প্রিয় দিও বিরহ পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
421

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৩.

মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। একপাশে থেকে রক্তাক্ত কিছু টেনে আনার গাঢ় ছাপ।
দুজন লোক দাঁড়িয়ে কিছু হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করছে। শিমুল নামের একজনকে হাঁক ছেড়ে ডাকতেই ষোল, সতেরো বছরের ছেলেটা এসে হাজির হয়। বোঝাই যাচ্ছে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। দু’জন লোকের মাঝে হায়দার নামের লোকটা শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘সব পরিষ্কার করেছিস তো? স্যার কিন্তু অপরিষ্কার জিনিস পছন্দ করেনা৷ ‘

শিমুল একগাল হেঁসে বলল,

‘হেয়া মুই জানি। হের লেইগেই তো এত দৌড় দিয়া দৌড় দিয়া কাজ করবার লাগসি। ‘

‘ঠিক আছে, শোন ঐটার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এটার দিকে সবাই নজর রাখবি। ভুলেও যেন পালাতে না পারে। এটাকে যে কেনো এতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে বলল স্যার, কে জানে! ‘

কথাটা বলে চেয়ারা বাঁধা যুবকের দিকে নির্দেশ করে ফজলু। ওর কথা শুনে হায়দার বলে,

‘জানিনা। শালা অনেক দিন ধরে স্যারের উপর নজরদারি করতেসিলো। কিন্তু টিকতে আর পারলো কই! ‘

বলেই দুজনে হো হো করে হেঁসে উঠলো। যেনো বিরাট কোনো কৌতুক পেশ হয়েছে এখানে। কথা বলতে বলতে বাহির থেকে হর্ণের আওয়াজ শুনলো দুজনে।
হড়বড় করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। দরজা খুলে এক সুঠাম দেহী পুরুষ প্রবেশ করলো। দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘কাজ শেষ? ‘

তিনজনই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। পুরুষটি ওষ্ঠে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে, তোমরা এখন যাও। আমি এখন এখানে কিছু কাজ করতে চাই। আমাকে একটা ধারালো ছুরি আর হাতুড়ি দিয়ে যেও। ‘

হায়দার নিচুস্বরে বলল,

‘ওসব রেডি করেই রেখেছি স্যার। আপনি চাইবেন জানতাম৷ ‘

পুরুষটি হেঁসে বলল,

‘হায়দার ওয়েল ডান। ‘

হায়দার, শিমুল আর ফজলু চুপচাপ স্থান ত্যাগ করে। তারা সবাই জানে এখানে এখন কী হবে। পুরুষটির মুখ থেকে প্রস্ফুটিত হাসিটি সরে যায়। ভেসে ওঠে তুমুল হিংস্রতা। কপালের অদৃশ্য রগগুলো দৃশ্যমান হতে থাকে। এক হাঁটু মুড়ে বসে ফ্লোরে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় চেয়ারে বেঁধে রাখা যুবকটির দিকে। এতটা সময় ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেশার মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও এখন জ্ঞান আছে সম্পূর্ণ। সে বুঝতে পারছে, এখন তার সাথে খুব একটা ভালো কিছু হবেনা। নিজেই যে নিজের বিরাট বিপদ ডেকে এনেছে সে। ভয়ে ভয়ে বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আর কখনো তার হয়ে কাজ করবো না। ‘

কথাটা বলার ঠিক এক মুহুর্ত পরই তারই দেহের থেকে আত্মা আলাদা হয়ে গেলো। পরিণত হলো লাশে। সামনের পুরুষটির সাদা পাঞ্জাবিটি রক্তে মেখে গেলো। এখন তার মুখের দিকে কেউ তাকালে বুঝতেও পারবেনা, যে সে হাতের ছুড়িটা দিয়ে এইমাত্র লোকটার মাথার উপরিভাগ কেটে দিয়েছে। মাথার উপরের অংশগুলো কেটে গিয়ে ভেতরের ব্রেইন আর রক্ত টগবগ করছে। যেন শরীরটা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা। পুরুষটি দীর্ঘক্ষণ সেই টগবগে রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সাইড থেকে রুমাল উঠিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে,

‘এতোটা সহজ মৃত্যু তোকে শুধু এজন্যই দিলাম কারণ শেষ মুহুর্তে তুই ক্ষমা চেয়েছিস। ওপারে ভালো থাকিস। ‘

পুরুষটি বের হয়ে যায়। শিমুল ততক্ষণে বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘স্যার, এটাকেও কী সবার মতো মাটিতে পুঁতে দেবো?’

