প্রিয় দিও বিরহ পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
435

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৬.

সুখময় প্রেমে অঢেল বর্ষণে মাখো মাখো সময় তখন।
সবটাই যেনো স্বপ্নের মতো সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর। এ যেনো ছোটবেলার ফেইরিটেইলের রূপকথার গল্প। যেখানে রঙ বেরঙের লাল-নীল পরীরা জাদুর কাঠি দিয়ে দুঃখ কষ্ট মুছে দেয়। ছোঁয়া দিয়ে সুখের পরশ ছড়ায়।
দিনের শুরুটা হয় ভালোবাসার চুম্বনে ও শেষ প্রহরের
সমাপ্তি হয় অজস্র সুন্দর মুহুর্তে। কখনো বারান্দায় বসে তো আবার কখনো চন্দ্রবিলাস করে। সংসারের মধ্যমণি এখন মেহতিশা। দর্পণের বাবা,মা,নিশিতা তারা মেহতিশা বলতে পাগল। এমনকি দিয়াও এখন তেমন অপছন্দ করেনা তাকে। মেহতিশার সঙ্গে সময় পেলেই গল্পের আসর জমায়। মেহতিশার দিনগুলো হাসিখুশি ভাবেই কাটছে। যে বাড়িটা ও বাড়ির মানুষ গুলোকে সহ্য হতো না। লাগতো অসহ্যকর। এখন তাদেরই দিনদিন আপন মনে হয়। আগে যাদেরকে নিয়ে দুদন্ড মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। এখন তাদের সঙ্গেই আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

কষ্টটা শুধু একজায়গায়ই। দর্পণের পা দুটো। সব সুখ গুলো ফিকে পড়ে যায় দর্পণের অসুস্থার নিকট। মেহতিশার বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে নিজের ভাগ্যল৷ কে দোষারোপ, হাহুতাশ করতো এই ভেবে যে একটা পঙ্গু লোকের সঙ্গে কীভাবে সারাজীবন কাটাবে সে! কিন্তু এখন সেই ভাবনা আর আসেনা। এখন মনে মনে কষ্ট হয় দর্পণের কষ্টে। প্রার্থনা করে, মানুষটা যেনো সুস্থ হয়ে ওঠে। সেই দিনটা হবে মেহতিশার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। যখন আর পাঁচটা মানুষের মতো দর্পণও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। ইচ্ছে মতো চলাচল করতে পারবে। এইজন্য মেহতিশা চিন্তা করলো, সে নিজেই এর দায়িত্ব নিবে ৷ এসব ভেবে ঘরে বসে মেহতিশা মোবাইলটা হাতে নিলো। কল করলো নিজের মামাতো ভাই মহসিনকে। যে কিনা কয়েকদিন আগেই লন্ডন থেকে এমবিবিএস করে এসেছে। এখন বেশ ভালো একটা হসপিটালের ডক্টর। মেহতিশা কল করলো তাকে। রিসিভ হতেই ওপার থেকে ভেসে এলো –

‘হেলো, বল মেহতিশা। কেমন আছিস?’

মেহতিশা মুচকি হেসে বললো,

‘ভালো আছি ব্রো। তুমি কেমন আছো? ‘

‘এই তো বেশ। ভাইকে তো ভুলেই গেছিস। ‘

‘আমি ভুলে গেছি! তুমি তো ব্যস্ত মানুষ। তোমার সাথে কথা বলতে এখন টিকিট কাটতে হয়। মোটা অঙ্কের ফিস না দিলে তোমার দেখা পাওয়া মুশকিল! ‘

‘হাহাহা, তুই আগের মতোই রয়ে গেলি। কথায় কথায় বমের মতো রেগে যাস৷ এমনিই কী আর সৌজন্যে তোকে চকলেট বম নাম দিয়েছিলো! ‘

হাসতে নিয়েও থেমে গেলো মেহতিশা। ওপাশ থেকে মহসিনও বুঝতে পারলো। সে বললো,

‘হ্যারে মেহতিশা, তুই তো পারতি সৌজন্যেকে একটা সুযোগ দিতে! ‘

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

‘তুমি এই কথা বলছো কীভাবে !’

