প্রিয় দিও বিরহ পর্ব-১৯+২০+২১

0
445

“প্রিয় দিও বিরহ”

১৯.

নিশিতা তখন গভীর নিদ্রায় বিভোর। মুখে মুচকি হাসি বিদ্যমান৷ স্বপ্নে মগ্ন সে। কীসের একটা সুবাস নাকে এসে লাগছে। নিশিতা ঘুমিয়ে স্মৃতির পাতায় বিচরণ করছে। গোলপাতা গুলো দুলে দুলে উঠছে বাতাসের তোড়ে। কী অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা!নিশিতা পরিবেশটা দেখে মনে মনে ভাবে এই জায়গাতে ওর বেবি হওয়ার পর অর্পণ আর সে আবারও আসবে। এসব ভেবেই পাশের সিটের অর্পণের হাতটা আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,

‘এই অপু! এই! ‘

অর্পণ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে তাকালো। দুই গালের মাঝে গর্ত ভেসে উঠলো। গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,

‘বলো নিশি। ‘

নিশিতা বড়ই আহ্লাদী সুরে বললো,

‘ওগো, আমার ইচ্ছে করছে কী জানো? আমি এই অসাধারণ মনমোহিনী রাস্তাটাতেই আজীবন থেকে যাই। ‘

অপূর্ব বললো,

‘তা তো যাবে না। তুমি এখানে থেকে গেলে তোমার এই হ্যান্ডসাম বরটাকে তো অন্য মেয়ে নিয়ে চলে যাবে! ‘

নিশিতা অপূর্বের কাঁধে কিল বসালো। মুখ ফুলিয়ে বললো,

‘রাখো তোমার রসিকতা। ভালো লাগে না সবসময়। ‘

‘উঁহু! রাগ করে না। সোনাবউ আমার! আমি তোমাকে এখানেই একটা বাড়ি বানিয়ে দেবো। দশটা দাসী থাকবে, তিনটা বাগান থাকবে, একটা ইচ্ছে জ্বিন থাকবে। সে সকাল বিকাল তোমার হুকুম পালন করবে। হবে না?

কথায় ফিক করে হেঁসে দিলো নিশিতা। দুই বছরের প্রেম,আড়াই বছরের সংসার। এই পুরোটা সময় জুড়েই কত মিষ্টি মুহুর্ত পাড় করেছে দুজনে। প্রেমের শুরুর দিকে তখন খুব একটা ভালো লাগতো না এই কৃষ্ণ বর্ণের ছেলেটাকে। অর্পণ হয়েছে তার মায়ের মতো দেখতে। কিছুটা কালো রঙের। কিন্তু কথায় আছে, গায়ের রং কখনো কারো মনকে বিচার করার ক্ষমতা রাখেনা। দিন যতই গেলো, নিশিতা ততই এই রসিক, হাসিখুশি মানুষটাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। একজন মানুষ কতটা শান্ত, হাস্যরসিক হতে পারে তা অর্পণকে না দেখলে বোঝা যাবেনা। দীর্ঘ একটা সময় পর এই ছেলেটাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা অনেক নির্মম হয়ে উঠছিলো। তখন পরিবারের সম্মতিতে চারহাত এক হয়। তবে, লালিমা শেখের খানিকটা আপত্তি ছিলো। কারণ তিনি চেয়েছিলেন আরও উচ্চ বংশীয় মেয়ে বিয়ে করাতে। কিন্তু তার পথের বাঁধা হয়েছিলো এই নিশিতা। আগুন সুন্দরীও তো না! সুন্দর বলা যায় তবে আহামরি নয়। তাই সব দিক মিলিয়ে তিনি মত দিচ্ছিলেন না এই বিয়েতে। তবুও,অর্পণ তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে। নিশিতার হাত সেই যে ধরেছিলো শেষ নিশ্বাস অব্দি ধরে রাখার পণ করেছিলো।

