প্রিয়তমা পর্ব-২০

0
415

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_২০

নিকষ কালো অন্ধকার ঘরে চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে রুবি।সামনের ব্যক্তি কে হতে পারে সেটা ঠাওর করতে পারছেনা।কৌশলে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎই সামনে থাকা ব্যক্তি ঘর কাঁপিয়ে হাসলো।চেনা কন্ঠস্বর শুনে রুবির ভেতরে এক শীতল শ্রোত বয়ে গেলো।এটা কি করে সম্ভব?হয়তো সে ভুল শুনছে ভেবেই আবারও ব্যস্ত হয়ে গেলো বাঁধন খুলতে।
অকস্মাৎ লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো পুরো রুম।হুট করে আলো জ্বলায় সামনে তাকাতে রুবির বেগ পেতে হলো।চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো।সামনে তরুণকে বুকে হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।চোখ বন্ধ করে আবার খুলে দেখলো সত্যিই তরুণ কিনা?নাহ এটা সত্যিই তরুণ।
তবে কি তরুণ রূপককে সব বলে দিয়েছে?এটা ভেবেই রুবির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হলো।
তরুণ ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে উঠলো।ধীর কন্ঠে বলল,বিশ্বাস হচ্ছে না আমি তোমার সামনে?দেখো বউ আমি!আমি তোমার প্রিয় স্বামী তরুণ দাঁড়িয়ে আছি বলেই গা জ্বালানো হাসি দিলো।
রুবি দৃষ্টি এদিক ওদিক লুকানোর চেষ্টা করছে।তরুণ পকেট থেকে রুমাল বের করে রুবির কপালের ঘর্ম বিন্দু মুছে দিতে দিতে আফসোসের সুরে বলল,আহারে!আমার বউটা ঘেমে-নেয়ে একাকার।ভয় হচ্ছে বুঝি?

রুবি লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে কথা বলার জন্য মুখ খুললো।কিন্তু বলতে পারলোনা কিছুই।মুখ তরুণ আগেই বেঁধে দিয়েছে।ছটপট করে উঠে তরুণের দিকে রাগি চোখে তাকালো রুবি।

তরুণ ভয় পাওয়ার ভান করে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,ভয় পাচ্ছিতো বউ!এরকম কেউ চোখ রাঙায়?মুখ খুলে দিতে হবে?আচ্ছা দিচ্ছি বলেই রুবির মুখের বাঁধন খুলে দিলো তরুণ।

রুবি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,কি চাই তোমার?

তরুণ বাঁকা হেসে বলল,সোজা পথে এসেছো তাহলে।
রুবি তেজি গলায় বলল,আমাকে এভাবে বেঁধে রাখার মানে কি?

মুহূর্তেই তরুণের চোখমুখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো।চোয়াল শক্ত করে বলল,তোমার সাথে অনেক হিসেব বাকি।
যার জন্য কাজ করছো,আমার সাথে অভিনয় করে বিয়ে করে এই বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করেছো সে কোন স্বার্থে তোমাকে এই বাড়িতে ঢুকিয়েছে,কিভাবে ব্যবহার করছে তুমি কি সেটা জানো?

রুবি উগ্রকণ্ঠে বলল,কোনো স্বার্থ নয়।রিভেঞ্জ নিতে এই বাড়িতে এসেছি।তুমি যেহেতু সুস্থ হয়ে গেছো তখন আমার আর এই বাড়িতে থাকা হবেনা সেটা আমি ভালো করেই জানি।
আমার বাবাকে মিথ্যে নারী পাচারের মামলায় ফাঁসিয়ে মেরে ফেলেছো তোমরা।রূপক এরেস্ট করেছে আমার বাবাকে।ওকে আমি কিছুতেই ছাড়বোনা।আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে আমি কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছিনা।