‘দেখ, সৌজন্যে তোকে কতটা ভালোবাসতো তা আমাদের কারোই অজানা নয়। ছোট্ট বেলা থেকে ছেলেটা তোকে না দেখলে পাগলের মতো করতো। আর তোরও যে ওকে অপছন্দ ছিলো, বলতে পারবি কখনো? ‘

‘অস্বীকার করবো না, সৌজন্যকে প্রথমে আমি শুধু মাত্র ভাইয়ের নজরে দেখলেও, ও যখন বিদেশ থেকে এলো তখন আমারও কিছু একটা ফিল হয়েছিলো। কিন্তু সেসবে আমি পাত্তা দেইনি। প্রথমত সৌজন্যে আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তারপর.. ‘

‘তুই এখনো নিজেকে অনাথ ভাবিস!’

মেহতিশার চোখ টলমল করে। সে হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে,

‘যতই হোক, আমি তো অনাথই। যদি নিঃসন্তান দম্পতি শামীউল্লাহ জামান আর আপন খালা ফেরদৌসি জামান আমাকে মা বাবা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়ি না নিয়ে যেতেন তাহলে কী এই মেহতিশা বেঁচে থাকতো! ‘

গলা ভেঙে যায় মেহতিশার। নিজের আসল পরিচয় ভিন্ন। ফেরদৌসির বড় বোন শাওমির একমাত্র মেয়ে মেহতিশা। মেহতিশার জন্মদাতা পিতা মাঈনুল হোসেন বড় একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তখন মেহতিশার এক বছর, তিনি একদল সন্ত্রাসীকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তারই ক্ষোভে একরাতে মেহতিশার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীগুলো। মেহতিশাকে সেখানে থেকে উদ্ধার করে বাড়ির দারোয়ান। ফেরদৌসি বন্ধ্যা। আর শামীউল্লাহ জামানেরও কিছু সমস্যা আছে তাই দুজনই পরবর্তীতে মেহতিশাকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিয়ে বড় করে তোলেন।

পুরনো কথা মনে পড়ে মেহতিশার। সে তো ছোট ছিলো তাই কিছুই তার মনে নেই। সবটা কিশোরী বয়সে থাকতে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাদী আর বড় চাচীর আলাপ করার সময় সে জেনে যায়। পরে কান্না করার জন্য সবাই তাকে এসব মজা করে বলেছে বলে সান্ত্বনা দিলেও, সত্যিটা বোঝার ক্ষমতা ছিলো মেহতিশার।

ফোনের ওপাশ থেকে মহসিন উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,

‘মেহতিশা, তুই কী পারতি না সৌজন্যেকে বলে একসাথে পালিয়ে আসতে। আমি নিজেই তোদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে রাখতাম। তুই তো কখনো নিজের উপর অন্য কারো মত মানিস না। তুই যদি রাজি না হতি, রাগ দেখিয়ে চলে যেতি তাহলে কী পারতো কেউ তোকে বিয়ে দিতে? ‘

মেহতিশা ভাঙা গলায় বললো,

‘আমি চাইলেই পারতাম বাবার মুখের সামনে না করে চলে যেতে। কিন্তু আমি ওই পরিবারটার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। ছোটবেলায় বাবা যদি আমাকে নিজের পরিচয় দিয়ে লালন পালন না করতেন আমি মরে যেতাম হয়তো। ‘

মহসিন কথা আর বাড়ালো না। সে নিরস গলায় বললো,

‘আচ্ছা। বাদ দে। আর বল হঠাৎ আজ কী মনে করে কল দিলি? ‘

‘ওহ হো! আমি ভুলেই গেছি। তুমি তো জানোই দর্পণের পায়ের অবস্থা কী। তুমি তো অনেক ভালো ডক্টর। কী ধরনের ট্রিটমেন্ট নিলে দ্রুত সেরে উঠবে তা বলো। ‘