‘না, এটার মাথাটা কেটে আমার শ্বশুর মশাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে, বাকিটা টুকরো করে পাশের কুকুর গুলোকে খাইয়ে দিস। ‘

‘ওকে বস। ‘

আকাশে তিমির কেটে গিয়ে আলোর কিরণ ফুটেছে।
আঁধার কাটিয়ে আরেকটা ঝলমলে সোনালী দিনের আগমন। কী সুন্দর রোদ এসে ঘর ছুঁয়েছে! দক্ষিণা বাতাস বইছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে ঘরের পর্দাগুলোকে। দর্পণ এক হাতে হেলান দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি বরাবরই নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রায় শায়িত মেহতিশা। মুখে অনবরত উষ্ণ শ্বাস পড়ায় ঘুম হালকা হয়। চোখ খুলেই দর্পণকে দেখে মুচকি হেসে দেয়। দর্পণও বিনিময়ে প্রশস্ত হাসে। মেহতিশার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

‘শুভ প্রভাত বউজান। ‘

‘শুভ প্রভাত। ‘

দর্পণের সাথে মিশে চোখ বুজে থাকে। দর্পণ মুচকি হেসে বলে,

‘উঠুন বউজান। তৈরি থাকুন। ‘

মেহতিশা ভ্রু কুচকে বলল,

‘কীসের জন্য তৈরি থাকবো? ‘

‘আপনার বাবাকে শান্তনা তো দিতে হবে তাই না? ‘

‘মানে? ‘

‘ফোনটা হাতে রাখুন। কখন কার মৃত্যু আসে বলা তো যায়না, ইন্না-লিল্লাহ। ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৪.

‘মৃত্যু’ কী ছোট্ট একটা সহজ শব্দ, কিন্তু সত্যিকারেই কী এর অর্থ সামান্য? মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী। একটা উক্তি আছে, মানুষ এমনভাবে বাঁচে যেনো তার কখনো মৃত্যু হবেনা। অথচ,মৃত্যুর পর মনে হয় যে তার কোনো কখনো পৃথিবী বুকে অস্তিত্বই ছিলো না। কতটা অস্তিত্বহীন হয় মানুষ মৃত্যুর পরে।

শামীউল্লাহ জামান থরথর করে কাঁপছেন। তার কল্পনাতেও কখনো তিনি এতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেননি। গায়ের প্রতিটি লোমকূপ তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছে, সামনে ভয়ঙ্কর পরিণাম তার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি কপালের ঘাম মুছলেন৷ বাড়ির সামনের
খাটিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। সেদিকে ঠিক ঠাক মতো তাকাতে পারছেন না তিনি। যতবার তাকাচ্ছেন, রূহ কেঁপে উঠছে। কী নিষ্ঠুর মৃত্যু দিয়েছে ছেলেটাকে! সবুজ নামের ছেলেটার কাটা মাথাটা পড়ে আছে খাটিয়ায়। তাও অক্ষত নয়। উপরিভাগটা কেটে চুল ফেলে দেয়া। বাকি শরীরটা যে কোথায় আছে কেউ হদীস জানেনা। এর থেকেও ভয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে, সকাল ভোর ছয়টায় হঠাৎ করেই সদরদরজায় টুং করে কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলেছিলো মেহতিশার মা। একটা কার্টুন বক্স দেখে কৌতূহল বশত খুলেছিলেন। ভেতরের মাথাটা দেখা মাত্রই চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। শামীউল্লাহ জামান বক্সটা হাতিয়ে দেখলেন, সেখানে একটা চিরকুটও লেখা আছে। কাঁপা হাতে কাগজটা খুলে দেখলেন রক্ত দিয়েই সেখানে কিছু লিখে রাখা। পেচানো হাতে লেখা,

