প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
463

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
সেলিম হোসেন শুয়ে আছেন। তার নিস্তেজ শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে। মুখখানা ফ্যাকাশে, রুগ্ন দেখাচ্ছে। ক্লান্ত, দুর্বল চাহনি‌। কয়েকদিন যাবৎ ভীষণ অসুস্থ তিনি। ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতেও পারছেন না। বিছানায় পড়ে আছেন। তবুও এবার আর ডাক্তার দেখালেন না। তার ধারণা তিনি বাঁচবেন না। ডাক্তার দেখিয়ে শুধু শুধু টাকা নষ্ট। পারভীন বেগম একটু তফাতেই চিন্তিত মুখে বসে আছে। সেলিম হোসেন ক্ষীণ গলায় ডেকে বললেন,
–‘পারভীন, আমার ফোনটা একটু দেও তো।’

পারভীন বেগম সামান্য অবাক হয়। লোকটা ঠিকঠাক ভাবে কথা বলতে পারছেন না। এ অবস্থায় ফোন দিয়ে কি করবেন?

–‘কি করবেন ফোন দিয়ে?’

সেলিম হোসেন অস্ফুট ভাবে বললেন,
–‘দেও। দরকার আছে।’

পারভীন বেগম চেয়ার ছেড়ে ওঠে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে সেলিম হোসেনের কাছে দেয়। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে শ্রাবণীর নম্বরটা খোঁজে। ফোনে শ্রাবণীর নম্বর নেই। কি আশ্চর্য ব্যাপার। পারভীন বেগম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
–‘কি করছেন আপনি? কি দেখছেন ফোনে?’

–‘শ্রাবণীর ফোন নম্বর নেই কেন পারভীন?’

পারভীন বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে ছোঁ মেরে সেলিম হোসেনের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে চিৎকার করে বললেন,
–‘শ্রাবণীর নম্বর দিয়ে কি করবেন? ওকে কেন ফোন করবেন? সারাক্ষণ শ্রাবণী, শ্রাবণী বলে মুখে ব্যথা করে ফেলছেন। সে জামাই নিয়ে শান্তিতে আছে। নিজ থেকে আমাদের খোঁজ নেয়? আমাদের দুই টাকা দিয়ে সহায়তা করে?’

সেলিম হোসেনের প্রত্যুত্তর করার শক্তি নেই। সে চোখ বুজে রইলেন। পারভীন বেগম থামলেন না,
–‘এই যে বিছানায় পড়ে আছেন। শ্রাবণী এসে কি করবে? চিকিৎসার খরচ দিবে আপনার? ওর মা তো স্বামী রেখে ভেগেছে অন্য পুরুষের সঙ্গে। দুশ্চরিত্রা মহিলা। ওকে ছোটবেলা থেকে তো আমিই সব অশান্তি ভোগ করে পেলেপুষে, খাইয়ে-দাইয়ে বড় করেছি । টাকাওয়ালা জামাই ধরে বিয়ে দিছি। এখন ছয় মাসে একদিন ফোন দেয় আমার কাছে? পেয়েছে মায়ের স্বভাব। নষ্ট কোথাকার।’

সেলিম হোসেন সব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। তিনি মনে মনে আওড়ালেন,
–‘ফোন দিয়ে কথা বলার মত সম্পর্ক তুমি রেখেছো পারভীন? তুমি অশান্তি ভোগ করোনি, ওকে তুমি অশান্তি ভোগ করিয়েছো।’

অনেকক্ষণ ধরে চেঁচামেচি করে পারভীন বেগম রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। খাটের পাশের টেবিলটার কাছে নীলা আর তুহিন চুপচাপ বসে আছে। সেলিম হোসেন নীলাকে বলল,
–‘টেবিলের উপর রাখা কালো ডায়েরিটায় শ্রাবণীর ফোন নম্বর আছে। নম্বরটা মোবাইলে টুকে দে তো। তোর মা যেন টের না পায়।’

তুহিন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখছে পারভীন বেগম আসছে কি-না। নীলা দ্রুত নম্বরটা টুকে দেয়। সেলিম হোসেন শ্রাবণীর নম্বরে ডায়েল করলেন। মোবাইলে টাকা নেই। কল গেল না। তিনি খানিক হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দিলেন। শ্রাবণীকে কিছু কথা বলা দরকার, ভীষণ দরকার। মরার আগে কথা গুলো বলা উচিত। শ্রাবণীর জন্য কিছু টাকাও রেখেছেন। টাকা গুলো দেওয়ার সুযোগ কি হবে? সেলিম হোসেন ফিসফিস করে তুহিনকে বললেন,
–‘আমার শার্টের পকেট থেকে বিশটা টাকা নিয়ে ফোনে রিচার্জ করে দে তো তুহিন। এই মোড়ের দোকানটায়-ই রিচার্জ করে। তোর মা যেন না দেখে।’

তুহিন পা টিপে টিপে বের হয় বাসা থেকে। এখন যদি পারভীন বেগমের সামনে পড়ে তো নির্ঘাত কয়েক ঘা খেতে হবে। তাকে ভীষণ ভয় পায় ওরা দুই ভাই-বোনে। এমনকি পারভীন বেগমের ভয়ে শ্রাবণীর কথা মুখে আনে না। কিন্তু শ্রাবণীকে ওরা ভালোবাসে, পছন্দ করে খুব।

সেলিম হোসেনের শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। তুহিন শ্রাবণীর কাছে ফোন করলো,
–‘আপা, আব্বা খুব অসুস্থ। তোমায় এখনই আসতে বলেছে। তুমি কি আসতে পারবে?’