‘হুম, আচ্ছা শোন। আমি আগে রিপোর্ট দেখবো। তুই কালকে আমার কাছে আসবি, রিপোর্ট দেখে আমি ঔষধ দেবো। ‘

‘ঠিক আছে ভাইয়া, রাখছি তাহলে। কালকে আসবো আমি। ‘

তারপর দিনই রিপোর্ট দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে আসে মেহতিশা। দর্পণকে নিজ হাতে ঔষধ খাওয়ায়। এবার সেও দেখবে কীভাবে দর্পণ সুস্থ না হয়!

দুপুরের খাবারটা রান্না করে মেহতিশা তখন টেবিলে সাজাচ্ছে। দিয়া বসে মোবাইল টিপছিলো। লালিমা শেখ ফল কাটছিলেন। আর দর্পণ অফিসের ম্যানেজারকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। সারাক্ষণ বাসায় থাকলেও দর্পণ কাজের দিকে সম্পূর্ণ নজর রাখে। পাই টু পাই হিসাব দিতে হয় প্রতিটি কর্মচারীকে।
অনলাইনে প্রেজেন্ট নেয় শিক্ষকের মতো সে। সিসি টিভি ক্যামেরায় নজর রাখে চারজন কর্মকর্তা। অতএব, কাজ থেকে অব্যাহতি নেই কারো। দর্পণ তখন গম্ভীর অভিব্যাক্তিতে কথা বলছে। চমকে উঠলো ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে যাওয়ার। সবাই বিস্মিত চোখে তাকালো সেদিকে। কাঁচের প্লেটটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর পাশেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে মেহতিশা। দর্পণ নিজে উঠতে না পারায় লালিমা আর দিয়াকে বললো ওঠাতে। মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে তার চিন্তায়। তড়িঘড়ি করে ওঠানো হলো মেহতিশাকে। আধা ঘণ্টার ভেতরেই ডক্টর এসে হাজির হলো। কিছু টেস্ট করে উনি মুচকি হেসে দর্পণের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘শুভেচ্ছা! বাবা হচ্ছেন আপনি। প্রাথমিক টেস্টে তাই বোঝা যাচ্ছে। আপনারা আরেকবার হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করিয়ে নিবেন। ‘

দর্পণের অভিব্যাক্তি বোঝা গেলো না৷ লালিমা খুশিতে অজ্ঞান মেহতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দিয়াও খুশি হলো খুব। ওরা ভাবলো দর্পণ হয়তো মেহতিশাকে একা চাচ্ছে। তাই দরজা বন্ধ করে ওরা বেরিয়ে গেলো।

ওরা বের হওয়ার পর দর্পণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেহতিশার দিকে তাকালো। মুখে ফুটে উঠলো বক্র হাসি। সে নিজের হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। একটা লাথি মেরে হুইলচেয়ারটা সরালো। স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে বিছানায় বসলো, মেহতিশার কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। পাশেই টেবিলের উপর রাখা ঔষধের পাতা গুলো ছুঁড়ে মারলো জানালা দিয়ে। মুচকি হেসে বললো,

‘বউজান, প্রসঙ্গ যখন আপনি তখন ভীষণ স্বার্থপর আমি।’

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

”প্রিয় দিও বিরহ”

১৭.

রাত্রির মধ্যপ্রহর। উদরের কাছটায় কেমন অদ্ভুত স্পর্শ লাগছে মেহতিশার ৷ ঘুম হালকা হয়ে আসলো। চোখ মেলে উঠে বসলো। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো দর্পণ ওর পেটের কাছটায় শুয়ে আছে। ওকে উঠতে দেখে মুচকি হাসলো। মেহতিশা মাথা ঝাকালো।
ঘড়িতে অনেক রাত হয়েছে। এতো রাত হলো কী করে!
সে তো দুপুরের খাবার রেডি করছিলো। বিছানায় আসলো কীভাবে! প্রশ্নবোধক চাহনিতে দর্পণের দিকে তাকালো। দর্পণ টেবিলসাইড থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে চামচ মুখের সামনে ধরে বললো,