‘কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। তোর পাঠানো সামান্য ছেলেটার যদি আমি এই অবস্থা করতে পারি। চিন্তা কর, আমি তোকে কী করবো।’

ভেবে আরেকদফা গলা শুকিয়ে আসলো শামীউল্লাহ জামানের। এই কাজ যে কে করেছে বুঝতে পারছে না।
তবে সন্দেহের তীর একজায়গায় ঠিকই গিয়ে লেগেছে। তিনি তৎক্ষনাৎ ফোনটা হাতে নিলেন। ডায়ালে গিয়ে মেহতিশাকে কল করলেন।

ডক্টরের কাছ থেকে চেক আপ করিয়ে মাত্র বাসায় ফিরলো দর্পণ আর মেহতিশা। দর্পণের পায়ের অবস্থার জন্য প্রতি মাসে একবার করে চেকআপ করে
আনতে হয়। প্রত্যেক বার বাবার সাথেই আসে সে। এবার মেহতিশা নিজেই বললো, সেই সাথে আসবে।
ডক্টর দেখিয়ে বাসায় এসে গোসলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো দর্পণ। মেহতিশা দর্পণের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো গুছিয়ে দিলো। একজন সার্ভেন্ট প্রতি দিন দর্পণের গোসলের সময় তাকে সাহায্য করে। মেহতিশা যদিও সাথে সাহায্য করতে চায় কিন্তু দ্বিধায় এগিয়ে যেতে পারে না। অতএব, দর্পণ ওয়াশরুমে ঢোকার পর মেহতিশা বিছানা গুছিয়ে নিয়ে বের হচ্ছিল। পেছনে মোবাইলের রিংটোনে ফিরে আসলো।
মোবাইলটা উঠিয়ে “বাবা” নামটা দেখতেই কপালে ভাজ পড়ে। মেহতিশা দোনোমোনো করে কলটা রিসিভ করে। কানে ধরতেই ভেসে আসে উত্তেজিত কন্ঠ-

‘মেহতিশা, তুমি এখন থেকে আরও সাবধানে থাকবে! কোনোরকম ভুল করবে না। ‘

মেহতিশা ভড়কে যায়। বুঝতে না পেরে বলে,

‘কী হয়েছে বাবা? ‘

‘সবুজ মারা গেছে। ‘

‘কে সবুজ?’

‘আরে! যাকে আমি দর্পণের দিকে নজর রাখতে বলেছিলাম। ‘

‘আশ্চর্য! বাবা, আমি তোমাকে বলেছি দর্পণের উপর আমরা সন্দেহ করে কিছু করতে পারিনা। তুমি আমাকে বিয়ে দিয়েছো শুধু মাত্র সন্দেহ করে। মেনে নিলাম,সেই কাগজটা যদি আমি পাই তাহলে দর্পণ অপরাধী কিন্তু না পেলে আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না সে এমন কিছু করেছে আর না চাচাকে মেরেছে। আর দর্পণ যদি ভুল কিছু না করে আমি তাকে কখনোই ছাড়বোনা। ‘

রাগান্বিত কন্ঠে সম্পূর্ণ কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠলো মেহতিশা। বুঝতে পারলো, দর্পণ নামক রহস্যময় মানুষটার সঙ্গে থাকতে থাকতে কতোটা মায়ামমতা জন্মে গেছে। সে কী দর্পণকে ভালোবেসে ফেললো! ধ্যান ভাঙে শামীউল্লাহ জামানের কথায়।

‘মেহতিশা! ভুলেও এমন কিছু করবে না তুমি। আমাকে তুমি যেমনটা কথা দিয়েছো তেমনটাই হবে। তোমার কাছে সময় ছয় মাস। তারপর আশা করি বাকীটা তোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবেনা। ‘

