প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৪১+৪২+৪৩
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
শ্রাবণী ব্যগ্র গলায় ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। পাবেল একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না। সে চোখ বন্ধ করে আছে তীব্র ক্রোধে। খানিক সময় পর চোখ মেলে বলল,
–‘প্লিজ শ্রাবণী কোনো প্রশ্ন করো না। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত মেজাজ আমার নেই। দুইটা খুন করতে ইচ্ছে করছে এখন আমার। তাহলে আমি শান্তি পেতাম।’
শ্রাবণী প্রশ্ন করলো না ফের। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে চুপচাপ বসে রইল। পাবেল সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছে বিক্ষিপ্ত মেজাজে। অসহ্য রকমের নীরবতা। শ্রাবণীর তীব্র হাঁসফাঁস লাগছে। মনের ভিতর জমে থাকা প্রশ্ন গুলো ওকে অস্থির করে তোলে। নীচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘আপনি কি এভাবেই চোখ বন্ধ করে বসে থাকবেন? ঘন্টা একটা পেরিয়েছে।’
পাবেলের যেন সম্বিত ফিরে। সে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘সামান্য একজন দারোয়ানের কি দুঃসাহস! ভাবতেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ওর চোখ দুটো তুলে, জিহ্বাটা কেটে গলাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে দিবো।’
–‘কি করেছে দারোয়ান চাচা সেটা তো বলবেন? একটা মানুষ যতই অপরাধ করুক। তাকে মেরে ফেলার অধিকার আপনার নেই।’
–‘আমায় নীতি কথা শুনাতে এসো না।’
পাবেল থেমে আবার বলল,
–‘আমার এক শত্রু আছে। বেশ পুরোনো শত্রু। সে দীর্ঘ দিন যাবৎ আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। সুযোগ পাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত তোমায় টার্গেট করলো আমার ক্ষতি করার জন্য। দারোয়ানকে টাকার লোভ দেখালো, দারোয়ান তাকে সাহায্য করল। দারোয়ান তোমায় কিডন্যাপ করতে সাহায্য করে। কথা বড়ো বেঈমান। বছরের পর বছর আমাদের বাড়িতে থেকেছে, খেয়েছে।’
শ্রাবণী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে স্তম্ভিত হয়ে। ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। আনোয়ার মিয়া ওর বাবার বয়সী। শ্রাবণীকে মা বলে সম্বোধন করে কথা বলত। কেমন সহজ-সরল চেহারা লোকটার। সে এত বড়ো একটা জঘন্য, কুৎসিত কাজ কিভাবে করল লোভের মুখের পড়ে? শ্রাবণী গভীর চিন্তিত আর করুন গলায় বলল,
–‘আমায় তুলে নিয়ে কি করেছিল? আমার কিছু মনে নেই। অজ্ঞান গিয়ে গিয়েছিলাম যখন হুঁশ ফিরে তখন দেখি বাসায়। আপনায় বলেছিলাম। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেনি। উল্টো আমায় দোষারোপ করেছেন।’
–‘তোমায় তুলে নেওয়ার পর একটা পুরানো বিল্ডিং-এ আটকে রাখা হয়েছিল তাই না? তোমাকে যে কিডন্যাপ করিয়েছিল সে গাড়ি নিয়ে আসছিলো সেই বিল্ডিং-এ। তোমার কপাল ভালো শ্রাবণী। আসার পথে সে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে। ভয়াবহ এক্সিডেন্ট। তারপর যাদের দিয়ে কিডন্যাপ করিয়েছিল তারা বুঝতে পারছিল না কি করবে। কি করে কি বিপদে পড়বে। একবার আমি জেনে গেলে ওদের মেরে ফেলবো-ওদের মনে এই ভয় ছিলো। ওরা কেউই রিস্ক নিতে চাইলো না। তোমায় অজ্ঞান অবস্থায়ই বাসার কাছে ফেলে গেল। দারোয়ান তোমাকে বাসায় নিয়ে আসলো। বেচারা পরিকল্পনা করেছিল তোমায় বাসায় এনে সবাইকে বলবে, রাস্তার পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছে। এছাড়া সে কিছুই জানে না। কিন্তু ওইদিন বাসায় আমি ছাড়া কেউ ছিলো না। আমিও ছিলাম ছাদে। পুরো বাসা ফাঁকা। দারোয়ান হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তাকে কারো মুখোমুখি হতে হয়নি, তোপের মুখে পড়তে হয়নি। তিনি তোমায় বাসা রেখে দ্রুত চলে গেলেন। আব্বা-আম্মা তো বাসায়ই ছিলেন না। তারা কেউ এই ব্যাপারে জানে না। বাসায় ছিলাম একমাত্র আমি। আমিও তোমার কথা বিশ্বাস করিনি। তোমারও হয়ত দারোয়ানকে নিয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ হয়নি। সুযোগ বুঝে দারোয়ান পুরোপুরি চেপে গেলেন।’
শ্রাবণী হতবাক, বিহ্বল। ও কিছু বলতে পারলো না। বিস্ময়ে বাক্যহারা। দারোয়ানের এই কুকর্মের বিষয়টা ও হজম করতে পারছে না। ওরকম সরল একজন মানুষ এমন কাজ করলো কীভাবে? কি নিকৃষ্ট লোকটা!
–‘ওই চিঠিটা কেন লিখলো? দারোয়ান চাচার কেন মনে হয়েছিল সে ধরা পড়ে যাবে?’
পাবেল একটা দম ফেলে বলল,
–‘দারোয়ান সেই কিডন্যাপারের কথা মত প্রতিনিয়ত আমার নামে মিথ্যা বলত তোমার কাছে। কারণ সেই কিডন্যাপার চাচ্ছিলো আমার সংসারটা ভেঙে যাক। দারোয়ানের হঠাৎ বিবেক বোধ জাগ্রত হয়েছে। সে আর কিডন্যাপারকে সাহায্য করতে চাইলো না। কিডন্যাপার তাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। সেজন্য দারোয়ান ওই চিঠি লিখে লাপাত্তা হয়ে যায়।’
–‘কিডনাপ্যারের সাথে কি নিয়ে শত্রুতা ছিলো আপনার? কি নাম তার? এই দীর্ঘ কথাবার্তার মাঝে আপনি একবারও তার নামটি উচ্চারণ করলেন না। কিডন্যাপার, কিডন্যাপার বলে গেলেন। সে ছেলে না-কি মেয়ে সেটাও কেন জানি আপনি এড়িয়ে গেলেন। আপনি কি তার লুকাতে চাচ্ছেন?’
