি করার। শীতে শরীর কাঁপছে। থ্রিপিস সব হোস্টেলে নিয়ে গেছে।‌ বাসায় কেবল শাড়ি গুলো রেখে গেছে। ও আলমারি থেকে একটা শাড়ি নামিয়ে পরে। গায়ে একটা চাদর চাপায়। পাবেলও শার্ট, প্যান্ট বদলিয়ে নেয়। হঠাৎ রুমের বাইরে ফরিদা বেগমের গলার আওয়াজ যায়। তিনি সদ্য ঘুম ভাঙা গলায় পাবেলকে ডেকে‌ বললেন,
–‘তোকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বললাম। নিত্য এত রাতে ঘুম থেকে ওঠে তোকে খাবার দিতে হয়। আর খাবার আমাকেই দিতে হবে। আসমা দিলে কি সমস্যা বুঝিনা।’

শ্রাবণী কাপড় বদলে খাটে বসেছে কেবল। ফরিদা বেগমের আওয়াজ পেয়ে পাবেল রুম থেকে বের হয়ে বলে,
–‘তুমি শুয়ে পড়ো আম্মু। শ্রাবণী এসেছে। ও খাবার দিবে।’

ফরিদা বেগম পরম আশ্চর্যে চোখ কপালে তুলে তাকায়। মনে হয় তিনি ঘুম চোখে ভুল কিছু শুনেছেন। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
–‘কে এসেছে?’

–‘শ্রাবণী।’

ফরিদা বেগম অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেন,
–‘শ্রাবণী।’

এরপর আবার বলেন,
–‘শ্রাবণী এসেছে মানে?’

তিনি পাবেলকে ঠেলে রুমে ঢোকে। সত্যি সত্যি শ্রাবণীকে দেখে তার চোখমুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। পাবেলের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলে,
–‘তুই ওকে এবাড়িতে ফের কেন এনেছিস? ও কেন এসেছে এবাড়িতে?’

ফরিদা বেগমের আচরণে শ্রাবণী নিজের রাগ চাপিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। এবাড়িতে থাকাকালীন অনেক সহ্য করেছে তাকে। এখন কেন মুখ বুজে থাকবে? শ্রাবণী শান্ত গলায় বলে,
–‘ফের আপনাদের বাড়িতে আসার ইচ্ছে আমারও ছিলো না। আপনাদের মত মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে থাকার রুচি আমারও নেই। আপনার ছেলে আমায় জোর করে কেন এনেছে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করুন।’

শ্রাবণীর শান্ত গলায় চাপা রাগের ফুলকি। ওর মুখে এমন কথা শুনে ফরিদা বেগম তেড়ে আসেন। যেন চড় মেরে বসবেন শ্রাবণীর গালে। পাবেল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘বেশি কথা বলো না শ্রাবণী।’

–‘আপনার মা আমায় শুধু শুধু অপমান কেন করছে? আমি কি আসতে চেয়েছি?’

পাবেল ফরিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘আম্মু ও আসতে চায়নি। আমি ওকে জোর করে এনেছি। কাল সকালে আবার চলে যাবে।’

ফরিদা বেগম বিস্মিত ভঙ্গিতে,
–‘পাবেল তোর মাথা কি গেছে? তুই এই মেয়ের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিস?’

ঝগড়াঝাঁটিতে জয়নাল সাহেবের ঘুম ভাঙে। তিনি বিছানা ছেড়ে ওঠেন। সব শুনে ফরিদা বেগমকে বলে,
–‘পাবেল যদি শ্রাবণীকে জোর করে এনে থাকে তো সমস্যা কোথায়? ও যদি সব ছেড়েছুড়ে শ্রাবণীকে নিয়ে স্বাভাবিক একটা জীবন যাপন করতে চায় তাহলে অন্তত আমি দুশ্চিন্তামুক্ত হবো।’

ফরিদা বেগম ক্রোধ নিয়ে বলে,
–‘শ্রাবণী যদি লেখাপড়া ছেড়ে আসতে পারে তো আসবে।’

শ্রাবণী এতক্ষণ নীরব ছিলো। চুপচাপ সব শুনেছে। এবার ও ফরিদা বেগমের মুখের উপর বলে ওঠল,
–‘আমি লেখাপড়া ছাড়বো না, এবাড়িতেও আসবো না।’

ফরিদা বেগম জয়নাল সাহেবের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,
–‘এইটুকু মেয়ে কিভাবে বেয়াদবের মত মুখে মুখে কথা বলছে দেখো। আর তোমরা একে লাই দিচ্ছো?’