নিশিতা হাসিমুখে অর্পণের কাঁধে মাথা রাখে। তার গর্ভে স্বপ্নশিশু তাদের। পাশে ভালোবাসার মানুষ। কী নেই তাদের? সুখ, শান্তি সবই আছে। পৃথিবীটা আসলেই বড় সুন্দর। কিন্তু নিশিতা কী তখন জানতো,এই সুখটা মরিচীকা মাত্র। কয়দিনের স্মৃতি হয়ে যা আজীবন রয়ে যাবে। ড্রাইভিং সিটে বসে তখন দু’জনে নানা স্বপ্ন বুনছে। নিশিতা তখন ধীরে ধীরে ঘুমে ঢলে পড়ছে। কানে ভেসে আসছে অর্পণের গাওয়া সুরমেশালো গান,

এই পথ যদি না শেষ হয় তবে
কেমন হতো তুমি বলোতো?

দীর্ঘ পাঁচটি মাসে নানা উথাল-পাতাল ঢেউ সংসারে উঠানামা করেছে। কখনো রাগ, অভিমান। কখনোবা দুষ্ট মিষ্টি মুহুর্ত। সবটা মিলিয়ে ভালোই কাটছে দিনকাল৷ সুন্দর সুখের দিন নাকি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। মেহতিশা নিজেকে এখন অবশ্য খুব সুখীই মনে করছে। তবে ভয়ও হয়, বলা তো যায়না কার নজর লাগে এই সুখে। দুঃখ না জানি এসে দাঁড়ায় এই সুখনীড়ে।
ঘুমটা আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। মাঝে মাঝে আবার মাঝরাতে ঘুম হয়না৷ তাই মেহতিশা করিডোরে হাঁটাহাঁটি করে। কখনো ক্যানভাসে এলোমেলো রঙ দিয়ে ছবি আঁকে। চিপসের প্যাকেটটা নিয়ে এসে খচরখচর করতে করতে দর্পণের পাশে বসলো। দর্পণ ল্যাপটপে কাজ করতে করতে একবার আঁড়চোখে তাকালো। রাত অনেক হলেও দু’জনেই জাগনা। দর্পণ অনেক বার ধমকি-ধামকি দিলেও মেহতিশাকে কোনোভাবেই ঘুম পাড়াতে পারেনি। তাই দর্পণও চুপ করে আছে। সেও কোনো কথা বলেনি। মেহতিশা ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করছে যেনো দর্পণ কিছু বলে।

খালি চিপসের প্যাকেটটা ল্যাপটপের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ফিক করে হেঁসে উঠলো মেহতিশা। দর্পণ প্যাকেটটা সরিয়ে দিয়ে প্যাকেটটা ফেলে মুখ বুঁজেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। মেহতিশার এবার রাগ লাগে। সে কাঁথা ধরে ইচ্ছেমতো টানাটানি করছে। দর্পণ এবার বললো,

‘ছেড়ে দিন, ব্যাথা পাবেন। ‘

‘না না না, ছাড়বো না। ‘

দর্পণ এবার মেহতিশার টেনে নিজের উপরে নিয়ে আসলো। গালের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,

‘এমন করছেন কেনো?’

মেহতিশা মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘আপনি কথা বলেন না কেনো?’

‘তাহলে আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেনো?’

‘ঘুম আসে না তো, আমি চেষ্টা করি। ‘

‘কচু করেন। দুই মিনিট শুয়ে এদিক ওদিক করেই উঠে গিয়ে চিপস নিয়ে বসলেন। একটু আগে চকলেট খেলেন। ‘

‘আমি খাইনি তো! ‘

‘কে খেয়েছে তাহলে?’