শ্রাবণী ঘুমিয়েছিলো। তুহিনের ফোনে ঘুম ভাঙলো। ও এক লাফ দিয়ে ওঠে বসে। গত কয়েকদিন ধরে অনেক বার ফোন করেছে সেলিম হোসেনের কাছে। কিন্তু ফোন ধরেনি। শ্রাবণীর দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। হঠাৎ করে সেলিম হোসেন ফোন ধরছেন না কেন? এর ভিতর শ্রাবণী একবার মনস্থিরও করেছিলো বাসায় যাবে। কিন্তু যাওয়া হয়নি। সেলিম হোসেন বিছানায় পড়ে আছে। সে আর ফোনের খোঁজ কীভাবে রাখবে? ফোন ছিলো পারভীন বেগমের কাছে। তিনি ইচ্ছে করেই শ্রাবণীর কল ধরেননি। শ্রাবণী অস্থির গলায় তুহিনকে জিজ্ঞেস করল,
–‘কবে থেকে অসুস্থ? কি হয়েছে?’

–‘সেই আগের অসুখই। কয়েকদিন ধরে অসুস্থ।’

–‘ডাক্তার দেখিয়েছে? বাবা কোথায় হাসপাতালে?’

–‘বাসায়। তুমি এসে পরো। রাখি। মা আসছে। তোমার সাথে কথা বলতে দেখলে রাগ করবেন।’

তুহিন দ্রুত ফোন রেখে দিলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। একটু পরেই মাগরিবের আজান দিবে। শ্রাবণী তড়াক করে বিছানা ছেড়ে ওঠে। কী করবে? কীভাবে যাবে এখন বাসায়? সন্ধ্যায় কোনো বাস আছে? শ্রাবণীর জানা নেই। বাসস্ট্যান্ড গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। একা যাবে না-কি পাবেলকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? দ্বিধায় পড়লো। ঝটপট বেরুতে হবে। শেষমেষ পাবেলকেই ফোন দিলো। শ্রাবণীর ফোন পেয়ে অফিস ফেলে চলে আসলো।

–‘বাসস্ট্যান্ড গিয়ে দেখেন তো। সন্ধ্যায় কোনো বাস আছে কি-না।’

উৎকণ্ঠাপূর্ণ কণ্ঠ শ্রাবণীর। পাবেল বলল,
–‘পাগল হয়ে গেছো না-কি? আমারই তো গাড়ি আছে। বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে কেন?’

শ্রাবণী বোকা বোকা মুখে বলে,
–‘তাইতো। আমার মাথা কাজ করছে না। দ্রুত চলেন।’

ওদের যেতে যেতে প্রায় সাড়ে নয়টা বাজলো। পুরো বাসা অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি নেই বোধ হয়। কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রাবণী দরজায় কড়া নাড়লো। পারভীন বেগম দরজা না খুলে বলল,
–‘কে?’

এই সময়ে তো কারো আসার কথা না।‌ শ্রাবণী বলল,
–‘মা আমি শ্রাবণী। দরজা খুলুন।’

পারভীন বেগম মোম হাতে এসে দরজা খোলে। বাসায় ঢুকতেই সেলিম হোসেনের কাতরানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভীষণ ক্ষীণ আওয়াজ। শ্রাবণী সোজা সেলিম হোসেনের কাছে গেলেন। তার মাথার কাছে বসলেন। পাবেল ওপাশের রুমে বসে আছে। সেলিম হোসেন শ্রাবণীর সাথে একা কথা বলতে চেয়েছে। পারভীন বেগমের মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। ঢং যত। সেলিম হোসেন আধশোয়া অবস্থায় আছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। তিনি হাঁপানো স্বরেই বলতে শুরু করলেন,
–‘আমি তোকে মিথ্যা বলেছিলাম। আমি ছোটখাটো একটা কাজ ধরেছিলাম। তবে বেতন ছিলো অল্প। ও দিয়ে তো ঠিকঠাক সংসারই চলে না; তোদের লেখাপড়ার খরচ দেওয়া তো দূর।’

শ্রাবণী আহত গলায় বলল,
–‘রাখো বাবা এসব কথা। আগে সুস্থ হও। তারপর বলো।’

–‘গলা সমান ধারদেনা তখন। পাওনাদাররা পথেঘাটে অপমান করে। লজ্জায় আমি বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেই। কিন্তু রেহাই পেলাম না। রোজ নিয়ম করে সকাল-সন্ধ্যা বাসায় এসে চিৎকার, চেঁচামেচি করতে থাকে। বাজার সদাই করার টাকাটাও ছিলো না। নীলা, তুহিনের স্কুল, প্রাইভেটের বেতনও দিতে পারছিলাম না। ওদের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছিলো।’

–‘বাবা তোমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। এখন এসব কথা বলার কি দরকার বলো তো?’

–‘দরকার আছে। আমরা ভাই-বোন অনেক। বাবার সামান্য জায়গা সম্পত্তি ছিলো। সবাই ভাগের ভাগ অল্প জমি পেয়েছিলাম। আমার জমি তো তুই জন্মের আগেই বিক্রি করে দিয়েছি। এছাড়া সবার জমিই আছে। ধারদেনা, অভাব-অনটন, এত অপমান সহ্য করতে পারছিলাম না। শেষে উপায়ান্তর না পেয়ে যাইফের মায়ের কাছে হাত পাতলাম। বললাম, আপা আমায় কিছু টাকা দেন। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। সেদিন তিনি আমায় ভীষণ চমকে দিয়ে বললেন, ‘আব্বার যে জমিটুকু আমি পেয়েছি ওটুকু তুই বিক্রি করে দে। কাউকে জানাতে হবে না। শ্রাবণীও শ্বশুর বাড়িতে অশান্তিতে আছে। ওকে তারা কলেজে ভর্তি করাতে চাচ্ছে না। ওর লেখাপড়ার খরচটাও দিস।’ সদরের উপর জমি। চড়া দাম। আমি বিক্রি করেছিলাম সস্তাতে। এখন দাম বেড়েছে। আট লাখ টাকায় বিক্রি করলাম। চার লাখ ছিলো দেনা। সব দেনা শোধ করলাম। সংসারের খরচ, তোদের লেখাপড়ার খরচ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত আরো দুই লাখের মত খরচ হয়েছে। এখন দুই লাখ দশ হাজার টাকা আছে। জমি বিক্রির কথা তোর মা জানেন না। তাকে অন্য ভাবে বুঝালাম। সে জানলে তোর লেখাপড়ার খরচ চালাতে দিতো না।’

