প্রিয়তমা পর্ব-২১

0
439

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_২১

রূপকের বাবা হাঁট থেকে বড় রুই মাছ নিয়ে এসেছেন।হাজেরা বেগম বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছেন রূপকের বাবাকে।মাছ কেনো কেটে আনলোনা?মাছ বড় হওয়ায় কাটতে বেগ পেতে হচ্ছে।বারবার হাত থেকে পিছলে ছুটে যাচ্ছে।হাজেরা বেগম ফারিহাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই বসলেন মাছ কাটতে।
দুপুরের রান্নার সব জোগার করে প্রীতি ঘরে গেলো।পরপরই হুট করে রুবি এসে প্রীতির ঘরে ঢুকে গেলো।প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকায়।সকাল থেকে দেখছে রুবির এলোমেলো দৃষ্টি।কেমন করে যেনো তাকিয়েছিলো ওর দিকে।

রুবি নিজেকে সামলে হালকা হাসলো।উত্তরে প্রীতিও হাসলো।রুবি ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,আমাকে মাফ করে দিও প্রীতি।আমি তোমাদের সাথে না বুঝে অনেক অন্যায় করেছি।
হয়তো আমি ক্ষমার যোগ্য না তবুও বলছি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

প্রীতি বোকার মতো চেয়ে রইলো।অবাক গলায় বলল,কিসের জন্য ক্ষমা চাইছো?

রুবি ছলছল চোখে বলল,তোমার মতো আমিও জানতামনা তোমার মতো আমার বাবা আর ভাইও নারী পাচারের সাথে জড়িত।আমার ভাই রকি আমাকে এখানে পাঠিয়েছে রূপকের সব ইনফরমেশন তাকে দিতে।আমি এই বাড়িতে থেকে রূপক কখন কি করে না করে,তার জীবনে কি ঘটছে না ঘটছে সব জানাতাম আমার ভাইকে।রূপক সব জেনেও চুপ করে রইলো।

প্রীতি বিস্ফোরিত চোখে তাকিলো।রুবিকে প্রথম থেকেই তার তেমন একটা ভালো লাগতোনা।কেমন জানি লাগতো রুবির ব্যবহার।তবে প্রীতি ভাবেনি এমন কিছু রুবির মনে চলছে।সে তো স্বাভাবিক ভাবেই ভেবে নিয়েছে একেক জনের ব্যবহার,চলার ধরণ একেক রকম।সবাইকে সবার ভালোলাগবে এমনটা নাও হতে পারে।
রুবি দুই হাত জোড় করে প্রীতির কাছে আরেকবার ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে যায়।
প্রীতির ভাবনার মাঝেই হাজেরা বেগমের ডাক পড়ে।দৌঁড়ে নিচে চলে যায় প্রীতি।

রুই মাছের টুকরো গুলো ফ্রিজে রেখে দেয় হাজেরা বেগম।চিংড়িমাছ রান্না করবেন বলে আগেই নামিয়ে রেখেছেন।প্রীতি মাছ ধোয়ার সময় সব মাছের খোলস ছাড়িয়ে নেয়।নয়তো খাওয়ার সময় খোলস ছাড়াতে কষ্ট আর বিরক্তি দুইটাই হয়।ফারিহা আর প্রীতি মিলে রান্না শেষ করে সব গুছিয়ে রাখে।প্রীতি আগে আগে গোসল সেরেই নিচে নেমে আসলো।এক এক করে সব খাবার ডাইনিং এ নিয়ে আসছে।