‘আপনার ছেলে৷ ‘

‘হু, এখন সব দোষ নন্দ ঘোষ। ‘

‘হুম, সব দোষ দর্পণ সাহেবের ছেলের। ‘

বলে নিজেই হাসিতে ফেটে পড়লো মেহতিশা। দর্পণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখলো। একসময় গভীর ঘুমে ঢলে গেলো মেহতিশা। দর্পণ একটু ভালো করে পরখ করে মেহতিশাকে শুইয়ে দিলো। পড়নের শার্টটা ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সারাদিনে মাত্র একবার দাঁড়ানো হয়েছে। তাই পা দুটো ঝিমঝিম করছে। আর কয়টা মাস ভালো করে গেলেই হলো। তারপর আর এই লুকোচুরির প্রয়োজন হবেনা। ভেবে ঠোঁট এলিয়ে হাসে দর্পণ। খেলাটা মজার আবার একটু রিস্কিও। এখন কিছুতেই ধরা দেয়া যাবেনা। হিতে বিপরীত হতে পারে। একবার এলোমেলো চুলে ঘুমিয়ে থাকা মেহতিশার দিকে তাকালো। মোবাইলটা নিয়ে পকেটে ঢুকালো। কাউকে একটা মেসেজ করে শিটি বাজাতে বাজাতে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলো।

দর্পণের দরজা আটকানো মাত্রই চোখ খুলে উঠে বসলো মেহতিশা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে দুই মিনিট থম মেরে বসে থাকলো। তারপর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো।
কতক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। কী সুন্দর নাটক করে যাচ্ছিলো এই মানুষটা!

আর একেই নাকি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলো সে। হাহাকার জাগছে বুকে। কয়েক দিন ধরেই ঘুম ভেঙে মাঝরাতে ওকে যখন বিছানায় পায়না মেহতিশা তখন একটু অদ্ভুত লাগছিলো। কারণ, দর্পণ তো আর একা চলাচল করতে পারে না। হুইলচেয়ারটাও তো বিছানার পাশেই পড়ে আছে। তাহলে দর্পণ কীভাবে বাহিরে যায়!মেহতিশা বুঝতে পারলো প্রতিটা রাতই দর্পণ ঘর ছেড়ে মাঝরাতে বেরিয়ে যায়৷ মেহতিশা দরজা বন্ধ দেখে চোখ মুছে নেয়। এই বিশ্বাসঘাতককে ভালোবাসাটা ওর পাপ ছিলো। বিরাট অপরাধ। ওর উচিত ছিলো বাবার কথা মতো ছয় মাস পর কাগজপত্র তল্লাশি করে বেরিয়ে যাওয়া। এসব ভেবে ক্রুদ্ধ মনে আলমারি খুলে দর্পণের গোপন লকারটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলো। যে লকারটায় কখনো আড়দৃষ্টিতে তাকিয়েও সে দেখেনি, আজ সেটাই হাতাচ্ছে। সময় সত্যিই পাল্টায়। একসময় আকাঙ্ক্ষিত কাগজটি পেয়েও গেলো। কাগজটার দিকে তাকিয়ে ভেজাচোখেও হাসলো।

এমন সময় হঠাৎ করেই দর্পণ ঘরে এসে গেলো। গেটের চাবিটা নিতে ভুলে গিয়েছিলো সে। মেহতিশাকে আলমারি খুলে নাড়াচাড়া করতে দেখে চমকে উঠলো।
দরজাটা লক করে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে সামনে আসলো। প্রথমবার দর্পণের ক্রোধ ভরা চোহারাটা দেখে মেহতিশার ভয় লাগলো। তবুও, সাহস সঞ্চয় করে বললো,

‘দর্পণ শেখ, ভালো মানুষীর মুখোশটা তাহলে খুলেই গেলো। ‘

দর্পণ মুচকি হাসলো৷ দেয়ালের এক পাশে হেলান দিয়ে হাত বুকের উপর ভাজ করে বললো,

‘জেনেই গেলেন তাহলে বউজান৷ ‘

পরমুহূর্তেই মেহতিশার গলাটা চেপে ধরে হিসিয়ে উঠলো,

‘জেনেছেন ভালো কথা, কিন্তু ভুলেও মুখটা খুলবেন না। পরিণাম একটুও ভালো হবে না। ‘

চলবে-

“প্রিয় দিও বিরহ”

২০.