পাবেল রাগী গলায় বলল,
–‘আশ্চর্য ব্যাপার শ্রাবণী! তুমি তার নাম কিংবা পরিচয় জানতে চাচ্ছো সেটা সরাসরি জিজ্ঞাসা না করে এভাবে কেন বলছো? আমি তার পরিচয় লুকাতে যাবো কেন?’
শ্রাবণী ঘোর থেকে বের হতে পারছে না এখনো। সেদিন যদি কিডন্যাপার গাড়ি এক্সিডেন্ট না করত তাহলে কী হতো? ওকে মেরে ফেলত? শ্রাবণী আঁতকে ওঠছে। অন্যমনস্ক ভাবে পাবেলের কথার বিপরীতে বলল,
–‘আমার যা মনে হয়েছে আমি তাই বললাম। যদি আমার ধারণা ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমি দুঃখিত।’
–‘ওর নাম সজল। রাজনীতি করতে গিয়েই পরিচয়। তারপর ঝামেলা, শত্রুতা।’
–‘কি নিয়ে শত্রুতা?’
–‘এত প্রশ্ন কেন করছো? বাদ দেও। ভালো লাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে।’
–‘কিন্তু আমার তো জানতে ইচ্ছে করছে।’
পাবেল প্রায় চিৎকার করে বলল,
–‘শ্রাবণী মুখে মুখে তর্ক করবে না। মেজাজ ঠিক নেই এখন আমার।’
পাবেলের রাগে দমলো না শ্রাবণী। আবার জিজ্ঞেস করল,
–‘আমি কি দারোয়ানের সাথে কথা বলতে পারি? কোথায় রেখেছেন তাকে?’
–‘তুমি দারোয়ানের সাথে কি কথা বলবে? তোমার সব প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিয়েছিই। আর কি জানার আছে তোমার? আমায় জিজ্ঞেস করো।’
শ্রাবণী ভার মুখে বলল,
–‘কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আমার মনে হচ্ছে আপনি অযথা রেগে যাচ্ছেন। আর একটা অনুরোধ। দারোয়ান চাচাকে কিছু বলবেন না। তার গায়ে হাত তোলবেন না। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। যে নিজের ভুল বুঝতে পারে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। তারপর যদি কিছু বলতেই ইচ্ছে করে তাহলে আপনার শত্রুকে বলেন। দুর্বলকে আঘাত করে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করার দরকার নেই।’
–‘যে মানুষ এত বড়ো অপরাধ করতে পারে তাকে তুমি দুর্বল বলছো? আর কেউ হাজার অপরাধ করে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে বলে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো?’
–‘লোভে পড়ে ভুল করে ফেলেছে হয়ত তিনি….।’
পাবেল ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় শ্রাবণীকে,
–‘কাকে কি করতে হবে তা আমি ভালো বুঝি। তুমি এ ব্যাপারে কথা বলো না। আমার কাজ আছে। উঠতে হবে।’
কথাটা বলে পাবেল আর সময় করলো না। দ্রুত পা ফেলে চলে গেল। পাবেল চলে যাওয়ার পরেও শ্রাবণী অনেকক্ষণ বসে রইল। কিডন্যাপের সেই ভয়াবহ মুহুর্তটা ওর স্মৃতিতে আবার যেন তাজা হয়ে যায়। কী বীভৎস, ভয়ানক। শ্রাবণীর বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। কত বড়ো বিপদ থেকে পার পেয়েছে ও। সবকিছুর পর আর একটা খটকা রয়ে গেছে শ্রাবণীর মনে। পাবেল কেন দারোয়ানের সাথে কথা বলতে দিচ্ছে না ওকে? এর পিছনে কোনো কারণ আছে না-কি শ্রাবণী অকারণেই সন্দেহ করছে? শ্রাবণীর মনে আরেকটা সন্দেহও আছে। পাবেল যে শত্রুর কথা বলেছে সে একজন মেয়ে। আর তার সাথে রাজনৈতিক বিষয়ক কোনো শত্রুতা নেই। অন্য কোনো বিষয়ে ঝামেলা। শ্রাবণীর এরকমই মনে হচ্ছে। এমন হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবুও শ্রাবণীর অচেতন মন কেন জানি বার বার এসবই ভাবছে।
______________
এই বিষয় নিয়ে সন্দেহ, দুশ্চিন্তা থেকে বের হতে শ্রাবণীর বের কয়েকদিন সময় লাগলো। ততদিনে শ্রাবণীর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়ে গেছে। রেজাল্ট ভালো হয়েছে। ওর পজিশন হলো ছয়। সেলিম হোসেন আসলেন শ্রাবণীর সাথে দেখা করতে।
–‘বাসায় বেড়াতে যাবি? কয়েকদিন থেকে আসবি চল।’
–‘না, বাবা। বাসায় গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। আমি গেলে মা ঝৈ ঝামেলা শুরু করবে আবার। কি দরকার যাওয়ার? নীলা, তুহিনকে নিয়ে তোমরা ভালো থাকো।’
–‘আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বো। এবার অসুস্থ হয়ে গেলে আর মৃত্যুর হাত থেকে আর রেহাই নেই বোধ হয় মা। তোর দাদীকে প্রায়ই স্বপ্ন দেখি। তিনি আমায় সাধেন।’
–‘ডাক্তার দেখাও। কে কবে মারা যাবে তা কি কেউ বলতে পারে? টাকা আছে তোমার কাছে? আমার লেখাপড়ার খরচ দিতে গিয়ে তুমি বিপদে পড়লে। সংসারের খরচ চালাচ্ছো, আমার, নীলা, তুহিনের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছো। তুমি কি চাকরিতে সত্যি এত বেতন পাও বাবা?’
সেলিম হোসেনের মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল। এই প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে যেতে চাইলেন,
–‘তুই বাসায় চল। তোকে সব বলব। অনেক কথা আছে তোর সাথে। মরার আগে বলে যাওয়া দরকার।’
শ্রাবণী রেগে বলল,
–‘বাবা তুমি আবোলতাবোল বলো না তো। অসুখ হলেই মানুষ মারা যায়?’