এই বলে ফরিদা বেগম রুমে থেকে বের হয়ে গেল। জয়নাল সাহেব শ্রাবণীকে দুই-চারটা ধমক দিয়ে তিনিও চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে পাবেলের দিকে। পাবেল বলে,
–‘মায়ের মুখে মুখে কথা না বললেই তো হতো। মা’কে তো আমি বলেছি, আমি তোমাকে জোর করে এনেছি।’

–‘আমি অনেক সহ্য করেছি আপনাদের। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়েছি। এখন আপনি আবার আমায় জোরজবরদস্তি করে বাসায় এনেছেন। আবার শুরু হলো হাউকাউ। আর কত সহ্য করবো আমি?’

শ্রাবণী একটু থেমে বলে,
–‘আপনি আমায় বাসায় কেন এনেছেন?’

–‘বলেছি তো আমি তোমায় মিস করছি।’

–‘কোনো মেয়ের প্রতিই আপনার অনুভূতি তো দীর্ঘ স্থায়ী হয় না‌। নিত্য নতুন মেয়ে, মদ গাঁজায় চুবে থাকা জীবনেই আপনার শান্তি। আজ মিস করেছেন, কাল আবার ভুলে যাবেন। এরকম একজন মানুষের সাথে জীবন কাটানোর ভুত আমার মাথা থেকে নেমে গেছে। এসব আদিখেত্যা দেখিয়ে লাভ নেই।’

পাবেল অবাক গলায় বলে,
–‘তুমি মুনিম আর আমার কথা শুনেছো?’

শ্রাবণী কিছু বলল না। পাবেল আবার বলল,
–‘এ কয়দিন সত্যি আমি তোমায় মিস করেছি।’

এবারও শ্রাবণী কিছু বলল না। দুইজনই থেমে থাকলো। অনেকক্ষণ পর পাবেল বলল,
–‘অনেক রাত হয়েছে। চলো খেয়ে আসি।’

–‘আমি খাবো না।’
পাবেল অনেকবার সাধলো। শ্রাবণী রাগ ধরে বসে থাকে। পাবেল একাই খেয়ে নিলো। শ্রাবণী কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। ঠাণ্ডা লেগে গেছে। শরীরও হালকা গরম লাগছে। জ্বর আসবে বোধ হয়। ক্লান্তও লাগছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পাবেল আসে। শ্রাবণীর গা ঘেঁষে শোয়। শ্রাবণী দূরে সরে গেল,
–‘কাছে আসবেন না আমার। গায়ে জ্বর এসেছে। শরীর খারাপ লাগছে। আপনি এই মতলবে বাসায় এনেছেন আমায়?’

পাবেল যেন কিছু বুঝলো না। বলল,
–‘কোন মতলবে? আচ্ছা খুব বেশি কাছে যাবো না। তোমায় জড়িয়ে ধরে রাখি শুধু?’

শ্রাবণী কঠিন গলায় বলল,
–‘না।’

এই বলে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে কাজের মেয়েটার ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে ওঠে দেখে পাবেল বিছানায় নেই। বেলাও অনেক হয়েছে। জয়নাল সাহেব নিজেই শ্রাবণীকে নাস্তার টেবিলে ডাকলো। যত যা-ই হোক জয়নাল সাহেবের ডাক উপেক্ষা করা যায় না। শ্রাবণী গেল। পাবেলও সেখানে। জয়নাল সাহেব বললেন,
–‘তোমার আর হোস্টেলে যেতে হবে না। এখানেই থাকো।’

–‘না, আমি থাকবো না এখানে।’

জয়নাল সাহেব রেগে গেলেন। তিনি শ্রাবণীকে বলল,
–‘আজকাল তোমার আর তোমার বাপের এত তেজ কোত্থেকে আসছে? এই বাড়ির চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখবো তোমায়। দেখি কিভাবে হোস্টেলে যাও তুমি। কে এসে তোমায় এখান থেকে নেয়।’

