প্রিয় দিও বিরহ পর্ব-১০+১১+১২

0
498

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১০.

গরমে খাঁ খাঁ করা নিস্তব্ধ দুপুর। মাঝে মাঝে দুই একটা কাক ডেকে ডেকে উঠছে। স্টাডিরুমটা পুরনো দিনের হলেও বেশ ঝা চকচকে। বিশাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বুকশেলফটা। সেখানে প্রথম সারিতেই
সসজ্জিত হয়ে নজর কারছে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ দ্বিতীয় সারিতে একে একে নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্রের নানান উপন্যাস শোভা পাচ্ছে। যদিও মনোরোম পরিবেশ। তবুও, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে মেহতিশার। সামনের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে কাঁপা হাতে সম্পূর্ণটা শেষ করে ফেলে। তৃষ্ণার জোয়ারে ভাসছে গলদেশ। যেনো তেনো তৃষ্ণা নয়।
ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। সামনেই শামীউল্লাহ জামান চশমা চোখে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হাত দিয়ে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছেন।

মেহতিশা সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে ছাঁদে গিয়ে ঘুরছিলো। দর্পণ ঘরেই তখন। আশফিন এসে কোথা থেকে দৌড়ে বলল,

‘তিশাপি, তোমাকে বড় চাচ্চু ডাকছে তার স্টাডিরুমে। ‘

মেহতিশা ভাবুক গলায় বলল,

‘কীজন্য ডাকছে জানিস?’

‘সেটা তো বলেনি। ‘

‘আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি। ‘

মেহতিশা ঘেমে ওঠে। এরকম জরুরি তলবে কেন ডাকলো! এমন ভাবেই আজ থেকে দশ দিন আগে ডেকেছিলেন তিনি। জীবনের মোড় আচমকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। না চাইতেও বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়েছিলো, নাহলে এতোদিনে বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে সুদূর জার্মানে থাকতো সে। নিজের আর্কিটেক্ট হওয়ার সপ্ন পূরণ করতো। যেতে পারেনি শুধু মাত্র এই বিয়ের জন্য। তাই তো এতোটা রাগ কাজ করে দর্পণকে দেখলে। যতবার তাকায় ততবার মনে হয়, যদি দর্পণ তার জীবনে না আসতো তাহলে এসব সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে দূরে গিয়ে ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে পারতো। হাহ! মেহতিশা তারপর ভাবতে ভাবতে স্টাডিরুমে এসে বসে। না জানি কী বলবে! ভেবে ভেবে অস্থির লাগে তার।

শামীউল্লাহ টানা দশ মিনিট তাকিয়ে থাকার পর স্মিত হেসে বললেন,

‘ভয় পাচ্ছো নাকি মা?’

মেহতিশা ঘাবড়ে বলল,

‘ককই নাতো! ‘

‘হাহাহা, যাকগে। ‘

তিনি ফাইলের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে মেহতিশার দিকে বাড়িয়ে দিলেন৷ মেহতিশা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে সেটা হাতে নিলো। পিলে চমকে উঠলো তার। একটা ডিভোর্স পেপারের এপ্লিকেশন । মেহতিশা বিস্মিত চোখে বাবার দিকে তাকালে তিনি বললেন,

‘চমকাচ্ছো কেনো? তোমাকে তো আগেই বলে দিয়েছি, এই বিয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই দলিল গুলো হাতে আনা। সেগুলো আনলে তবেই তো আমরা সেই ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ গুলোকে সাহায্য করতে পারবো।’

মেহতিশার চোখ দু’টো ঘোলা হয়ে আসে। মাত্র তিনদিনের সম্পর্কে এক অদ্ভুত টান অনুভব হচ্ছে তার। ছয় মাস হলেই দর্পণ নামের মানুষটার থেকে আলাদা হয়ে যাবে, ভাবলে মনটা কেমন করে ওঠে।
সে ঘোলা চোখে করুণ দৃষ্টিতে বলে,