শামীউল্লাহ জামান ফোন রাখলেন ক্রোধ নিয়ে। রাগ উঠে গেলো তার। কী বোকা মেয়েটা! দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন তিনি। মেয়েটাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন নিজ হাতে। মেহতিশা ঠিক নারকেলের মতোন। বাহিরে শক্ত রাগী দেখালেও দুটো মিষ্টি কথায় গলে পানি হয়ে যায়। সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। বড্ড ভালোওবাসেন তিনি। পৃথিবীতে সে একজন খারাপ মানুষ হতে পারেন। কিন্তু খারাপ বাবা বলা যায় না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মেহতিশাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। তবে, জোর দিয়ে হলেও সেখান থেকে বের করে আনবেন। বোকা মেয়েটা হয়তো নিজেও বুঝতে পারছেনা, কী ভয়ঙ্কর ফাঁদেই না সে পা দিয়েছে। পুরো দাবা খালায় সামন্য একটা গুটি মাত্র মেহতিশা।

চোখ দুটো টলটল দীঘির জলের মতো উপচে এলো মেহতিশার। নাক ফুলিয়ে কান্না দমালো সে। বিয়ের কদিন আগ থেকে এ পর্যন্ত কী কর্কশ আচরণই না করছেন তিনি। অথচ, ছোট বেলায় একটা ফুলের টোকাও গায়ে লাগতে দেননি তিনি। পদে পদে বুঝিয়ে দিচ্ছেন,পর কখনো আপন হয়না। মেহতিশা তবুও চুপ থাকে। তবে রাগ দমাতে পারেনা। দর্পণকে সে সেই প্রথম দিন থেকেই প্রচন্ড ধমকা ধামকির উপর রেখেছে। পায়ে পায়ে দোষ ধরেছে। সন্দেহ নিয়ে কথা শুনিয়েছে অযথাই। কিন্তু সত্যি হলো, এ পর্যন্ত কোনো সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায়নি। তাহলে শুধু শুধু কেনো সে দর্পণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে? এর তো কোনো মানেই হয়না। নিজের মনকেই সবশেষে প্রশ্রয় দেয় মেহতিশা। এখন মনে মনে দর্পণকে আগের মতো সন্দেহ চোখে দেখেনা। বিশ্বাস যেনো অন্তঃকরণে ঠাই পেয়েছে পাকাপোক্ত ভাবে। সে বিশ্বাস নিজ হাতে সযত্নে রোপণ করেছে দর্পণ। সেখানে হাজার হাজার সন্দেহজনক তীরও ঠুনকো মেহতিশার কাছে। এতোটা বিশ্বাস কীভাবে নিজের প্রতি তৈরি করেছে দর্পণ কে জানে! এখন মেহতিশার মনে হয় সে প্রেমে পড়েছে। দর্পণ নামক মিষ্টি হাসির মানুষটার দিকে তাকালে এখন আর কোনো বিরক্তি কাজ করেনা। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকতে প্রাণভরে ভালোবাসতে।

কিন্তু, বাবার কারণে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অক্ষম হয় সে। মেহতিশা মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ঠিক করেছে।
সে ততোদিন পর্যন্ত দর্পণকে মনের কথা বলবে না, যতদিন না দর্পণকে সে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারে। মেহতিশা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, দর্পণ কখনোই এতোটা হিংস্র হতে পারেনা। আচ্ছা, যে মানুষটা হুইলচেয়ার ছাড়া উঠতেও পারেনা সে কীভাবে এতো বড় কাজ করবে!আজ রাতই সে তল্লাশি করবে। তারপর বাবার সামনে হাসিমুখে বলবে, “বাবা, আমি বলেছিলাম না, দর্পণ খুব ভালো একজন মানুষ। সে কখনোই এমন করতে পারেনা। ” ভেবে আলতো হাসে সে।

আঁচলে টান লাগতেই পেছনে ফেরে। দর্পণের স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখটা চোখে পড়ে। মেহতিশা হাসি লুকিয়ে বলে,