–‘মারা যাওয়ার আগে মানুষের মনে কু ডাক দেয়। সে বুঝতে পারে।’
–‘তোমার সাথে আমি তর্ক করতে চাচ্ছি না।’
শ্রাবণী থেমে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
–‘কি কথা বলার আছে? এখনই বলো।’
–‘না, এখন বলা যাবে না। তুই কবে বাসায় যেতে পারবি আমায় জানাস। আমি তোকে নিতে আসবো। তোর মা যা ঝামেলা করার করুক। আমি মরার পর তো আর যেতে হবে না।’
পাবেল দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরেই। এ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। হঠাৎ শ্রাবণী আর সেলিম হোসেনকে চোখে পড়লো। তারা বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। পাবেলের কেন জানি সেলিম হোসেনের সামনে পড়তে ইচ্ছে হলো না। ও পিছনে পিছনে হাঁটছে। শ্রাবণী হঠাৎ পিছনে ফিরে পাবেলকে দেখলো। এরপর কয়েকবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। সেলিম হোসেনও শ্রাবণীর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে পাবেলকে দেখে। পাবেল অপ্রস্তুত মুখে সালাম দেয়। সেলিম হোসেন নীরস গলায় সালামের জবাব দিয়ে বলল,
–‘কেমন আছো?’
–‘জি বাবা ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
সেলিম হোসেন অবাক হয়। পাবেল তাকে এর আগে কখনো বাবা বলে সম্বোধন করেছে কি-না তার এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। হয়ত করেছে। পাবেলের বেশভূষায়ও বেশ পরিবর্তন। আগে তার চেহারায় নেশাগ্রস্ত ভাবটা স্পষ্ট ছিলো। সেলিম হোসেন বললেন,
–‘এই তো ভালো আছি।’
–‘আমাদের বাসায় চলেন শ্রাবণীকে নিয়ে বেড়িয়ে আসবেন।’
অদ্ভুত ব্যাপার! সেলিম হোসেনের সাথে কথা বলতে পাবেলের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, বিব্রতবোধ হচ্ছে। এরকম আগে কখনো হয়নি। সেলিম হোসেন সৌজন্য দেখিয়ে বলল,
–‘জরুরি কাজ আছে। বাসায় ফিরতে হবে। তুমি যেয়ো সময় করে।’
সেলিম হোসেনের বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সে চলে গেল। পাবেল যেন স্বস্তি পেল। শ্রাবণী বলল,
–‘আপনি কোথা থেকে আসলেন?’
–‘তোমাদের ফলো করতে করতে আসলাম। একটা কথা বলো তো শ্বশুর মশাইয়ের সামনে আমার অত অস্বস্তি লাগছিলো কেন?’
–‘এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।’
দুজন ফুটপাত ধরে হাঁটছে। পাবেল প্রশ্ন করল,
–‘শ্রাবণী তোমাদের কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে? দাওয়াত করলো আমাকে।’
–‘হুম হবে।’
–‘তুমি চাইলে অনুষ্ঠানে গান গাইতে পারো। আমি তোমার গিটারটা দিয়ে যাবো? তুমি যদি গান গাও তবে আমি অবশ্যই যাবো অনুষ্ঠানে।’
–‘গিটারটা দিয়ে যেয়েন। তবে আমি গান গাইবো না।’
–‘তুমি সেজেগুজে স্টেজে ওঠে গান গাইলে আমি শিওর সব ছেলেদের চোখ ঝলসে যাবে তোমার রূপে। আর তোমার যা গানের গলা। কি রিনরিনে, মোলায়েম, সুরেলা। তাই না গাওয়াই ভালো। আমার বোধ হয় হিংসে হবে।’
কথাটা বলেই হো হো করে হাসলো পাবেল। শ্রাবণী মনে মনে বলল, মাঝে মাঝে একটু হিংসে হলে মন্দ হয়না। ও গান গাওয়ার রিহার্সাল শুরু করেছে সেই কবে। কত বছর পর স্টেজে ওঠে গান গাওয়ার সুযোগ হলো। এখন ওকে বাঁধা দেওয়ায় কেউ নেই। ও অবশ্যই গান গাইবে। শুধু শুধু মিথ্যা বলেছে পাবেলকে। অনুষ্ঠানের দিন পাবেলকে চমকে দিবে, ওর রূপে পাবেলের চোখই ঝলসে দিবে।
শ্রাবণী পাবেলের দেওয়া কালো গাউনটা পড়লো। কানে কালো ঝুমকা। কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। হালকা মেকআপ। ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক। তিথি চোখ দু’টো কপালে তুলে বললো,
–‘কি ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগে তোমায় শ্রাবণী। মনে হচ্ছে অপ্সরী, কালো পরী। উফ্ শ্রাবণী। তুমি এভাবে স্টেজে ওঠো না। ছেলেদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে।’
শ্রাবণী হেসে বলল,
–‘সুন্দর আবার ভয়ঙ্কর হয় তিথি?’