‘বাবা, এর কোনো বিকল্প নেই? ‘

‘মানে! এক মিনিট তুমি আবার অন্য কিছু ভাবছো না তো? মেহতিশা কান খুলে শুনে রাখো, তোমাকে এই বিয়ে দেয়ার কারণ হচ্ছে তুমি দর্পণকে তোমার জালে আবিষ্ট করে ধ্যান সরিয়ে সেই পুরনো কোম্পানির সব কাগজপত্র নিয়ে চলে আসবে। দর্পণ বিন্দু মাত্র টের পাওয়ার আগেই আমরা সব সামলিয়ে ফেলবো। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, তোমাকে এরপর আমি জার্মান পাঠিয়ে দেবো। তবে হ্যা, যদি তুমি কাগজপত্র যদি না আনতে পারো তাহলে জার্মানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখো না। মনে রাখবে, দর্পণ শুধু আমাদের ক্ষতিই করেনি সঙ্গে তোমার মেঝো চাচার প্রাণও নিয়েছে। আমার ভাইটাকে প্রাণে মেরেছে এর হেস্তনেস্ত তো হবেই। ‘

মেহতিশা মূর্তির মতো মাথা নাড়িয়ে উঠে যায়। গায়ে তেমন শক্তি পাচ্ছে না সে। ঘর থেকে বের হতে হতে বিরবির করে বলে,

‘আজ যদি সত্যিকারেই তোমার মেয়ে হতাম তাহলেও কী আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে?’

গাড়ির চাকা আবারও ঘুরছে। পথযাত্রা শেখ মহলের উদ্দেশ্যে। নাইওরের পালা শেষ হয়েছে। এবার মেহতিশা ও দর্পণ ফিরছে নিজ নীড়ে। আসলে, শুধু দর্পণের। মেহতিশার মতে সে নীড়হীনা। সে ভেলার মতো ভাসতে থাকে এদিকে ওদিকে। বেশি ভার হলেই ডুবে যায়। আবারও কোনো রৌদ্রস্নাত দিনের অপেক্ষায়।
বাসায় ফিরে সবার সাথে কথা বলে ঘরে আসে মেহতিশা। দর্পণ হুইলচেয়ার চালিয়ে ওয়াশরুম থেকে বাহির হয়। হাত মুখ ধুয়ে এসে খাবারের থালা হাতে নেয়। মেহতিশা হঠাৎ করেই বলে,

‘আমাকে দিন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ‘

দর্পণ চকিতে তাকায়। মনে মনে কিছুটা সন্দেহ হলেও ভীষণ খুশিও হয়। মেহতিশা হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। হাতে প্লেটটা নিয়ে এক লোকমা ভাত তুলে মুখের সামনে ধরলো৷ দর্পণের চোখের ভাষা পড়তে পারলো মেহতিশা। বুঝতে পারলো, দর্পণ ভাবছে সে হা করলেই মেহতিশা খাবার সেদিনের মতো ফেলে দেবে।
মেহতিশা ফিক করে হেঁসে বলল,

‘আজ ফেলবো না জনাব। ‘

দর্পণ একটু ভরসা পেয়ে হা করে। মেহতিশা সযত্নে মুখে তুলে দেয়। দর্পণ ভাবে, তবে কী ধীরে ধীরে মেহতিশা তাকে মেনে নিতে শুরু করলো! যদি সত্যি হয় তাহলে, এসব ভেবে মনে প্রচুর আনন্দ অনুভব করে সে। দর্পণ মেহতিশা দু’জনেই খাবার শেষ করে নেয়। বহুদিন পর যেনো দর্পণ মন খুলে কথা বললো মেহতিশার সঙ্গে। মেহতিশার প্রাণোচ্ছল বাক্য দর্পণের লুকানো বাচ্চামো স্বভাব বের করে আনলো। সব কাজকর্ম শেষে রাতে শোবার সময়, দর্পণ একটু দ্বিধা রেখে এক পাশে শুয়েছিলো। মেহতিশা লাইট নিভিয়ে
টুপ করে দর্পণের হাত জড়িয়ে বাহুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। দর্পণ মুচকি হাসলো। মেহতিশার মাথায় হাত রেখে মনে মনে বলল,’ভালোবাসি’। অথচ অপর দিকে মেহতিশা বাঁকা হেসে বলল,

‘আম সরি দর্পণ শেখ। ‘

চলবে-

”প্রিয় দিও বিরহ ”

১১.