শ্রাবণীর চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। সেলিম হোসেন বললেন,
–‘এখন যে টাকা আছে তা থেকে তোর জন্য সত্তর হাজার রেখেছি। বাকীটা নীলা, তুহিনের।’

শ্রাবণী ভেজা গলায় বলল,
–‘আমার টাকা লাগবে না বাবা।’

–‘ভবিষ্যতে কখনো লাগতে পারে। যত্ন করে রেখে দিস।’

এরপর অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সেলিম হোসেন। শ্রাবণীও নিঃশব্দে বসে আছে। দীর্ঘ সময় এভাবেই কাটলো। পারভীন বেগম ডাকছে। শ্রাবণী হঠাৎ তাকিয়ে দেখলো সেলিম হোসেনের চোখ দু’টো ভিজে যাচ্ছে। ওর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠলো। সেলিম হোসেনের মাথায় হাত রেখে ব্যগ্র গলায় বলল,
–‘বাবা কি হয়েছে?’

–‘তোর মা’কে দেখতে ইচ্ছে করছে। তাকে একটু আসতে বলতে পারবি?’

–‘কি বলছো তুমি এসব? ওই জঘন্য মানুষটাকে দেখার ইচ্ছা কেন হলো? তাকে কোথায় পাবো? তার ঠিকানা আমি জানি না। তাকে কখনো দেখিওনি।’

–‘মরার আগে মানুষের অনেক উদ্ভট ইচ্ছে হয়। আমি ঠিকানা জানি। তুই যাবি?’

–‘না, বাবা। আমি তোমার এই ইচ্ছে পূরণ করতে পারবো না। তোমাকে এখন হাসপাতালে নিয়ে যাবো। তুমি কোনো কথা বলো না আর।’

সেলিম হোসেন তীব্র অনুরোধ রেখে বলে,
–‘তুই এখনই পাবেলকে নিয়ে যা তোর মায়ের বাসায়। আমি জানি সে আসবে।’

–‘আমি কখনোই যাবো না। তোমার যদি দেখতে ইচ্ছে করে তো নীলা, তুহিনের মা’কে দেখো। আর যা-ই হোক সে তো স্বামী-সন্তান ছেড়ে যায়নি।’

সেলিম হোসেনকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। তার এই অসুস্থতার খবর এতদিন কাউকেই জানানো হয়নি। শ্রাবণী সবাইকে জানালো। ওর মনের ভিতর খচখচ করছে। সেলিম হোসেনের ইচ্ছেটা পূরণ করা উচিত? বিয়ের সময় পাবেলের পরিবারকে বলা হয়েছিল, শ্রাবণীর মা মারা গেছে। সে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে গেছে এ বিষয়টা চাপিয়ে রাখা হয়েছিলো। এখন পাবেলকে কিভাবে বলবে এটা? শ্রাবণী হাসপাতালে করিডোরে বসে চোখের পানি ফেলছে। হঠাৎ ডাক্তার জানালেন, সেলিম হোসেন মারা গেছেন।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৪৫)
ইসরাত জাহান তানজিলা
________________________
সেলিম হোসেন মারা গেছেন আজ চার দিন হলো। শ্রাবণী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। সবকিছু দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর। ঘুম ভেঙে গেলেই যেন এই কষ্ট, যন্ত্রণা সব চলে যাবে। চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা। চোখে এখনো জল টলমল করছে। কিছুক্ষণ পর পর দুই এক ফোঁটা জল আপনাআপনি গড়িয়ে পড়ছে। কারো পায়ের আওয়াজ পায়ে যাচ্ছে বারান্দার দরজার কাছে। শ্রাবণীর তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করলো না কে এসেছে।

–‘শ্রাবণী।’

মৃদু স্বরে ডাকল সেলিনা চৌধুরী। তারপর আরো কয়েক পা এগিয়ে গেল শ্রাবণীর দিকে। ওর শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখলো। ভীষণ আদুরে গলায় বললেন,
–‘চল মা। খেয়ে নে একটু। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

–‘আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে। তুমি যাও ফুফু। আমি পরে খাবো।’

সেলিনা চৌধুরী গেলেন না। তিনিও দাঁড়িয়ে থাকলেন শ্রাবণীর পাশে।

–‘পাবেলের সাথে তোর সর্ম্পক এখন কেমন? এখনো হোস্টেলে থাকিস?’

–‘এই তো ভালোই। হুম হোস্টেলেই থাকি।’

শ্রাবণী একটু থেমে বলল,
–‘ফুফু আমি তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।’

সেলিনা চৌধুরী সামান্য চমকে জিজ্ঞেস করল,
–‘কিসের জন্য হঠাৎ তুই আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিস?’

–‘তুমি বলো তো কিসের জন্য?’

–‘তুই-ই বল।’

–‘আমার ধারণা তুমি বুঝতে পারছো কিসের জন্য।’

–‘না, আমি বুঝতে পারছি না।’

–‘তুমি তোমার জমিটুকু দিয়েছো বলেই বাবা ঋণমুক্ত হয়ে মরতে পেরেছে অন্তত। নয়ত পারতো না। মৃত্যুর পরও পাওনাদাররা তাকে বিচ্ছিরি গালিগালাজ করতো। তোমার জন্যই আমি কলেজে ভর্তি হতে পেরেছি। সত্যি ফুফু কলেজে ভর্তির পর আমি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। তাতে আমি নতুন করে বাঁচতে শিখেছি, ভালো থাকতে শিখেছি, নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি, স্রোতের বিপরীতে চলতে শিখেছি। আমার নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে। এতকিছুর পিছনে সমস্ত অবদান তো তোমার। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া এখন কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই। যদি কখনো সুযোগ হয় তো করবো।’

–‘সেলিমকে না করেছিলাম এ ব্যাপারটা কাউকে বলতে। তাও তোকে বলে দিয়েছে।’

–‘বলে ভালো করেছে। নয়ত জানতাম কিভাবে?’