(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩১)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
জয়নাল সাহেবের কথা শুনে শ্রাবণী স্তম্ভিত। চমকিত চোখে তাকিয়ে রইল। এই বাড়ির চার দেয়ালে মধ্যে ওকে বন্দি করে রাখা জয়নাল সাহেবের জন্য নিতান্তই সহজ ব্যাপার- একথাটা শ্রাবণী বেশ ভালো করেই জানে। কিন্তু এরকম জঘন্য কুৎসিত একটা কাজ তারা করবে তা ও একেবারেই ভাবেনি। জয়নাল সাহেব নাস্তার টেবিল ছেড়ে ওঠতে ওঠতে বললেন,
–‘বাসা থেকে এক পা ও বের হবে না। পাখা গজিয়েছে! পিপীলিকার পাখা গজায় মরার জন্য। পাবেল তোমায় হোস্টেল থেকে আনতে গিয়েছিল। তুমি বাসায় থেকেই পড়ো- এটা বলার পরও আসোনি।’

জয়নাল সাহেব একটু থামলেন। তার রাগ বাড়ছে ক্রমশ। তিনি আবার বললেন,
–‘বিয়ে হয়েছে। সংসার করবে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখো বিয়ের পর কয়টা মেয়ে পড়ে? আবার বাড়ি থেকে সবার অমতে বের হয়ে হোস্টেলে গিয়ে ওঠেছো। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে। তার কি দুঃসাহস! ফরিদা, দারোয়ানকে বলে দেও ওকে যেন বাইরে বের হতে না দেয়। এতদিন ভালো ভাবে বলেছি। ভালো কথায় কাজ হয়নি।’

ফরিদা বেগমের মন মতন হয়েছে। তার মুখাবয়ব দেখে তাই মনে হচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দারোয়ানকে বলল শ্রাবণীকে যেন বাসা থেকে বের হতে না দেওয়া হয়। শ্রাবণী এখনো নাস্তার টেবিলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। পাবেলও সেখানে উপস্থিত। পুরো সময় জুড়ে সে একটি কথাও বলল না। জয়নাল সাহেব নিজের রুমে চলে গেলেন। এরপর একে একে সবাই চলে গেল। পাবেলও। পুরো বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। শ্রাবণীও পাবেলের পিছনে পিছনে গেল। চোখেমুখে তীব্র ক্ষোভ। রুমে ঢুকে দেখে পাবেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট গায়ে দিচ্ছে। বেরুবে এখন। আয়নায় শ্রাবণীর প্রতিবিম্ব দেখে পিছনে ফিরে তাকায়।

–‘আমায় আটকে রাখার জন্য এনেছেন? কি জঘন্য কুৎসিত আপনারা।’

ধীর, শান্ত গলায় কথাগুলো বলল শ্রাবণী। কোনো রকম চিৎকার, চেঁচামেচি করছে না। হিমেল হাওয়ায় দোল খাওয়া দিঘির জলের মতন ঠোঁট দুটো কেবল কাঁপছে রাগে। পাবেল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,
–‘বাড়িতে থেকে পড়ো। সমস্যা কোথায়? হোস্টেলে যাওয়ার জন্য এত মরিয়া হয়ে ওঠেছো কেন? যথারীতি বাড়াবাড়ি করে ফেলছো‌ এখন। আর তোমায় বাড়িতে নিয়ে আসার পিছনে আমার কোনো উদ্দেশ্যে ছিলো না। তুমিই মুখে মুখে তর্ক করে বাবার রাগ বাড়িয়েছো।’

–‘কথার জবাব দেওয়াটা কি তর্ক? আপনারা যদি ভর্তি হওয়া নিয়ে ঝামেলা না করতেন তাহলে তো আমি বাড়ি থেকে বের হতাম না।’

–‘হ্যাঁ, ঝামেলা করেছি। মানছি। কিন্তু এখন তো ঝামেলা নেই।’

–‘লেখাপড়া যখন বাপের টাকায় করতে হচ্ছে তখন এবাড়িতে থাকবো কেন? আর আপনাদের ঝামেলা কখনো শেষ হবে না। হোস্টেল ছেড়ে বাসায় আসলেই আবার নতুন করে সব শুরু হবে। আপনার মা কাজের মেয়েটা বিদায় করে দিবে বাসায় আসার সাথে সাথেই। তারপর আমার সকাল, দুপুর, রাত রান্নাঘরেই কাটাবো।’

–‘লেখাপড়ার খরচ আমরা দিলে এবাড়িতে থাকবে?’