হেমন্তের শুরু। পরিবেশের বিচিত্রিতা ধরা যাচ্ছে না। এই বৃষ্টি তো এই গরম। এই সর্দি লাগছে তো আবার দৌড়ে পালাচ্ছে। কী জানি, কত রূপই না সে দেখাবে।
সময় পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে। কেটে গেছে সংসারে পদার্পণের চারটি মাস। রাগ, অভিমান, আর দিনশেষে
প্রণয়সিক্ত অজস্র ভালোবাসা। মেহতিশা এখন আর সেই আগের মতো রাগারাগি করে না। দিন যতই যায়
সে ততই সংসারী রূপে আবর্তিত হচ্ছে। কখনো তাকে দেখা যায় সকালে দর্পনের জন্য চায়ের কাপ হাতে হাজির হতে, দর্পণের কাপড় গুছিয়ে ভাজ করতে, কখনোবা কাঁচা হাতে রান্না শেখার আকুল চেষ্টায়। সব মিলিয়ে পাক্কা গৃহিণী। কে জানে এসব কী সে মন থেকেই করে নাকি সবই নাটক! প্রশ্ন থেকে যায় বটে।
উত্তর মেলেনা। চোখ নাকি মনের কথা বলে। দর্পণ যতবার মেহতিশার ধূসর গোধূলির মতো দুটি চোখের দিকে তাকায় ততবারই নতুন করে প্রেমে পড়ে। মন বলে ঐ দুটি চোখও একরাশ ভালোবাসে তাকে! দর্পণের সন্দিহান মন তখন মেহতিশাকে কাছে পেলেই সুধায়,
‘সত্যিই ভালোবাসেন তো বউজান?’

মেহতিশা মুচকি হাসে। প্রতুত্তর করেনা। দর্পণ আস্বস্ত হয়। ভেবে নেয়, নিশ্চুপতা সম্মতির লক্ষ্মণ। দর্পণ অধর ছোঁয়ায় মেহতিশার ললাটে ৷ গাঢ় স্পর্শ। আবেশে ঘোর লেগে যায় মেহতিশার। টুকরো টুকরো মায়ার বাঁধনে বেঁধে যেতে থাকে দর্পণ। ভালোবাসা মানে হয়তো সত্যিই ধ্বংস। মানুষ অবলীলায় সেই ধ্বংসের খাতায় নাম লেখায়। দর্পণের মাঝে মাঝে এখন মনে হয় মেহতিশার জন্য সে প্রাণও দিতে পারে। শুধু তার একটাই চাওয়া, ভালোবাসা কাছে থাকুক।

ঘড়ির কাটায় ছয়টা বেজে চার মিনিট। একে অপরের হাতে হাত রেখে গভীর তন্দ্রায় ডুবে আছে একজোড়া কপোত-কপোতী। নড়েচড়ে উঠলো দর্পণ। দর্পণের বাহুর উপরে নিয়ম করে শুয়ে ছিলো মেহতিশা। দর্পণের নড়ায় ঘুম হালকা হয়। উঠে বসলো সে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে রইলো দুয়েক মিনিট। এতো নড়ছে কেন মানুষটা! ভোর রাত থেকেই বারবার নড়াচড়া করছে। দর্পণ ঘুমের মধ্যে একেবারেই শান্ত থাকে। কখনো আঙুলটাও নাড়াতে দেখেনি। মুখটা যেভাবে অল্প একটু হা করে থাকে তেমনটাই সকাল হলে দেখা যায়। ঠোঁট দুটো উল্টে আছে। চুলগুলো বড় হয়েছে। ফর্সা রঙের মুখটা লাল হয়ে গেছে। মেহতিশা ভ্রু কুচকায়। দ্বিধাহীন হাতটা ছুঁইয়ে দেয় দর্পণের কপালে। পিলে চমকে উঠে। গা গরম হয়ে আছে। এজন্যই বুঝি মেহতিশার গরম লাগছিলো। মেহতিশা
অস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। প্রায় দৌড়ে বাথরুম থেকে পানি নিয়ে আসে মগে। পরিষ্কার কাপড় এনে জলপট্টি দিতে থাকে। এতো সকালে অন্যরা কেউই ওঠেনি। তাই বসে বসে জলপট্টি দিতে থাকলো। তাপমাত্রা হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। মেহতিশা দর্পণের দিকে তাকিয়ে এবার ভয় পেয়ে যায়। নীল হয়ে গেছে মুখটা। মেহতিশা কাঁপা হাতে দর্পণের দুই গালে হাত রাখে। আলতো করে ডাক দেয়,