শ্রাবণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। সেলিনা চৌধুরী জিজ্ঞেস করল,
–‘তোরা আর কয়দিন থাকবি?’

–‘গেলে হয়ত আর আসা হবে না। কি করতে আসবো? কিসের টানে আসবো? মা না-কি নীলা, তুহিনকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি চলে যাবে। একা একজন মহিলা মানুষ বাচ্চা দুইটা নিয়ে এখানে থাকবেও বা কিভাবে? পৃথিবীটা কি অদ্ভুত ফুফু! যখন ডাক্তার বলল বাবা মারা গেছে তখন কি চিৎকার করে কাঁদলাম। আস্তে আস্তে কান্না, কষ্টের তীব্রতা কমে আসছে। কয়েক বছর পর হয়ত কষ্টটা একদম ক্ষীণ হয়ে যাবে। কারো চলে যাওয়াতে কিছু আসে যায় না বোধ হয়, পৃথিবীর কিছু বদলায় না। সব স্বাভাবিক ভাবে চলে।’

শ্রাবণীর মাথায় উদ্ভট, উদ্ভট চিন্তা আসছে। ও চিন্তামগ্ন হয়ে যায়। রুহুল চৌধুরী ডাকলেন সেলিনা চৌধুরীকে। সেলিনা চৌধুরী তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল। শ্রাবণী সারা সকাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিলো। বারান্দা থেকে বাসার ভিতর ঢুকতে উদ্যত হলেই যাইফের সাথে দেখা হয়ে গেল। একদম মুখোমুখি। এ কয়দিন অবশ্য অসংখ্য বার দেখা হয়েছে কিন্তু এভাবে সামনাসামনি না। শ্রাবণীর মনে হয়েছে যাইফের সামনে পড়লে ওর অস্বস্তি হবে সেজন্যই ও এড়িয়ে চলেছে। যাইফ নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল,
–‘কি অবস্থা তোমার শ্রাবণী?’

শ্রাবণী কেবল নিচু গলায় বলল,
–‘ভালো।’

তারপর আর কিছু বলল না। শ্রাবণী রুমের ভিতর ঢুকে পড়লো। যাইফের সাথে ওর সম্পর্কটা না চাইতেও অনেক জটিল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবে দুই-চারটা কথা বলার মত সম্পর্কও যেন নেই। পাবেল খাটে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। শ্রাবণীকে দেখেই উঠে বসলো,
–‘তুমি আর কয়দিন থাকতে চাচ্ছো? আমার বাসায় যেতে হবে।’

–‘আরো দুই-এক দিন থাকি। ভালো লাগছে না।’

–‘যাইফের সাথে কি কথা বলেছো?’

–‘তেমন কিছু না। আপনি কি এখনই চলে যাবেন? দুপুরে খেয়ে যান।’

–‘না।’

পাবেল চলে গেল। শ্রাবণী আরো কয়েক দিন থেকে তারপর গেল। হোস্টেলে গিয়েই দুই দিন পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। গায়ে জ্বর, মাথা ব্যথা। পাঁচ দিনেও জ্বর কমলো না। মাথায় চক্কর দিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো। সেরে উঠতে কয়েকদিন লেগে যায়। শরীর ভীষণ দুর্বল, ক্লান্ত হয়ে। পাবেল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
–‘তোমাকে এবার বাসায় নিয়ে যাবো। এ অবস্থায় হোস্টেল যেতে হবে না।’

শ্রাবণী বাসায় যেতে চাইলো না। পাবেল এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল। অনেকদিন পর এসেছে এ বাড়িতে। রুমে ঢুকেই গায়ে কম্বল চাপিয়ে শুয়ে পড়লো। সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায়। তবুও শীত লাগছে। কয়েকদিন যাবৎ প্রচণ্ড শীত পড়ছে। শুক্রবার হওয়ায় পাবেল বাসায়। সে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। কিছুক্ষণ পর এসে শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল,
–‘শ্রাবণী কিছু খাবে? কি খেতে ইচ্ছে করছে তোমার বলো? রান্না করে দিতে বলি আসমাকে।’

শ্রাবণী খানিক হেসে বলল,
–‘কিছু না।’

পাবেল শ্রাবণীর কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–‘জ্বর এসেছে না-কি আবার?’

–‘উঁহু। এমনিতেই শীত লাগছে।’

ফরিদা বেগম পাবেলকে ডেকে পাঠালেন। শ্রাবণীর এখানে আসা নিয়ে তিনি যথারীতি আবার ঝগড়াঝাঁটি শুরু করেছে। শ্রাবণীকে সহ্য করতে পারছেন না কিছুতেই। পাবেলকে দেখেই বললেন,
–‘তোমার বউ কী আবার হোস্টেলে চলে যাবে?’

–‘না। এখানেই থাকবে।’

–‘এখানে থাকতে হলে কাজকর্ম করে খেতে হবে। তাকে কাজের মেয়ে দিয়ে কাজ করিয়ে খাওয়াতে পারবো না। আর এ বাড়িতে নিজের মনমতো চলাফেরা করা যাবে না। এতকিছুর পরেও বাড়িতে জায়গা দিয়েছি তা-ই অনেক। ফের যদি আমার মুখে মুখে কথা বলে থাপ্পর দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। বাপে লাই দিয়েছে বলেই এতদূর; এখন তো বাপ মরছে। এখন উড়াউড়ি কমবে।’

–‘মা তুমি দয়া করে কোনো অশান্তি করো না আর। আসমা বাসার সবার জন্য রান্না করতে পারে, শ্রাবণীর জন্য রান্না করতে পারবে না?’

