প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
377

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩৮+৩৯+৪০
ইসরাত জাহান তানজিলা
_______________________
সকাল বেলা বড়ো একটা অঘটন ঘটে গেল। পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত। এ বাসার বাজার সদাই সাধারণত মিজান উদ্দিনই করে। রোজকার মত সে বাজার নিয়ে আসলো। দু’হাতে বড়সড় সাইজের দুইটা বাজারের ব্যাগ। বেশ ভারী। বেচারা হাঁপিয়ে গেছে। সকাল বেলার ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ভিতরও সে ঘেমে একাকার। ফরিদা বেগম বাসার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে আছে বিক্ষিপ্ত মেজাজে। আজকাল পাবেলের আচরণ তিনি সহ্য করতে পারছেন একদম। শ্রাবণীর প্রতি পাবেলের অত দরদ তার কাছে বিষাক্ত লাগছে। ছেলেটা আগে মোটেও এরকম ছিলো না। এখন ফরিদা বেগমের কথার কদর করছে না, গুরুত্ব দিচ্ছে না। তার কথার চেয়ে শ্রাবণীর কথার গুরুত্ব যেন পাবেলের কাছে দিন দিন বেড়ে চলেছে। ওইটুকু একটা মেয়ে কাল এসে আজ তার ছেলের মাথা খাবে এটা তিনি মানতে পারবে না। এসব ভাবলেই ফরিদা বেগমের মন রাগে জ্বলে ওঠে। মানসিক অশান্তি হয়। তিনি অতি কষ্টে রাগ চাপায়। চোখ দুটো গভীর ভাবে বন্ধ করে। চেহারা বিক্ষুব্ধ দেখাচ্ছে। মিজান উদ্দিন বাজারের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে বাসার দিকে যাচ্ছে। ফরিদা বেগম হাঁটার শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। গম্ভীর গলায় ডাকল,
–‘মিজান মিয়া এদিকে আসো।’

বাজারের ভারী ব্যাগ দুইটা বাসার ভিতর নিয়ে রাখতে পারলেই মিজান উদ্দিন বাঁচে। হাত লাল হয়ে গেছে তার। গাড়ি ভাড়া বাঁচাতে পুরো রাস্তা হেঁটে এসেছে। ফরিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
–‘ব্যাগটা রাইখা আসি খালা।’

ফরিদা বেগমের মুখখানি ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে যায়। এমনিতেই সে রেগে আছে। রাগটা অযথা মিজান উদ্দিনের উপর ঝাড়লেন,
–‘আমি তোমায় এখন আসতে বলছি। মুখের উপর কথা কেন বলো? কাল থেকে আসতে হবে না আর তোমার। নতুন মানুষ রেখে নিবো।’

চাকরিচ্যুত করার হুমকি শুনে মিজান উদ্দিন ভীত হলো না। এরকম হুমকি ফরিদা বেগম প্রায়ই দেয়। সে অনিচ্ছাকৃত ভাবে গেল ফরিদা বেগমের কাছে। ফরিদা বেগম কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘দারোয়ান আসেনি কেন আজ? তোমাদের তো গলায় গলায় খাতির। তার চাকরিও নট করে দিবো।’

–‘খাতির আর কি! আমার লগে দেখা হইলেই টাইন্নাটুইন্না আমারে চায়ের দোকানে লইয়া যাইবে। নিজের পকেট থেকে চাইর আনাও বাইর হয় না। বিল আমারই দিতে হয়। ব্যাটা আস্ত কিপ্টা খালা।’

–‘মেয়ের অসুখের কথা বলে তিন মাসের বিল অগ্রিম নিয়া রাখছে আর এখন…।’

ফরিদা বেগমের কথা শেষ হতে পারে না। মিজান উদ্দিন বলে ওঠে,
–‘দেখা হইছিলো আমার লগে। আমারে একটা চিডি দিছে। আর বলছে তার শরীর ভালো না। আজ আইবে না। আমি তো দেখছি শরীর পুরা ভালো, ফিটফাট। ওসব মিছা কথা।’

ফরিদা বেগম ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে তাকায়। সামান্য আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
–‘চিঠি? কিসের চিঠি?’

–‘আপনার ছেলের বউরে দিতে কইছে। আমারে খুলতে মানা করছে। তারপরও খুলে দেখছি। কিন্তু আমি তো পড়তে পারিনা।’

ফরিদা বেগম ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘কোথায় চিঠি? দারোয়ান শ্রাবণীকে কিসের জন্য চিঠি দিবে? কই দেও তো আমাকে।’

মিজান উদ্দিন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল,
–‘আপনারে দিমু? আপনার ছেলের বউরে দিতে কইছে।’

মিজান উদ্দিনের এখন মনে হচ্ছে ফরিদা বেগমকে চিঠির কথা বলাটা ভুল হয়েছে। কথার স্রোতে মুখ ফসকে বেড়িয়ে পড়ল। ফরিদা বেগম কঠিন স্বরে আদেশ দিলো,
–‘কি হলো মিজান মিয়া? চিঠিটা দিতে বলছি না তোমাকে? দেও।’

মিজান উদ্দিন অনিচ্ছাকৃত ভাবে চিঠিটা বের করলো পকেট থেকে। এক টুকরো কাগজ। দুই ভাঁজ করা। ফরিদা বেগম কাগজটা হাতে নিয়ে বলল,
–‘তুমি যাও এখন। ব্যাগ রেখে এসো।’