‘দর্পণ, উঠুন। শুনছেন?’

দর্পণের সারাশব্দ পাওয়া যায় না। এমনিতে বেশ সজাগ সে। ঘরে পাতা পড়ার শব্দ হলেও ঘুম ভাঙে। এখন উঠছেনা কেন? মেহতিশা বুঝতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে৷ শ্বাশুড়ির ঘরের দরজায় ঠকঠক করে। দর্পণের মা ঘুমঘুম চোখে বের হন। মেহতিশাকে দেখে অবাক হয়ে বলেন,

‘কী ব্যাপার বউমা? এতো সকালে এখানে! ‘

মেহতিশা কেঁদে ফেললো। আঁটকে আঁটকে বলল,দর্পণ ঘুম থেকে উঠছেনা গায়ে প্রচুর জ্বর। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। দর্পণের বাবাকে ডাকলেন। একে একে চেচামেচির আওয়াজে সবাই ঘর ছেড়ে বের হলো। এমনকি নিশিতাও। মেয়েটা সবসময় ঘরেই থাকে। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সবসময় পাগলামি করেনা। ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। জানালার দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভাবে৷ সেও বের হয়ে আসতে চাইলো। কাজের মহিলা এসে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। দিয়া, দর্পণের মা, বাবা দর্পণের ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করে বললেন,জ্বর ১০৪ ডিগ্রিতে। সিজনাল জ্বর হলেও একবার টেস্ট করে নেয়া ভালো। যেহেতু এখন করোনা মহামারী পরিস্থিতি ভালো না। ঘন্টা খানেকের মাঝেই হাসপাতালে শিফট করানো হলো দর্পণকে। জ্বরের কারণে ঘুমের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছে সে।

কেবিনের সাদা বিছানায় মলিন শরীরে শোয়ানো দর্পণ৷ মেহতিশা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কী দেখছে কে জানে। সকাল থেকে সে একদমই খালি পেটে। গলা দিয়ে খাবার নামেনি৷ লালিমা শেখ নিজেও অসুস্থ মানুষ। তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন শুধু মেহতিশাই আছে৷ দিয়া যদিও এসেছিলো৷ তবে তারমধ্যে হাসপাতালে থাকার কোনো আগ্রহবোধ দেখা যায়নি। কেমন গা ছাড়া ভাব। মেহতিশা বুঝতে পারে, নিজের পরিবারের সবার থেকে একটু দূরে সরে থাকে দিয়া। কী কারণ, বোঝেনি।

ক্লান্ত নেত্রপল্লবে শূন্যে তাকিয়ে আছে মেহতিশা। বিকট শব্দে মোবাইলটা বেজে উঠলো। সেটায় বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘বাবা ‘। মেহতিশা বেখায়ালী হাতে তুলে কানে লাগায়। শামীউল্লাহ জামান ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলেন,

‘শুনলাম, দর্পণ নাকি এখন অসুস্থ। ‘

মেহতিশা প্রশ্ন করে,

‘তুমি কীভাবে জানলে?’

‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে। টাকা থাকলে বাঘের চোখও পাওয়া যায়। যা বলার জন্য কল করেছি, এখন যেহেতু দর্পণ হাসপাতালে। তাই তোমার জন্য কাগজ বের করা সহজ হবে৷ বাসায় গিয়ে হাত চালাও। ‘

মেহতিশা বিরক্ত হয়। অভিভ্যাক্তিতে ধরা পড়ে। সে মনোযোগ না দিয়ে হেলা করে বলে,

‘হু, দেখবো। ‘

তিনি রাগত স্বরে বলেন,

‘দেখবো কী? এখনই বাসায় যাও। ‘

‘উনি অসুস্থ বাবা। ‘

‘অসুস্থ তো! ও মরুক ৷ তোমার কী? ‘

‘আমি হাসপাতালে থাকবো। রাখলাম। ‘

শান্ত কন্ঠস্বরে কথাটা বলেই কল কেটে দেয় মেহতিশা।
এগিয়ে যায় দর্পণের বিছানার দিকে। এককোণে বসে মাথা এলিয়ে দেয়। ঘুম নেমে আসে চোখে। দর্পণের জ্ঞান ফিরে হঠাৎ। সে নড়তেই মেহতিশা সজাগ হয়। অস্থির ভাবে বলে,’আমি এখনই ডক্টর ডাকছি। ‘

দর্পণ মেহতিশাকে আঁটকে দেয়। মেহতিশা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকায়। দর্পণ মেহতিশার হাত টান দিয়ে কাছে আনে। মেহতিশার চোখ টলমল করে। সেই সকাল থেকে কী নির্জীব হয়ে ছিলো এই মানুষটা। বুক ভারি লাগে। করুণ দৃষ্টিতে তাকাতেই দর্পণ মুচকি হাসে। দুই হাতে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। মেহতিশা নরম বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে যায়। দর্পণ ঠান্ডা স্বরে বলে,

‘ভয় পেয়েছিলেন বউজান?’

অনেকটা সময় পর বউজান ডাক শুনে আবেগি হয় মেহতিশা। দর্পণের হাতটা আঁকড়ে ধরে বলে,

‘আপনি অনেক খারাপ। ভোররাতে আপনার খারাপ লাগছিলো,আমায় ডাকেননি কেনো? ‘

‘আপনাকে ঘুম থেকে উঠাতে ইচ্ছে করছিলো না। ‘

‘কেনো?’

‘ঘুমালে আপনাকে সুন্দর লাগে। ‘

মেহতিশা অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়। লজ্জায় মুখ লুকায় দর্পণের বুকে। দর্পণ সশব্দে হাসে৷ মনে মনে আওড়ায়,

‘আমি বলেছিলাম, আপনি আরশীজালে ফেঁসে যাবেন। আপনি ফেঁসে গেছেন বউজান। ‘

চলবে –
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১২.

আজ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে দর্পণ। শরীর মোটামুটি সুস্থ। বাসায় ফিরে একের পর কলেই সময় কাটাচ্ছে। মেহতিশা আগে যদিও জানতো দর্পণ রাজনীতির সাথে জড়িত। তবে এখন বুঝতে পারছে,
কয়েক দিন পরে ভোটে সে দাঁড়াবে। আনমনে মেহতিশা ভাবতে থাকে, যে নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারেনা সে কীভাবে ইলেকশনে দাঁড়াবে!ভাবতে ভাবতে দর্পণের দিকে তাকিয়ে থাকে। দর্পণ তখন ডান হাতে মোবাইল কানে দিয়ে আরেক হাতে কাগজে কিছু তুলছিলো। হঠাৎ মেহতিশার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। মেহতিশা অপ্রস্তুত হয়। তাড়াহুড়ো করে নিজের কাজে মন দেয়। কাঠের টেবিলটা মুছতে শুরু করে। দর্পণ মুচকি হেসে বলে,

‘আমার দিকে তাকালে আমি মাইন্ড করবো না, বউজান। ‘

মেহতিশা লজ্জিত হয়। এড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘মোটেও না, আমি তো এমনি ওদিকে তাকিয়েছি। ‘

‘ওদিকে কোথায়? ‘

‘ঐ যে আপনার পেছনে। ‘

‘আমার পেছনে কী আছে?’