‘চুল মোছেননি কেনো? ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

‘আপনি মুছে দিন। ‘

মেহতিশা লজ্জা পায়। দ্বিধা কাটিয়ে সাইড থেকে টাওয়াল উঠিয়ে নেয়। ঝুঁকে টাওয়ালটা নিয়ে মুছে দিতে থাকে। দর্পণের মুগ্ধ দৃষ্টি জোড়া তখন মেহতিশার দিকে আবদ্ধ। মেহতিশা মনোযোগ দিয়ে যত্ন করে চুল মুছে দিচ্ছে। দর্পণ আচানক মেহতিশার কোমর টেনে কোলে বসিয়ে নিলো। মেহতিশা ধরফর করে উঠতে নিলেই দর্পণ, মেহতিশার হাত দুটো চেপে ধরে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাকায়। মেহতিশা দৃষ্টি নত করে রাখে।
অস্বস্তিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে দর্পণ। দুষ্ট ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে দেয় মেহতিশার কোমল গালে। ক্ষণকাল কেটে যায়। মেহতিশা একটু স্বাভাবিক হয়ে একটা প্রশ্ন করে,

‘আপনি প্যারালাইজড কবে থেকে দর্পণ?’

দর্পণের চোয়াল শক্ত হয়। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দুই বছর ছয় মাস থেকে। ‘

মেহতিশার কলিজায় কামড় লাগে। ঠিক দুই বছর ছয় মাস আগেই তো মেঝো চাচার মৃত্যু হয়েছিলো!

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৫.

ভাতের শেষ লোকমাটা নিশিতার মুখে তুলে দিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। নিশিতা বাচ্চাদের মতো পানিটুকু পান করে বলে,

‘তুমি খুব ভালো, আর অনেক সুন্দরও। ‘

মেহতিশা কথা শুনে মৃদু হাসে। এ বাড়িতে আসার পর নিশিতা মেয়েটাকে ওর অস্বাভাবিক মনে হতো। প্রথম প্রথম এই ঘরের আশেপাশে আসতেও লাগতো প্রচুর ভয়। যতসম্ভব দূরেই থাকতো সে। তবে, কাল থেকে মেহতিশার বারবার মনে হচ্ছিল যদি কোনোভাবে নিশিতার সঙ্গে একটু কথা বলা যায় তাহলে হয়তো কিঞ্চিৎ পরিমাণ রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হবে৷ তারপরই সকালে একবার এই ঘরে এসেছিলো। ওকে দেখে নিশিতা তেড়েফুঁড়ে এসেছিলো মারতে। যেই মেহতিশা হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিলো অমনি নিশিত হেঁসে উঠলো। চকলেটের প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করলো। মেহতিশার মায়া লাগলো দেখে।
মেয়েটাকে দেখে ক্ষুধার্ত লাগছে। হয়তো কিছু খেতে দেয়া হয়নি তাকে। মেহতিশা খেয়াল করেছে লালিমা নিশিতাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। যেনো বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে আঁটকে রাখছে। বাঁচল কী মরলো কিছুই যায় আসে না। মেহতিশা রান্না ঘরে ঢুকে একটা প্লেটে ভাত, সবজি, আর মাছ নিয়ে আসে। মেখে খানিকটা নিশিতার মুখের সামনে ধরতেই নিশিতা গপগপ করে খেয়ে নেয়। এক বসায় সম্পূর্ণ ভাতটাই খায় নিশিতা। মেহতিশা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে নিশিতার পাশে বসে। নিশিতা আপনমনে পড়নের শাড়ির আঁচল টেনে খেলা করছে। মেহতিশা হাসিমুখে বলে,

‘আপু, আপনি অসুস্থ কতদিন ধরে? ‘

নিশিতা মুখটা অবুঝের মতো করে বলল,

‘আমি অসুস্থ না তো!

মেহতিশা মনে মনে নিজেকেই বকে। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কী কখনো নিজেকে অসুস্থ স্বীকার করে! সে কিনা বোকার মতো জিজ্ঞেস করছে।
মেহতিশার হাত ঝাকিয়ে নিশিতা ঠোঁট উল্টে বলে,

‘শোনো শোনো, আমি অসুস্থ না তো। আমি রাগ করেছি। ‘

মেহতিশা মাথা নাড়িয়ে তাল মেলায়। যেনো কোনো ছোট বাচ্চাকে প্রসন্ন করার প্রয়াস। নিশিতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘বুঝেছো, আমি রাগ করেছি অনেক রাগ। তাই তো বারবার রেগে যাচ্ছি। ‘

‘আচ্ছা! ‘

‘হ্যা..তাইতো। ‘

‘কিন্তু, কীসের জন্য এতো রেগে আছো আপু?’

