প্রিয় প্রহর পর্ব-০৫

0
556

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৫
শুভ্রর বাড়ি ফিরতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাবার দশা। দুপুর দুইটার পর শুভ্র বাড়ি ফেরে। অনুষ্ঠানটা বাড়িতে হবার কারণে আরোহী স্টেজে দশ মিনিট শুভ্রকে ছাড়া বসে আবার নিজের রুমে ফেরত আসে। আরোহী ধরেই নিয়েছে শুভ্র আজকে ফিরবে না সময়মত। এদিকে গেস্টরাও শুভ্র কোথায় তা জিঙ্গাসা করছে। শুভ্রর বাবা শুভ্রর ইমারজেন্সিতে সার্জারি আছে বলে কাটিয়ে নিচ্ছে কিন্তু তাও কিছু মানুষের মুখ তো বন্ধ হয় না। শুভ্র নিজের রুমে এসে দেখে আরোহী ও আয়ানা দুজন বসে আছে। শুভ্র কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজের নজর সরিয়ে নেয়। আরোহী এটা খেয়াল করে সাথে আয়ানাও।

শুভ্র ওদেরকে কিছু না বলে টেবিলে উপর ওয়ালেট ও ফোন রেখে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার অন করে ভিজতে থাকে। আজ তার এতোদিনের ভালোবাসা ঠিকই তার ঘরে প্রবেশ করেছে কিন্তু বউ হিসাবে নয় শালী হিসাবে।
আয়ানা আরোহীকে একা রাখা সমীচীন মনে করে সেখান থেকে চলে যায়। আরোহী একই জায়গায় বসে মনে মনে ভাবে,

” জানিনা কোনোদিন আপনি আমাকে ভালোবাসবেন কিনা! তবে আমার মনে আপনার জন্য ভালোবাসা ফুরাবে না। অভিমানে অভিমানিনী হতে আমিও জানি তবে আপনি কি সেই অভিমান ভাঙ্গতে আসবেন! হয়তো আসবেন না। আপনার প্রতি অব্যাক্ত অনুভূতি আমি স্বভাবসুলভ ব্যাক্ত করতে পারিনি। আমি আয়ুর মতো নিজের অনুভূতি ব্যাক্ত করতে পারিনা। তাই বলে এটা না যে আমি ভালোবাসতে পারি না! আমিও আপনাকে ভালোবাসি এবং তা আমার দীর্ঘ সময়ের অনুরুক্তি। ”

শুভ্র শাওয়ার নিতে থাকার সময় বুঝতে পারে সে কাপড় ছাড়াই ওয়াশ রুমে চলে এসেছে। ওয়াশরুমের হ্যাঙ্গারে শুধু তাওয়ালটা আছে। এখন তাওয়াল পড়ে বাহিরে যাবে এটা তার কাছে কেমন যেন লাগছে! ওয়াশরুমের দরজা সামান্য খুলে রুমে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে তাওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে। আরোহী তখন ব্যালকনিতে গিয়েছিলো। আরোহীর কাছে ব্যালকনিটা অনেক সুন্দর লাগে। ব্যালকনির এক সাইড থাই গ্লাস দিয়ে কভার করে সেখানে ডিভান রাখা আছে। আর তার সামনে মানে ডিভানের পাশে খোলা থাই গ্লাস বিহীন জায়গায় বেলি, কাঠগোলাপ, পর্তুলিকা এসব ফুলের গাছ আছে। বারান্দার স্থানটা দক্ষিণ দিকে হওয়ায় অনেক সুন্দর বাতাস আসে।

শুভ্র ওয়াশরুম থেকে তাওয়াল পরিহিত অবস্থায় বের হয়ে, তাড়াতাড়ি করে রুমের দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দেয়। আরোহী ব্যালকনি থেকে হঠাৎ দরজা লক করার শব্দ পেয়ে রুমে এসে দেখে, শুভ্র কাবার্ড থেকে তার রিসেপশনের ড্রেসগুলো বের করছে আর শুভ্রর শরীরে নিম্নাংশে শুধু তাওয়াল পেঁচানো। আরোহী চোখ দুটো বন্ধ করে পেছোন ফিরে বলে,

–এই! আপনি ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগে দেখবেন না, রুমে বা ব্যালকনিতে কেউ আছে কিনা!

হঠাৎ কারও গলার আওয়াজে শুভ্র হকচকিয়ে ওঠে। জলদি করে পেছন ঘুরে দেখে আরোহী তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র তোতলানো স্বরে বলে,

–তুতুমি এখানে কি ককরো? আমি তো রুম চেক করেই নিয়েছিলাম। সাবধান পেছোন ফিরবে না। আর যেখান থেকে এখন এসেছো সেখানে ফেরত যাও।

আরোহী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে আবার ব্যালকনিতে চলে যায়। দশ মিনিটের মাথায় শুভ্র পরিপাটি হয়ে আরোহীকে ব্যালকনি থেকে ডাক দেয়। শুভ্র এক ঝলক আরোহীর দিকে তাকিয়ে নজর সরায়। এরপর একসাথে রুম থেকে বেরিয়ে স্টেজের উদ্দেশ্যে যায়।

হ্যাঁ! আরোহীকে শুভ্রর কাছে সুন্দর লাগছে। যতোই হোক রূপ তো একই। তবে এখন মনটাকে ভালোবাসার অপেক্ষা।
শুভ্র একটা জিনিস বিয়ের পর থেকে খেয়াল করেছে, আরোহী অনেকটা চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের রৌদ্রি ও চঞ্চল রূপ দেখায় তবে চুপচাপ থাকতে দেখা যায় এখন।