মিজান উদ্দিন মাথা নাড়ায়। সে চলে গেল। ফরিদা বেগম বিস্মিত। দারোয়ান বাড়ির বউকে চিঠি দিচ্ছে। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাগজটার ভাঁজ খুললেন। তাতে লেখা–
শ্রাবণী আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। আমার মনে হচ্ছে আমি ধরা পড়ে যাবো। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।

ছোট ছোট অক্ষরে এই চারটা লাইনই লেখা কেবল। ফরিদা বেগম চমকিত মুখে কয়েক বার পড়লো চিঠিটা। দারোয়ান পালিয়ে গেছে? কিসের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে শ্রাবণীর কাছে? কি অন্যায় করেছে? দারোয়ানের সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিলো শ্রাবণীর? তার মনে এই মুহূর্তে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। তিনি তড়িৎ গতিতে ছুটে গেলেন বাসার দিকে। বাসায় ঢুকে প্রথমেই জয়নাল সাহেবকে ডাকলো। জয়নাল সাহেব তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। হঠাৎ করে তার শরীর খারাপ করেছে। ফরিদা বেগমের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তিনি বিরক্ত গলায় বলল,
–‘বাসায় মরেছে কেউ? এরকম ডাক চিৎকার দিচ্ছো কেন?’

ফরিদা বেগম জয়নাল সাহেবের হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিলো। তিনি চিঠিটা পড়ে অবিশ্বাস্য গলায় বললেন,
–‘দারোয়ান লিখেছে এই চিঠি? দারোয়ান পালিয়ে গেছে? শ্রাবণীর সাথে দারোয়ানের কি সম্পর্ক? ওই ব্যাটা তো মেয়ের অসুখের কথা বলে আমার কাছ থেকে তিন মাসের বেতন অগ্রিম নিয়েছে। এত বছর ধরে কাজ করে। সেই বিশ্বাসে দিয়েছি।’

জয়নাল সাহেব হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। ওই বুড়ো লোকের সাথে শ্রাবণীর কি সম্পর্ক হতে পারে? তিনি পাবেলকে ডাকলেন। পাবেল পরম আশ্চর্যে শ্রাবণীকে কেবল জিজ্ঞেস করল,
–‘এগুলো কি শ্রাবণী?’

শ্রাবণী হতভম্ব। ও তৎক্ষণাৎ কিছুই বলতে পারলো না। বলার মত কিছু খুঁজে পেল না। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। পাবেল ফের ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করে,
–‘এগুলো কি শ্রাবণী? কথা বলছো না কেন?’

শ্রাবণী বিচলিত মুখে থেমে থেমে বলে,
–‘আমি কিছুই জানি না।’

ফরিদা বেগমের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে। তার আর গায়ে সইছে না। তিনি গলা ছেড়ে হুংকার দিয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে বলল,
–‘দারোয়ানের মত বুড়ো লোকের সাথে তো বউয়ের কি সম্পর্ক ছিল জিজ্ঞেস কর? কি কুকর্ম করেছে যা ধরা পড়ার ভয়ে দারোয়ান পালিয়ে গেছে?’

–‘মা দারোয়ান চিঠিতে লিখে দেয়নি যে তার সাথে শ্রাবণীর কি সম্পর্ক ছিলো বা কেন‌ ক্ষমা চেয়েছে। যেটুকু লিখেছে তাতে কোনো কিছুই পরিষ্কার না। যতক্ষণ না পরিষ্কার হয় ততক্ষণ শ্রাবণীকে একটিও বাজে কথা বলবে না।’

ফরিদা বেগমের চোখ কপালে ওঠে গেল যেন। দারুণ ক্রোধ নিয়ে তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকায়। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যতম বস্তুটি দেখছে তিনি এই মুহূর্তে। কয়েক পা এগিয়ে গেল পাবেলের দিকে,
–‘বউয়ের হয়ে ওকালতি করিস? এই মেয়েটা মাথা খেয়েছে তোর?’

জয়নাল উদ্দিন এতক্ষণ নীরব ছিলেন। রাগ হলে তিনি এরকমই গম্ভীর হয়ে থাকে। চুপচাপ চিন্তাভাবনা করে ঠাণ্ডা মাথায়। নীরবতা ভেঙে শান্ত গলায় বলল,
–‘পাবেল, দারোয়ান যেখানে থাকত সেখানে একটু খোঁজ নিয়ে দেখ তো সেখান থেকেও পালিয়ে গেছে কি-না। বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার, পরিষ্কার হওয়া দরকার।’

আনোয়ার মিয়া আগে এই বাসার নিচ তলার ছোট্ট ঘরটাতেই থাকত। তার বউ গ্রামে থাকতো। মেয়ে অসুস্থ বলে ঢাকায় এসেছিল ডাক্তার দেখাতে। জয়নাল সাহেবের কাছে ভীষণ অনুরোধ করল মেয়ের চিকিৎসার জন্য কয়েক মাসের টাকা অগ্রিম দিতে। জয়নাল সাহেব বিশ্বাস করে দিলেন টাকা। ডাক্তার দেখানোর তার পর বউ আর গ্রামে যেতে চাইল না। অতি সত্বর তাকে একটা বাসা ভাড়া নিতে হলো।

