প্রিয় প্রহর পর্ব-০৩

0
624

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩
ডায়নিং টেবিলে সবাই ইতিমধ্যে বসে গেছে। রিয়ানা তার তিন বছরের মেয়েকে ঘুম থেকে তোলে ফ্রেশ করাচ্ছে এরপর আসবে। আরোহী রান্নাঘরে তার ফুফি যে কিনা এখন তার শাশুড়ি, তার কাছে যায়। আরোহীর ফুফি আরোহীকে জোর করে ডায়নিংয়ে এনে বসায়। ডায়নিংয়ে শুভ্রর ফুফি ও ফুফাতো বোন সামিরা বসে আছে। শুভ্রর ফুফি আরোহীকে বসতে দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলে,

–নতুন বউ কোথায় শশুর বাড়িতে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সকলের জন্য নাস্তা বানাবে, তা না করে সে সরাসরি নাস্তা খেতে এসেছে!

রিয়ানা নিজের মেয়েকে নিয়ে মাত্র ডায়নিংয়ে আসলো আর এসেই এরূপ মন্তব্য শুনে রাগ উঠে যায়। সে জানে তার ফুফি চেয়েছিল সামিরাকে শুভ্রর বউ বানাতে। তাই রিয়ানা বলে,

–আরে ফুফি! তুমিও না! এখন ওসব কেউ মানে নাকি? আর আরোহীতো আমাদের পর না সে তো আমাদের বাড়ির মেয়ে। আরোহী তাও কিন্তু রান্নাঘরে গিয়েছিলো মা কে সাহায্য করতে। আর সামিরাকে দেখো! সে কি পারতো না সকাল থেকে আমি যেমন মা কে কাজে সাহায্য করেছি তেমনি সেও আমার সাথে একটু কাজে হাত লাগাতে? কিন্তু সামিরার কি সেই ফুসরত আছে বলো! হাতেপায়ে ম্যানিকিউর, প্যানিকিউর করে পটের বিবির মতো সোফায় বসে বসে ফোন চালাচ্ছে।

সামিরা এসব শুনে জবাব দিবে তার আগেই শুভ্রর ফুফি মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা শুনে ফুসে উঠে বলে,
–আমার মেয়ে কি এখানে কাজ করতে এসেছে নাকি? সে কি বাড়ির বউ যে এসব কাজ করবে? শুভ্রর বিয়ের জন্য এসেছি আর তোরা আমাদের কাজ না করার খোঁটা দিচ্ছিস!

আরোহী চেয়ারে বসে মুখ টিপে হাসছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে তবে শুভ্রর এবং শুভ্রর মায়ের নজর এড়ায় না। শুভ্রর মা আরোহীর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আরোহীকে মিটিমিটি হাসতে দেখে আলতো ধাক্কা দিয়ে থামতে বলে। আরোহীও তার ফুফির কথায় মুখে হাত দিয়ে ঘার নারায় যে সে আর হাসবে না কিন্তু তাও সে মুখে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে হাসছে। শুভ্র এসব দেখে ভাবে, আরোহীর জায়গায় তারা (আয়ানা) হলে কি করতো?
শুভ্র ভেবে এই উত্তর পায় যে, তারা (আয়ানা) হলে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতো! আর শুভ্র নিজে তখন তারার হয়ে প্রতিবাদ করতো।

রিয়ানা তার ফুফির কথায় মুচকি হেসে বলে,
–তোমরা তো বিয়ে খেতে এসেছো। তাহলে ভালো করে বিয়ে খাও। আমার ভাইয়ের বউকে এভাবে কথা শোনানোর কি আছে বলো? আমার মা যেখানে কিছু বলছে না সেখানে তোমার কি দরকার এগুলো বলার।

শুভ্র ফুফি নিজের ভাগ্নির কথা শুনে রাগে কটমট করতে করতে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকায়। শুভ্রর বাবা খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,

–আপা, তোমার কি দরকার আরুমাকে এতোকিছু বলার? থাক না। কাল এতো ধকল গেলো তাই সকাল সকাল আসতে পারে নি। তুমি তোমার মতো খাও আর রিয়ানা! উনি তোমার ফুফি হয়। এভাবে বলবে না আর।