শ্রাবণী চুপ।‌ পাবেল বলল,
–‘কথা বলছো না কেন?’

–‘না। তাও থাকবো না। আপনাদের আগাগোড়া চেনা হয়ে গেছে আমার।’

পাবেল এবার বিদ্রুপ করে হেসে বলল,
–‘এই অতিরিক্ত কথার জন্যই বাবা রেগেছে। বয়সের তুলনায় আসলে বেশি বুঝো তুমি।‌ আমাদের আগাগোড়া চিনে ফেলেছো? ষোলো-সতেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে এত বুঝতে পারে তোমায় না দেখলে জানতাম না। তোমায় চার দেয়ালের ভিতরই আটকে রাখা উচিত। ভালো ব্যবহারের মর্ম বুঝো না।’

এই বলে পাবেল রুম থেকে বের হয়ে গেল। দরজাটা বিকট শব্দে আটকালো। বাইরে থেকে লক করে দিলো। শ্রাবণী স্তম্ভিত। ওকে রুমে আটকে রেখে গেছে পাবেল! ভিতর থেকে হাত দিয়ে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করলো। কেউ দরজা খুললো না।

দুপুরে আসমা এসে খাবার দিয়ে গেল। শ্রাবণীর চোখ লাল হয়ে আছে। কষ্ট না রাগ হচ্ছে ওর। রাগে কেঁদেছে। খাবার যেখানে রেখে গেছে সেখানেই পড়ে রইলো। আসমা দরজা খুলে রেখে গেছে। তাতে অবশ্য লাভ নেই। দারোয়ান বের হতে দিবে না। পাবেল বাসায় ফিরেছে দুপুরের পর। প্রায় বিকাল তখন। শ্রাবণীকে সকালে যেভাবে রুমে বসে থাকতে দেখেছে এখনো সেভাবেই আছে। পাবেল বলল,
–‘এখনো আছো তুমি? আমি তো ভেবেছি দরজা-জানালা ভেঙে পালিয়েছো।’

শ্রাবণী ক্রোধপূর্ণ চোখে তাকায়। পাবেল কৌতুকভরা গলায় বলল,
–‘ওভাবে তাকিয়ো না। ভয় পাই।’

পাবেল ওর সাথে মজা করছে? একটা মানুষকে আটকে রাখার মত বিচ্ছিরি কাজ করেছে তা কি ভুলে গেছে? শ্রাবণী কিছু বলল না। পাবেল বলল,
–‘রাঙামাটি যাচ্ছি তিন দিনের জন্য। যাবে তুমি? চাইলে যেতে পারো।’

–‘আমায় কি এভাবেই আটকে রাখবেন?’

–‘তুমিই তো বেশি জেদ করছো। আমি হোস্টেল থেকে তোমার বইখাতা সব নিয়ে আসি। এখানে থেকেই পড়ো। তুমি সবেমাত্র কলেজে পড়ছো। লেখাপড়া শেষ হতে হতে আট-নয় বছর লেগে যাবে। ততদিনে আমার বয়স কত হয়ে যাবে হিসেব করে দেখো? তুমি যদি এভাবে হোস্টেলে থেকেই লেখাপড়া শেষ করো তাহলে আমার জীবন যৌবন সব শেষ হয়ে যাবে।’

পাবেল ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগ গুছিয়ে শাওয়ার নিলো। শ্রাবণী কাতর মুখে বসে আছে। পাবেল বলল,
–‘এরকম গোমড়া মুখে বসে থাকতে হবে না। চলো হোস্টেলে দিয়ে আসি। বলেছি তো, মিস করছি তোমায়। আর খারাপ আচরণ করবো না। এবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবুও তুমি…। কাউকে তো ধরে বেঁধে বন্দি করে রাখা সম্ভব না। তুমি আমায় বিশ্বাসই করতে পারছো না।’

শ্রাবণী বিস্মিত চোখে তাকায়। সত্যি পাবেল ওকে হোস্টেলে দিয়ে আসবে? ও তাকিয়ে আছে পাবেলের দিকে একদৃষ্টিতে। পাবেলের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। যে মানুষটা বার বার বিশ্বাস ভাঙে তাকে বিশ্বাস করে কিভাবে? পাবেল ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘বসে আছো কেন? যাবে না তুমি? আমার বের হতে হবে তাড়াতাড়ি।’

শ্রাবণী সন্দিহান ভাবে বলল,
–‘আপনি সত্যি বলছেন?’

