প্রিয়তমা পর্ব-২২

0
386

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_২২

ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনী।চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক।দূর থেকে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ শব্দ তুলে চলেছে।বিভিন্ন গলির মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ আলো টিমটিম করে জ্বলছে।বড় বড় দালানের পেছনে একটা ছোট্ট কুঠুরিতে বাসা বানিয়েছে রকি আর রাজিব শেখ।
রাজিব শেখ বেশ চিন্তিত স্বরে বললেন,তরুণ ছেলেটা যেহেতু সুস্থ হয়ে গেছে তখন রূপক সব জেনে গেছে।কিন্তু আমরা যে চট্টগ্রামে আছি সেটা জানলো কি করে?আমাদের ফোন আর সিমকার্ডতো ফেলেই এসেছি।
রকি বাঁকা হেসে বলল,রুবির কাছ থেকে নাম্বার জেনেছে।এই নাম্বার থেকেই আমি রুবিকে কল করেছি রূপকের ব্যাপারে জানার জন্য।এতক্ষণে হয়তো রুবিও সব সত্যি জেনে গেছে আমাদের ব্যাপারে।এবার তার প্রয়োজনটাও ফুরিয়ে গেছে।তাকেও এবার তার যোগ্য জায়গায় নিয়ে আসবো বলেই হুহুা করে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো রকি।

রাজিব শেখ বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন।ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বললেন,নিজের বোনকেও ছাড় দেবেনা দেখছি।
রকি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল,টাকাই সব কিছু।তাছাড়া ও এখন আর আমার কোনো কাজে আসবেনা।
তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,তোমার মেয়েকেও নিয়ে আসোনা।
রাজিব শেখের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।ক্ষোভে রকির শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,খবরদার!আমার ব্যবসার সাথে আমার মেয়েকে জড়াবেনা।আল্লাহ আমাকে জান্নাত দিয়েছেন।

রকি হো হো করে হেসে উঠে।ঝাড়া মেরে কলার ছাড়িয়ে বলল,ঘরে জান্নাত রেখে বাইরে জাহান্নাম খুঁজতে এসেছো?গুড!ভেরি গুড!

—————————————————————
রকি রাজিব শেখ আর মিরন হায়দারের হাত পা চেয়ারের সাথে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা।ফারুখ সামনে চেয়ার টেনে বসেছে।দূরেই রূপক আর তরুণ এদিকেই আসছে।রকি রাজিব শেখ আর মিরন হায়দারের বীভৎস চেহারা দেখে গা গুলিয়ে আসছে প্রীতির।

🥀🥀
সেদিন রাতে রূপক আর তরুণ সময় ব্যয় না করে হোটেলে গিয়ে উঠে।পরেরদিন থেকে রকি আর রাজিব শেখের ছবি দেখিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে তাদের দেখেছে কিনা?কিন্তু কেউই বলতে পারলোনা।শেষ মুহূর্তে এসে একজন রকির চেহারা দেখে বলল,মনে হচ্ছে দুদিন লোকটাকে পেছনের গলির দিকে যেতে দেখলাম
রূপক শিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো,আপনি শিওর?
লোকটা ঠিক করে বলতে পারলোনা।বলল,মনে হচ্ছে উনাকেই দেখেছি।রূপক আর তরুণ ছুটলো পেছনের গলির দিকে।ফোর্সসহ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেলোনা।তরুণ বিল্ডিংগুলোর পেছনের দিকের জঙ্গলের মতো জায়গায় আস্তে আস্তে এগোলো।তার সাথে রূপক ও সেদিকে গেলো।একটা ছোট্ট কুঠুরি।মনে হচ্ছে কেউ থাকেনা এখানে।চারপাশে ঘাস লতাপাতায় ভরপুর।বেড়ার গা ঘেষে পরজীবি উদ্ভিদগুলো বেয়ে উঠেছে।ওখানে কিছু না পেয়ে ফিরে আসার সময় রূপক আরেকবার পেছনে তাকালো।যদি কেউ না থাকে তাহলে দরজাটা ভেতর দিয়ে বন্ধ হবে কেনো?নিশ্চয়ই বাইরে দিয়ে তালা দেওয়া থাকতো।রূপক সবাইকে চোখের ইশারায় ওকে অনুসরণ করতে বলল।রূপক আর তরুণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বলে দুজনে দরজার দুপাশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।হাতে পিস্তল।