আকস্মিকতায় হতভম্ব মেহতিশা। যে দর্পণ এতো দিনের সংসারে একবার কড়া চোখেও তাকায়নি। সে কিনা আজ গলা চেপে ধরেছে। ব্যাথার চেয়েও বেশি বুকে কষ্ট হচ্ছে। যার চোখে এতোগুলা দিন ভালোবাসার অথৈজল দেখতে পেয়ে অভ্যস্ত আজ সে চোখদুটো বড়ই অচেনা। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ চোখ ভারি হয়ে গেছে। মস্তিষ্কশূন্য পুরোপুরি।
দর্পণ কী করে পারলো এতো বড় নাটক করতে! মেহতিশা উন্মাদের মতো দর্পণের বুকে ঝাপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘এসব মিথ্যা তাই না?আপনি মজা করছেন আমার সঙ্গে! নাহলে এইসব স্বপ্ন! হ্যা হ্যা সব স্বপ্ন! ‘

দর্পণের ভেতর কী ভাবানুভূতি হলো বোঝা যাচ্ছে না। সে মেহতিশার মাথাটা টেনে শক্ত করে বুক থেকে সরালো। ধারালো ফলার বর্শা ছুড়ে বললো,

‘মিথ্যা নয় মেহতিশা। এসব সত্য। আপনাকে তো মানতে হবে। ‘

তারপর ছেড়ে দিয়ে বিছানায় রাজার মতো বসে পায়ের উপর পা তুলে হেসে বললো,

‘আফটার অল, আপনি শামীউল্লাহ জামানের কন্যা। নাটক করা তো আপনাদের কাজ। ‘

মেহতিশা ক্ষণকাল অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললো,

‘আমি কোনো নাটক করিনি। ‘

‘সত্যিই কোনো নাটক করেননি! ‘

মেহতিশা মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে পড়লো, বললো,

‘হ্যা, বাবা আমাকে বাধ্য করেছিলো আমি যেনো আপনাকে নাটক করে কাগজ গুলো হাতিয়ে নেই। আমার প্রচুর রাগ ছিলো আপনার উপর। আপনাকে তখন একটুও সহ্য হচ্ছিল না। আমার অমতে এমন কেনো বিয়ে দিলো? কেনো? কেনো? আমার মাথায় এসব বারবার আঘাত করতো৷ আমি রাজি না থেকেও রাজি ছিলাম। ধীরে ধীরে আমি নাটক করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার সাদাকালো জীবনে একফালি সবুজ সিগন্যালের মতো আপনি আসলেন। কারো একজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আমি নিঃশব্দে কাটিয়ে দিতে পারি,কারো অপেক্ষায় রাত জেগে চোখর নিচে ডার্ক সার্কেল বানাতে পারি, কাউকে সবটা দিয়ে ভালোওবাসতে পারি। এসব কোনো নাটকের স্ক্রিপ্ট না। আপনাকে ভালোবাসা এখন আর কোনো নাটক সিনেমা নয়। আপনাকে ভালোবাসাটা এখন আমার প্রাণবায়ু। ‘

দর্পণের চোখ দু’টোতে তাচ্ছিল্য। তা দেখে বুকে মুচড়ে ধরে কষ্ট গুলো মেহতিশার। তবে কী দর্পণ তাকে কখনো ভালোইবাসেনি! তার সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। মেহতিশা ধপাধপ পা ফেলে দর্পণের সামনে আসলো। তারপর শক্তি দিয়ে দর্পণের কলার টেনে ধরলো। চিৎকার করে বললো,

‘এমনটা আপনি কী করে করতে পারেন! আপনার সাহস কী করে হয়! এবার আপনি দেখবেন এই মেহতিশা কী। ‘

