প্রিয় প্রহর পর্ব-০৪

0
604

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৪
দশ মিনিটের মাথায় ফর্মাল ড্রেসআপে ড্রয়িং রুমে আসে শুভ্র। শুভ্রকে ফরমাল ড্রেসআপে দেখে তার বাবার চোখ কুঁচকে ফেলেন। আরোহী ও রিয়ানা জানেন এমন কিছু হবে তাই তারা চুপ করে দেখে যাচ্ছে। শুভ্রর বাবা বলেন,

–এখন কি তুমি হসপিটালে যাচ্ছ শুভ্র?
–হ্যাঁ বাবা।
–আজকে তোমার রিসেপশন তা কি তুমি ভুলে গেছো? আজকে তোমার মামা-মামি আর আত্নীয়-স্বজন ও গেস্টরা আসবে। তুমি না থাকলে খারাপ দেখা যাবে।

শুভ্র একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–ঠিক আছে বাবা। আমি চেষ্টা করবো সময়ের মধ্যে চলে আসার। আসি আম্মু।

শুভ্র চলে গেলে আরোহী মাথা নুইয়ে নিজেকে তাচ্ছিল্য হাসে অতঃপর খাবার শেষ করে শুভ্রর রুমে যেটাতে এখন তারও সমান অধিকার আছে কিন্তু এই রুমে থাকা মানুষটার উপর যে নেই! ব্যলকনিতে যেয়ে নীল আকাশে দৃষ্টিপাত করে মনে মনে বলে,

” সত্যি! ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত। কাউকে হাসায় তো কাউকে কাঁদায়। কেউ মরীচিকার পিছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে যায় তাও তার সেই মরীচিকাকেই লাগবে। ”

আপনমনে হেসে আরোহী একটা উর্দু/হিন্দি শায়েরী আউরায়,
” হামনে জিসে চাহা, ভো চাহে কিসি অর কো!
হামনে জিসে চাহা, ভো চাহে কিসি অর কো!
খোদা কে লিয়ে, জিসে ভো চাহে,
ও ভি চাহে কিসি অর কো! ”

রিয়ানার আগমনে ভাবনার ছেদ ঘটে আরোহীর। রিয়ানা তার তিন বছরের মেয়ে রিপ্তিকে নিয়ে এসে আরোহীর সাথে পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
–কি ভাবছিস আরু? মন খারাপ? শুভ্রকে নিয়ে ভাবছিস?
–না! না! আপু। আমি এমনি নিজেকে নিয়ে ভাবছিলাম।
–নিজেকে আর কতো লুকাবি? আমি জানি কাল শুভ্র তোর সাথে নিশ্চয় রুড বিহেভ করেছে। শুভ্র তো বিয়েতে রাজী ছিলো না।
–আপু, উনারো কষ্ট হয় সেটা আমি বুঝতে পারি। তবে আয়ু যেখানে উনাকে ভাই ভাবে আর আয়ু ধ্রুবকে ভালোবাসে। সেখানে শুভ্র ভাইয়ের দখল দেওয়াটা ভালো দেখায় না।

আরোহী এগুলো বলে রিয়ানার কোল থেকে রিপ্তিকে নিজের কোলে নেয়। রিয়ানা মলিন হেসে বলে,
–শুভ্র তো বুঝতে পারেনি এসব কিছু হবে। ডাক্তারি পড়তে এব্রোড চলে গেল। আর ছয় মাস আগে ফিরে এখানে সরোয়ার্দিতে জয়েন করলো। তারপর তো দুই মাস আগে আয়ানাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। শুভ্র এটা বুঝতে পারেনি যে, “সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।”

এর মধ্যে ছোট রিপ্তি আরোহীর মুখে হাত দিয়ে বলে,
–আলু (আরু) মিমি! তুমি তালতে (কালকে) এয়েচো (এসেছো) তাহলে তালা (তারা) মিমিকে তেনো (কেনো) আনলে না?