–‘তুমি নিজেকে আয়নায় দেখো তাহলেই বুঝবে ভয়ঙ্কর হয় কি-না।’
শ্রাবণী আয়নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতিথির আসনে বসে থাকা পাবেল আহমেদের চোখ দু’টো আপনাআপনি বড়ো হয়ে গেল। শ্রাবণী তাকে বলেছিল সে গান গাইবে না। স্টেজে গান গাইতে তার ভালোলাগে না। শ্রাবণী যখন স্টেজে ওঠলো পুরো অনুষ্ঠানের সবার মনোযোগ ওর দিকে। ও যখন গান গাইতে শুরু করলো ওর সুরেলা কণ্ঠের মন্ত্রে চারদিক নীরব হয়ে গেল। কতশত পুরুষ এক দেখাতেই ওর প্রেমে পড়ে গেল। অনুষ্ঠানের পরই কেউ কেউ প্রেম নিবেদনের কথা ভাবতে লাগলো। গান গাওয়া শেষ হতেই চারদিকে করতালি, হৈচৈ। শ্রাবণীর চোখ ভিজে এলো। ওর কতদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। পাবেল হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে। অতিথির আসন ছেড়ে ওর এখন স্টেজে ওঠে বলতে ইচ্ছে করছে,
–‘এ মেয়ে একান্তই আমার। আমার স্ত্রী।’
(চলবে)
প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৪২)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। শ্রাবণী ভিড়ের ভিতর থেকে সরে গিয়ে চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। প্রচণ্ড গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ও একটা আইসক্রিম কিনলো। বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক ওর দিকে এগিয়ে আসছে। গায়ের রং একদম ফর্সা। কালো শার্টে ভালো মানিয়েছে। দেখতে বেশ সুদর্শন। মনে হচ্ছে শ্রাবণীর সাথে কথার বলার উদ্দেশ্যেই আসছে। গান গেয়ে স্টেজ থেকে নামার পর এ পর্যন্ত চারজন প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কেউই সরাসরি এসে বলেনি, মানুষ দিয়ে বলিয়েছে। শ্রাবণী সবাইকে স্পষ্ট গলায় বলে দিয়েছে, আমি বিবাহিতা। আশ্চর্য ব্যাপার! কেউই ওর এই কথা সিরিয়াস ভাবে নেয়নি। ঠাট্টা ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কালো শার্ট পরা সুদর্শন পুরুষটিও কি সেই একই উদ্দেশ্যে নিয়ে আসছে? শ্রাবণী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। ছেলেটা দূর থেকেই পলকহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভারী অস্বস্তিকর ব্যাপার! হাইস্কুলে পা রাখার পর থেকেই সুন্দরী হওয়ার দরুন এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির স্বীকার অসংখ্য বার হয়েছে। অথচ তখন প্রেম, ভালোবাসার মানেটাই বুঝতো না। ছেলেটা ওর কাছাকাছি এসে হালকা কেশে বলল,
–‘শ্রাবণী, তোমায় পাবেল ভাই ডাকছে। তিনি ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন।’
ছেলেটা আঙুল দিয়ে কলেজের পিছন দিকের ফাঁকা, নিরিবিলি জায়গাটা দেখালো। শ্রাবণী মনে মনে ফিক করে হেসে ফেলল। ছেলেটার সম্পর্কে এতক্ষণ কি আজেবাজে ভাবলো। ও মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
–‘কোথায় আপনার পাবেল ভাই?’
ছেলেটা হাত দিয়ে আবার দেখালো। শ্রাবণী বলল,
–‘ও আচ্ছা। আপনি যান আমি আসছি।’
–‘আরেকটা প্রশ্ন করি?’
প্রশ্ন করতেও সম্মতি চাচ্ছে। ভারী ভদ্রলোক! শ্রাবণী সম্মতি দেওয়ার পর বলে,
–‘আমি মাহফুজ। পাবেল ভাইকে বড়ো ভাইয়ের মত জানি। আমি তো জানি তিনি বিয়েসাদি করেন না। আজ হঠাৎ করে তোমায় দেখিয়ে বলল, এই মেয়েটা আমার বউ। আমার ধারণা তিনি মিথ্যা বলছেন। সম্পর্কে তুমি তার কাজিন-টাজিন হবে হয়ত। আমি কি ঠিক বলেছি?’
শ্রাবণী হ্যাঁ না কিছু বলল না। রহস্যময় ভাবে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে চলে গেল। মাহফুজ বিরক্ত হয়ে পিছন থেকে ডেকে বলল,
–‘আমার প্রশ্নের উত্তরটা তো দিয়ে যাও অন্তত।’
শ্রাবণী পিছনে তাকালো না। সোজা হেঁটে চলে গেল। এক হাত প্যান্টের পকেটে অন্য হাতে মোবাইল চালাচ্ছে পাবেল। শ্রাবণীকে দেখে মোবাইলের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। তারপর জিজ্ঞেস করে,
–‘প্রেমের প্রস্তাব কয়টা পেয়েছো সুন্দরী?’
শ্রাবণী হতাশ হওয়ার ভান করে বলে,
–‘আপনি যেভাবে সবার কাছে আমাকে বউ বউ বলে বেড়াচ্ছেন, প্রেমের প্রস্তাব আর পাবো কিভাবে?’
–‘তুমি না-কি গান গাইবে না? মিথ্যা কেন বললে?’
–‘কোনো কারণ ছাড়াই বলেছি।’
–‘কালো ড্রেসে তোমায় যতটা সুন্দর লাগবে ভেবেছি তারচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। চোখ ফেরানো দায়। আর এত সুন্দর করে গান গাইলে। আমি তোমার গানের মুগ্ধ শ্রোতা শ্রাবণী।’
পাবেল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ গুলো চকচকে করছে। কেমন লোভী দৃষ্টি। শ্রাবণীকে কাছে পাওয়ার ভীষণ লোভ, তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষা তার চেহারায়। শ্রাবণী কি পাবেলের এই চাহনির অর্থ বুঝতে পারছে না? না-কি সব বুঝেও চতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে যাচ্ছে? সেই কবে শ্রাবণীকে একান্তে পেয়েছে মনে নেই। আজ নতুন করে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা জেগেছে মনে।
অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। শ্রাবণী ভ্রু কুঁচকে পাবেলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
–‘কি হলো? কি ভাবছেন?’
পাবেল শ্রাবণীর চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–‘আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো আমি কি ভাবছি? আমার চেহারা দেখেও কি তুমি আমার চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, তৃষ্ণাটা ধরতে পারছো না?’