তখনই রূপক বাড়িতে ঢোকে।ঘর্মাক্ত শরীরের সাথে শার্ট আটকে আছে।গলার টাই ঢিলে করতে করতেই বাড়িতে ঢুকলো।প্রীতিকে খাবার টেবিলে আনতে দেখে আশেপাশে তাকালো।কাউকে দেখতে না পেয়ে চট করে প্রীতির গালে চুমু দিয়ে সরে দাঁড়ালো।প্রীতি চমকে পাশে তাকিয়ে রূপককে দেখলো।রূপক এমন একটা ভাব করলো যেনো এখানে কিছুই হয়নি।ঢাকনা সরিয়ে দেখছে কি রান্না হয়েছে।সবগুলো খাবারের ঢাকনা সরিয়ে শেষের বাটিতে চিংড়ি মাছ দেখে নিজেকে সামলাতে পারলোনা।চামুচ দিয়ে একটা তুলেই মুখে দিয়ে দিলো।চিংড়ি মাছ রূপকের পছন্দের খাবারের তালিকায় আছে।কিন্তু চিংড়ি মাছে রূপকের এলার্জি আছে।চোখনাক লাল হয়ে হাঁচি শুরু হয়।একদিন একটু হাঁচি আসবেই তাই বলে প্রিয় খাবারের স্বাদ মিস করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় বলে রূপক মনে করে।
প্রীতি কড়াচোখে তাকিয়ে বাটি সরিয়ে নিয়ে বলল,আপনার না এলার্জি আছে চিংড়ি মাছে?
প্রীতির থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে আরেকটা মাছ মুখে দিলো।প্রীতি কটমট করে তাকালো।রূপক ডোন্টকেয়ার ভাব নিয়ে রূমে চলে গেলো।

———————————————
দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়েছিল রূপক।বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে হাঁচি শুরু হয়েছে।হাঁচি দিতে দিতে নাকমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।একবার হাঁচি আসলে একসাথে ১০/১২ টা হাঁচি আসে।একেবারে শরীর ব্যথা হয়ে গেছে,সাথে মাথাটাও হালকা ভার হয়ে আছে।
প্রীতি রুমে এসে এই অবস্থা দেকে ব্যঙ্গ করে বলল,একেবারে ঠিক হয়েছে।নিজের যেটাতে ক্ষতি হয় সেটা কে খেতে বলেছে?

রূপক নাক ডলে বিড়বিড় করে বলল,কেউ একজনের সান্নিধ্যে আসলেই আমার সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।তবুও মন বারে বারে তাকে ছুঁতে চায়।প্রিয় জিনিসে যতই এলার্জি থাকুক না কেনো সেটা সবসময় প্রিয়ই হয়।
রূপক বিড়বিড় করে বললেও প্রীতির কানে সবটা যায়।একটু লজ্জাবোধ করে পরক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়।রূপক প্রীতিকে টেনে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।মাথায় প্রীতির হাত নিয়ে চোখ বুঁজে বলল,মাথাটা একটু টিপে দাও ব্যথা করছে।প্রীতি মুখ ফুলিয়ে বলল,কি দরকার ছিলো চিংড়ি মাছ খাওয়ার?এখন অসুখ হচ্ছে কার?
রূপক চোখ বন্ধ রেখে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,তুমি পাশে থাকলে কোনো অসুখ আমায় ছুঁতে পারেনা।প্রিয়তমার সংস্পর্শে থাকলেই আমি সুস্থবোধ করি।
প্রীতি লাজুক হাসলো।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রূপককে দেখতে লাগলো।

রূপক চট করে উঠে বসলো।প্রীতি হকচকিয়ে বলল,কি হয়েছে?
রূপক দুষ্টু হেসে বলল,আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা হচ্ছে?এর জন্য কিন্তু শাস্তি পেতে হবে।
প্রীতি একটু পিছিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল,আব আমি কখন আপনাকে দেখছিলাম?আর দেখলেই বা আপনার কি?দূরে যান সরুন।
রূপক বাঁকা হেসে সামনে আগাতে থাকে আর প্রীতি পিছিয়ে গিয়ে খাটের কারুকার্যের সাথে ঠেস দিয়ে বসে।পেছাবার আর জায়গা নেই।রূপক আস্তে আস্তে প্রীতির মুখের কাছে এগিয়ে ঠোঁটের দিকে তাকালো।মাত্র অধর স্পর্শ করবে তখনই বাঁধা হয়ে রূপকের হাঁচি চলে আসে।নাক ডলে আবার এগোতে গেলেই একসাথে হাঁচির কম্পিটিশন শুরু হয়।প্রীতি প্রথমে মিটিমিটি হাসছিলো কিন্তু এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে।রূপক ক্লান্ত হয়ে অসহায় চোখে প্রীতির দিকে তাকায়।