রিপ্তির কথায় ওরা দুজনে হেসে দেয়। রিয়ানা তার মেয়েকে বলে,
–রিপ্তি আম্মু, তোমার আরু মিমি এখন তোমার শুভ্র মামার বউ। মানে আরু মিমি এখন মামি! মামি তো মামার সাথেই থাকবে।

রিপ্তি খুশিতে হাতে তালি দিতে থাকে। সে আয়ানাকে তার মামার মতো “তারা” বলে কিন্তু উচ্চারন সমস্যার কারণে “তালা” বলে। আরোহীকে সবার মতো আরু বলতে যেয়ে নামের দফারফা করে “আলু” বলে। রিপ্তি আয়ানার থেকে আরোহীকে বেশি ভালোবাসে কারণ আরোহী রিপ্তির সাথে দুষ্টামিটাও বেশি করে।

রিয়ানা আরোহীকে জলদি করে বলে,
–আরু, একটু পর মামা-মামিরা চলে আসবে। পার্লার থেকে মানুষজনও এখনি চলে আসবে রেডি হয়ে নিস। আমি যাই, দেখি তোর দুলাভাইয়ের কিছু লাগে কিনা।

রিয়ানা রিপ্তিকে রেখে চলে যায়। রিপ্তি আরোহীর সাথে খেলতে ব্যাস্ত।
_______
এদিকে শুভ্র হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে আছে। আজকে তার ডিউটি বলতে গেলে নেই। তাও সে একটু আগে একবার ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে এসেছে। একটা সার্জারিতে সে সিনিয়র ডাক্তারের সাথে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে থাকবে সাথে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাক্তার তো থাকবে। সার্জারিটা সে সকালে এসে রিকুয়েস্ট করে নিয়েছে।

হঠাৎ শুভ্রর কেবিনে আসে শুভ্রর কলেজ জীবনের ফ্রেন্ড শিলা এবং এখন সে তার কলিগ হয়। শিলা শুভ্রকে এভাবে বিমূর হয়ে বসে থাকতে দেখে বলে,
–বিয়ের বর! এতো উদাসীন কেন?

শিলার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে শুভ্রর। শিলা কিন্তু দরজায় নর করে এসেছে তাও শুভ্রর ধ্যানে বিঘ্ন ঘটে নি। শুভ্র শিলার দিকে তাকিয়ে বলে,
–ওহ তুই! বস।
শিলা বসে। এরপর বলে,
–জবাব দিলি না? এতো উদাসীন কেনো যে তোর কেবিনে চুরি হলেও তুই ধরতে পারবি না!

শুভ্র চেয়ারে গা এলিয়ে মলিন ভাবে বলে,
–যার মনটা আর ঠিক নেই তার এসব জিনিস পত্রের কি মূল্য থাকবে!

শিলা বুঝতে পারে তাও এখন শুভ্রকে এগুলো থেকে বের করতে হবে তাই বলে,

–তোর মনে আছে? এইচএসসি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার শেষ দিন তোকে আমি প্রোপোজ করেছিলাম। আমি কিন্তু তোকে কম ভালোবাসি নি! তোর সাথে দশম শ্রেণী থেকে ফ্রেন্ডশীপ আমার। তিন বছরে তোকে অনেকটাই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু পরিনাম কি হলো! তুই রিজেক্ট করলি আমায়। আমি সেদিন তুই রেগে ফ্রেন্ডশীপ নষ্ট করে চলে যাবার পর চিৎকার করে কেঁদে ছিলাম। সেদিন তুই ফিরিস নি। সেদিন তুই বলে গিয়েছিলি তোর ভালোবাসার মানুষ আছে। তারপর শুনলাম তুই এব্রোড চলে যাবি ডাক্তারি পড়তে। আমি কিন্তু তখনো তোর রিজেক্ট করার কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তুই চলে গেলি আর আমি তোর সাথে ফ্রেন্ডশীপটাও ধরে রাখতে পারি নি। এরপর আমার সাথে রিসাবের বিয়ে হয়। মেডিকেলের প্রথম বর্ষের পরেই। রিসাব আমায় প্রথম থেকে ভালোবাসতো। যেদিন প্রথম আমায় দেখে সেদিন থেকেই। আমিও আর রিসাবের ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করি নি। কারণ প্রত্যাক্ষিত হবার কষ্টটা আমি বুঝি। দেখ, এখন আমি রিসাবকে অনেক ভালোবাসি। আমদের এক মেয়ে আছে।

শুভ্র শিলার কথা শুনলো। শুভ্র ভাবে,
” এই শিলা মেয়েটা স্কুল থেকে আমাকে এতো হেল্প করতো আর আমার কিছু লাগলে, বলতে না বলতে তা হাজির করতো। আর তাকে আমি রিজেক্ট করে ফ্রেন্ডশীপ টাও নষ্ট করে চলে গিয়েছিলাম। ”