‘সব পরে বলবো বউজান। আগে খাবারটা খেয়ে নিন৷ দুপুর থেকে না খাওয়া আপনি। ‘

মেহতিশা দ্বিরুক্তি করেনা। লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপটি করে খেয়ে নেয়। দর্পণ হাসে। পানি পান করিয়ে মুখটা মুছে দেয়। খাওয়া শেষ হওয়ার পর মেহতিশা দর্পণের হাত ঝাকায়। দর্পণ প্লেট রেখে মেহতিশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মেহতিশার হাতটা নিজের মাথার উপর রেখে বললো,

‘হাত বুলিয়ে দাও৷ ‘

মেহতিশা হেলান দিয়ে শুয়ে দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে ৷ দর্পণ দুই হাতে মেহতিশার কোমড় জড়িয়ে রেখে উদরে মুখ গুঁজে রেখে বললো,

‘আমি কদিন ধরে আপনাকে ঘুম থেকে উঠে বলতাম,
একটা মায়াবী পুতুলের মতো বাচ্চা আমাকে রোজ বাবাই বলে ডাকে। মনে আছে বউজান?’

মেহতিশা বললো,

‘হ্যা, থাকবেনা কেনো! গতকালই তো বললেন।’

দর্পণ তাকালো। মেহতিশা তার চোখের দিকে তাকিয়ে
দেখে দর্পণের চোখ বেয়ে উষ্ণ জলের কণা গড়িয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে। মেহতিশা ঘাবড়ে গেলো। দর্পণের গালে দুই হাত রেখে বললো,

‘হুশ! এভাবে বাচ্চাদের মতো কেউ কাঁদে দর্পণ! ‘

দর্পণ চোখ বুজলো। মেহতিশাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত করে বললো,

‘আমার স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে বউজান। আই এম গোয়িং টু বি এ ফাদার। আই ওয়ান্ট টু বি এ বেস্ট ফাদার ইন দা ওয়ার্ল্ড। ‘

শীতের ভাপা পিঠার মনমাতানো সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।
কুয়াশা ভেদ করে দূরের বিশাল রাক্ষসী বিল্ডিং গুলো দেখা মুশকিল হয়ে গেছে। তালগাছ গুলো সুবিশাল মাটি জুড়ে সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাবুই পাখির সুদর্শন বাসাটা অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। দুইটা বাবুই পাখি বসে মাথা ঘষাঘষি করছে।

পেটের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখেই মেহতিশা হাসলো। সবে মাত্র দুই মাস। এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি। মেহতিশা আলতো পায়ে হেঁটে খাটে বসলো। রিং বাজছে মোবাইলে। এই নিয়ে দশম বার। কলটা রিসিভ করতে ইচ্ছে না করলেও কলটা উঠালো সে। প্রতি বারের চেয়েও উর্ধ্বে রাগত স্বর শোনা গেলো-

‘তোমার মাথা কী পুরোপুরি গেছে মেয়ে! আমি তোমাকে বারবার বলেছি তুমি ভুলেও এই ভুল করবে না। অথচ, তুমি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলে! কেনো করলে এমন! পেট বাঁধিয়ে বসে গেছো। কেনো! এতো ধৈর্যহীন কেনো! আমি তো বলেছিলামই। চারটে মাস শেষের পথে। আর মাত্র দুটো মাস ছিলো! ‘

মেহতিশার লজ্জায় অপমানে মাথা কাটা যায় যেনো। নিজের পিতার থেকে এমন শ্রীহীন বাক্য মোটেও কাম্য নয়। মেহতিশা ভেজা কন্ঠে বললো,

‘বাবা, এখন আমার কী করার আছে বলবে! ‘

‘কী করবে আর! কোনো মতে দুটো মাস থাকো। তারপর আমি তোমার এবর্শান করাবো। কাকপক্ষীও টের পাবে না। ‘