দর্পণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘কী করবেন আপনি? ‘

মেহতিশা উন্মাদের মতো দর্পণের থেকে দুই কদম পিছিয়ে গেলো। টলমল চোখে হাসলো। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আপনার মতো বেইমানের সন্তানকে আমি আমার গর্ভে জায়গা দেবো কেনো দর্পণ শেখ? ‘

দর্পণ চমকে উঠলো। সে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়ায়। মেহতিশা বাহুদ্বয় শক্তি দিয়ে চেপে ধরে। মেহতিশা ভাবাবেগশূণ্য। দর্পণ ক্রুদ্ধ নয়নে বলে,

‘এরকম কিছু করার চিন্তা ভাবনা বাদ দিন মেহতিশা।
খবরদার! আমার বাচ্চার সাথে যদি কিছু করার চেষ্টাও করেন, কসম আমি আপনার বংশকে নির্বংশ করে দেবো। ‘

মেহতিশা হাসে। যেন তার কিছু আসে যায় না। দর্পণ কী করতে পারে সে দেখতে চায়। দর্পণ রাগে কাপে থরথর করে। লম্বা শ্বাসে সে তা নিয়ন্ত্রণ করে আনে।
আগের মতো নিষ্পাপ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,

‘অনেক হয়েছে। আপনি এখন ঘুমাবেন। আর একটা কথাও বলবেন না। যা জেনেছেন ভালো হয়েছে। কালকে আমার সঙ্গে হ্যা-তে হ্যা বলবেন। ‘

মেহতিশা শক্ত হয়ে থাকে। সে ঘুমাবেনা। তার প্রশ্নের জবাব চাই। চোখ বন্ধ করে বললো,

‘আমি আমার প্রশ্নের জবাব চাই৷ ‘

‘কীসের জবাব? ‘

‘আপনি এমন কেনো করলেন? আপনি কী সত্যি মেঝোচাচাকে খুন করেছিলেন? ‘

দর্পণ হাসলো। মেহতিশাকে জোর করে চেপে বিছানায় শোয়ালো। মেহতিশা পণ করেছে কিছুতেই শোবেনা।
দর্পণ বললো,

‘আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। ‘

মেহতিশা মুখ পাশ ফিরিয়ে নেয়। সবটা হজম করতে হিমশিম খাচ্ছে সে৷ কীভাবে কেউ এতো ভালো নাটক করে! দর্পণ রোজকার মতোই তাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজ নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করতেই জল হয়ে বের হয়ে গেলো বুকের নোনাব্যাথা। চোখে ঘুম আসার পর অনুভব হলো তার ঘাড়েও উষ্ণ জলের কণা গড়িয়ে পড়লো বুঝি।

লালিমা শেখ খুশিতে কেঁদে যাচ্ছেন। দিয়াও খুশিতে চোখ মুছলো। কতগুলো দিন পর নিজের ভাইটাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখছে সে। দর্পণের বাবাও হাসছেন। অর্পণ যবে থেকে নেই তখন থেকে খুব একটা কথা বলেননা তিনি। চুপচাপই থাকেন। আজ তিনিও ছুটলেন গরীব মিসকিনদের খাওয়াতে। মিষ্টি খাওয়াবেন সাত পাড়ায়। সামনেই দর্পণ মুচকি হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সাজানো নকল ডাক্তারটা বড়ই পেশাদার ভঙ্গিতে ডাক্তারি সুটকেস আটকাচ্ছে। মেহতিশা বড়ই অবাক হয় এই অভিনেতাদের দেখে। মেহতিশা মনে মনে ভাবলো, এরা তো নোবেল পাওয়ার অধিকার রাখে! এতো নিখুঁত অভিনয় কী করে করলো!