শুভ্রর ফুফি মুখ ভেংচি দিয়ে খাবারে মনোযোগ দেয়।
—–
যখন শুভ্রর ফুফি জানতে পারলো শুভ্রর সাথে আয়ানার বিয়ের কথা বলবে তখন ইনিয়েবিনিয়ে নিজের মেয়ের কথা বলেছিলো শুভ্রর বাবা তথা তার ছোট ভাইকে। এরপর যখন শুনলো আয়ানা শুভ্রকে বিয়ে করতে রাজী না তখন তো সে খুশিতে নিজের মেয়ের সাথে শুভ্রর বিয়ের কথা বলেই ফেলে কিন্তু শুভ্রর বাবা “মিস্টার রিয়াদ” ওই মূহুর্তে মনে হয়েছে আয়ানা নাহয় কিন্তু আরোহীকে নিজের পূত্রবধু করাই যায় এমনকি তার স্ত্রী “মিসেস কিয়ারা” তারও একই মতামত। মিস্টার রিয়াদ ছেলের মনের ভাব জানেন আয়ানার প্রতি তাই সেই কষ্টে কিছুটা মলম লাগানোর জন্য সে আরোহীকে শুভ্রর বউ করার প্রস্তাব রাখে। আরোহীর বাবা-মায়ের কোনো আপত্তি ছিলো না তবে তাঁদের আরোহীর মতামতের প্রয়োজন। তাই আরোহীকে জিঙ্গাসা করলে আরোহী রাজী হয়ে যায়। কারণ আরোহী শুভ্রকে ভালোবাসে অনেক আগে থেকে তবে শুভ্রকে এবং কাউকেই জানায়নি এ বিষয়ে।
আরো একটি কারণ হচ্ছে শুভ্রকে আয়ানা বিয়ে করতে মানা করে দেওয়ার পরে শুভ্র ধ্রুবের কথা এবং ডিটেইলস জানতে পেরে ধ্রুবের সাথে দুইদিন দেখা করে। প্রথম দিন তো ধ্রুবকে বলেই ফেলে, ” তারার (আয়ানা) থেকে দূরে থাকতে।” এগুলা যখন আয়ানা শুনে তখন আয়ানা সারারাত কান্না করে কাটিয়ে দিয়েছে। তারপরের দিন আবারো শুভ্র ধ্রুবের সাথে দেখা করে এবং সে যে আয়ানাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে তা জানায়। আরো বলে সে তারাকে (আয়ানা) বিয়ে করতে চায় কিন্তু তারা (আয়ানা) চায় না।
এগুলো যখন আরোহী জানতে পারে আর সাথে এটাও যে শুভ্রর বাবা-মা তাকে শুভ্রর বউ করতে চায়। তখন আরোহী আর মানা করেনি। আরোহী রাজী হয়ে যায় বিয়েতে। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাবে এবং নিজের বোনের ভালো থাকা নিশ্চিত হবে।

________

ধ্রুব এদিকে আয়ানাকে ফোন করেছে।
–“ধ্রুবতারা”!
আয়ানা কল রিসিভ করে ধ্রুবের মুখ থেকে “ধ্রুবতারা” সম্বোধন শুনে তার সব চিন্তা যেনো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
–ধ্রুবতারা, কিছু বলো? আরুর জন্য তোমার চিন্তা হচ্ছে?
আয়ানা ধ্রুবকে উদ্দিগ্ন হয়ে বলে,
–চিন্তা তো হচ্ছেই। আরু আমার জন্য এই বিয়েটা করেছে। এটা আমায় এবং সবাইকে বললেও আমি আমার বোনকে চিনি। আরু আমার কাছ থেকে যতোই লুকিয়ে রাখুক, আমি জানি আরু শুভ্র ভাইকে ভালোবাসে!

ধ্রুব অবাক হয়ে বলে,
–কি বলছো এগুলা! আরু শুভ্র স্যারকে ভালোবাসে? কিন্তু কিভাবে? আরুকে কখনো শুভ্র স্যারকে নিয়ে কিছু বলতে দেখি নি।

আয়ানা মলিন হাসে। এরপর বলে,
–আমাকে আগলে রাখতে যেয়ে সে নিজের অনুভূতি জাহির করা ভুলে গেছে। সবার কাছে আরু দূরন্ত, ডানপিঠে ও চটপটে। তবে আমার কাছে আরু আমার ছোট বোন কিন্তু ওর ব্যাবহারে মনে হবে আমি ওর ছোট! জমজ হলেও কয়েক মিনিটের ছোট আরু আমার। আর আরু আমাকে আগলে রাখে, একজন বড় বোন যেভাবে তার ছোট বোনকে আগলে রাখে সেভাবে। আমার জন্য সে ভালোবাসা পাবেনা জেনেও শুভ্র ভাইকে বিয়ে করেছে তবে আরোহী নিজে শুভ্র ভাইকে ভালোবাসে।
” আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি কিন্তু সে মানুষটা যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে তখন আমাদের কতটা কষ্ট হয় তা একমাত্র তারাই বুঝে। ”