পাবেল উদ্বিগ্ন হয়ে বাসা থেকে বের হলো। আনোয়ার মিয়াকে পেলে হাড়গোড় ভেঙে দিবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে মনে কুৎসিত ভাবে গালি দিচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। পাবেল পুরোপুরি সুস্থ হলেও গাড়ি চালাতে কিছুটা অসুবিধা হয়। শ্রাবণী সোফায় বসে আছে। চিন্তিত মুখ। ভেবে কুল পাচ্ছে না। দারোয়ান কেন এসব লিখলো? কি অন্যায় করেছে ওর সাথে? কেন‌ লিখলো এরকম অদ্ভুত চিঠি? এসব যতই ভাবছে ততই অস্থির আর ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ছে। ওদিকে ফরিদা বেগম এখনো থামেনি। পাবেল‌ বাসা থেকে বের হওয়ার পর আবার শুরু করেছে। তার কথায় বাজে ইঙ্গিত রয়েছে। দারোয়ানের সাথে শ্রাবণীর প্রেম ট্রেমের সম্পর্ক ছিলো- ফরিদা বেগম এমন কিছুই ইঙ্গিত করছে। ঘৃণায় আর লজ্জায় শ্রাবণীর গা গুলিয়ে আসছে। ওর মাথার ভিতর যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। ভেবে ভেবে দিশেহারা। ফলাফল শূণ্য। দারোয়ানের এরকম চিঠি লেখার কোনো কারণই খুঁজে পেল না। মিছে মিছে এ ধরণের চিঠি একজন মানুষ লিখবে? ভয়াবহ রকমের দুর্ভাবনায় শ্রাবণীর মন অস্থির হয়ে ওঠল।

পাবেল খোঁজ নিয়ে দেখলো দারোয়ান বাসা ছেড়ে দিয়েছে। সে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলো। বাসার সবাই বিষয়টা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ফরিদা বেগম। তিনি পাবেলকে বলল,
–‘ওসব খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে নিজের বউয়ের কাছে জিজ্ঞেস কর। সে সব জানে।’

জয়নাল সাহেব শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল,
–‘শ্রাবণী তোমার কি মনে হচ্ছে দারোয়ান মিছে মিছে তোমায় একরকম একটা চিঠি লিখেছে? একজন মানুষকে এরকম একটা মিথ্যা চিঠি লেখার যৌক্তিকতা কি? বাড়ির বউকে দারোয়ান এরকম চিঠি লিখে! কেমন নোংরা ব্যাপার। মানুষ শুনলে কি ভাববে।’

শ্রাবণী থমথমে মুখে বলল,
–‘দারোয়ান চাচার দেখা হলে উনি নিজ থেকেই আমার সাথে টুকটাক কথা বলতেন। তাও হাতে গোনা কয়েকবার কথা হয়েছে। আমি জানি না উনি কেন এরকম চিঠি লিখলো।’

পাবেল বিষয়টা মাথা থেকে ঝাড়তে পারছে না কিছুতেই। ওর জানতে হবে যেভাবেই হোক। জয়নাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করল,
–‘বাবা দারোয়ানের গ্রামের বাড়ি কোথায় যেন ছিলো? বরিশাল?’

–‘হ্যাঁ। তুই কি এখন গ্রামের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিবি?’

পাবেল জোর গলায় বলল,
–‘আমার জানতে হবে বিষয়টা।’

শ্রাবণী শুয়ে আছে চোখ বুজে। মাঝে মাঝে ভ্রু দু’টো কুচকাচ্ছে। রাত প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। পাবেল রুমে আসলো। শ্রাবণীকে ডেকে তুলল। চাপা গলায় প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘দারোয়ানের সাথে তোমার কি সম্পর্ক ছিলো? একদিন বাসায় ঢোকার সময় দারোয়ানের সাথে সিঁড়িতে দেখা হয়েছিল আমার। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। বোধ হয় চাচ্ছিল না আমার সাথে দেখা হোক। তবুও হয়ে গেল। তোমায় জিজ্ঞেস করার পর তুমি কথা ঘুরানোর জন্য বলেছিল বেড রুমের ফ্যানটা চলছে না। কিন্তু ফ্যান ঠিকঠাকই চলছিলো।’
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩৯)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_______________________
পাবেল প্রশ্নটা করার পর শ্রাবণী কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে রইল। এই ব্যাপারটা পাবেল মনে রাখবে শ্রাবণী সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কি উত্তর দিবে এখন? যা সত্যি তা বলে দেওয়াই উচিত মনে হয়। বলার আগে পাবেলকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো ওর। ও গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল,
–‘আপনাদের বাসার সবাই আমায় প্রশ্ন করছে দারোয়ানের সাথে আমার কি সম্পর্ক ছিলো? একটু আগে আপনিও একই প্রশ্ন করলেন। আপনার কি ধারণা বাপের বয়সী একজন লোকের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো? আপনার মা তো সেরকমই ইঙ্গিত করছে।’

পাবেল বিরক্ত মেজাজে উত্তর দিলো,
–‘আমি তোমায় শুধু জিজ্ঞেস করেছি কি সম্পর্ক ছিলো। সম্পর্ক মানে তো কেবল প্রেম বুঝায় না শ্রাবণী। আমি বাসায় না থাকাকালীন এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে, এভাবে চিঠি লিখে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া। এর মানে কি দাঁড়ায়? তোমাদের দুজনের মাঝে গোপন একটা বিষয় ছিলো। আমি জানতে চাচ্ছি সেই গোপন বিষয়টা কি? কি অন্যায় তোমরা করেছো? কিসের ধরা পড়ার ভয়?’