শ্রাবণী নির্বিকার ভাবে বলে,
–‘আমি মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে পারিনা।’
পাবেলের যেন খানিক রাগ হলো। সে চাপা এক অভিমান নিয়ে বলে,
–‘আচ্ছা বেশ। যাও তুমি। বুঝতে হবে না তোমার। এভাবে সেজেগুজে ঘোরাফেরা করলে কে আবার কখন তুলে নিয়ে যাবে।’
এই বলে পাবেল আর সময় করলো না। সে নিজেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। যাওয়ার আগে শ্রাবণীকে বলল,
–‘পাবেল আহমেদকে এখনো মেয়েরা প্রেমের প্রস্তাব দেয়, বিয়ের প্রস্তাব দেয়। শুধু তুমিই আমায় দাম দিলে না। দিবে কিভাবে? তোমার বুদ্ধি যে হাঁটুর নিচে। খাঁটি হীরাও চিনতে ভুল করছো।’
শ্রাবণী পিছনে ফিরে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,
–‘খাঁটি লোহা।’
পাবেল হেঁটে একটু দূরে গিয়ে আবার উঁচু গলায় বলল,
–‘জায়গাটা ফাঁকা আছে শ্রাবণী। আমি কিন্তু এখন চাইলে তোমায় জড়িয়ে ধরতে চুমু খেতে পারি।’
শ্রাবণী চমকে ওঠে। এক দৌড়ে ওখান থেকে গিয়ে মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে। চারদিকে চোখ বুলায়। পাবেল কি এসেছে ওর পিছনে? না, আশেপাশে কোথায়ও তাকে দেখা যাচ্ছে না। শ্রাবণী রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আয়নায় সামনে দাঁড়ায়। অকারণে নিজেকে দেখে কয়েক মিনিট ধরে। জীবনের প্রতি অনেক বিতৃষ্ণা, তিক্ততা ছিলো শ্রাবণীর। আস্তে আস্তে সেগুলো ধুয়েমুছে যাচ্ছে। এখন নিজেকে ভালোবাসতে শিখছে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।
____________
ভর দুপুরে উত্তপ্ত পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছে পাবেল। মাথার উপর এসে কয়েক খণ্ড মেঘ জমেছে হঠাৎ। গরম চলে গেছে প্রায়। হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে কেবল। সকাল বেলা শীত শীত লাগে। দুপুরে আবার চারদিক তপ্ত হয়ে ওঠে। পাবেল মুনিমের বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটছে। গাড়িটা সকালে খারাপ হয়েছে। ট্যাক্সি, রিক্সা ডাকতে ইচ্ছে হলো না। সেজন্য পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে। মুনিম ভীষণ বুদ্ধিমান মানুষ। বিজ্ঞের মতন গম্ভীর মুখে কথা বলে, উপদেশ দেন। বন্ধু মহলের কেউই তার এই বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব পছন্দ করে না। আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে। অথচ সমস্যায় পড়লে সর্বপ্রথম ছুটে যাবে তার কাছে। পাবেল বসে আছে মুনিমের বাসার ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমের সাজসজ্জা চোখ ধাঁধানো। মুনিম গোসল করছে। পাবেল বসে বসে অপেক্ষা করছে তার জন্য। মুনিমের বউ তুলি এসে নাস্তার ট্রে’টা নিঃশব্দে পাবেলের সামনে রাখলো। তুলি দেখতে রূপবতী। পাবেল এই প্রথম দেখেছে। এবাসায় শেষ কবে এসেছে মনে হয়। ওদের বিয়েতেও থাকার সুযোগ হয়নি। তুলির চেহারায় আড়ষ্ট ভাব। পাবেলের সামনে সে অস্বস্তি বোধ করছে। পাবেল ভেবেছিল তুলি তার সামনে বসে গল্পগুজব করবে। কিন্তু না, সে নাস্তার ট্রে রেখেই চলে গেল। মুনিম কবে যেন বলেছিল তার বউ লাজুক প্রকৃতির, কথাবার্তা কম বলে।
মুনিম গোসল সেরে বের হয়। ড্রয়িং রুমে পাবেলকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
–‘আরে তুই আমার বাড়িতে? আমি কি ভুল দেখছি না-কি?’
–‘না, সঠিক দেখছিস।’
মুনিম সিংগেল সোফাটায় বসতে বসতে বলল,
–‘ফোন-টোন না করে এভাবে হুট করে? কি ব্যাপার?’
–‘কোনো ব্যাপার না। এমনি এসেছি। বেড়াতে এসেছি। তোর বউকে দেখতে এসেছি।’
মুনিম হাসতে হাসতে বলে,
–‘এমনি আসার মানুষ তুই না। দেখেছিস আমার বউকে? নাস্তা দিয়ে গেল যে! ও তো এসে বোধ হয় পরিচয় দেয়নি তাই না?’
–‘পরিচয় ছাড়াই বুঝেছি। তোর মেয়ে কোথায়?’
–‘ঘুমাচ্ছে ও। একটু পরই জেগে যাবে। দুপুর বেলা আধা ঘন্টার বেশি ঘুমায় না।’
–‘তোর একটা কাজ করতে হবে।’
–‘তা তোকে দেখেই বুঝেছি। আমার কাজ বাড়াতে এসেছিস।’
মুনিম একটু থেমে বলল,
–‘তোদের অবস্থা কি বল? তোর বউ কোথায়? আছে না-কি ডিভোর্স হয়েছে?’
–‘ও ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি।’
–‘আমি কি উকিল না-কি যে তুই ডিভোর্সের ব্যাপার নিয়ে এসেছিস আমার কাছে?’
পাবেল বিরক্ত মুখে বলল,
–‘ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলতে আসিনি। আগে পুরো কথা শোন আমার।’
–‘বল।’
–‘শ্রাবণীর সাথে আমি এখন সম্পর্কটা ঠিক করতে চাচ্ছি। ও আমার কথা বুঝতে চাচ্ছে না। এমনও হতে পারে যে আমিই বুঝাতে পারছি না। তুই একটু ওকে বুঝিয়েসুজিয়ে সম্পর্কটা ঠিক করে দে।’
–‘মেয়েটাকে শান্তিমত লেখাপড়া করতে দে অন্তত। তোদের জ্বালায়-ই তো বাসা ছেড়েছে। ও এখন নিজের মত বাঁচতে শিখেছে, ভালো থাকতে শিখেছে। এটা দেখে তোর হিংসা হচ্ছে? প্রেম বেড়েছে?’
–‘না হিংসে না এটা। আমি সত্যি মন থেকে অনুভব করছি ওকে।’
–‘নেশা করা ছেড়েছিস তুই? মেয়েদের সাথে মেলামেশা বাদ দিয়েছিস? মেয়েটা সব ভুলে নতুন করে তোর কাছে যাবে। ক’দিন পর ওকে আর তোর ভালো লাগবে না। তারচেয়ে ভালো হয় ওকে ওর মত থাকতে দে। তুই তোর মদে চুবে থাক, নিত্য নতুন মেয়ে নিয়ে ভালো থাক। এসবেই তো তোর শান্তি তাই না? এটা তো তোর মুখেরই কথা।’
–‘আমি খারাপ অভ্যাস থেকে নিজেকে বের করার চেষ্টা করছি। মানুষ সব সময় এক রকম থাকে না মুনিম।’
–‘ওর লেখাপড়ার খরচ কি তুই দিচ্ছিস?’
–‘না।’
–‘আগে ওর প্রতি ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন কর। তারপর ভালোবাসার কথা শুনাস।’
–‘আচ্ছা ওর লেখাপড়া খরচ আমি দিবো।’
–‘এটা আরো আগে দেওয়া উচিত ছিলো।’
–‘মাথায় ছিলো না। তোকে যা বলেছি তা কি তুই করবি না?’