–‘না, পারবে না। কোন লাখ সাহেবের মেয়ে ও যে ও’কে রান্না করে খাওয়াবে? বড় হয়েছে বস্তিতে। এ বাড়িতে এসে এত জমিদারি কিসের? আর ওর লেখাপড়ার খরচা কে দিবে?’

পাবেল বিরক্ত মেজাজে বলল,
–‘আমি দিবো।’

–‘হ্যাঁ, লেখাপড়া করাও। কলেজ, ভার্সিটি সব পাস করাও।‌ কয়দিন পর দেখবা তোমায় রেখে চলে গেছে। ফুফাতো ভাইয়ের সাথে তো ফষ্টিনষ্টি চলছেই।’

পাবেল কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেল। শ্রাবণী এখনো শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়।
______________
ভর দুপুর। শ্রাবণী কলেজে গেছে। সামনেই ওর টেস্ট পরীক্ষা। হোস্টেলে ঠিকঠাক লেখাপড়াটা অন্তত করতে পেরেছে। এ বাড়িতে আসার পর ফরিদা বেগম প্রতিদিন কোনো না কোনো ঝামেলা করে বসবে। পাবেল মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করে, মাঝে মাঝে চুপ থাকে। ভরদুপুরে এক ভদ্র মহিলা এসেছে শ্রাবণীর সাথে দেখা করতে। বয়স আনুমানিক চল্লিশের কাছাকাছি। চোখে চশমা, গায়ে জামদানি শাড়ি। দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। দারোয়ানকে স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘এটা জয়নাল সাহেবের বাসা? তার ছেলের নাম পাবেল? ছেলের বউ শ্রাবণী?’

নতুন দারোয়ান চাকরি নিয়েছে। সে শ্রাবণী দেখেছে কিন্তু নাম জানে না। বলল,
–‘হ এডা জয়নাল সাহেবের বাড়ি। তার ছেলের নাম পাবেল। কিন্তু ছেলের বউয়ের নাম জানি না।’

–‘আমি শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

–‘সে সকালে কলেজে গেছে। বাসায় নাই।’

–‘ফিরবে এখন?’

–‘দুপুরের পর ফিরে। আইজ কহন ফিরে কেডা জানে।’

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রাবণীর জন্য অপেক্ষা করছে বোধ হয়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গাড়ির ভিতর গিয়ে বসলেন। গাড়ি নিয়ে এসেছেন। এর ভিতর পাবেল বাসায় আসলো। ভদ্রমহিলা তখনো বসে আছেন গাড়ির ভিতরে। পাবেলকে দেখে দারোয়ান বলল,
–‘আপনের বউয়ের নাম ছেরাবনী? তার লগে একজন দেখা করতে আইছে। গাড়ির ভিতর বইসা রইছে।’

–‘ছেরাবনি না শ্রাবণী। কে এসেছে?’

ভদ্রমহিলা গাড়ির ভিতর থেকে বের হলেন পাবেলকে দেখে। বললেন,
–‘আমি শ্রাবণীর আত্মীয়। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। দেখা করা যাবে?’

–‘হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি এখানে বসে আছেন কেন? বাসার ভিতরে চলুন। শ্রাবণী কলেজ থেকে এখনই এসে পড়বে।’

ভদ্রমহিলা পাবেলের পিছনে পিছনে গেল। পাবেল জিজ্ঞাসা করল,
–‘আপনি শ্রাবণীর কেন হন? আমি ওদের বাসায় বেশ কয়েকবার গেছি। আপনাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’

ভদ্রমহিলা নিজের পরিচয় বলতে বোধ হয় ইচ্ছুক না। তিনি বললেন,
–‘কে হই তা পরে বলি।’

ড্রয়িং রুমে বসলেন তিনি। আসমা নাস্তা দিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা কিছু খেলো না। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। ফরিদা বেগম গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
–‘কে আপনি?’

পাবেল এসে বলল,
–‘শ্রাবণীর আত্মীয়। ওর সাথে দেখা করতে এসেছে।’

ফরিদা বেগম প্রশ্ন করলেন,
–‘কে হন আপনি শ্রাবণীর?’

ভদ্রমহিলা ইতস্তত বোধ করে বললেন,
–‘আমি শ্রাবণীর মা।’

পাবেল আর ফরিদা বেগম দু’জনই চমকে উঠল। পাবেল বলল,
–‘শ্রাবণীর মা মানে?’

ভদ্রমহিলা এরপর আর উত্তর দিলেন না। এর ভিতর শ্রাবণী কলেজ থেকে আসলো। ও ভদ্রমহিলাকে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
–‘কে আপনি?’

পাবেল বলল,
–‘কি বলছে ইনি? সে না-কি তোমার মা!’

শ্রাবণী কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। পরম আশ্চর্যে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইল। বুঝ হওয়ার পর কখনো মাকসুদা বেগমকে দেখেনি ও। তবুও ওর চিনতে অসুবিধা হলো না,
–‘আপনি? আপনি কেন এসেছেন এখানে? কি কাজ আপনার এখানে? দয়া করে চলে যান।’

মুহূর্তেই বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল যে শ্রাবণীর মা মারা যাননি। তিনি অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে গিয়েছিল। এ বিষয়টা বিয়ের সময় গোপন করা হয়েছে। জয়নাল সাহেব মাকসুদা বেগমকে বের করে দিলেন বাসা থেকে। এলাকায় জানাজানি হলে মানসম্মান যাবে। সবাই শ্রাবণীর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেল, এমনকি পাবেলও। ছোট বেলা থেকে সবাই শ্রাবণীকে এই বিষয়টা নিয়ে আজেবাজে কথা বলত। শ্রাবণী তখনও বুঝত না এখানে ওর দোষ কি? আজও বুঝতে পারছে না।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৪৬)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
সবার কথা উপেক্ষা করে শ্রাবণী নিজের রুমের চলে আসলো। ওর অস্থির লাগছে, কান্না পাচ্ছে। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়ে। দীর্ঘ সময় পর কেঁদেকেটে চোখমুখ লাল করে বের হয়। মাকসুদা বেগম কেন এসেছে? এত গুলো বছর পর হঠাৎ কিসের জন্য শ্রাবণীকে মনে পড়লো তার? ওর বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে। শ্রাবণী অবশ্যই তার কথা শুনতো। কিন্তু জয়নাল সাহেব তীব্র অপমান করে তাকে বের করে দিলো। পাবেল রুমে আসলো। শ্রাবণী রাগে জ্বলে ওঠেল,
–‘আপনি আগে আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। বাচ্চাও ছিলো আপনার। আরো কত জঘন্য কাজকর্ম করেছেন আপনি। সেগুলো বিয়ের আগে আমাদের জানিয়েছিলেন? বিয়েটা আমার অমতে হয়েছে। নয়ত আমি এই তুচ্ছ বিষয়টাকে বিয়ের আগেই জানাতাম।’