আয়ানার কথায় ধ্রুবর মন কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। শুভ্রর সাথে যতবার ধ্রুবর দেখা হয়েছে ঠিক ততোবার শুভ্র ধ্রুবের দিকে ব্যাথিত নয়নে চেয়েছিল। একই মেডিকেলে একজন অধ্যায়নরত আর আরেকজন ডাক্তার। প্রায় প্রতিদিন একবার হলেও ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। কোথাও বসে কথা হয়েছে দুই বার তবে দেখা তো অনেকবার হয়েছে। ধ্রব ব্যাথিত সুরে বলে,

–শুভ্র ভাইয়ের চোখে আমি তোমাকে হারানোর স্পস্ট ব্যাথা দেখেছি। জানো, যখন আমরা জানতে পারি,
” আমাদের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কেউ তার মনের রানীর জায়গা দিয়েছে! তখন নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর ভয়ে মন ব্যকুল হয়ে উঠে। ” আমাদের অগ্রমস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের কাজ এগুলা।
ক্ষুদা, তৃষ্ণা, ঘাম, ঘুম, রাগ, পীড়ন, ভালোলাগা, ঘৃণা, উদ্বেগ, এসবের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে হাইপোথ্যালামাস।

আয়ানা ব্যঙ্গ করে বলে,
–ডাক্তার সাহেব! আমি বুঝতে পারছি, আপনি নিউরোসার্জন হতে চান। কিন্তু আমি আবার এই নিউরোসার্জন হতে চাই না!

আয়ানা সবসময় এমন করে কথা বলে যা শুনে কেউ কষ্টের কথা বলতে নিলেও হেসে ফেলে। ধ্রুব হাসতে হাসতে বলে,
–তুমি তাহলে কি হবা? অার্থোপেডিক্স? নাকি হার্ট সার্জন?

আয়ানা ভাব নিয়ে বলে,
–আমি মেডিসিনের এবং ব্লাড স্পেশালিস্ট হবো। হার্ট সার্জন এর মধ্যে আরু ইন্টারেস্টেড, আমি না।

ধ্রুব প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
–আজ তো আরুর রিসেপশন। আমি কি যাবো?

আয়ানার ভ্রু কুঁচকে আসে ফোনের অপর পাশ থেকে। তারপর বলে,
–তুমি কেনো যাবানা? আমার আম্মু-আব্বু, ভাইয়ারা আর আরু নিজে তোমাকে বলছে। তাহলে তুমি কেনো যাবানা?

ধ্রুব ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–কেউ হয়তো আমাকে দেখে সহ্য করতে পারবে না। কারো হৃদয়ে আমাকে দেখে রক্তক্ষরণ শুরু হবে।

আয়ানা বুঝতে পারে ধ্রুবের কথা। তাও সে ধ্রুবকে নিয়েই যাবে।
–দেখো ধ্রুব, তোমাকে যেতেই হবে। তুমি যে কারণে যেতে চাইছো না সেটা হলেও তোমার কিছু করার নেই। শুভ্র ভাইকে মেনে নিতে হবে সবটা। আমার বোনকে আমি কষ্ট পেতে দিবো না।

আয়ানা কথাগুলো যেনো রাগ নিয়ে বলে। আয়ানা আবার বলে,
–এতোদিন আরু আমাকে আগলে রেখছে। সবসময় আমার শক্তি হয়েছে। এখন থেকে আমার বোনকে আমি আগলে রাখবো। আর ধ্রুব তুমি জলদি আঙ্কেল-আন্টি কে নিয়ে চলে আসবে। রাখছি! অনেক কাজ পড়ে আছে।

আয়ানা ফোন রেখে দেয়।
______
জলদি করে নাস্তা শেষ করে শুভ্র টেবিল থেকে উঠে রুমে যায় আর দশ মিনিটের মাথায় ফর্মাল ড্রেসআপে ড্রয়িং রুমে আসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,