তরুণ আয়েশ করে রুবির সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে।দুই আঙ্গুলে কপাল চুলকে বলল,তোমার বাবা যে নির্দোষ,তাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে এটা তোমাকে কে বলেছে?তোমার ভাই বলেছে তাইতো?
কিন্তু কি বলোতো?তুমি কি তখন এখানে ছিলে?তুমিতো কলেজে ওঠার পর থেকেই ঢাকায় থাকতে।তাহলে তুমি কি করে জানবে তোমার বাবা আর ভাই কি করছে?
রুবি ক্ষেপে যেতেই তরুণ রুবিকে থামিয়ে দিলে।হিসসস!একদম চুপ।আমি বলবো আর তুমি শুনবে।
নয়তো আবারও মুখ বেঁধে বসিয়ে রাখবো।
রুবি আগুন চোখে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু বলছেনা।

তরুণ আবার বলা শুরু করলো।তোমার বাবা একজন নারী পাচারকারী ছিলেন।তার নামে কোনো মিথ্যে মামলা করা হয়নি।রুবির দিকে কিছু ডকুমেন্টসের ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,তুমি নিজেই চেক করো।
রুবি তার বাবার বিরুদ্ধে সব ডকুমেন্টস দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,এসব কিছু মিথ্যে।আমার বাবা এমন নয়।সব তোমাদের ষড়যন্ত্র।
তরুণ ক্ষীণ হেসে বলল,বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে?হওয়ারই কথা।কারণ কোনো মেয়ে তার বাবার এমন অপকর্ম মেনে নিতে পারবেনা।তোমার মতো প্রীতিও বিশ্বাস করতে চায়নি তার বাবা নারী পাচারের সাথে জড়িত।

রুবি অস্ফুট স্বরে বলল,প্রীতির বাবা?
তরুণ সায় জানিয়ে বলল,হুম,প্রীতির বাবা।তোমার বাবাকে ধরার পর পুলিশ ভেবেছিলো আর কেউ বাকি নেই শুধু তোমার বাবা একাই একাজে জড়িত।কিন্তু ছ’মাস না যেতেই আবারও শুরু হয় নারী পাচার।তোমার বাবা,ভাই,প্রীতির বাবা জড়িত ছিলো।কিন্তু পুলিশ শুধু তোমার বাবাকেই ধরতে পেরেছে।এরপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমার ভাই তোমাকে মিথ্যে বলে এই বাড়িতে রূপকের সব ইনফরমেশন নিতে পাঠায়।আর তার জন্য কি করলে?আমাকে ব্যবহার করলে।আমি যখন জানতে পারি তোমার বাবার অবর্তমানে তোমার ভাই নারী পাচারের ব্যবসা করছে তখনই আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করো।তারপরই আমাকে মারার চেষ্টা করো যাতে আমি রূপককে কিছু না জানাতে পারি।সেদিন যখন আমার জ্ঞান ফিরেছিলো তখন আমার মনে হয়েছে আমার হাতে সময় নেই তাই সেদিনই রূপককে আমি সব কিছু জানিয়ে দিয়েছি।রূপক ডক্টরের সাথে কথা বলে ডক্টরকে বলেছে যাতে আমি কোমায় আছি এটা সবাইকে বলে।তখন থেকে তোমরা জানতে আমি কোমায়।

তারপর বাকিটা রূপক সামলে নেয়।রূপকের বাড়িতে ঢোকার জন্য আমাদের বিয়ের রেজিস্টি পেপার কাজে লাগিয়েছো।বুদ্ধির তারিফ করতে হয় তোমাদের ভাই বোনের।তুমি কি ভেবেছো রূপক কিছু না জেনে কোনো খোঁজ না নিয়েই তোমাকে নিজের বাড়িতে থাকতে দিলো?
রুবি অস্থির হয়ে উঠে বলল,তুমি সব মিথ্যে বলছো।আমার ভাই আমার বাবা এমন কাজ কখনো করবেনা।তরুণ কপাল কুঁচকে বলল,আচ্ছা?তাহলে তোমার ভাই প্রীতিকে কেনো তুলে নিয়ে গিয়েছিলো?