রূপক গলার স্বর উঁচু করে বলল,রকি,রাজিব শেখ বেরিয়ে আসুন।আর পালানোর কোনো পথ নেই।পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করুন।ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা।রূপক আবারও বেরিয়ে আসার কথা বলল।সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ভাঙার প্রস্তুতি নিলো।দরজায় বাহু দিয়ে বার কয়েক ধাক্কা দিতেই কুঠুরির পেছন থেকে হুড়মুড়িয়ে কিছুর শব্দ হলে।সবাই দৌঁড়ে সেদিকে যেতেই দেখলো রকি আর রাজিব শেখ জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।রকি যুবক বলে রাজিব শেখের তুলনায় তার দৌঁড়ের গতি অনেকটাই বেশি।পেছন থেকে রূপক শুট করে দিলো রাজিব শেখের পায়ে।তিনি মুখ থুবড়ে পড়লেন।পুলিশ ফোর্স এসে তাকে ধরলো।রকি একবারও পেছনে না তাকিয়ে পালিয়ে গেলে জঙ্গলের ভেতর।

সবার চোখের আড়াল হয়ে কুটিল হাসি দিলো রকি।সাথে পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে।কাল মেয়েগুলোকে বিক্রি করে সবটাকা মেরে আমেরিকায় গিয়ে উঠবে।বাবার সম্পত্তির দলিল অলরেডি নিজের নামে করে সেগুলো বিক্রি ও করে দিয়েছে।কৌশলে রুবির থেকে সাইন নিয়ে নিয়েছে।একবার আমেরিকায় গেলে আর বাংলাদেশের মুখোমুখি হবেনা।বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ কিছুইনা।নিজের ব্যবসার জন্য সেই কেসের একজন পুলিশ অফিসারের সম্পূর্ণ খবরাখবর তার জানা জরুরি ছিলো যা রুবির মাধ্যমে নিয়েছে।
এখনই নিজের আস্তানায় যাবে।যেটা তাদের গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে।যেখানে মেয়েগুলোকে গুম করে রেখেছে।

পরেরদিনই রকি তার আস্তানায় পৌঁছে যায়।মিরন হায়দারকে কল করে ঠিকানা জানিয়ে দেয়।আজ রাতেই মেয়েগুলোকে তার হাতে হস্তান্তর করবে।কল কেটেই লম্বা একটা ঘুম দেয়।
এদিকে কনস্টেবল নিজাম রূপককে কল করে জানিয়ে দেয় রকি মিরন হায়দারকে কল করেছিলো আর ঠিকানা দিয়ে আজ রাতেই যেতে বলেছে।
রূপক আর তরুণ সবাইকে নিয়ে তখনই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।আর সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যায়।
বাড়িতে না গিয়ে সোজা থানায় যায়।সেখান থেকে মিরন হায়দারকে নিয়ে রকির দেওয়া ঠিকানায় চলে যায়।সাথে রাজিব শেখকেও নিয়ে যাওয়া হয়।ওদের সাথে এসে ফারুখও যোগ দেয়।