সদ্য ঘুম থেকে উঠেই মেহতিশা দেখলো তাকে আদুরে কন্ঠে ডাকছে দর্পণ৷ পাশে মা বাবা আর দিয়া দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে। মেহতিশা বোকার মতো চেয়ে রইলো।
কী হচ্ছে বুঝতে পারছেনা। তারপর দেখলো দর্পণ তাকে চোখ গরম করে ইশারা করছে, যেনো সেও সমানতালে নাটক করে। নাহলে, ফলাফল ভালো হবেনা। সেও হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘আরে,আপনার পা ঠিক হয়ে গেছে! ‘

‘হ্যা বউজান, দেখুন আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি। সকাল বেলা উঠে দেখি পা নাড়াচাড়া করতে পারছি। সব আপনার সেবা যত্নের ফলে। ‘

মেহতিশা মুখ খিঁচে রাখলো। মা বাবাকেও কত বড় ধোঁকায় রাখছে লোকটা! অসভ্য লোক ৷ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ডক্টররা চলে গেলো। বলা বাহুল্য, এই
লোকগুলোকে দর্পণই ভাড়া করে এনেছে। ভালোই নাটক জানে সবগুলো।

অনেক দিন পর সবার সামনে হেঁটে বাইরে আসতে পারলো দর্পণ। নিজেকে অনেক দিন পর মুক্ত লাগছে তার। অফিসে ঢোকার কারণে এতোদিন পর সবাই চমকে উঠলো। কেউ এতো তাড়াতাড়ি তাকে আশা করেনি। সেই আগেরকার মতো সবাই মাথা নিচু করে সালাম জানালো তাকে৷ দর্পণ মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। সবার আগে অর্পণের কেবিনটায় গেলো। সেখানের জিনিসপত্রে ধুলো পড়েছে। দুটো ফটোফ্রেম রাখা। একটাতে অর্পণের সেলফি। আর আরেকটাতে দর্পণের সঙ্গে। দুইভাই ঘুরতে গেছিলো, তখনকার সময়ের। দর্পণের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। সে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বললো,

‘ভাই, মিস ইউ। ‘

চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

২১.

শীতের কনকনে ঠান্ডা কুয়াশায় মিনিট খানেক গা ডুবিয়ে বসে থাকলেও এখন একটু কষ্টই হচ্ছে। সকালের সময়টা রোজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা জানালায় পাশে বসেই কাটায় মেহতিশা। নাহয়, এই সময়টা দর্পণ তার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসে। দর্পণের হাসিমাখা মুখটাই তখন দিনের শুরুটা রঙিন করে তোলে। অথচ, আজ মেহতিশা ঘুম থেকে উঠে আনমনেই বলছিলো,
‘দর্পণ, এসিটা বন্ধ করে দিন শীত লাগছে। ‘

পুরনো অভ্যাস চাইলেই হঠাৎ করে ছাড়ানো সম্ভব না। একদিন দুইদিন তিনদিন, তারপর ধীরে ধীরে হয়তো সয়ে যায় মনে। মনটা মানিয়ে নিতে শিখে। মেহতিশার তখন প্রচন্ড মন খারাপ হলো। ভাবতে লাগলো, ‘এতদিনই তো ভালো ছিলো দর্পণ, নাটক হলেও আমি ভালো ছিলাম। এভাবে কতদিন ধুঁকে ধুঁকে মরবো? ‘
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়ে। আজ আর বারান্দায় দাঁড়াতে ইচ্ছে করলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে এলো। অনেক গুলো গোলাপ, হাসনাহেনা ফুলের টব লাগানো আছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো মেহতিশা। ফুলগুলো অনেক স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কী অপরূপ! এগুলো নাকি দর্পণের টব। সবগুলোর যত্নই সে নিজের হাতে নিতো। ঘরে বসার পর এগুলো লিমন কাকার দায়িত্বে ছিলো। যিনি এখনো মালি হিসেবে এ বাড়িতে কাজ করে। আজ সকালেও নাকি দর্পণ এগুলোতে পানি দিয়েছে। মেহতিশা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, এত সুন্দর ফুলগুলো যার, তার মনটা এতো কুৎসিত কেনো?