–‘আমি কি তোমার দোষ দিয়েছি? তোমার মায়ের তো এখানে আসা উচিত হয়নি। এসব তোমার বাবা গোপন করেছে। সে তো আর বেঁচে নেই।’

–‘মা’কে আমি এখানে দাওয়াত করে আনিনি। বড়ো হওয়ার পর তাকে এই প্রথম দেখেছি আমি। সে কিভাবে আমার ঠিকানা পেল, কেন এখানে এসেছে তা আমি জানি না। বাবার ধারণা ছিলো পাত্রপক্ষ এসব জানলে বিয়ে ভেঙে যাবে। আর আপনি আমার দোষ দেননি? বাসার সবার সাথে সুর মিলিয়ে ঠিকই তো রাগ দেখিয়েছেন আমার উপর। আমার উপর কিসের জন্য রাগ দেখালেন? আপনারা এত কুকর্ম করেন তাতে মানসম্মান যায় না। আর এই সামান্য বিষয়ে মানসম্মান যাবে। উনাকে তো আমিই বলেছি চলে যেতে। তারপরও আপনার বাবা-মায়ের ওরকম আচরণ করার কি দরকার ছিলো?’

–‘তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে। আমি তোমার উপর রাগ করিনি। আমার রাগ হয়েছিল তোমার মায়ের উপর।’

–‘আমার ভালো লাগছে না। আমি এ ব্যাপারে আর কথা বলতে চাচ্ছি না।’

পাবেল আর এই প্রসঙ্গটা তুলল না। কিন্তু ফরিদা বেগম কি এত সহজে থামবে? এই নিয়ে শ্রাবণীকে অপমান, অপদস্থ করা সপ্তাহখানেক চলল। শ্রাবণী অতিষ্ঠ, তিক্ত হয়ে ওঠল আবার এ বাড়িতে। পাবেলকে বলল,
–‘আমার এখানে থাকা সত্যি আর সম্ভব না। আমি সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমাকে কেন নিয়ে এসেছেন এখানে? আমার ভালো থাকাটা বোধ হয় আপনার ভালো লাগছিলো না। তাই আপনি আমাকে টেনেটুনে আমার এই নরকে নিয়ে আসলেন। আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা এতই বেড়েছিল যে আপনি আমাকে ছাড়া থাকতেই পারছিলেন না। কিন্তু আপনি কি আমাকে ভালো রাখতে পেরেছেন?’

পাবেল শ্রাবণীর কথার প্রত্যুত্তর না করে ফরিদা বেগমের কাছে গেল। জয়নাল সাহেবও সেখানে উপস্থিত। পাবেল শক্ত গলায় বলল,
–‘শ্রাবণীকে নিয়ে তোমার সমস্যা কি মা বলো তো? তোমার যা ইচ্ছে করতে থাকো। আমি ওকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’

ফরিদা বেগম আচমকা কষিয়ে চড় মেরে বসলেন পাবেলের গালে। জয়নাল সাহেব হতবাক। ফরিদা বেগম কখনো পাবেলের গায়ে হাত তোলে না। তিনি হঠাৎ এরকম একটা কাণ্ড করে বসবে তা কেউই বুঝতে পারেনি। ফরিদা বেগম রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
–‘আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে এসেছিস? কি ভেবেছিস তুই? আমার এতদিনের সাজানো সংসারটা এলোমেলো করে দিয়েছে ওই ছোটলোকের বাচ্চায়। আমি ওকে ছেড়ে দিবো?’

পাবেল বাসা থেকে রাগ করে বের হয়ে গেল। রাত হয়ে গেছে। এখনো বাসায় ফেরেনি। শ্রাবণী সন্ধ্যা থেকে কল দিয়ে যাচ্ছে। ফোন বন্ধ করে রেখেছে পাবেল। বেচারা ওর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে থাপ্পড় খেলো। শেষমেষ সাব্বিরের কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারলো পাবেল সেখানে আছে। রাতে বাসায় ফিরবে না। পরদিন ভোরে বাসায় আসলো থমথমে চেহারা নিয়ে। নেশা করেছে আবার। ঢলে পড়ার মত অবস্থা। এ লোক যতই বলুক নেশা করা ছেড়ে দিবে। কিন্তু তা হয়ত কখনোই পারবে না। এ ঝামেলার শেষ কোথায় শ্রাবণীর জানা নেই। ও রেগে বলল,
–‘আপনি না-কি নেশা করা কমিয়ে দিবেন? আপনি কিন্তু আপনার কথা রাখছেন না।’

পাবেল উদ্ভ্রান্তের মত জড়িয়ে ধরে শ্রাবণীকে। ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বলে,
–‘আমি আমার এসব কথা রাখি বা না রাখি কিন্তু তোমায় যে ভালোবাসি এ কথা ঠিকই রাখবো।’

কয়েকদিন যাবৎ ফরিদা বেগম শ্রাবণীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা কমালো। তিনি আজকাল তার রুম থেকেই বেরুয় না। শ্রাবণী একটু স্বস্তি পেলো এবার।
____________
শ্রাবণী বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে আছে। আসমাকে ডেকে এক কাপ চা দিতে বলল। আসমা চা দিয়ে যায়। পাবেল রেডি হচ্ছে অফিসে যাওয়ার জন্য। রেডি হতে হতে শ্রাবণীকে বলল,
–‘আজ বিকালে এক জায়গায় যাবো। রেডি হয়ে থেকো।’

–‘কোথায় যাবেন?’