–‘আমি নিজেই তো তোকে বিশ্বাস করতে পারিনা ঠিকঠাক। অন্যকে বিশ্বাস করতে বলবো কিভাবে?’
পাবেলের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে মুনিমের উপর। মনে মনে কয়েকটা গালি দিলো তাকে। মেজাজ খারাপ করে বলল,
–‘আচ্ছা কিছু করতে হবে না তোর। আমি গেলাম।’
পাবেল সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। মুনিম বলল,
–‘আরেহ বোস বোস। রাগ করলে হবে? আমি যা বলেছি তা কি মিথ্যা? আমার মেয়ে ওঠেছে। দেখে যা। তোর ব্যাপারটা ভেবে দেখবো।’
ফুটফুটে তিন-চার বছরের একটা মেয়ে দৌড়ে আসে ড্রয়িং রুমের দিকে। এসেই লাফ দিয়ে মুনিমের কোলে ওঠে বসে। ভীষণ স্নিগ্ধ, সুন্দর চেহারা মেয়েটার। নাম পুতুল। দেখতেও পুতুলের মতন। পাবেল রাগ কমিয়ে বসে। কতক্ষণ অনর্থক ছেলেমানুষী কথাবার্তা বলে পুতুলের সঙ্গে। তারপর চলে আসে।
_____________
শীতের প্রকোপ বেড়েছে। হিমশীতল উত্তরা বাসাতে গায়ে কাঁপন ধরায়। এমনই এক শীতের বিকালে মুনিম দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। ইন্টার সেকেণ্ড ইয়ারেরও কয়েক মাস চলে গেছে শ্রাবণীর। পাবেল ভেবেছিল শ্রাবণীর রাগ, জেদ বড়ো জোর কয়েক মাস পরই নড়বড়ে হয়ে যাবে। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে শ্রাবণী। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। পাবেলের প্রতি যে আগের মত রাগ আছে তাও না। কিন্তু বিয়ের পর শ্রাবণীর যে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকেই ও বুঝেছে আত্ম সাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। জীবনের মোড় যেকোন সময় ঘুরে যেতে পারে। দিন শেষে নিজের বলে কিছু থাকা চাই, নিজের আলাদা একটাই পরিচয় দরকার। এই চিন্তাটা সর্বপ্রথম ওর মাথায় যাইফ ঢুকিয়েছিল। মুনিমকে দেখে অবাক শ্রাবণী। তাকে এর আগে মাত্র একবার দেখেছে। তবুও তার চেহারা ভুলেনি। না ভোলার বিশেষ একটা কারণ আছে। মুনিমের প্রতি শ্রাবণীর মনে অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। তা অবশ্য মুনিম জানেন না। পাবেল একবার তার সব বন্ধুদের দাওয়াত করেছিল। তখন মুনিমও এসেছিল। সেদিন শ্রাবণী আড়ালে দাঁড়িয়ে মুনিম আর পাবেলের কথা শুনেছে। সেদিনের সেই কথা শুনেই বুঝেছিল মুনিম ভীষণ ভালো মানুষ। আর পাবেল জঘন্য একজন মানুষ।
(চলবে)
প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৪৩)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
মুনিম কয়েক পা এগিয়ে শ্রাবণীর দিকে যায়। হালকা হেসে বলে,
–‘আমি পাবেলের বন্ধু। মুনিম।’
শ্রাবণী কোনো ভনিতা না করে বলল,
–‘চিনতে পেরেছি।’
–‘তুমি আমায় কিভাবে চিনলে? এর আগে তো তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি।’
–‘হ্যাঁ তাই তো। তাহলে আপনি আমায় কিভাবে চিনলেন?’
–‘তুমি বেশ বুদ্ধিমতী। পাবেল চিনিয়ে দিয়েছে।’
শ্রাবণী আশেপাশে চোখ বুলালো। মুনিম বলল,
–‘পাবেল নেই এখানে। ও চলে গেছে।’
মিথ্যা বলল মুনিম। পাবেল আশেপাশেই আছে।
–‘শ্রাবণী আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। একটু না অনেকখানি। সময় হবে তোমার?’
শ্রাবণী হাতের কব্জিতে আবদ্ধ ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘হ্যাঁ হবে সময়। এখানে দাঁড়িয়েই বলবেন? আর আপনাকে কি আপনার বন্ধু পাঠিয়েছে? আমি হয়ত বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে এসেছেন।’
–‘তার আগে বলো তুমি আমায় চিনলে কিভাবে? এর আগে তো কখনো তোমার সাথে আমার আলাপ হয়নি।’
–‘আপনারা বন্ধুরা মিলে একবার গিয়েছিলেন বাসায়। তখন আপনায় দেখেছিলাম। আপনি অবশ্য আমায় দেখেননি।’
–‘তোমার স্মৃতিশক্তি তো বেশ ভালো। আচ্ছা চলো আগে কোথায়ও বসি। তারপর কথা বলি।’
শ্রাবণী মুনিমের পিছনে পিছনে হাঁটলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা পাবেলকে হঠাৎ দেখে ফেলল ও। বেশ আরাম করে সিগারেট ফুঁকছে সে। মুনিম বলেছিল পাবেল এখানে নেই, চলে গেছে। শ্রাবণী তার কথা বিশ্বাস করেনি। ও জানে সে এখানেই আছে।
শ্রাবণী মুনিমের মুখোমুখি বসলো। শরীরটা ক্লান্ত আজ ওর। ঘুম পাচ্ছে। ক্ষুধাও লেগেছে। দুপুরে খায়নি। হাত-পা ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। মুনিমের সাথে দেখা না হলে এতক্ষণে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতো। কিন্তু একটা মানুষ কথা বলতে এসেছে তাকে না করলে কেমন খারাপ দেখায়। মুনিম বলল,
–‘শ্রাবণী কি অর্ডার করবো তোমার জন্য? কি খেতে পছন্দ করো তুমি?’
–‘এখন আমি কিছুই খাবো না ভাইয়া। একটু আগেই খেয়েছি।’
মিথ্যা বলল। স্বল্প পরিচিত একজন মানুষের টাকায় খেতে ওর ভালো লাগবে না, অস্বস্তি হবে। মুনিম জোর করে বলল,
–‘বিরিয়ানি অর্ডার করি?’