আধা ঘণ্টা সময় কাটানোর পর শীতে গা কুঁকড়ে আসছিলো। তাই নিচে নেমে আসলো। রুমে এসে গায়ে চাদর পেচিয়ে নামলো। অন্য দিনগুলোতে রান্না ঘরে ঢুকে দর্পণের জন্য চা বানায়। তারপর দিয়ার সঙ্গে গল্প করে। এখন মেহতিশার সামান্য হাসিটুকু দিতেও অনেক কসরত মনে হচ্ছে। সোফায় বসে টিভিটা অন করলো যদিও মনোযোগ সেখানে নেই। লালিমা শেখ মেহতিশাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন,

‘একি মা, তুমি ওভাবে না খেয়ে বসে আছো কেনো? ‘

মেহতিশা হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘এমনি, খেতে ইচ্ছে করছে না। ‘

‘ওহহো, এখন তো আর দিপু নেই। নাহলে নিজেই এসে তোমাকে খাইয়ে দিতো। পাগল ছেলে আমার, সকালেই অফিসে ছুটছে। কিছু খায়ওনি। ‘

‘উনি কিছু খেয়ে যাননি! ‘

‘না তো, সাড়ে সাতটাতেই রেডি হয়ে দৌড়েছে। টাইম নিয়ে অনেক পজেসিভ। যা কাজই করে অনেক দায়িত্ব নিয়ে ভালোবেসে করে। ‘

প্রথমে মেহতিশার চিন্তা হচ্ছিল দর্পণ খালি পেটে বের হয়ে গেছে বলে। কিন্তু, লালিমা শেখের প্রশংসা শুনে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে। হাহ! কত গর্ব নিয়ে প্রশংসা করছেন তিনি৷ অথচ, আসলে দর্পণ কেমন তা তো জানে মেহতিশা। আর কিছু পারুক আর না পারুক, অভিনয়টা ঠিকই পারে। তাও নিখুঁত। নাহলে দু’টো বছর কীভাবে কেউ প্যারালাইসের নাটক করে ঘরে বসে থাকে। হঠাৎ করেই মেহতিশার মনের বিদ্যুতের গতিতে একটা প্রশ্ন খেলে গেলো, ঠিকই তো দু’টো বছর কীভাবে দর্পণ প্যারালাইসের অভিনয় করলো? একজন সুস্থ মানুষ কী পারে এভাবে! আর করলেও কেনো? মেহতিশা তো নিজেও দর্পণের রিপোর্ট নিয়ে নিজের কাজিনকে দেখিয়েছিলো। ভাইয়াও তো বলেছিলো, সত্যিই দর্পণের পা অচল। সে হাটতে পারেনা। অনেক সময় লাগবে তার সুস্থ হতে। তাহলে? মেহতিশা তাড়াতাড়ি উঠে গেলো। লালিমাকে বললো, মা আমি রুমে যাচ্ছি আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। নাহার খালাকে বলে নাস্তাটা উপরে পাঠিয়ে দিয়েন।

লালিমা শেখ বললেন, ঠিক আছে তুমি রেস্ট নাও মা যাও। নিচে নামার দরকার নাই। বেশি খারাপ লাগলে আমি দর্পণকে কল করে বলবোনে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে।

মেহতিশা কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে ঘরে এসে গেলো। এসেই ড্রয়ার থেকে দর্পণের মেডিসিন গুলো বের করলো, তারপর ঔষধের নাম গুলো সার্চ গুগলে সার্চ দিলো। রেজাল্টে দেখালো, ঔষধগুলো এক ধরনের সিভিট আর কিছু ভিটামিন। অথচ, ভাইয়া কিছু পায়ের হেলথ ইমপ্রুভমেন্টের মেডিসিন দিয়েছিলো। মেহতিশা বুঝতে পারলো, দর্পণ এখানেও কোনো চাল খাটিয়েছে। এবার বুঝতে পারছে, ঔষধ গুলো মেহতিশা নিজেই আনতে চেয়েছিলো কিন্তু দর্পণ দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়েছিলো। তার মানে, টাকা দিয়ে দর্পণ এখানেও কারসাজি চালিয়েছে। তাইতো, ঔষধের প্রেসক্রিপশনটা আর পরবর্তীতে খুঁজে পায়নি। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো মেহতিশা। চোখ বেয়ে জল পড়ছে। চোখ মুছে মেহতিশা ঠিক করলো এবার যেভাবেই হোক, সে বের করবে কী কারণে দর্পণ এসব করলো। আর তারপরই এ বাড়ি ছেড়ে, দর্পণকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবে। আর বাচ্চাকেও নিয়ে যাবে। এটাই হবে দর্পণের উত্তম শাস্তি। উঠে বাবাকে কল করে থমথমে কন্ঠে বললো,