মেহতিশা রেগে গেলো। এতোদিন নির্বিকার থেকেছে শুধু এই ভেবে যে তিনি মেহতিশাকে বাঁচিয়েছিলেন।
বড় করেছেন আদর করে। তবে, এখন অনেক হয়েছে। আর একটুও সহ্য করবেনা সে। মেহতিশা চেঁচিয়ে বললো,

‘ব্যস,অনেক হয়েছে। এতোদিন সহ্য করেছি কারণ আমি কৃতজ্ঞ আপনার উপর৷ কিন্তু আজ আর না। আপনার কোনো কথাই আমি আর শুনবো না। দর্পণের উপর আমার বিশ্বাস আছে। সে কখনোই ভুল কিছু করবে না। আপনার সাহস কী করে হয়! আমার সন্তানকে নিয়ে বলার অধিকার নেই আপনার। আর কখনো কল করবেন না আমাকে। ‘

মেহতিশা কল কেটে দিলো। শামীউল্লাহ জামান তখন চিৎকার করে বলছেন,

‘খবরদার, এমন ভুল করোনা মেহু। তুমি পস্তাবে অনেক পস্তাবে! ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ”

১৮.

আমরা মানুষ ভালোবাসার বড্ড পাগল। যেখানে এক টুকরো ভালোবাসা পাই সেখানে অনড় হয়ে যাই। ভালোবাসাময় মানুষটাকে অন্ধ হয়ে বিশ্বাস করি। চোখে ভালোবাসার পট্টি বেঁধে ভালোবাসি। ধ্যান জ্ঞান সব হয় ওই মানুষটা৷ মেহতিশা সে দলের মানুষ। যে কিনা অল্পতেই রাগে, অল্পতেই হাসে,অল্পতেই ভালোবাসে। এ ধরনের মানুষরা নরম মনের হয় সাধারণত ভেতর থেকে। বাহির দিয়ে শক্ত। মেহতিশাকে প্রথম দেখলে যে কেউ নাকউঁচু রূপবতী মেয়ে ভাবতে বাধ্য। কিন্তু মেহতিশার সঙ্গে কয়েক দিন যে কেউ থাকলেই বুঝতে পারবে সে অত্যন্ত মসৃণ মনের। রেগে মাঝে মাঝে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও পরে কেঁদেকেটে একাকার হয়। দিয়ার তাই মনে হয়। দিয়া একটু ইন্ট্রোভার্ট ধরনের। সে সবার সাথে কথা বলে মিশতে পারেনা।