——————————————————
রাতে তরুণের কল পেয়ে রূপক বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।প্রীতি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।বিকেল থেকেই পিঠ ব্যথা করছে।রূপক আপাতত একটা পেইন কিলার খাইয়ে দিয়েছে।কাল একবার ডাক্তার দেখিয়ে আনবে।এরকম ছোট ছোট সমস্যা গুলোতে পেইনকিলার খেয়ে ব্যথা কমিয়ে রেখে পরে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

তরুণ জানালো রকি আর রাজিব শেখের খোঁজ পাওয়া গেছে।তারা আপাতত চট্রগ্রামে আছে।আগের ফোন আর সিম তাদের গোডাউনে ফেলে এখন নতুন সিম ব্যবহার করছে।
নতুন নাম্বার দিয়ে রুবিকে কল করেছিলো বিধায় তরুণ রুবির কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে লোকেশন ট্র্যাক করে জানতে পেরেছে তারা চট্টগ্রাম।তরুণসহ আরো কয়েকজন এখনই চট্টগ্রামে রওনা দিয়েছে রকি আর রাজিব শেখকে ধরার জন্য।
রূপক তরুণকে সাবধানে যেতে বলে লাইন কেটে দিলো।

আজ সকালে রূপক থানায় যাওয়ার কথা বলে অন্য আরেকটা কাজ সেরে নিয়েছে।মিরন হায়দারকে ধরতেই রূপক আর তরুণ আজ ব্যস্ত ছিলো।তাকে আটক করা হয়েছে।এই সপ্তাহে মিরন হায়দারের কাছে ৫০ জন মেয়েকে চালান করার কথা ছিলো।কিন্তু রকি আর রাজিবের কোনো খোঁজ নেই।এখন যদি চট্টগ্রামে গিয়ে তরুণ রাজিব শেখ আর রকিকে না ধরতে পারে তাহলে অন্য পরিকল্পনা কাজে লাগাবে।মিরন হায়দারকে অবশ্যই কল করবে রকি আর রাজিব শেখ মেয়েগুলো বিক্রি করার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে।আগে যেই গোডাউনে মেয়েগুলোকে রাখা হতো এখন সেখানে নেই।পালানোর আগে রকি আর রাজিব শেখ তাদেরকে অন্যকোথাও নিয়ে রেখেছে।
এখন অপেক্ষা শুধু সেই কাঙ্খিত দিনের যেদিন মিরন হায়দারের ফোনে রকি আর রাজিব শেখের কল আসবে।

ফারুখ আপাতত ক্লান্ত।সারাদিনই বাসায় বসে থাকে।এখন আর বাড়ি থেকে তেমন বের হয়না।খাওয়ায় মন নেই।দিনের বেলা যেমন তেমন রাত হলেই যন্ত্রণাগুলো তিনগুণ হয়ে উঠে।বুকে অসহ্যনীয় ব্যথা অনুভব হয়।ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।চিৎকার করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে মন চায়।কিন্তু পারেনা।মা এমনিতেই ভেঙে পড়েছেন।এখন যদি ফারুখও এরকম করে তাহলে উনার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
কিন্তু প্রতিদিন রাত ঠিক এগারোটায় স্বপ্নার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে।আগে যেমন রাত এগারোটা হলেই দেখা করতে যেতো?রূপক মাঝেমাঝে ডুকরে কেঁদে ওঠে।যেখানে স্বপ্নাকে কবর দেওয়া হয়েছে ওই পথ দিয়ে কেউ চলাফেরা করেনা।আত্মহত্যা করায় স্বপ্নার জায়গা কবরস্থানে হয়নি।একটা জলাশয়ের পাশেই মাটি খুঁড়ে কবর দেওয়া হয়েছে।কবরের মাটি হাতে নিয়ে নিজের শরীরে মেখে উন্মাদের মতো আচরণ করে ফারুখ।এমন দৃশ্য যেকোনো মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম।

ফারুখ ধরা গলায় বলল,দেখো প্রতিদিনের মতো তোমার জন্য ফুলের ভালোবাসা নিয়ে এসেছি।কিন্তু আগে তুমি ফুলটা হাতে নিয়ে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখতে।আর এখন বই ছাড়াই ফুল শুকিয়ে যাই অথচ তুমি ছুঁয়েও দেখোনা।কেনো চলে গেলে আমাকে একা করে?
তুমি একটা মিথ্যাবাদী।আমাকে হাজারও প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেগুলো পূরণ না করেই চলে গেলে?
চলেই যখন যাবে মায়া বাড়িয়েছিলে কেনো তবে?
—————————————————————