–‘না, না। আমি খাবো না। আপনি শুধু আপনার জন্য এক প্লেট অর্ডার করুন।’
মুনিম এ পর্যায়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। সে মূল প্রসঙ্গে আসতে চলেছে। মনে মনে কথা গোছালো। তারপর বলল,
–‘আমাকে যে পাবেল পাঠিয়েছে তো হয়ত আমি অস্বীকার করলেও তুমি বিশ্বাস করতে না। বেচারা না-কি নিজের মনের কথা গুলো তোমায় ঠিকঠাক বুঝাতে পারছে না। সেজন্য আমায় বুঝাতে পাঠালো।’
শ্রাবণী কিছু বলল না। মুনিম আবার বলল,
–‘আমার কি মনে হয় জানো? পছন্দের মানুষের জন্য নিজেকে বদলানোর চেষ্টা, খারাপ অভ্যাস গুলো ছাড়ার চেষ্টা পৃথিবীর অতি সুন্দর জিনিস গুলোর একটি। মানুষটা অতীতে যতই অপরাধ করুক না কেন তাকে একটু সুযোগ দেওয়া বোধ হয় উচিত তাই না?’
মুনিম এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বুঝালো শ্রাবণীকে। শ্রাবণী তার কথা গুরুত্ব দিচ্ছে কি দিচ্ছে না তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে বেশ মনোযোগী শ্রোতার মতন শুনছে। মুনিম ভীষণ চমৎকার ভাবে মানুষকে বুঝাতে পারে, কথা বলার ভঙ্গি মনোমুগ্ধকর। নিচু গলায় ছোট ছোট করে কথা বলে। মুনিমের কথা শেষ হওয়ার পর শ্রাবণী বলতে শুরু করে,
–‘আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না আমি আপনাকে কিভাবে চিনি? আপনারা সব বন্ধুরা বাসায় গেলেন। যেকোন রাগের বশত আমি আপনাদের সামনে যাইনি। আপনি আর আপনার বন্ধু তিনতলায় বসে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। আমার প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিলো। আমি সেদিন আড়াল থেকে শুনেছি আপনাদের কথাবার্তা। আড়াল থেকে কারো কথা শোনা উচিত না। হয়ত সেদিন আমি অনুচিত একটা কাজ করেছিলাম।’
শ্রাবণী থামলো। অনেকক্ষণ থেমে থেকে আবার বলতে শুরু করে,
–‘আপনি তাকে নানান ভাবে বুঝাচ্ছিলেন। কিন্তু সে আপনার কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। তার চোখেমুখে ছিলো বিরক্তি কেবল। সেদিন আপনার প্রতি আমার একটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে আমি আপনার নাম, চেহারা কিছুই ভুলিনি। আচ্ছা আপনার মনে আছে সেদিন আপনার বন্ধু কি বলেছিল? মনে না থাকলেও আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। কোনো মেয়ের প্রতিই আমার অনুভূতি দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। নিত্য নতুন মেয়ে, মদ গাঁজায় চুবে থাকা কি শান্তির জীবন–এই কথা গুলো আমার ব্রেনে গেঁথে গেছে ভয়াবহ ভাবে। এতদিনে আমি একটুও ভুলিনি। আমি যখনই তাকে বিশ্বাস করার কথা ভাবি তখনই নতুন করে মনে পড়ে।’
মুনিম থতমত খেয়ে গেল। শ্রাবণী ওসব কথা শুনেছে তা তার জানা ছিলো না,
–‘তুমি একটু ওকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো সত্যি সত্যি সে বদলিয়েছি কি-না।’
–‘খারাপ কাজে জড়ানো ভীষণ সহজ। কিন্তু ও থেকে বের হওয়া কঠিন। যা অধিকাংশ মানুষই পারে না।’
–‘অধিকাংশ মানুষ পারে না। তার মানে অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ তো পারে। পাবেল কি সেই অল্পসংখ্যক মানুষের একজন হতে পারে না?’
–‘আপনার সাথে আমি যুক্তিতে পারবো না।’
–‘তাহলে আমার যুক্তি মেনে নেও।’
শ্রাবণী অনেক সময় ভাবলো। মুনিম ডিস্টার্ব করলো না। এই ফাঁকে সে এক কাপ কফিও খেয়ে নিলো।
–‘তোমার দরকার হলে দুইদিন সময় নেও। ভালো ভাবে ভাবো। ভেবে অবশ্যই আমায় জানাবে।’
দুইদিনেও শ্রাবণীর ভাবনা ফুরালো না। টানা কয়েকদিন ওঠতে-বসতে ভেবেছে। ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে গেছে। সেদিন মুনিম ওর ফোন নম্বর নিয়েছিল। সে এখন দিনে কয়েকদিনে কয়েকবার ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, তোমার কি চিন্তাভাবনা শেষ হয়নি? কবে জানাবে? শ্রাবণী এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। সেলিম হোসেনের সাথে কথা বলেই নিয়েছে। তারপর নিজেই ফোন করে ডাকলো মুনিমকে। মুনিম বেশ উত্তেজনা নিয়ে আসলো। সে ব্যগ্র হয়ে আছে শ্রাবণীর কথা শুনতে। আর ওদিকে পাবেল তো প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। শ্রাবণী একদম ঠাণ্ডা, শীতল মেজাজে বলল,
–‘আমি আপনার যুক্তি মেনে নিয়েছি। আমি তাকে সুযোগ দিচ্ছি। কিন্তু…।’
মুনিম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
–‘আহ! কিন্তু কি? তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমার বন্ধু ধৈর্যহারা হয়ে যাচ্ছে।’
শ্রাবণী যেন ধৈর্যর পরীক্ষা নিচ্ছে। সে দীর্ঘ সময় চুপ থাকলো। মুনিমের অস্থিরতা দেখে হেসে বলল,
–‘কিন্তু আপনার বন্ধুকে জব করতে হবে। ছোটখাটো যেকোন একটা জব হলেই হবে। বেকার থাকা যাবে না। আর তার বাবা-মা যেন আমার সাথে কোনো দুঃর্ব্যবহার না করে সেটাও তাকে নিশ্চিত করতে হবে।’
–‘ও একজন নেতা মানুষ। ভবিষ্যতে এমপিও হয়ে যাবে দেখো। তাছাড়া ওর বাপের বড়ো বিজনেস আছে। চাকরি না হলেও চলে। রাজনীতি নিয়েই ও ব্যস্ত থাকে। চাকরির সময় কোথায় বলো?’