‘খাট! ইশ, কী ধুলো পড়েছে! ওটাই দেখছিলাম। মুছতে হবে। ‘

দর্পণ হেসে ফেলে। মেহতিশা সেদিকে ধ্যান দেয়না। এগিয়ে আসে হাতের কাপড়টা নিয়ে খাটের উপরের বক্সটা মুছতে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই যেনো করছে সে। দর্পণ ক্ষণকাল তাকায়। হাতের মোবাইলটা পাশে রাখে। মেহতিশা উবু হয়ে মুছছিলো। দর্পণ দুষ্ট হেসে মেহতিশার ঢিলে আঁচল ধরে টানতেই মেহতিশা ধপাস করে বিছানায় পড়ে।
আকস্মিক ঘটনায় অবাকতার রেশ কাটেনা। কী থেকে কী হলো বোধগম্য হয়নি। পিটপিট করে তাকাতেই দেখলো দর্পণের উত্তপ্ত শ্বাস পড়ছে তার মুখমন্ডলে।
অস্বস্তিতে কুঁকড়ে আসে মেহতিশা। দর্পণকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। দর্পণ নড়ে না। শক্তিতে পেরে ওঠেনা মেহতিশা। ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে,

‘সরুন৷ ‘

‘যদি না সরি? ‘

দর্পণের নির্লিপ্ত উত্তর। মুখে বিরাট হাসি। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয় মেহতিশা। লজ্জামাখা হাসিতে
মাথা নিচু করে। দর্পণ তাকে চমকে দিয়ে অঁধরে গাঢ় স্পর্শ দিয়ে সরে আসে। মেহতিশা বিশাল লজ্জা পেয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে শুনতে পায়, দর্পণের প্রাণখোলা হাসি৷

ঝিঁঝি পোকার ডাক। নিস্তব্ধ রাত্রি। আকাশের ঠিক মধ্যেখানে সাদা গোল রুটির মতো একটা চাঁদ উঠেছে।
সেই ঝকঝকে সাদা চাঁদটাতেও একটা আবছায়া দাগ লেগে আছে। কল্পসাহিত্যের অর্ধেকটাই এই চন্দ্র নিয়ে।
তবুও এর রহস্য একচুল পরিমাণ কমেনি।

কী অদ্ভুত এই রাত! অবশ্য নিশিতার জন্য প্রতিটা রাতই একাকী নিঃসঙ্গ। নিশিতা হাতের শিকলটার দিকে তাকায়। হেসে দেয় ফিক করে। জোর করে খাওয়ানোর জন্য সকালে কাজের মহিলাটাকে কষে থাপ্পড় মেরেছিলো সে। নিশিতার মতে সে ঠিকই করেছে। সে বারবার বলছিলো, তাকে তার অর্পণ আসবে। খাইয়ে দিবে। নিশুপাখি বলে বুকে জড়িয়ে ধরবে। কাজের মহিলাটা খ্যাকখ্যাক করে বলছিলো ‘ওরে পাগলিনী! তোর স্বামী মরেছে। আর আসবে না।’ তাইতো গালে চরটা দিয়েছিলো সে। তার বিনিময়ে তাকে লালিমা ঘরের জানালার সাথে হাত বেঁধে শিকলবন্দী করে দেন।

নিশিতা চুপচাপ চেয়ে থাকে হাতটার দিকে। একদিন হাতটা ধরেই এক প্রেমিক পুরুষ কথা দিয়েছিলো কখনো ছেড়ে যাবেনা তাকে। কথা রাখেনি সে। চলে গেছে দূর, বহুদূর। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা।
নিশিতা নিজের এলোমেলো চুলগুলো মাথা নাড়িয়ে সরায়। হেলান দিয়ে দরজায় বসে। বিছানার উপর থেকে ফটোফ্রেমটা টেনে নিয়ে আসে। বুকে জড়িয়ে ধরে। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে।
একজন সুদর্শন যুবক হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে বোয়ালখালী চোখে পাশে তাকাচ্ছে। পাশ দিয়ে শাড়ি পরিহিত নিশিতা সলজ্জ হেসে বান্ধবীদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। কী মধুময় স্মৃতি ছিলো! তবে আজ সব ধূসর কেনো! কেনো সেই প্রিয় মানুষটা হারিয়ে গেলো অতীত হয়ে। নিশিতা ছবিটার উপর হাত বুলিয়ে বলে,

‘প্রিয়, তোমার নামের বিরহ আমাকে ভালো থাকতে দেয়না। ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।