–‘আমার ভীষণ ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু দাওয়াত করেছে। তোমাকেও যেতে হবে।’

–‘আমার তো যেতে ইচ্ছে করছে না।’

–‘ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে।’

পাবেল বিকেলে বাসায় এসে দেখে শ্রাবণী‌ রেডি হয়নি। চেয়ারের উপর বই হাতে চোখ বুজে বসে আছে। পাবেল ওর কাছে গিয়ে সামান্য রেগে জিজ্ঞেস করল,
–‘শ্রাবণী তোমায় আমি কি বলেছিলাম?’

আশ্চর্য! এ মেয়ে এভাবে চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। পাবেল তো ভেবেছিল চোখ বুজে আছে। এভাবে কেউ ঘুমাতে পারে? পাবেল ওকে ডেকে ঘুম থেকে তুলল।
–‘এভাবে ঘুমাচ্ছিলে তুমি?’

–‘ভীষণ ঘুম পেয়েছিল। পড়তে পড়তে কিভাবে যেন ঘুমিয়ে গেছি।’

–‘সেই সকালে তোমার এ অবস্থায় দেখে গেছি। তুমি কি এখনো গোসলও দেওনি?’

শ্রাবণী না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায় কেবল। পাবেল রেগে যায়। পাবেলের রাগের মুখে পড়ে শ্রাবণী দ্রুত গোসল সেরে রেডি হয়ে নেয়। হালকা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পরেছে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কানের দুল আর লিপস্টিক। দারুণ লাগছে দেখতে।

ওদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মানুষের ভিড় শ্রাবণীর ভালোলাগে না শ্রাবণীর। ও এক কোণে বসে আছে। পাবেলকে আশেপাশে দেখছে না। এখানেই তো ছিলো। সে হঠাৎ কোত্থেকে যেন এসে শ্রাবণীর ঠোঁটে চুমু খেল। ব্যাপারটা আশেপাশের সবাই প্রায় খেয়াল করেছে। শ্রাবণী লজ্জায় হতভম্ব। চাপা গলায় অপ্রস্তুত মুখে বলল,
–‘এতগুলো মানুষের সামনে কি করলেন এটা? আমি বাসায় চলে যাবো। আপনার সাথে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।’

পাবেল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলে,
–‘এত লজ্জা পাওয়া কি আছে? আমার বউকে আমি চুমু খেয়েছি।’

শ্রাবণী ওখান থেকে উঠে যায়। অস্বস্তিকর অবস্থা। খেতে বসেও এক কাণ্ড করে বসলো পাবেল। সে জেদ করলো এই অনুষ্ঠানের সবার ভিতর বসে শ্রাবণীকে খাইয়ে দিবে। শ্রাবণী মানতে নারাজ। ও বিব্রত বোধ করে বলল,
–‘আমি কিন্তু খাবার রেখে ওঠে যাবো। আপনি এরকম কেন করছেন? বার বার লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছেন আমাকে।’

–‘তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বন্ধুমহলের সবাইকে দেখাতে চাচ্ছি। ভালোবাসার ক্ষেত্রে বয়সের ব্যবধান কোনো বাঁধা না।’

–‘এসব কেন মানুষকে দেখাতে হবে বলুন তো? আর আপনি এখানে এসে আমার প্রতি যতটা আদর, যত্ন ভালোবাসা দেখাচ্ছেন ততটা আদর, যত্ন ভালোবাসা কিন্তু আমার প্রতি নেই আপনার। আমরা অত হ্যাপি কাপল না।’

–‘আমি তোমাকে ভালোবাসি শ্রাবণী।’

–‘যতটা দেখাতে চাচ্ছেন ততটাও না।’

পাবেল এক প্রকার জোর করে শ্রাবণীর মুখে খাবার তুলে দিলো। শ্রাবণী গলা সমান অস্বস্তি নিয়ে গিললো। খাওয়া-দাওয়া শেষে আড্ডা দিতে
বসলো সবাই। রাত অনেক হয়েছে তখন। এখানে আসার পর থেকে শ্রাবণী একটা বিষয় লক্ষ্য করছে। একটা মেয়ে পাবেল আর ওর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। ভীষণ ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যেন চোখ দিয়েই গিলে খেয়ে ফেলবে। সবাই হাসিঠাট্টায় মশগুল। এর ভিতর শ্রাবণী পাবেলকে জিজ্ঞেস করল,
–‘ওই মেয়েটা আমাদের দিকে ওভাবে তাকাচ্ছে কেন?’

শ্রাবণী কথাটা শেষ হতে না হতেই মেয়েটা হঠাৎ এসে পাবেলের শার্টের কলার ধরে ডাক চিৎকার শুরু করে দেয়। পাবেলকে বিচ্ছিরি ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। পাবেল মেয়েটার দুই গালে কষিয়ে কয়েকটা চড় মারে। উপস্থিত সবাই হতবাক। সবাই টেনেটুনে পাবেলকে দূরে নিয়ে যায়। পাবেল রাগে কাঁপছে। আর মেয়েটারও কম যায় না। তার মুখও বন্ধ হচ্ছে না। এদের ভিতর কি ঝামেলা বা শত্রুতা শ্রাবণীর জানা নেই। ও স্তম্ভিত হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। যে বন্ধুর বাসায় অনুষ্ঠান মেয়েটা গিয়ে আবার তার শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
–‘শালা ওকে দাওয়াত করবি তো আমায় কেন দাওয়াত করেছিস? তামাশা করছিস তোরা আমার সাথে?’