–‘রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলেই মদ গাঁজা খাওয়ার অফুরন্ত সময় পায়। চাকরি করলে তা আর পাবে না। আর বাপের বড়ো বিজনেস। তাতে তার কি?’
–‘আচ্ছা আমি ওকে বলবো। ও কি বলে তা তোমায় জানাবো। বেচারা সারাজীবন বাপের টাকা আয়েশ করে উড়িয়েছে। এই বয়সে এসে চাকরির মত প্যারা নিতে রাজি হবে?’
শ্রাবণীর ওখান থেকে গিয়ে মুনিম আবার পাবেলের কাছে গেল। কি এক বিপদে পড়লো এদের ব্যাপারটা নিজের কাঁধে নিয়ে। নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে এখন। পাবেল কয়েকদিন যাবৎ ওকে দৌড়ের ওপর রেখেছে। আজকেই শেষ। এরপরে আর ও নেই এসবে। মুনিম গিয়ে পাবেলের সামনে পায়ে পা তুলে বসে বলল,
–‘তোকে চাকরি করতে হবে। ছোটখাটো যেকোন চাকরি।’
পাবেল সব শুনতে রাজি। কিন্তু চাকরির কথা শুনে হতাশ। বলল,
–‘তুই ওকে বল ওর যত টাকা, যত যা চাই সব আমি দিবো। চাকরি করতে পারবো না।’
শ্রাবণী মানলো না। মুনিম পাবেলকে বুদ্ধি দিলো,
–‘আরেহ শোন। যে কোনো একটা কোম্পানিতে ঢুকে যা। তোর তো কত আত্মীয় আছে। দুই এক মাস করে ছেড়ে দিস।’
পাবেল কিছু বলল না। মুনিম বলল,
–‘তোকে ভীষণ অসহায়ের মত লাগছে রে।’
বলেই হো হো করে হাসলো। তারপর আবার বলল,
–‘এবার সবাইকে ডেকে ফাইভ স্টারে ভরপেট খাওয়াতে হবে পাবেল। আমি ওদের সবাইকে ফোন দিচ্ছি।’
ফাইভ স্টারে খাওয়া-দাওয়া হলো, পার্টি হলো। কিন্তু চাকরির ব্যাপারটা মনে পড়লেই পাবেল বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কি যে যন্ত্রণা! এই মেয়ে এত ওর চেয়ে কয়েক কাঠি সরেস।
_______________
পাবেল চাকরি করবে শুনে জয়নাল সাহেব হাঁ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তিনি কি কানে ভুল শুনছেন না-কি তার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেল? পাবেল বেশ কয়েকবার বলার পরেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না।
–‘তুই ঠিক আছিস তো? তোর শরীর-মন সব ঠিক আছে? আজকে কি বেশি গিলেছিস? এক ঘন্টা বাথটাবের ঠাণ্ডা জলে থেকে মাথা ঠিক করে আয়।’
–‘আশ্চর্য! তুমি এভাবে বলছো কেন বলো তো? আমি পুরোপুরি ঠিক আছি, আমার মাথা ঠিক আছে।’
–‘না, তোর মাথা ঠিক নেই।’
–‘বাবা আমার চাকরির দরকার। বেশি না তিন-চার মাসের জন্য। এমন তো না যে চাকরি করার মত যোগ্যতা আমার নেই।’
জয়নাল সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
–‘তোকে কত হাজার বললাম আমার সাথে ব্যবসা দেখাশোনা কর। ওইটুকুই তো ধৈর্য্যে কুলায় না। আর তুই কি-ন চাকরির কথা বলছিস? ঘটনা কি বল তো। তুই কি চাকরি করে দেখিয়ে দিবি বলে কারো সাথে বাজি ধরছিস?’
–‘তোমার এত প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারবো না। আমার প্রয়োজন দেখেই তো তোমার কাছে বলেছি।’
জয়নাল সাহেব তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললেন,
–‘কিসের চাকরি করবি তুই? তোর যদি শুভ বুদ্ধি উদয় হয়, সৃষ্টিকর্তা যদি তোকে বুঝ জ্ঞান দিয়ে থাকে তাহলে আমার সাথে ব্যবসা কর।’
–‘না, আমার চাকরিই দরকার। আগামী কয়েকদিনের ভিতরই তুমি সেটা ম্যানেজ করবে।’
–‘তুই পারিস না ম্যানেজ করতে? আমায় বলছিস কেন?’
–‘হ্যাঁ পারি। কিন্তু ওসব নিয়ে আমার টাইম নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না।’
এই বলে পাবেল চলে গেল। জয়নাল সাহেব এখনো আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা হজম করতে সময় লাগবে তার।
পাবেল একটা কোম্পানিতে চাকরি নিলো। আজ তার অফিসের প্রথম দিন। বেচারার চোখেমুখে এক রাজ্যের বিরক্তি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো। এরপরও যদি শ্রাবণী কোনো তালবাহানা করে তো তাহলে তার হাত-পা ভেঙে বাসায় নিয়ে আসবে। ওর এত দুর্দিন এসে গেল যে চাকরি করতে হচ্ছে! প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। শ্রাবণীর কাছে ফোন দিয়ে শক্ত গলায় বলল,
–‘আমি অফিসে যাবো। কলেজের সামনে দাঁড়াও তুমি। এখনও যদি কোনো ঢং করো তো হাত-পা ভেঙে রাস্তায় বসিয়ে রাখবো।’
শ্রাবণী হাসি চাপিয়ে রেখে হালকা গলায় বলল,
–‘আপনি অফিসে যাবেন তো আমার কলেজের সামনে দাঁড়াতে হবে কেন? আমার কাজ আছে। আমি ওসব পারবো না।’
শ্রাবণী পাবেলকে একটু রাগিয়ে দিতে চাইলো। পাবেল তীব্র রাগ নিয়ে লম্বা স্বরে ডেকে বলল,
–‘শ্রাবণীইইইই। মেজাজ খারাপ করো না তুমি আমার।’
পাবেল শ্রাবণীর সামনে এসে গাড়ি থামালো। সাদা একটা শার্ট ইন করে পরা, গলায় টাই বাঁধা। আহা! কি নিরীহ লাগছে! গাড়ি থেকে নেমে ভরা রাস্তায় শ্রাবণীর গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে চলে গেল। একটি কথাও বলল না। শ্রাবণী বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।
(চলবে)