নিশিতা চুপ করে থাকে ৷ হাতটা কয়েকবার মোচড়ামুচড়ি করে টলটলে চোখে তাকায়। মেহতিশা ভড়কে গেলো। সে নিশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘কী হলো আপু?তুমি কাঁদছো কেনো?’

‘আমি তো রোজ কাঁদি, আরও কাঁদবো! খুব খুব কাঁদবো!’

‘কেনো কাঁদবে! ‘

নিশিতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে দাঁড়ায়। ছন্নছাড়া পায়ে বালিশের নিচ থেকে ফটো ফ্রেমটা বের করে। মেহতিশা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। নিশিতা ছবিটা এনে মেহতিশার সামনে ধরে। মেহতিশা ছবিটায় দৃষ্টিপাত করে। ছবিতে সুদর্শন যুবকটিকে দেখে বুঝতে পারে এটা বুঝি দর্পণের বড় ভাই অর্পণ। যে কিনা নিশিতার স্বামী। পাশ দিয়ে কম বয়সী একটা মায়াবী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চমকায় মেহতিশা। ছবিটায় নিশিতাও আছে। কী অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে একসাথে! অথচ এখন নিশিতার দিকে তাকালে একসমুদ্র বিষাদ ঝলমল করে ওঠে। চোখের নিচটায় কালসিটে আস্তরণ। মুখটা শুকনো৷ দুই একটা ব্রণ। ছবিতে যেখানে কোমড় জড়িয়ে আছে দীর্ঘ কেশরাশি। সেখানে এখন কাঁধটাও পাড় করছে বহু টেনেটুনে। কী উষ্কখুষ্ক লাগছে। বহুদিন অবহেলার ছাপ শরীরে। অথচ, ঘরটা! কোনো এক সময় হয়তো একটা স্বপ্নপুরী ছিলো। দুজন ভালোবাসার মানুষের হাতে বোনা স্বপ্ন গুলো এখনো দেয়াল জুড়ে আছে। হাতে বানানো কালারিং প্রজাপতি, কাগজের নকশা,রোমাঞ্চকর ওয়াল পেইন্টিং সহ আরও অনেক কিছু। বারান্দার দিকে তাকালেও বোঝা যাবে সেখানেও অসংখ্য অমলিন স্মৃতিরা ঘুরে বেরায়।

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিশিতা তখন ছবিটার দিকে তাকিয়ে অশ্রুপাত করছে। মেহতিশা কিছু বলার আগেই নিশিতা বললো,

‘তুমিই বলো, সবাই বলে ও আর নাকি আসবে না। কিন্তু ও আমার হাত ছুঁয়ে বলেছে ও আসবে। আমাকে কখনো ছাড়বেনা। ‘

মেহতিশা একবার বলে উঠছিলো, তুমি এতো ভালোবাসো যাকে সে আবার আসবে, তাঁকে তো তোমার টানে আসতেই হবে! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো মৃতরা কখনো ফিরেনা। মিথ্যা আশ্বাস কীভাবে দেবে সে! মেহতিশা মলিন মুখে বলে,

‘সে আর আসবেনা আপু, আপনি অপেক্ষা করা ছেড়ে দিন৷ ‘

নিশিতা ফুঁসে ওঠে। মেহতিশার দিকে চিৎকার দিয়ে বলে,

‘বেরিয়ে যাও তুমি! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও! আর কখনো আমার সামনে আসবেনা। তুমিও খারাপ! সবাই খারাপ। ‘