–‘চৈতি প্লীজ শান্ত হ। কলার ছাড়।’

মেয়েটার নাম চৈতি। এদের যেহেতু ফ্রেন্ড বয়স তাহলে অনেকই হবে। মেকাপের জন্য ঠিকঠাক বুঝা যাচ্ছে না। বাসা জুড়ে তুলকালাম কাণ্ড। সকল আনন্দ, আড্ডা মুহুর্তেই ভেস্তে যায়। পাবেল শ্রাবণীর হাত ধরে টেনে ওই বাসা থেকে বের হয়ে গেল। পুরো রাস্তায় শ্রাবণী অসংখ্য বার জিজ্ঞেস করেছে,
–‘মেয়েটা এমন করলো কেন? কি সমস্যা? কি বিচ্ছিরি একটা কাণ্ড হলো।’

–‘আমার মেজাজ ঠিক নেই। এই ব্যাপারে তুমি আমায় কিছু জিজ্ঞেস করো না। ওসব তোমার না জানলেও হবে।’

শ্রাবণী কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ওই ঘটনা নিয়ে পাবেলের রাগ কয়েকদিনেও কমলো না। তিন-চার ধরে অফিসে যায়নি। চাকরি-চুকরি ওসব আর ভালো লাগছে না। সামনে এমপি ইলেকশন তাই নিয়ে চিন্তায় আছে সে।
_______________
ফরিদা বেগম ভার মুখে বসে আছেন। জয়নাল সাহেব বললেন,
–‘হয়েছে কি তোমার কয়েকদিন যাবৎ?’

ফরিদা বেগম প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
–‘আমার কোনো কিছু ভালো লাগছে না। আমাকে এই যন্ত্রণায় তুমিই ফেলেছো।’

–‘এই এক কথা প্রতিদিন বলে কোনো লাভ হবে?’

–‘লাভ হবে না-কি লস হবে তা জানি না। তবে আমি এবার আর ছেড়ে দিবো না। আমার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমার নিয়ে ফেলেছি। আমার ছেলেকে আমার থেকে আলাদা করে ভিন্ন বাসা নিয়ে থাকার কথা বলছে। আমার তো একটাই সন্তান। আমি তাকে ছাড়া থাকবো কিভাবে? কয়েকদিন পর দেখবে হুট করে বউয়ের কথা মত পাবেল ভিন্ন বাসা নিয়েছে। এখান থেকে চলে গেছে। আমি এসব সহ্য করবো? আমি আমার পথের কাঁটা দূ্র করে ফেলবো।’

–‘আরে পাবেল কথার কথা বলেছে বাসা ছেড়ে চলে যাবে। এটা নিয়ে এত রাগের কি আছে?’

–‘না, কথার কথা বলেনি। সিরিয়াসলি বলছে। শ্রাবণী এ বাসায় থাকতে চাচ্ছে না।’

জয়নাল সাহেব ও দুশ্চিন্তায় পড়লেন। শ্রাবণীর এত সাহস বাড়বে তা কে জানতো। জানলে কখনো এই মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করে আনতেন না। তাদের গণ্ডির বাইরে চলে গেছে একদম। ফরিদা বেগম বললেন,
–‘পেপার-পত্রিকা, টেলিভিশনে দেখো না ছেলের বউকে মেরে বাড়ির উঠোনে পুঁতে রাখে। আমিও ওকে মেরে ওভাবে পুঁতে রাখবো। আমার সব অশান্তির কারণ এখন ও। আমার অশান্তি আমি দূর করে ফেলবো।’

–‘পাগল হয়ে গেছো তুমি।‌ কি সব বলছো?’

–‘আমি যা বলছি তাই করবো। তুমি এ ব্যাপারে আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না। আমার বাপের বাড়িতে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়েছি আমি। ধরা পড়লে থানায় পঞ্চাশ লাখ দিয়ে পুলিশের মুখ মেরে দিবো।’

–‘তুমি যত সহজ ভাবছো তত সহজ না। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।’

–‘হ্যাঁ, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার হাতে গড়া সংসারে আমার গুরুত্ব কমে গেছে। আমার মাথা ঠিক থাকবে কিভাবে? আমার ছেলে বউয়ের কথা মত আমার থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাচ্ছে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।’

জয়নাল সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তিনিও এখন শ্রাবণীকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে মেরে ফেলার কথা ভাবেননি। তিনি বললেন,
–‘রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। আমায় ভাবতে দেও। তুমি যা করার কথা ভাবছো তা বোকামি। এভাবে খুন করলে পাবেল তো জেনে যাবে। পাবেল যখন জানবে ওর বউকে তুমি মেরেছো তখন তোমার প্রতি তার ঘৃণা জন্মাবে। পাবেল এখন মেয়েটাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। হিতেবিপরীত হবে তখন। ভালো কোনো উপায় ভাবো। আমিও চাই না পাবেল আমাদের থেকে আলাদা হোক।’

–‘তাহলে মানুষ ভাড়া করে খুন করাবো ওকে। একটা খুন করাতে কত লাখ যাবে? দশ লাখ? গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে বলবো। তাহলে সবাই ভাববে এক্সিডেন্ট।’

ফরিদা বেগম তার বড় ভাইয়ের কাছে ফোন দিলেন। তার বাবা মরেছে অনেক বছর। জমিজমাও ভাগ হয়েছে। তবে তা এখনো‌ ভাইদের দখলে। প্রয়োজন হয়নি বলে বিক্রি করেননি। কিন্তু এখন তার প্রয়োজন। তার ইচ্ছা ছিলো সব জমি পাবেলের নামে লিখে দিবে। সে ইচ্ছে এখন আপাতত নেই। শ্রাবণীর রক্তাক্ত লাশটা দেখাই এখন তার একমাত্র ইচ্ছা। জয়নাল সাহেবকে বললেন,
–‘তুমি সব ব্যবস্থা করো। যত টাকা লাগে আমি দিবো। একটা কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।’
(চলবে)