শিলা আবার বলে,
–ভাবিস না তোকে এগুলো বলছি বলে এখনো তোর প্রতি আমার ফিলিংস আছে! সত্যি বলতে আমার তোর প্রতি ফ্রেন্ডশীপ ছাড়া অন্য ফিলিংস আসে না। জীবনে আমি দ্বিতীয়বার এমন কাউকে ভালবেসেছি যে আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছে। আমার অতীত জেনে আমাকে গ্রহণ করেছে। “আই রিয়েলি লাভস এ লট টু রিসাব।”

শুভ্র ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–কিন্তু আমার সাথে যার বিয়ে হয়েছে সে আমার ভালবাসার মানুষটার জমজ বোন। একরকম চেহারা তবে স্বভাব যেনো দুই মেরুর মতো। আমি কিভাবে “তারা” কে ভুলবো বলতে পারিস?

শিলা মুচকি হেসে বলে,
–সময় দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। কথায় আছে না,
“টাইম উইল হিলস এভরিথিং!”
একসময় তুইও তোর অর্ধাঙ্গিনীকে অনেক ভালোবেসে ফেলবি।

শিলা চলে যায় সেখান থেকে। শুভ্র ভাবতে থাকে কিন্তু তখনি সার্জারির জন্য ডাক আসে তো শুভ্র চলে যায় সার্জারি করতে।
______
আরোহী তৈরি হচ্ছে রিসেপশনের জন্য। একটা হালকা মিষ্টি রঙের বেনারসি শাড়ি পড়েছে আরোহী। হালকা করে ফাউন্ডেশন, ফেস পাউডার, হালকা পিংক ব্লাসন, হাইলাইটার, চোখে কাজল, আইলাইনার সাথে হালকা পিংকিশ আইশ্যাডো, চোখের পাঁপড়িতে মাস্কারা দিয়ে ঠোটে বেবি পিংক লিপস্টিক দিয়ে সাজ কমপ্লিট করেছে আরোহী। পার্লারের মানুষজন যখন আরোহীকে আরো ভারী মেকআপ করতে চাইছিলো। একদম ব্রাইডাল মেকআপ তখন আরোহী নাছোড়বান্দা কারণ কালকের মতো সে ভারী মেকআপ করবে না। আরোহীর বাবা-মা ও আয়ানা এসে যখন দেখে এই অবস্থা তখন আয়ানা পার্লারের মানুষজনকে বলে হালকা করে যেভাবে বলছে সেভাবে মেকআপ করে দিতে।
মেকআপের পর্ব শেষ হলে যখন স্টোন জুয়েলারি গুলো পড়ানো হয়। আরোহীর চুল গুলো মাঝে সিঁথি করে একটু কার্ল করে ছেড়ে রেখেছে। মাঝ সিঁথিতে স্টোনের বড় টিকলি। তখন আয়ানা নিজে নিজের বোনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

আয়নাকে এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরোহী বলে,
–মুখ বন্ধ করা আয়ু। তোকেও আমার মত সেম লাগবে যদি একই রকম সাজ দিস তবে।

আয়ানা দাঁত বের হেসে করে বলে,
–এজন্যই তো তোর দিকে তাকিয়ে আছি। নিজের দিকে তো তাকিয়ে থাকতে পারবো না এভাবে হা করে!

আরোহী হেসে ফেলে আয়ানার কথায়।
আয়ানাকেও কিন্তু কম সুন্দর লাগছে না! আয়ানা নিজেও আজকে পিংক পড়েছে। পিংকি স্টোন বসানো জর্জেট শাড়ি। সাথেই স্টোনের জুয়েলারি। মেকআপ টাও আরোহীর মতো করেই শুধু চুলের স্টাইলটা ভিন্ন। আয়ানা সাইড সিঁথি করে সাইড টিকলি (নামটা ভুলে গেছি) দিয়েছে।

ধ্রুব তো আসার সময় পুরোটা সময় আয়ানার দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে এসেছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
যাদের আয়ানা ও আরোহীর নাম গুলো বুঝতে অসুবিধা হয়, আমি ব্র্যাকেটে কোনটা কাকে মিন করেছে লিখে দিচ্ছি।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।