শ্রাবণী কথা বলছে না। পাবেল আবার বলল,
–‘মায়ের কথা নিয়ে মন খারাপ করো না। মা তোমায় পছন্দ করে না। আমরা যাকে অপছন্দ করি সুযোগ পেলেই তাকে হেনস্থা করতে চাই। তোমার চৌত্রিশ বছর বয়সী পাবেল আহমেদকেই ভালোলাগে না আর ষাট বছর বয়সী দারোয়ান আনোয়ার মিয়াকে ভালো লাগবে। গাঁজাখুরি, অযৌক্তিক, উদ্ভট কথাবার্তা।’

পাবেলের কৌতুক ভরা গলা। হো হো করে হাসলো সে। এরকম সিরিয়াস মুহূর্তে পাবেলের এই রসিকতা দেখে শ্রাবণীর কপালে ভাঁজ পড়ে। ও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। পাবেলের হাসি থামলে শ্রাবণী বলে,
–‘ভালো মানুষ হলে বয়স চৌত্রিশ কেন চল্লিশ হলেও প্রেমে পড়া যায়। আপনি তো হলেন…।’

পাবেল‌ শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে গেল। ওর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। দু’হাতে ওর গাল চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,
–‘এই মেয়ে কি আমি? থামলে কেন বলো?’

শ্রাবণী ব্যঙ্গ করে বলল,
–‘আপনি ভীষণ ভালো। কিন্তু দুনিয়াতে খারাপ কাছ যা আছে একটাও বাদ রাখেননি।’

পাবেলও শ্রাবণীর মত করে বলল,
–‘ও আচ্ছা। দারোয়ান ষাট বছর বয়সী হলেও ভীষণ ভালো মানুষ ছিলো বোধ হয়। সেজন্য তুমি তার প্রেমে পড়ে গেলে। প্রেমের পর বেচারাকে বোধ হয় বিয়ের জন্য চাপ দিলে। সেজন্য পালিয়ে গেল।’

পাবেলের কণ্ঠে রসিকতা। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার মতন রসিক মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। নয়ত এমন সিরিয়াস মুহূর্তে মানুষ মশকরা, ইয়ার্কি করতে পারে? হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ার জোগাড় তার। শ্রাবণী চোখ লাল করে তাকিয়ে রইল। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে ও ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। কিন্তু ভিতরে এর উল্টো। ওর কেন যেন রাগ হলো না। পাবেল হাসি থামিয়ে আবার আফসোসের সুরে বলল,
–‘আনোয়ার মিয়ার তো সামনের দুইটা দাঁত নেই। আমার তো দাঁত সবগুলোই আছে। তবুও আমায় ভাল লাগলো না?’

শ্রাবণী বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
–‘আশ্চর্য! মজা করার মত বিষয় মনে হচ্ছে এটাকে আপনার?’

পাবেল এবার চেহারায় সিরিয়াস ভাব আনার চেষ্টা করে বলল,
–‘মোটেও মজা করার বিষয় না। দারোয়ান ব্যাটাকে খুঁজে বের করে হাড়গোড় ভাঙবো। মেয়ের চিকিৎসার জন্য তিন মাসের বেতন অগ্রিম দিলাম। আর এখন সে পালিয়েছে। কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ হয় মানুষের ভিতর আজকাল।’

শ্রাবণী পাবেলের কথা শুনে যাচ্ছে। মন্দ লাগছে না। অমাবস্যার রাত আজ। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে। পাবেল মৃদু স্বরে ডাকল,
–‘শ্রাবণী।’

শ্রাবণী অমনযোগী ভাবে সারা দেয়,
–‘বলুন।’

–‘আমার দিকে তাকাও। তারপর বলছি।’

শ্রাবণী তাকায় পাবেলের দিকে। তাকিয়ে সামান্য হাসে। পাবেল এবার শক্ত গলায় বলল,
–‘আমার ধারণা তুমি দারোয়ানের ব্যাপারে কিছু লুকাচ্ছো। যদি ঘোর অন্যায়ও করে থাকো তাও বলো। প্রমিজ, কিচ্ছু বলবো না তোমায়। তবুও বিষয়টা মিটে যাক।’

শ্রাবণী এবার সত্যি বলে দিলো,
–‘আপনার বাবা-মা তখন গ্রামে ছিলো। আমিও আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম বাবা অসুস্থ ছিলো তাই। বাড়ি থেকে ফেরার পর আনোয়ার চাচা হঠাৎ আমায় বলল আপনি ফাঁকা বাড়িতে মেয়েদের নিয়ে ছিলেন। এসব বলার পর তিনি আমায় তীব্র অনুরোধ করে বলেছিলেন, আমি যেন তার কথা আপনার কাছে বলি। তার ওসব কথা সত্যি ছিলো না-কি বানোয়াট ছিলো তা আমি জানি না। তিনি আমায় বানিয়ে বানিয়ে ওসব বলবে কেন? মিথ্যা বলবো না, আমিও তার কথা বিশ্বাস করেছি। এইটুকুই। এরপর আমি হোস্টেলে চলে গেলাম। তার সাথে আর আমার কথাবার্তা হয়নি।’

পাবেল তীব্র বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে তার বিস্ময়টা ক্ষোভে গড়াচ্ছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেল রাগে। ও কোনো ডাক, চিৎকার কিংবা উচ্চশব্দ ছাড়াই বলল,
–‘দারোয়ান মিথ্যা বলেছে। পুরোটাই মিথ্যা।’

শীতল কণ্ঠে গলায় চাপা ক্রোধ। দারোয়ানকে এখন সামনে পেলে যেন গলা কেটে ফেলবে। পাবেল শ্রাবণীর পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়,
–‘আমার জানতে হবে কেন তিনি আমার নামে তোমার কানে এরকম বিষ ঢালল। কি উদ্দেশ্যে ছিলো তার? আমি ওই বুড়োটাকে যে কোনো উপায়ে খুঁজে বের করবোই। আর শ্রাবণী তোমার কথা যেন মিথ্যা প্রমান না হয়।’