আগে মিরন হায়দার ভেতরে ঢোকে।স্বাভাবিক ভাবেই রকির সাথে ফর্মালিটি শেষ করে পেমেন্ট সম্পন্ন করে।এরপর রকি মেয়েগুলোকে মিরন হায়দারের হাতে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হাঁটা ধরে।মিরন হায়দার পিছুপিছু যায়।বিল্ডিং এর একেবারে শেষপ্রান্তে চলে যায়।মিরন হায়দার ভ্রু কুচকে তাকালেন এখানেতো কোনো রুম নেই তবে মেয়েগুলোকে কোথায় রেখেছে?
দেয়ালে পেইন্টিং আটকানো ছিলো মিরন হায়দার সেগুলোই দেখছিলেন।পেইন্টিং গুলো দেখে মনে হচ্ছে একেবারে জীবন্ত কোনো দৃশ্য।রকি একটা পেইন্টিং এর উপর হাত রাখলো।সেটি ঘুরিয়ে দিয়ে দেওয়ালে হাত রাখলো।সাথে সাথেই হাট করে একটা দরজা খুলে গেলো।মূলত পেইন্টিং এর পেছনে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া ছিলো।মিরন হায়দারকে নিয়ে রকি ভেতরে ঢুকলো।ভতরে গিয়ে আরেকটা দরজার লক খুলে দিলো।

তখনই পুলিশ পেছন থেকে পিস্তল তাক করলো।রকির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়ালো রূপক।সে দুহাত উপরে তুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফন্টা আঁটার চেষ্টা করলো।কিন্তু এখান থেকে পালানোর রাস্তা নেই।একে একে সবগুলো মেয়েকে বের করে শেষে গিয়ে রূপক তরুণ দুজনেই চমকে গেলো প্রীতি,রবি,ফারিহা তিনজনকে দেখে।দ্রুত ওদের হাত মুখের বাঁধন ছাড়িয়ে রূপক জিজ্ঞেস করলো তোমাদেরকে কখন এখানে আনলো?
প্রীতি রূপকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।ফারিহা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,বাবা বাড়িতে ছিলেননা।হঠাৎ কতগুলো লোক এসে আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসলো।মা বাঁধা দেওয়ায় উনাকে একটা রুমে ধাক্কা মেরে আটকে রাখেছে।

রূপকের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।রকির নাক বরাবর একটা পাঞ্চ মারলো।গলগলিয়ে নাক দিয়ে রক্ত বের হলো।তরুণকে মেয়েগুলোকে নিয়ে যেতে বলল রূপক।ও প্রীতি আর ফারিহাকে নিয়ে পেছনে আসলো সাথে রুবিও আছে।
ফারুখ পুলিশ ফোর্সদের সাথে গেলো।আসামি তিনজনকেই ইচ্ছেমতো মারলো বেঁধে রেখে।রকির দুই পায়ের মাঝখানে জোরসে কয়েকটা লাথি মারলো।রকি একেবারে গুটিয়ে গেলো।রাজিব শেখকেও ছাড় দেয়নি ফারুখ।

রূপক আর তরুণ এসে ফারুখকে থামিয়ে দিলো।বলল,আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে।
রাজিব শেখ ঢুলুঢুলু চোখে প্রীতির দিকে তাকালেন।অস্ফুট স্বরে বলল,আম্মাজান।প্রীতি ঘৃণায় মুখ ফওরিয়ে নেয়।
রকি গা ঝেড়ে বলল,বন্দি পেয়ে নিজেদের ক্ষমতা জারি করছো?একবার শুধু বাঁধন ছুটিয়ে দাও তখন দেখবে আমি কি করি।
তরুণের রাগ উঠে গেলো।রকির হাত পায়ের বাঁধন ছুটিয়ে দিতে গেলো।হাতের বাঁধন খোলা হলেই রূপক আটকে দেয়।
বলল,এর কথায় কান দিয়ে কেসটাকে আর লম্বা করিসনা।আজই এই কেসের শেষ হবে।তরুণ সরে দাঁড়ালো।