মেহতিশা চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিশিতা দৌড়ে খট করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। দরজার পাশেই ধপ করে ছবিটা নিয়ে বুকে চেপে বসে।
সে পাগল হলেও ভালোবাসা বোঝে। সে সব বোঝে। শুধু প্রিয় মানুষের মৃত্যুই বুঝতে পারেনা। নাকি বুঝেও মানতে চায়না, কে জানে! নিশিতা আকাশের কালো মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে নির্নিমেষ অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,

‘আমি তোমার অপেক্ষা করবো প্রিয়, শেষ নিঃশ্বাস অব্দি অপেক্ষা করবো। তুমি এসো, তোমার না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। ‘

আকাশে তখন অবাধ্য মেঘের গর্জন। রাতের আকাশে থমকে থমকে গর্জে উঠছে। একে নাকি বলা হয় শীত নামানো বৃষ্টি।
তীব্র বৃষ্টির ছিটা এসে ঢুকে যাচ্ছে ঘরের জানালা ভেদ করে। অকর্মণ্যতায় ঝিমাচ্ছে মেহতিশা। নিশিতার কাছ থেকে আসার পর মন খারাপ করে কতক্ষণ এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করলো। সকাল থেকেই আজ রিনিঝিনি বৃষ্টি। দর্পণ অফিসের ফাইলপত্র ঘাঁটছে।
মেহতিশা সেদিকে খানিকক্ষণ তাকায়। মিনমিন করে বলে,

‘শুনছেন?’

‘……..’

‘এই শুনুন না!’

দর্পণ হাতের কলমটা সাইডে রেখে তাকায়। মেহতিশা দেখে দর্পণের চোখে কালো ফ্রেমের চশমাটা বড্ড মানিয়েছে। লোকটাকে সব কিছুতেই মানায়। এই যে এতক্ষণ গম্ভীর চোখমুখে ফাইলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কীসব ভাবছিলো তখন তাকে মেহতিশার তুর্কী নায়ক বুরাক ডেনিযের মতো লাগছিলো। এখন আবার যেই মুখটা গম্ভীর থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তৎক্ষনাৎ চোখমুখ ফিরে পেলো তার আসল সত্ত্বা। লোকটা সম্পূর্ণটাই রহস্যে ভরপুর। যাই হোক, মেহতিশা ভালোবাসে এখন এই লোকটাকে। আত্মা দিয়ে ভালোবাসে। এক পৃথিবী সমান ভালোবাসে। সরল স্বীকারোক্তি মনে মনে। বাহিরটা নিরুত্তাপ। মেহতিশাকে অন্য রকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে, দর্পণ কপালে ভাজ এনে বলল,

‘কী বউজান?তাকিয়ে থাকার জন্যই কী ডাকলেন?’

মেহতিশা ভড়কায়। তবে লজ্জা পায়না। কারণ ততোদিনে তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা কতখানি এগিয়েছে তা বলার বাকি রাখেনা। মেহতিশা সোফা থেকে উঠে এলো। দর্পণ খাটের পাশটায় আধশোয়া হয়েছিলো। তাকে চমকে দিয়ে মেহতিশা দর্পণের হাত থেকে ল্যাপটপ সহ বাকি কাগজপত্র সরিয়ে জগাখিচুরি বানিয়ে সেসবের জায়গা দখল করে আদুরে ভঙ্গিতে বসে দর্পণের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অশান্ত মনের শান্তি প্রয়োজন। দর্পণ হাসলো। কিছু বললো না। মেহতিশা চোখ বুজে শুয়ে রইলো। বাহির থেকে বৃষ্টির ছিটা এসে গায়ে লাগছে। ঘরের বাতিগুলো সব নিভানো। বাহিরের থেকে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ ঘরকে স্বর্গের ন্যায় অনুভূত করাচ্ছে। দর্পণের মধ্যেকার সুপ্ত পুরুষ সত্ত্বা তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। অতি নিকটে শায়িত সুদর্শনা নারীটি তাকে পোড়াচ্ছে।
রমনীটির পিঠ এলিয়ে থাকা রেশমী চুলগুলো আছড়ে আছে খাটে। বুকের উপর থেকে শাড়ি অনেকটাই সরে আছে। দৃশ্যমান হয়েছে ফর্সা কাঁধ, গলা। হাঁটুর কাছাকাছিতে এসে গেছে শাড়ির নিম্নাংশ। ফর্সা গোলাপি পা যুগল বেরিয়ে আছে। দর্পণ অভিমানী সুরে বলে,

‘বউজান, আমার হিংসে হচ্ছে। ‘

মেহতিশা চোখ খুলে বলে,

‘কাকে হিংসে হচ্ছে?’