শ্রাবণী দৃঢ় গলায় বলল,
–‘আমি কোনো মিথ্যে বলেনি।’
_____________
সকাল বেলা পাবেল ফরিদা বেগমকে আড়ালে ডাকলো। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ জরুরি কথা বলবে। কেউ যেন না শুনে সেজন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে আড়ালে ডেকেছে। পাবেল শুরতেই বলল,
–‘মা আমি জানি তুমি শ্রাবণীকে পছন্দ করো না। আমিও আগে ওকে সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু এক ছাদের নিচে থাকতে থাকতে ওর প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে।’

ফরিদা বেগম কঠিন মুখে বলল,
–‘অতসব ভনিতা বাদ দিয়ে কি বলতে চাচ্ছিস সোজাসুজি বল? বউয়ের হয় আবার কি ওকালতি করতে এসেছিস?’

–‘মা তুমি অযথা রাগ করছো। শ্রাবণীর প্রতি আমার ভালোবাসাটা তুমি কেন সহ্য করতে পারছো না সেটা বলবে? বিয়ে তো তোমরাই আমায় করিয়েছো।’

–‘বিয়ে আমি তোকে বিয়ে করাইনি। তোর বাপ করিয়েছে। আর তুই এসব কথা বলতে ডেকেছিস আমাকে? কিভাবে সহ্য করবো আমি ওকে? ওইটুকু মেয়ে মুখের উপর কথা বলবে, বাড়ি থেকে সবার অমতে বেড়িয়ে যাবে। সেসব আমি সহ্য করবো?’

–‘তুমি দারোয়ানকে জড়িয়ে ওকে বাজে ইঙ্গিত দিয়ে কথা কিভাবে বললে? ওকে তোমার পছন্দ না। তাই বলে এরকম কথা?’

ফরিদা বেগম রাগে জ্বলে ওঠে। পাবেলের গালে দুইটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে হয় তার। কৈফিয়ত চাইতে আসছে তার কাছে? তিনি উঁচু গলায় বলে,
–তোকে কে বলেছে আমি দারোয়ানকে জড়িয়ে ওকে বাজে ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলেছি? শ্রাবণী বলেছে? আমাদের মা-ছেলের সম্পর্ক নষ্ট করতে ওঠে পড়ে লেগেছে ওই মেয়েটা। আমার নামে বিষ ঢালছে তোর কানে।’

রাগে ফরিদা বেগমের শ্বাস গরম হয়ে যাচ্ছে। এ বাড়িতে তার গুরুত্ব কি এতটাই কমে গেছে যে তাকে তার ছেলের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়? কষ্টে তার চোখে ছলছল করে ওঠছে। গলা ভিজে আসছে। বল্লমের ঘা খাওয়া বাঘিনীর মত গলার সব রগ ফুসে ওঠে ফরিদা বেগমের,
–‘তোর এই ভালোবাসা, ভালোলাগা কদ্দিন থাকে আমিও দেখে নিবো। কত মেয়ের প্রতি তোর এমন প্রেম দেখেছি।’

–‘ওসব কথা রাখো। আমি চাইনা তুমি শ্রাবণীর সাথে কোনো অশান্তি করো। এটুকুই।’

ফরিদা বেগম দ্রুত পা ফেলে ওখান থেকে চলে গেল। তার হাঁটার শব্দে ফেটে পড়া রাগ, দারুণ ক্রোধ। নিচতলা থেকেও পাওয়া যাচ্ছে এই শব্দ। পিছন ফিরে অগ্নিমূর্তি হয়ে কয়েকবার তাকালো পাবেলের দিকে। পাবেল নির্বিকার। তার ভিতরে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।

শ্রাবণী এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। কাল ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে। রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে আবহাওয়া শীতল। হালকা শীত শীত লাগছে। পাবেল রুমে ঢোকে। টেবিলের উপর চায়ের কাপ রাখার মতন‌ শব্দ হলো। শ্রাবণীর চোখ খুলে তাকাতে ইচ্ছে হলো না। পাবেল ডেকে বলল,
–‘শ্রাবণী চা খাবে?’

শ্রাবণী ঘুম জড়ানো চোখেই বলল,
–‘উঁহু।’

একটু পর চমকে চোখ মেলে তাকায়। পাবেল ওর জন্য চা এনেছে? ওকে চা সাধছে? ভয়াবহ ব্যাপার। ওর চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়।
–‘ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নেও। আমি বানিয়েছি।’

শ্রাবণীর বিস্ময় আর একটু বাড়লো। ও এক লাফে উঠে বসলো।
–‘আপনি চা বানিয়েছেন?’

–‘হ্যাঁ। মায়ের সাথে একটু রাগারাগী হলো। তার কাছে তো চা চাওয়া যাবে না। আসমাও নেই আজ। তুমিও ঘুমাচ্ছো। তাই নিজের জন্য বানাতে গিয়ে ভাবলাম তোমার জন্যও এক কাপ বানাই।’

–‘মায়ের সাথে কেন রাগারাগী হয়েছে?’

–‘এমনি। চা কেমনে হয়েছে?’