রকি হাহা করে হেসে টিটকারি করে বলল,শালা এক-একটা কাপুরুষ।তরুণ আর দাঁড়িয়ে থাকলোনা।এবার বাঁধন খুলেই দিলো।সাথে রাজিব শেখের বাঁধন ও খুললো।উনার বাঁধন খুললেও তেমন কিছু করতে পারবেননা।উনার পায়ে গুলি লেগেছে।
রকি ওর পেছনে থাকা একজনের বাহুতে আঘাত করে পিস্তল নিয়ে নেয়।
বাঁকা হেসে পিস্তল প্রীতির দিকে তাক করে।প্রীতির প্রতি তার একটা ক্ষোভ আছে।একে মারলে রাজিব শেখ,ফারুখ,রকি তিনজনই জব্দ হবে।রূপক সাথে সাথে নিজের পিস্তল রকির দিকে তাক করে।রাজিব শেখ নিজেও একজনের থেকে পিস্তল নিয়ে রকির দিকে তাক করে বলল,আমার মেয়ের কিছু হলে তুই ছাড় পাবিনা।
রকি বাঁকা হেসে ট্রিগারে চাপ দিলো।কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই আওয়াজ হলো।রকি ধপ করে নিচে পড়ে গেলো।সারা শরীর রক্তে মাখামাখি।রাজিব শেখের পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়েছে।রাজিব শেখ পরপর আরও তিনটি গুলি করে রকির বুক ঝাঁজরা করে দিলেন।
সবার বিস্ফোরিত দৃষ্টি সেদিকে।পেছন থেকে প্রীতির আর্তনাদ শুনে সবাই সেদিকে তাকালো।রূপক দেরি না করে দৌঁড়ে গিয়ে প্রীতির মাথা কোলে নিলো।

একসাথে দুজনের পিস্তল থেকে বুলেট বেরিয়েছে।রকির পিস্তল থেকে এসে প্রীতির পেটে বিঁধেছে আর রাজিব শেখের পিস্তল থেকে রকির বুকে।
রাজিব শেখ পা টেনে প্রীতির কাছে আসার আগেই রূপক প্রীতিকে কোলে তুলে দৌঁড় লাগালো।তার আগেই ফারুখ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো।

তরুণ ভেতরের সবকিছু সামলে নিয়ে সবাইকে নিয়ে থানায় চলে গেলো।রাজিব শেখের চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।এজন্যই বোধহয় হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন—

–——পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে,কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।

রূপকের কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে।প্রীতিকে শক্ত করে বুকে আগলে রেখেছে।অস্থির কন্ঠে ফারুখকে তাড়া দিয়ে বলল,আরও দ্রুত চালাও।ফারখ গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে আরও।রূপক চোখদুটো ক্রমশ লাল হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে একটু পরই চোখ ভেঙে বর্ষণ নামবে।প্রীতি কাঁপা কাঁপা হাতে রূপকের গাল স্পর্শ করে বলল,আমি বাঁচতে চাই।আপনার সাথে বৃদ্ধ বয়স পার করতে চাই।আমি মরে গেলে যদি অন্যকেউ আপনার প্রিয়তমা হয়ে যায়।এটা আমি কিছুতেই মানতে পারবোনা।আমি খুব হিংসুটে স্বভাবের।আমিই শুধু আপনার প্রিয়তমা হবো আর কেউ নয়।

রূপকের চোখ দিয়ে গলাগলিয়ে পানি পড়তে লাগলো।কান্নামাখা কন্ঠে বলল,চুপ করো তুমি।তোরমার কষ্ট হবে কথা বললে।কিছুই হবেনা তোমার।আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি।তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।
সামনে ফারুখের চোখেও পানি।বারবার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে আর সে বারবার মুছে চলেছে।নয়তো ড্রাইভিং এ সমস্যা হতে পারে।

প্রীতি শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বলল,আপনি কাঁদছেন কেনো?আমি আবার ফিরবোতো।আচ্ছা আমি যদি আর নাও ফিরি তাহলেও আপনি বিয়ে করতে পারবেননা।কথা দিন আমাকে।রূপক শব্দ করে কেঁদে উঠলো।প্রীতিকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রীতির ঠোঁটে চুমু খেলো।সারামুখে পাগলের মতো চুমু দিয়ে বলল,কিছু হবেনা তোমার।তুমি আমার জন্য আল্লাহর দেয়া নিয়ামত,দামী উপহার।এই দামী উপহার আমি কখনো হারাতে দেবোনা।
প্রীতির শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
#চলবে…….