‘আমি আসছি। ‘


গলার টাইটা আরও একবার ঢিলে করে নিয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু গিলে নিলো।
এতো ঠান্ডাতেও ঘামছে দর্পণ। কী অসহ্য রকমের গরম লাগছে। উঠে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিলো। মাকে দু’বার কল করে খোঁজ নিয়েছে মেহতিশা কী করছে,কোথায় যাচ্ছে। মেহতিশাকে কল করেছিলো। মেয়েটা ধরেনি। দর্পণ জানে, ইচ্ছে করেই ধরেনি। নাহ, গার্ড লাগাতে হবে। না জানি মেহতিশা কখন কী করে বসে। সকালে মেহতিশার দৈনিক ঔষধগুলো সাইডে রেখে দিয়েছিলো, একটা কাগজে লিখেও রেখেছে। যাতে ব্রেকফাস্ট করে নেয়। দেখেওনি হয়তো। দর্পণের মেজাজটা গরম হয়ে গেছে। অফিসের কাজ গুলো শেষ করে একবার ক্লাবে যেতে হবে।

অর্পণ থাকতে এই ব্যবসাপাতির দায়িত্ব ছিলো অর্পণেরই। দর্পণ ক্লাব, রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এখন দুইদিক কীভাবে যে সামলাতে হয়, শুধু দর্পণই জানে। আগে মাঝে মধ্যে দুই একবার এসে পেন্ডিং এ থাকা কাজগুলো দেখে দিতো। বাড়তি কিছু কাজ ছাড়া কিছু করা লাগেনি। এখন তো বাবারও বয়স হয়েছে। তিনি খুব একটা প্রেশার নিতে পারেন না। দর্পণ ঘড়িতে সময় দেখলো সাড়ে এগারোটা বাজে। মেয়েটা কী এখনো না খেয়ে বসে রইলো! নাহ, অস্থির অস্থির লাগছে দর্পণের। বাসায় থাকলে মেয়েটা কতশত পাগলামি করতো। ল্যাপটপটাকে নাকি মেহতিশার সতীন মনে হয়। দর্পণ যখন ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে, তখন মেহতিশা হিংসার দৃষ্টি দিয়ে বলতো, আমার ইচ্ছে করে এই ল্যাপটপটাকে দুই ভাগ করে ভেঙে ফেলতে! দর্পণ সারাক্ষণ এটা নিয়ে কাজ করতো বলে কত রাগ করতো। আনমনে হাসলো। কল করলো মেহতিশার নাম্বারে।


নিজের বাড়ি থেকে চোখ মুখ ফুলে থাকা অবস্থায় বাসায় ফিরলো মেহতিশা। চোখ মুখের অবস্থা করুণ।
লালিমা দেখে এক মুহুর্ত থমকে গেলেন। অস্থির হয়ে দর্পণকে কল করলেন। মেহতিশা ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। নির্মম দহনে পু্ড়ছে যেন।

কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসকষ্ট লাগছে। ব্যাগে মোবাইলে রিং হচ্ছে। তীব্র ঘৃণা নিয়ে মেহতিশা বিরবির করে বললো,

‘আই হেইট ইউ দর্পণ, আই জাস্ট হেইট ইউ। ‘

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।