‘বৃষ্টিকে। ‘

‘মানে?’

মেহতিশা ভ্রু কুচকে থাকে। দর্পণ মেহতিশার কপালে অঁধর ছোঁয়ায়। আদুরে কন্ঠে বলে,

‘এই যে, দেখুন বৃষ্টিগুলো আপনাকে কীভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে! আমার রাগ হচ্ছে বউজান। ভীষণ রাগ হচ্ছে। বৃষ্টিরা খুব দুষ্ট। ওরা যাচ্ছে না কেনো! ‘

দর্পণের বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেঁসে ফেলে মেহতিশা। আলতো হাতে ধাক্কা বসিয়ে দেয় দর্পণের কাঁধে। দর্পণের মোহাচ্ছন্নতা কাটে না। সে এগিয়ে আসে মেহতিশার মুখ বরাবর। দর্পণের উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাস এসে তার মুখ স্পর্শ করতেই শিউরে ওঠে মেহতিশা। দর্পণের অবাধ্য ঠোঁট মেহতিশার সারা মুখ, গলদেশ ছুঁয়ে দেয়। নাক ঘষে মেহতিশা কাঁধে। মেহতিশা খেয়াল করে এতো ঠান্ডা পরিবেশ থাকার পরও সে ঘামছে। দরদর করে ঘামছে। দর্পণকে সরিয়ে সে উঠে যেতে চাইলো। দর্পণ মুচকি হেসে তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলো। ঘোর লাগানো গলায় বলল,

‘বৃষ্টির মতো আমিও আপনাকে ছুঁয়ে দিতে চাই। ‘

মেহতিশা উপেক্ষা করে চলে যেতে পারেনা। সে নেশাগ্রস্তের মতো কাছে চলে আসে। কেঁপে কেঁপে সে দর্পণের পড়নের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে। দর্পণের পুরুষালি হাতজোড়া পেচিয়ে রাখে মেহতিশার সর্বাঙ্গ। মেহতিশাও মত্ত হয়ে পড়ে মুহুর্তেই। অথচ,এমনটা করার অনুমতি তার নেই। তাকে ধরে বেঁধে দেয়া হয়েছে কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সে নিষেধাজ্ঞা ভাঙলেই ধেয়ে আসবে ঘোর বিপদ। তবুও, মেহতিশা ভুলে বসে সব কিছু। যদিও অনেকটা সময় পর মেহতিশার কানে বাজে বাবার কথাগুলো, দর্পণকে ভুলেও নিজের কাছে আসতে দেয়া যাবে না। ভালোবাসাও যাবেনা। করা যাবে না কোনো স্বীগারোক্তি। বাঁধ ভেঙে ফেলে মেহতিশা। হার মানে ভালোবাসার মানুষের কাছে। এমনকি একসময় আওড়েও ফেলে,

‘ভালোবাসি দর্পণ সাহেব। আপনার আরশীজালে আমি বাজে ভাবে ফেঁসে গেছি। ‘

কেটে যেতে থাকে একটা অন্যরকম রাত্রি। দর্পণের ঘুমন্ত মুখমণ্ডল তখন মেহতিশার গলায় মুখ গুঁজে রাখা। সে যেনো কতকাল নিদ্রাহীন থেকেছে। মেহতিশা তখন আধোঘুম আধোজাগ্রত। সময়টা তখন মাঝরাত। কোথায় যেন গান বাজছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মনমোহিনী বিষাদমাখা সুর,

তারে আমি দূর হতে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব।
তারে আমি দূর হতে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব…

চলবে-
লেখিকা -নাঈমা হোসেন রোদসী।