–‘হ্যাঁ সত্যি। তুমি দূরে চলে যেতেই আমি তোমার অভাব বোধ করতে লাগলাম। কথায় বলে না? দূরত্ব বাড়লে গুরুত্ব বাড়ে। এসব আমি এখন যতই বলি। তুমি বিশ্বাস করবে না। অবশ্য এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস না করাই স্বাভাবিক।’

শ্রাবণী অতি আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। বলল,
–‘কারো প্রতিই তো আপনার অনুভূতি দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। আপনার এই গুরুত্ব, অভাব বোধ কতদিন থাকে কে জানে।’

–‘জানতে হবে না। রেডি হও। বের হবো।’

–‘আপনার বাবা-মা কিছু বলবে না?’

–‘আমার বাবা-মায়ের কথা কি তুমি পরোয়া করো? তোমার সাহস আছে মানতে হবে। প্রথমে তো আমি তোমায় বোকাসোকা ভেবেছিলাম।’

শ্রাবণী শাড়ি বদলিয়ে থ্রিপিস পরে নেয়। যেটা পরে কাল হোস্টেল থেকে বের হয়েছিল। শাড়ি পরে কি হোস্টেলে যাওয়া যায়? পাবেলের সাথে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় জয়নাল সাহেব আর ফরিদা বেগম দুজনের সামনে পড়লো। কেউই কিছু বলল না। পাবেল তাহলে আগেই তাদের বলেছে। শ্রাবণী বড়োসড়ো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পাবেলের আচরণেও সামান্য খুশি হলো। খুব বেশি খুশি হতে পারলো না। পাবেল যতই আবেগ, অনুভূতির কথা বলুক তাকে এত সহজে বিশ্বাস করা একদমই যায় না।

বাসার গেট থেকে বের হওয়ার পর পাবেল বলল,
–‘শ্রাবণী তুমি রাঙ্গামাটি যেতে চাইলে কিন্তু যেতে পারো। রাঙ্গামাটি গিয়েছো কখনো?’

–‘উঁহু, যাইনি।’

–‘তাহলে চলো। মেঘের শহর সাজেক নিয়ে যাবো। পাহাড়ের উপরে বসে জ্যোৎস্না দেখাবো।’

শ্রাবণী এক পলক তাকালো পাবেলের মুখের দিকে। তাকাতেই পাবেলের চোখে চোখ পড়ে গেল। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। হঠাৎ অদ্ভুত এক অস্বস্তি ভর করল শ্রাবণীর মনে। পাহাড়ের উপর বসে জ্যোৎস্না দেখা অতি চমৎকার একটা ব্যাপার। জ্যোৎস্না দেখাতে নিয়ে পাহাড় থেকে ফেলেও দিতে পারবে এই লোক। শ্রাবণী মাথায় এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা আসছে। পাবেল বলল,
–‘যাবে না তাহলে তুমি?’

–‘না।’

–‘জোর করে নিয়ে যাই যদি?’

শ্রাবণী আতঙ্কিক দৃষ্টিতে তাকায়। পাবেল হালকা হেসে বলল,
–‘ভয় পেয়ো না। জোর করবো না।’

ফুটপাত ধরে হাঁটছে ওরা। পাবেল আগে হাঁটছে, শ্রাবণী সামান্য পিছনে। শেষ বিকাল। থেকে থেকে নিস্তেজ রোদ চোখ মেলছে। কয়েক মুহূর্ত পর আবার মিইয়ে যাচ্ছে। পাবেল রাঙামাটি যাবে তাই গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। দশ-পনেরো জন মিলে যাবে এক সাথে। কলেজের কাছাকাছি এসে পাবেল বলল,
–‘আমি যাচ্ছি তাহলে। হোস্টেল সুপারকে বলা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।’

–‘কি বলেছেন তাকে?’