গাড়ি এসে থামলো চট্টগ্রামে।তরুণ সহ বাকিরা আগে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো।কাল রাতে সবাই খেয়েছে এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে।অথচ পেটে এখনো কিছুই পড়েনি।
খাবার খেয়ে চট্টগ্রামের মেইন শহরে আশেপাশের একটা হোটেলে উঠলো সবাই।দশমিনিট একটু বিশ্রাম নিয়েই সবাই বেরিয়ে পড়ে রকি আর রাজিব শেখকে খোঁজার উদ্দেশ্যে।চার ভাগে বিভক্ত হয়ে চারদল চারদিকে গেলো।

পুরোদিনে বেশ কয়েকটা জায়গা খুঁজে ফেলেছে কিন্তু রকি আর রাজিব শেখের দেখা মিললোনা।সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এসেছে তখনও তরুণ রকি আর রাজিব শেখকে খুঁজে চলেছে।এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলবেনা।তরুণ সামনের একটা গলি থেকে বেরিয়ে আসছে।চারদিক থেকে চারটা গলির মুখ এসে এক জায়গায় মিলিত হয়েছে।
রকি হুডিওয়ালা জ্যাকেট পড়ে বেরিয়েছে ফোনে রিচার্জ করতে।ফোনে ব্যালেন্স নেই।এখনই ইমারজেন্সি একটা কল করা লাগবে।যদিও এতরাতে দোকান পাট খোলা থাকেনা।মাঝেমধ্যে দুই একটা দোকান খোলা পাওয়া যায় বিধায় রকি বেরিয়েছিলো।
তরুণ যেখান দিয়ে হেঁটে আসছিলো সেখানে একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে।আলো এসে তরুণের মুখে পড়েছে।

রকি উত্তর দিকের গলি থেকে পশ্চিমের গলিতেই যাচ্ছিলো কিন্তু লাইটের আলোয় তরুণের চেহারা স্পষ্ট হতেই আগ পিছ না ভেবে পেছনে দৌঁড় লাগালো।উত্তর দিক থেকে কারো দৌঁড়ের শব্দ শুনে তরুণ সেদিকেই ছুটলো।
উত্তরের গলির সাথে আরো দুইটা গলি মিলিত হয়েছে।তরুণ সামনে গিয়ে রূপকের মুখোমুখি হলো।রূপক পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে বলল,শিট!পালিয়েছে।
তরুণ অবাক হয়ে বলল,তুই কখন আসলি চট্টগ্রাম?
রূপক লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,প্রীতিকে সকালে ডাক্তার দেখিয়েই গাড়িতে উঠেছি।একটু আগেই এখানে এসে পৌঁছেছি।গাড়ি থেকে নেমে আসার সময় রকির মতো কাউকে দেখে পিছু নিলাম কিন্তু শিওর ছিলাম না।দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে উল্টো দৌঁড়ে আসতে দেখে মুখ দেখে শিওর হলাম ও রকি।হয়তো তোকে দেখেই উল্টো দৌঁড় লাগিয়েছে।কিন্তু হাত ফসকে গেছে।

তরুণ বলল,এখন কিন্তু ওরা সাবধান হয়ে যাবে।আমরা যে ওদের খুঁজতে খুঁজতে চট্রগ্রাম পৌঁছে গেছি সেটা জেনে এখন নিশ্চয়ই তারা শহর পাল্টাবে।
রূপক হাঁটতে হাঁটতেই বলল,ওরা ও কম চালাক না।ওরা জানে আমরা ও তারা অন্যশহরে উঠেছে ভেবে চট্টগ্রাম থেকে চলে যাবো অন্যকোথাও খুঁজতে।আর তারা চট্টগ্রামেই থেকে যাবে।চারদিকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে।
তরুণ ভাবুক হয়ে বলল,আগেতো ভেবে দেখিনি।

রূপক তাড়া দিয়ে বলল,বাসা কোথায় নিয়েছিস?সেই কখন থেকে হেঁটেই চলেছি।
#চলবে……….

(ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং।)