মেহতিশাকে যেদিন সে এ বাড়িতে প্রথম দেখলো তখন তা-ই ভেবেছিলো। মেহতিশার ফর্সা নিখুঁত চেহারাটা দেখে মনে মনে নিজেকে কেমন একটা ছোট মনে হচ্ছিল। আসলে, প্রতিটা মেয়েই নিজের চেয়ে সুন্দর কোনো মেয়েকে সামনে দেখলে তুলনা করে আপনা-আপনি। দিয়া সেদিন কথা বলতে একটুও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি মেহতিশাকে দেখে। একে তো সোনালী পাকা ধানের মতো গায়ের রং, বড় টানা চোখ,আর কাটকাট নাক। যেনো কোনো বলিউড সিনেমার নায়িকা। দিয়ার গায়ের রঙটা তার মায়ের মতো। একটু কালচে ধরনের। মুখের গঠন যদিও সুন্দর। কিন্তু, আবার উচ্চতা কম। নিজেকে নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভোগে সে। সবার সামনে তেমন একটা আসেনা। অনেক গুলো দিন কেটে যাওয়ার পর মেহতিশা যখন দিয়াকে খেয়াল করে। তখন মেহতিশা নিজেই সেধে কথা বলেছিলো। তাই একটু লজ্জাই পেয়েছিলো সে। দিয়া ইন্টার পাশ করে এবার অনার্সে ভর্তি হলো। নিজের থেকে বয়সে বড় একজন তার ঘরে এসে নিজ থেকে কথা বললো ভেবে একটু লজ্জিত হলো। তারপর নিজ থেকেই টুকটাক কথা বলতো। একটু মিশে যাওয়ার পর ভালোই লাগতো৷ সারাদিন ঘরবন্দী থেকে দমবন্ধ লেগে যায় ওর। যেদিন শুনলো মেহতিশা প্রেগন্যান্ট। সেদিন থেকে আরও বেশি খুুশিমনে এসে গল্প করতে লাগলো দিয়া। বিকাল হতেই রোজ এটা ওটা খাবার নিয়ে এসে রুমে বসে মেহতিশা আর দিয়া মুভি দেখে ল্যাপটপে। বিকেল হলো যখন তখনই দিয়া বই রেখে পপকর্ণ ভেজে মেহতিশার রুমের দিকে গেলো। মেহতিশা তখন ফোনে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো।
একা বসে বসে বোর হওয়ার থেকে তাই ভালো হবে বলে মনে হচ্ছিল। দর্পন সেই যে এক ঘন্টা থেকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলছে। মেহতিশা কোনো কাজ না পেয়ে কথা বলছিলো। দর্পণ এখন সব কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে তাকে ৷ দুই একটা কাজ করলেও দর্পণের রাগ দেখে কিছু করার সাহস পায়না৷ মেহতিশার কেনো জানি মনে হয় দর্পণ মেহতিশা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর অনেক রাগ দেখায়। মাঝে মাঝে তো মেহতিশার মনে হয় সে বুঝি এই বাচ্চাটার সৎ মা। যে কিনা বাচ্চাটাকে একটুও চায়না। উনিশ থেকে বিষ হলেই দর্পণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই যেমন, সকালেই পানি খেতে গিয়ে কিছুটা পানি ফ্লোরে পড়ে গেছিলো। সেটা খেয়াল করেনি মেহতিশা। আবার ওই পাশ দিয়ে হাঁটার সময় পানিতে পা রাখার আগে দর্পণ তাকে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। তারপর কিছুক্ষণ আরও ওকে বেখেয়ালি, আনমনা, কেয়ারলেস বলে বকাঝকা করলো। মেহতিশা এক পলকের জন্য থমকে গিয়েছিলো। টলমল চোখে তাকালো। দর্পণ পরমুহূর্তেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরে সরি বললো। তখন মেহতিশা সব ভুলে খেয়ে ফেললো। এতো সুন্দর করে সরি বললে কী আর রেগে থাকা যায়!

দিয়া ঘরের দরজায় নক করতেই মেহতিশা কল কেটে দিয়ে বললো,

‘বোকা মেয়ে, তোমার আসার জন্য নক করার দরকার নেই তো। ‘

দিয়া মুচকি হেসে ভেতরে এলো। বিছানায় এসে বসেই রোজ যে কথাটা সবার আগে বলে তাই বললো-

‘ছোট ভাবি,ছোটু কবে আসবে! ‘

মেহতিশা হেসে উঠলো৷ প্রতি দিন যে কেউ এক কথা কীভাবে বলে বোঝেনা ও৷ মেহতিশা দিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘এখন তো সবে আড়াই মাস। আরও অনেক দিন বাকী। এই দেখতে দেখতে চলে যাবে। ‘