–‘ভালো তবে চিনি বেশি হয়েছে। আমি চায়ে কম চিনি খাই।’

শ্রাবণী মনে মনে আশ্চর্য হয়ে গেল। ও পাবেলের সাথে একদম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। তাহলে কি ওদের সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গেছে? পাবেল বলল,
–‘আমি দারোয়ানকে খুঁজতে বের হবো। মাথা থেকে ঝাড়তে পারছি না বিষয়টা কিছুতেই। মানসিক অশান্তি হচ্ছে।’

শ্রাবণী বাঁধা দিলো না। বাঁধা দিলেই হয়ত ভাববে শ্রাবণী মিথ্যা বলেছে। ও নিজেও উদগ্রীব হয়ে আছে দারোয়ানের এই অদ্ভুত কাণ্ডের কারণটা জানতে।
পাবেল দারোয়ানের গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত খুঁজে আসলো। গ্রামের বাড়ি খালি পড়ে আছে। ভাঙাচোরা একটা দোচালা টিনের ঘর। অনেক পুরানো। চারদিকে জঙ্গল ঘেরা। এবাড়িতে কেউ থাকে না। আশেপাশে অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করেছে। তারা বলেছে আনোয়ার মিয়া বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় থাকে। ওখানে গিয়ে লাভ হলো না পাবেলের। হতাশ হয়ে ফিরে এলো। এই হতাশার সাথে সাথে রাগটাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
বাসায় এসে শাওয়ার সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শ্রাবণী ব্যাগ গোছাচ্ছে। হোস্টেলে চলে যাবে ও। কয়েকদিন পর এক্সাম। এখানে পড়া হচ্ছে না। ফরিদা বেগম একটা না একটা ঝামেলা বাঁধিয়েই রাখে। পাবেল শ্রাবণীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ও ব্যাগ গোছাচ্ছে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে, চোখে কাজল দিচ্ছে পাবেল সবটা দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।
–‘এক্সাম শেষ হলে আবার আসবে? না-কি আর আসবেই না?’

শ্রাবণী দুই দণ্ড ভেবে বলল,
–‘আসবো।’

–‘তোমার গিটারটা নিয়ে যাও।’

–‘ওটা টেনে হোস্টেলে নিবো? এখানেই থাকুক।’

পাবেল শ্রাবণীর হাত ধরে টেনে ওর পাশে বসালো। মুখটা শ্রাবণীর মুখের কাছাকাছি নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
–‘যেতেই হবে? থাকা যায় না?’

শ্রাবণী কিছু বলার আগেই পাবেল নিজের প্রশ্নের উত্তরে নিজেই বলল,
–‘আচ্ছা যাও। যাওয়ার আগে তোমায় একটা গান গেয়ে শুনাই?’

শ্রাবণী ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলে। পাবেল খালি গলায় অদ্ভুত ভঙ্গিতে গাইতে শুরু করে,
দীপ ছিলো, শিখা ছিলো
শুধু তুমি ছিলে না বলে আলো জ্বলল না।
ভাষা ছিলো, কথা ছিলো
কাছে ডাকলে না বলে মন কথা বলল না….

(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৪০)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
পাবেল কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে।‌ খুবই স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় কোনো ব্যস্ততা কিংবা তাড়া নেই। মনে হচ্ছে এভাবে আরো দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেও সে কোনো রকম বিরক্ত বোধ করবে না। পাশের টং দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসলো। তারপর সিগারেট ধরালো। ঘন্টার পর ঘন্টা গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মত ধৈর্য অবশ্য পাবেলের নেই। কিন্তু সাব্বির ওর মাথায় কি এক বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিলো! সেদিন দীর্ঘ আলাপের পরে সাব্বির কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই পাবেলকে বলল,
–‘ছোট বেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি। তারপরও তোকে মাঝে মাঝে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আর ওইটুকু মেয়ে তোর অত খারাপ আচরণের পরেও এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করবে কি করে বল তো? ওর মনে নানান সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তোকে বিশ্বাস করবে কি করবে না এই নিয়ে বড়ো চিন্তায় আছে বেচারি।’

–‘তো আমার কি করা উচিত আমার? তোর তো মাথা ভালো। স্কুলে সব সময় ফার্স্ট হতি। বুদ্ধি দে।’

সাব্বির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো না। চুপ মেরে রইল চিন্তিত মুখে। সে নিশ্চয়ই ভালো কোনো বুদ্ধির খোঁজ করছে। পাবেল বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। অনেকক্ষণ পর সাব্বির মুখ খুলল। চাপা উত্তেজনা তার গলায়,
–‘এখন থেকে প্রতিদিন গিয়ে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকবি। শ্রাবণী যখনই বের হয় তখনই যেন তোকে দেখে। ও প্রাইভেটে গেলেও বাইক নিয়ে ওর পিছনে পিছনে যাবি।’

পাবেল ধমক দিয়ে বলল,
–‘ধ্যাত! এসবের বয়স আছে আমার? ওসব বিশ-বাইশ বছরের ছোকরাদের কাজ।’

–‘আহা ভাই! প্রেমিকদের মনের বয়স সর্বদা বিশ-বাইশই হতে হয়। তুমি কি প্রেমিক হতে চাও না ভাই? বউয়ের মন জয় করতে চাও না?’

–‘অন্য কোনো বুদ্ধি নেই?’