–‘বলেছি তুমি আমার বউ। এখন তুমি হোস্টেলের দুই-চারটা ইট খুলে ফেললেও তিনি কিছু বলবেন না।’

পাবেল চলে গেল। শ্রাবণী কিছুক্ষণ সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। বড়ো অদ্ভুত! পাবেলও পিছনে ফিরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণী মুখ ঘুরিয়ে নিলো। জটিল এক ধাঁধায় আটকে গেছে ও। পাবেল এবার সত্যি অনুভব করছে ওকে? মেয়েদের সঙ্গ ছেড়েছে? নাকি সেসব দিব্যি চলছে? শ্রাবণী জানতে ইচ্ছে করে।
________________
এই সেলিম হোসেনের মাথায় বা হঠাৎ কি ভুত চেপেছে কে জানে। শ্রাবণীর সাইন্সে পড়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বাপের আর্থিকের কথা ভেবে সেই ইচ্ছা চুলোয় জ্বালিয়ে বলল, আর্টসে পড়বে। তখন ওর কাছে পড়তে পারাটাই বড়ো ব্যাপার ছিলো। কিন্তু ওকে চমকে দিয়ে সেলিম হোসেন জোর গলায় বললেন, তুই সাইন্সেই ভর্তি হ। তোর মাথা ভালো, ভালো কিছু করতে পারছি। শ্রাবণী বলছিল, বাবা সাইন্সে পড়লে অনেক খরচা যাবে। লোকটা ম্যাজিশিয়ানের মতন রহস্যময় ভাবে বললেন, আমি ম্যানেজ করবো। এমন ভঙ্গিতে বলল মনে হলো জাদু দিয়ে টাকাটুকা বানিয়ে ফেলবে। শ্রাবণীর সাথের প্রায় সবাই প্রাইভেট পড়া শুরু করেছে। কিন্তু শ্রাবণীর এখন সেলিম হোসেনের কাছে প্রাইভেটের কথা বলতেও সংকোচ হচ্ছে। বাসায় গিয়েছে সেই কবে। ওর যেতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ। সেখানে যাওয়া মানেই ঝামেলার সৃষ্টি। নিজের ইচ্ছা চাপা দিলো। এর ভিতর একদিন সেলিম হোসেন আসলেন। শ্রাবণীকে কিছু খাবারদাবার কিনে দিয়ে গেল। প্রাইভেটও পড়তে বললো। শ্রাবণী দুই সাবজেক্ট পড়া শুরু করলো। সকালে আর বিকালে। বিকালেরটা কলেজের বাইরে গিয়ে পড়তে হয়। একদিন বিকালে পড়া শেষে হোস্টেলে ফিরে দেখে পাবেল অপেক্ষা করছে ওর জন্য। শ্রাবণী সামান্য অবাক হলো। পাবেল বলল,
–‘চলো একটু কলেজের বাইরে বের হই।’

–‘একটু পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আর কাল আমার পরীক্ষা আছে প্রাইভেটে। পড়তে বসতে হবে।’

–‘পড়তে তো সন্ধ্যার পরও বসতে পারবে। সমস্যা কি তোমার? সবকিছুতে না, না করো। ঝামেলা করবো এখানে বসে?’

শ্রাবণী বিরক্ত মুখে তাকিয়ে থাকে। একটু পর পাবেল কি যেন ভেবে বলল,
–‘আচ্ছা বের হতে হবে না। পড়তে বসো। তোমার জন্য রাঙ্গামাটি থেকে একটা শাড়ি এনেছিলাম। এই নেও।’

পাবেল শ্রাবণীর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো। শ্রাবণী ধরলো। তারপর জিজ্ঞেস করল,
–‘আপনার গার্লফ্রেন্ডদের জন্য কি এনেছেন?’

–‘অসংখ্য গার্লফ্রেন্ড আমার। বেকার মানুষ। অত জনকে দেওয়া সম্ভব না। বউ তো একটাই। সেজন্যই বউয়ের জন্য এনেছি।’

কথাটা বলেই হাসলো পাবেল। পাবেলের মেয়েদের নিয়ে মেতে থাকা। মদ গাঁজায় ডুবে থাকা। সব জানে শ্রাবণী। সব জেনেও নির্বিক ও। ওসব নিয়ে খারাপলাগা তো দূর এখন ভাবেও না। কি আশ্চর্য! পাবেল চলে গেল।
(চলবে)