দিয়া উৎফুল্ল হয়ে বললো,

‘আমার মনে হয় আমাদের একটা ছোট রাজপুত্র আসবে। ‘

‘হাহাহা,এতো তাড়াতাড়ি তুমি কীভাবে জানলে! ‘

‘আমি জানি, রাজপুত্রটা আসলে আমি তাকে অর্পণ বলে ডাকবো। ‘

মেহতিশা থমকে যায়। দিয়া চোখ মোছে। অর্পণ নামের বড় ভাইটাকে সে আজও খুব মিস করে দু’টো বছর সে নেই। কষ্টে বুকে ব্যাথা করে দিয়ার। একমাত্র ঐ বড় ভাইটাই ছিলো যে তাকে খুব বুঝতো। এখনও বাহির থেকে আসলে লেবুর ঘ্রাণ পেলে দিয়া অস্থির হয়। কারণ এক সময় ঐ অর্পণ ভাইটাই তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। বাহির থেকে আসলে লেবুর শরবত বানিয়ে রসিক গলায় বলতো,’দিয়ু,নে শরবতটা খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে! আমি কিন্তু অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি। ‘ দিয়া অনেক হাসতো তখন। অর্পণও মজা করে বলতো,হেঁসে নে হেঁসে নে, আমি যখন থাকবো না তখন এই অমৃত কেউ খাওয়াবে না তোকে। দিয়া এখনও সেসব মনে করলে কাঁদে।

মেহতিশা বুঝতে পারলো ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই মন ভালো করতে বললো,

‘জানো দিয়া, তোমার ভাইটা আমাকে সময় পেলেই বকে। ভীষণ পঁচা তোমার ভাই। ‘

দিয়ার তখনও মনটা আঁধারে নিমজ্জিত। সে আঁধারিয়া কন্ঠে বললো ,

‘তুমি মনে কষ্ট নিওনা আপু। আসলে দর্পণ ভাই ভয় পায় তো তাই এমন করে। আগের বার যখন নিশিতা আপু এমন প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন.. ‘

মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেকেই বকলো দিয়া। মেহতিশা তখন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে উৎকন্ঠিত হয়ে বললো,

‘প্রেগন্যান্ট ছিলো! তাহলে সেই বাচ্চাটা এখন কোথায়? ‘

দিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,

‘নেই। ‘

‘নেই মানে?’

‘মারা গেছে। ‘

কত সহজেই দিয়া বলে ফেললো মারা গেছে। কথাটা হজম করতে অনেক কষ্ট হলো মেহতিশার। সে দিয়ার হাতটা চেপে ধরে বললো,

‘কীভাবে মারা গেছে?’

‘সে অনেক কথা। নিশিতা আপু তখন চার মাসের প্রেগনেন্ট। চেক আপের জন্য অর্পণ ভাই তাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলো। রাস্তায় গাড়ি কীভাবে যেনো নষ্ট হয়ে যায়। অর্পণ ভাই,গাড়ি ঠিক করার জন্য একটু দূর থেকে ম্যাকানিক ডাকতে গেছিলো। এসে দেখলো কে যেনো নিশিতা ভাবিকে রাস্তায় পিটিয়ে ফেলে রেখেছে। অর্পণ ভাই এসে পাগলের মতো তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চাটা মারা গেছে পেটেই। তারপর থেকে নিশিতা ভাবি পাগলপ্রায়।’

চোখজোড়া ভেজা দিয়ার। ক্ষতগুলো বোধ হয় এখনি সারেনি। মেহতিশা থমথমে মুখে বললো,

‘তারপর? অর্পণ ভাইয়া কীভাবে মারা যায়? ‘

দিয়া কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে যায়। বোধ করে, এতোগুলা কথা বলাও ঠিক হয়নি। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘তুমি এসব নিয়ে আর ভেবো না। ভাইয়া ভয় পায়, যদি তোমার সাথেও এমন হয়! তাই তুমি সাবধানে থেকো। ‘

মেহতিশা তখনও অস্থির পরবর্তীতে কী হয়েছে তা জানতে। কীভাবে অর্পণ ভাইয়া মারা গেছে, আর নিশিতা আপুর বাচ্চাটাকে কে মারলো! শত শত প্রশ্ন ওর কানে চিৎকার করছে। মেহতিশা দিয়াকে শেষ আরেকটা প্রশ্ন করলো,

‘দিয়া, এতোটুকু বলো কীভাবে মারা গেছিলো অর্পণ ভাইয়া!’

‘আমি আর বলতে পারবো না ভাবি। বারণ আছে। ‘

‘কে বারণ করেছে? ‘

‘ভাইয়া। ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।