–‘না, নেই। এগুলো হলো সহজ উপায়ে বউ বা প্রেমিকাদের মন জয় করার উপায়। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ভাই এরচেয়ে ভালো বুদ্ধি তুমি আর পাবে না।’

–‘আচ্ছা দেখি।’

–‘আর শোন, আরেকটা ব্যাপার। তুই গিয়ে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি কেবল। শ্রাবণী যেখানে যাবে তুইও পিছনে পিছনে যাবি। কিন্তু ওর সাথে কথা বলবি না তেমন। চোখাচোখি হলে সামান্য হাসবি। সুন্দর করে হাসার চেষ্টা করবি। তাহলে দেখিস তোর প্রতি ওর আগ্রহ বেড়ে যাবে।’

পাবেলের তখন মনে হয়েছে সাব্বিরের বুদ্ধিটা বেশ ভালো। কিন্তু এখন ওকে মনে মনে কুৎসিত গালি দিচ্ছে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। এর ভিতর একবারও শ্রাবণীর সাথে দেখা হলো না। একটু পর অবশ্য সাব্বিরকে দেখা গেল। সে বোধ হয় পাবেলের হালচাল দেখতে এসেছে। পাবেলের সামনে এসে আচমকা বাইক থামালো। মুখ টিপে হেসে বলল,
–‘আরে নেতাজি যে। রাজনীতি ছেড়েছুড়ে আপনি গার্লস কলেজের সামনে কি করছেন?’

পাবেল ভয়াবহ রেগে গেল। রেগেমেগে বলল,
–‘থাপ্পড় গিয়ে গাল লাল করে দিবো।’

সাব্বিরের হাসিটা আগের চেয়ে বিস্তৃত হলো। সে হো হো করে হেসে বলল,
–‘এখানে তুই শ্রাবণীর জন্য এসেছিস। সুন্দরী মেয়ে দেখে এটা আবার ভুলে যাস না। তোর তো চরিত্রে গণ্ডগোল আছে।’

পাবেল হুংকার ছাড়তেই সাব্বির বাইক নিয়ে চলে গেল। পাবেলও ভাবলো চলে যাবে। এসব ওর কর্ম না। পরিচিত কারো সাথে দেখা হলেই হাসি তামাশার ছলে বিদ্রুপ করে। মনে মনে লজ্জা পেলেও মুখে বিব্রতকর ভঙ্গিতে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। পাবেল চলে যেতে উদ্যত হতেই শ্রাবণীকে দেখে। শ্রাবণী কয়েক বার তাকালো। ভেবেছিল পাবেল এগিয়ে আসবে কথা বলতে। কিন্তু ওর ধারণা ভুল হলো। পাবেল আসলো না। দূর থেকে তাকিয়ে হাসছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। শ্রাবণী এর আগে অনেকবার হাসতে দেখেছে পাবেলকে। কিন্তু হাসির ভঙ্গি এরকম ছিলো না। পাবেল সাব্বিরের কথা মত সুন্দর ভাবে হাসার চেষ্টা করছে। শ্রাবণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেল। প্রাইভেট থেকে ফিরেও শ্রাবণী দেখলো পাবেল সেই আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। কি আশ্চর্য! শ্রাবণী আগ্রহ বোধ করল,
–‘আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন? কেন এসেছেন এখানে?’

পাবেল সরাসরি শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘এসেছিলাম কাজে।’

–‘কি কাজে এসেছেন জানতে পারি? কলেজের কোনো সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ হয়েছে না-কি? হলে বলুন। দেখি আপনার উপকার করতে পারি কি-না।

–‘কয়েক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে চোখ পড়লো না।’
এইটুকু বলে পাবেল চলে গেল। শ্রাবণী বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। পাবেল কি ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল? তার হাবভাব দেখে তো সেরকম মনে হলো না।

এরপর থেকে প্রায়ই পাবেলকে কলেজের সামনে দেখা যায়। সে কি এখন সব কাজকর্ম ফেলে‌ কলেজের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে? শ্রাবণীর সাথেও তেমন কথাবার্তা বলে না। চোখাচোখি হলে শুধু হাসে। অদ্ভুত ব্যাপার! এই লোকটা হঠাৎ এরকম আচরণ করা শুরু করেছে কেন? শ্রাবণী একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলল,
–‘আপনি কি কলেজের দারোয়ানির চাকরি নিয়েছেন না-কি?’

–‘না নেইনি। তবে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে দারোয়ানি করা ভালো মনে হয়।’

–‘আপনি প্রতিদিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন বলেন তো?’

পাবেল রহস্যময় ভাবে হেসে বলল,
–‘বলা যাবে না।’

এইটুকু বলেই সে আবার চলে গেল। শ্রাবণীর সাথে নিজ থেকে কথা বলে না। আর শ্রাবণী কথা বলতে গেলে দুই একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েই চলে যায়। এর কারণটা ঠিক কি হতে পারে? শ্রাবণী শুয়ে শুয়ে ভাবছে। এরকম অদ্ভুত আচরণ করে কি পাবেল ওর মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে? শ্রাবণীও ঠিক করলো ও যত যা-ই করুক ও আর নিজে থেকে কথা বলতে থাকবে না। দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাবে।
________________
শ্রাবণী কিছু কেনাকাটা করা দরকার। এক্সাম চলছে। তাই সময় পাচ্ছে না। একদিন সময় করে বের হলো। একাই বের হয়েছে। হিয়া, তিথি, মারিয়া ঘুমাচ্ছে। রাত জেগে পড়ে ক্লান্ত ওরা। ওদের বিরক্ত করা উচিত হবে না। শ্রাবণী শপিং মলে ঢুকতেই পাবেলের সাথে দেখা। আশ্চর্য! আজকাল হয়েছেটা কি? যেখানেই যায় সেখানেই দেখে পাবেলকে। শ্রাবণী তাকে দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে আছে। আজ আর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে না।‌ পাবেলের চতুরতা ও ধরে ফেলেছে। পাবেলই গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালো।
–‘কি সুন্দরী দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছো কেন? আমি যে তোমার হাজবেন্ড এটা কি তুমি যাচ্ছো দিন দিন?’