বর-বউকে স্টেজে দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। যারা এতক্ষন কানাঘুষা করছিলো, তারা চুপ হয়ে যায়। আরোহীর বাবা-মা ও ভাইদের য়ের সাথে শুভ্র ভাব বিনিময় করে। এতদিন তারা ছিলো শুধু মামা-মামি ও বড় ভাই।
ধ্রুব ও আয়ানা এখন এখানে নেই। তারা কোথাও কিছুটা চুপিসারে নিজেদের সময় দিচ্ছে যাতে অপরপাশে আরোহী-শুভ্র একে অপরকে স্বস্তি পায়।

বর ও বউয়ের খাবারের জন্য টেবিল সাঁজাতে থাকে আর তাই এখন স্টেজ অনেকটা ফাঁকা। শুভ্র আরোহীর পাশেই বসে আছে। মানুষজনের আনাগোনা কম দেখে শুভ্র আরোহীকে আস্তে আস্তে বলে,

–আমার জন্য নিজেকে পরিবর্তন করো না। তুমি যেমন ছিলে তুমি কেমন থাকো। কারো মতো হবার প্রয়োজন নেই তোমার। প্রতিটা মানুষ তার নিজের মধ্যে অন্যতম। নিজের গুণে গুণান্বিত হয় প্রত্যেকে। তুমি চঞ্চল ও রৌদ্রময়ী সেটাই ঠিক আছো।

আরোহী মুচকি হেসে বলে,
–আমি কারো জন্য পরিবর্তন হচ্ছি না। আর যদি পরিবর্তন হই, সেটা হবো নিজের প্রয়োজনে। একটা কথা মনে রাখবেন, “মানুষ পরিবর্তনশীল।” সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় মানুষের চিন্তা, চেতনা, ভাব, অনুভূতি সবকিছুর কিন্তু কিছু অনুভূতি অপরিবর্তনীয়। আমি বা আপনি যদি নিজে কঠোর চেষ্টা না করি তাহলে তা পরিবর্তন করা অসম্ভব। আমার মনের কিছু অনুভূতি আছে যেটাতে আমার নিজেরে কন্ট্রোল নেই। সেগুলোকে আমি শত চেষ্টা করেও পরিবর্তন করতে পারবো না। আর এখন এমন এক জায়গায় আছি যেখানে সেই চেষ্টা করাটা বেমানান।

শুভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরোহীর চোখের দিকে। কালো মণি যুক্ত চোখের ভাষা সে এখন বুঝতে পারছে না পুরোপুরি তবে এটুকু তার বোধগম্য হয়েছে যে কিছু তো লুকিয়ে আছে ওই দুটি চোখে। আরোহী চোখ নামিয়ে চাহনি সরিয়ে বলে,

–ভালোবাসার অনুভূতি সত্য বলতে অপরিবর্তনীয়। সেটা যদি সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে সেটা ভালোবাসা না! তবে হ্যাঁ, মিথ্যা মোহ কেটে যাওয়া ভালো। মিথ্যা মোহ ও ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার থেকে সেটা থেকে উঠে আসা ব্যাক্তির নিজের জন্য ভালো এবং সকলের জন্য। একটা কথা সত্যি,
” যা আপনার তা আপনার। ”
হিন্দিতে শুনেছিলেন না!,
” আগার কিসিকো দিল সে চাহো তো,
পুরি কায়নাত তুমহে উছছে মিলানে কি
সাজিস মে লাগি জাতিহে। ”
(হিন্দি বলতে পারলেও উচ্চারন লিখতে কষ্ট)

শুভ্র সবটা শুনছে। আরোহীর বলা দুটো কথার মমার্থ বুঝতে পারলেও কোনটা কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা বুঝতে পারছে না। দুটোই যদি শুভ্রর নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তাহলে আজকে সে কেন তার ভালোবাসার মানুষটা থেকে দূর হয়ে গেলো?

শুভ্র ও আরোহীকে খাবার খাওয়ার জন্য নিতে এসেছে। নীড় ও মেঘ দুই ভাই তাদের ছোট বোন ও বোনজামাইকে খাবার টেবিলে নিতে এসেছে। ধ্রুব ও আয়ানা টেবিলেই ওদের অপেক্ষা করছে।

শুভ্র টেবিলের কাছে যেয়ে ধ্রব ও আরোহীকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে তার বুকের ভিতরে সুক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভুব হয়। আরোহী শুভ্রের তাকানোর দিকে লক্ষ্য করে নিজে গিয়ে আয়ানার পাশে বসে। শুভ্রকে আরোহীর পাশে বসানো হয়।
নীড় গিয়ে শুভ্রর পাশে বসার পর মেঘ বসতে নিবে তার আগেই সাদিয়া এসে নীড়ের পাশে বসে। মেঘ তা দেখে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আর সাদিয়া দাঁত কেলিয়ে মেঘের দিকে চোখ টিপ মারে। এরপর মেঘ সাদিয়ার পাশে বসবে তার আগেই সাবিলা এসে সাদিয়ার পাশে বসে। মেঘ এবার সাবিলার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। সাবিলা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সাদিয়ার সাথে কথা বলছে।
আরোহী ও আয়ানা তাদের মেঘ ভাইয়ের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ! মেঘকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব নিজের পাশের চেয়ারটায় মেঘকে বসতে বলে। মেঘ সাবিলার থেকে চোখ সরিয়ে সাদিয়ার দিকে “খাইয়া ফালামু” লুকে তাকায়।

নীড় মেঘকে এভাবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
–মেঘ, বসে পর। এখানে টম এন্ড জেরীর মতো শুরু করিস না আবার।

মেঘ নীড়ের কথায় বসে পরে।

পাশের টেবিল থেকে মিস্টার মুনতাসির ও মিসেস নূর তাদের চার ছেলে মেয়েকে নিজেদের সঙ্গীর সাথে দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,