রুবি বলল,রূপককে ভয় দেখানোর জন্যই তুলে নিয়ে গিয়েছিলো।আবার সেদিনই ছেড়ে দিয়েছে।প্রীতির তো কোনো ক্ষতি করেনি।তরুণ ফিচেল হেসে একে একে সব ডকুমেন্টস যখন দেখালো তখন রুবি পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলো।তরুণ আরও বলল,স্বপ্না মেয়েটাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমার ভাই ধর্ষণ করেছে যার কারণে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে।এখন প্রীতির বাবা আর তোমার ভাই রকি দুজনই গা ঢাকা দিয়েছে।যার কারণে রকিকে ফোনে পাচ্ছোনা।
ফারুখের কাছে কিছু ভিডিও ক্লিপ ছিলো যেগুলো তরুণ সংগ্রহ করেছে।একটা ভিডিও অন করে রুবির সামনে ফোন তুলে ধরলো।
যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রকি অনেকগুলো মেয়ের থুতনি ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।আবার অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে,কারো গায়ে হাত তুলছে।চারপাশের অবস্থা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা কোন জায়গা।আর মেয়েগুলো এখানে কেনো?
সব দেখে রুবি স্তব্ধ হয়ে গেলো।চোখ দিয়ে গলগলিয়ে পানি পড়তে লাগলো।

তরুণ কিছু না বলেই রুবির হাতের বাঁধন খুলে দিলো।মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো রুবি।এতদিন কিনা মিথ্যে জেনে মিথ্যাকে সংঘ দিয়েছিলো।তরুণ শান্তনা দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পেলোনা।উল্টো রাগ হলো কেনো সব কিছু যাচাই না করে ভাইয়ের কথায় বিশ্বাস করলো?

———————————————————
আঁধার ডিঙ্গিয়ে ধরনীর বুকে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশ।দূরে মোরগ ডেকে জানান দিচ্ছে ভোর হয়েছে।আঁধার ছাপিয়ে আস্তে আস্তে আলোকিত হলো চারপাশ।রূপকের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে আছে প্রীতি।
হাজেরা বেগম নামায শেষ করে তসবি হাতে নিচে নেমে আসলেন।ফারিহা এসে আগে চা বসালো।আজ আর প্রীতিকে কেউ ডাকলোনা।
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে অভ্যেস হয়ে গেছে প্রীতির।তাই আজও তার ব্যতীক্রম হলোনা।ঘুম ভেঙে গেলো।খুব সন্তর্পণে রূপকের বলিষ্ঠ হাতের শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো।পড়নের এলোমেলো কুঁচকানো শাড়ি ঠিক করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।

নাস্তা শেষ করে রূপক থানার উদ্দেশ্যে বের হবে।প্রীতিকে রুমে ডেকে পাঠালো।হাতের কাজ শেষ করে প্রীতি রুমে ঢুকলো।রূপককে রেডি হতে দেখে অবাক হয়ে বলল,আপনি কোথায় যাচ্ছেন এত সেজেগুজে?
রূপক প্রীতির দিকে টাই বাড়িয়ে দিয়ে বলল,দাও টাই বেঁধে দাও।একবার থানায় যাবো।
প্রীতি আগাগোড়া একবার রূপককে পরখ করে নিয়ে বলল,এই পোশাকে থানায় যাবেন?ইউনিফর্ম কই?আর আপনার না আজকের দিন ছুটি?
রূপক শান্ত কন্ঠে বলল,একটু কাজ আছে।কাজ সেরেই বাসায় ফিরবো।
প্রীতি টাই বেঁধে দিয়ে সরে দাঁড়ালো।রূপক প্রীতির কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে কপালে অধরের উষ্ণ পরশ দিয়ে ছেড়ে দিলো।
বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,ফিরতে দুপুর হবে।
প্রীতি কপালে হাত ছুঁইয়ে লাজুক হাসলো।

রূপক থানায় গিয়ে পৌঁছালো।সবাই রূপককে অনেকদিন পর দেখে কুশল বিনিময় করলো।কনস্টেবল নিজাম রূপককে স্যালুট জানাতেই রূপক তার পিঠে হালকা চাপড় মেরে বলল,কেমন আছো নিজাম?

ভালো আছি স্যার।অনেকদিন পর আপনাকে দেখে এখন অনেক ভালো লাগছে।

থানার সামনে একটা বাইক এসে থামলো।সবার দৃষ্টি সেদিকে।বাইকে থাকা ব্যক্তি মাথা থেকে হেলমেট খুলতেই সবাই অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
তরুণ বাইক থেকে নেমে ভেতরে ঢুকলো।
#চলবে……..

(ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং।)