শ্রাবণী স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–‘আমার স্মৃতিশক্তি অত খারাপ না।’

–‘মাঝেও হুটহাট ফোনটোন করতেও তো পারো না-কি? এক্সাম কেমন হচ্ছে তোমার?’

–‘খুব ভালো।’

–‘তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। তোমার এক্সাম চলছে, তোমায় তো উপহার দেওয়া দরকার তাই না? সেজন্যই কেনাকাটা করতে এসেছিলাম।’

–‘আপনার সাথে আমার হুট করে দেখা হয়নি। আপনি আমাকে দেখেই এখানেই এসেছেন। ঠিক বলছি না?’

–‘হ্যাঁ ঠিক বলছো। আচ্ছা বলো তোমায় কি কিনে দিবো?’

–‘কিছু না।’

–‘আমি তোমায় কিছু দিতে চাচ্ছি তোমার পছন্দ মতো। বলো তোমার কি পছন্দ?’

শ্রাবণী উত্তর দিলো না। পাবেল ওকে দুইটা গাউন কিনে দিলো। দুইটাই কালো রঙের। ডিজাইন ভিন্ন।
–‘যদি ইচ্ছে হয় তো একদিন কালো গাউন পড়ে আমার সামনে এসো। কালো পরী লাগবে তোমাকে।’

যাওয়ার আগে পাবেল আবার বলল,
–‘আমার বয়সটা তো বেড়ে যাচ্ছে শ্রাবণী।‌‌ আমার ব্যাপারটাও মাথায় রেখো।’

কথাটা বলেই হাসলো। হাসতে হাসতে চলে গেল। শ্রাবণী সেদিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা ওকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে? মন্দ না।

রাত প্রায় দুইটা বাজে। চারদিক নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক করে চলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কেবল। পাবেল সোজা হয়ে বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে আছে। ল্যাপটপে মুভি দেখছে। হিন্দি রোমান্টিক মুভি। হঠাৎ ওর আজ মনে হচ্ছে শ্রাবণী পাশে থাকলে ভালো হত। শ্রাবণীর প্রতি যে খুব বেশি ভালোবাসা, টান অনুভব করছে তাও‌ না। কিন্তু ও আশেপাশে থাকলে ভালোলাগে। এই ভালোলাগাটা হয়ত ভালোবাসার প্রথম ধাপ। মুভিতে নায়ক নায়িকার ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। পাবেল সেখানে শ্রাবণীকে কল্পনা করছে। মেয়েটা ওর অহরহ ভাবনার কারণ হয়ে ওঠছে। পাবেল ল্যাপটপ সাইডে রেগে চোখ বুজে। একাকী লাগছে আজ হঠাৎ। এরকম একাকিত্ব শেষ করে অনুভব করেছে তা ঠিক মনে করতে পারছে না। পাবেলের ফোন বেজে ওঠে। এত রাতে কে ফোন দিয়েছে? ইরা নামে সেইভ করা নম্বরটা ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে। এই মেয়েটার সাথে ওর কয়েক মাসের সম্পর্ক ছিলো। পাবেল ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো। ফরিদা বেগম পাবেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি‌ সেদিনের পর থেকে। সকাল বেলার চা আগে ফরিদা বেগম দিয়ে গেলেও এখন আসমাকে দিয়ে পাঠায়। তবে পাবেল এই বিষয়টা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ওর আচরণে মনে হয় সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। সাব্বিরের দেওয়া বুদ্ধিটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। অত ভনিতা ও করতে পারবে না।

শ্রাবণীর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একদিন হঠাৎ পাবেল শ্রাবণীকে তলব করলো। ভীষণ জরুরি তলব। এত জরুরি তলব উপেক্ষা করা যায় না। পাবেল উদগ্রীব হয়ে আছে। শ্রাবণী যেতেই তীব্র অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘শ্রাবণী আমাদের বিয়ের কয়েক দিন পর তুমি আমাকে বলেছিলে যে তোমায় কিডন্যাপ করেছে আমাদের ড্রাইভার। মনে আছে ব্যাপারটা?’

শ্রাবণী চমকানোর গলায় বলল,
–‘অত বীভৎস একটা ব্যাপার সারাজীবন মনে থাকবে।’

–‘তোমায় তুলে নিয়ে কি করেছে? কয়জন ছিলো ওরা? চেহারা মনে আছে তোমার?’

শ্রাবণী উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
–‘কি হয়েছে? ওসব কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

পাবেল রেগে গিয়ে বলল,
–‘কোনো প্রশ্ন করো না। যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দেও।’

–‘আমায় অজ্ঞান করে রেখেছিল। তারপর দেখি আমি বাসায়। চেহারা মনে নেই। আতঙ্কে সব ভুলে গেছি। দেখলে চিনতে পারি।’

–‘কোনো মেয়ে মানুষ ছিলো ওখানে?’

–‘না।’

–‘দারোয়ানকে পেয়েছি।’

শ্রাবণী চমকে গিয়ে বলল,
–‘কোথায় এখন সে? আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। তিনি ওই চিঠি কেন লিখেছে?’

–‘জায়গা মত আছে। তোমার কথা বলার দরকার নেই তার সাথে। যা জানার ছিল আমি জেনেছি।’

–‘কি জেনেছেন বলেন? কিডন্যাপের ব্যাপারটা হঠাৎ কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

পাবেল উত্তর দিলো না। গম্ভীর, রাগান্বিত মুখ তার। শ্রাবণী অধৈর্য হয়ে বলল,
–‘আশ্চর্য আপনি কথা বলছেন না কেন?’

(চলবে)