প্রিয় বেলা পর্ব-০২+০৩

0
558

প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২.+৩

চোখে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। তবে আশপাশটা কেমন ঝাপসা দেখছে সে। আঁখিজোড়া বড্ড জ্বালা করছে। মাথার সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় উঠে বসার জো নেই। ধীরেধীরে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। চারিদিকের অচেনা, অপরিচিত দেওয়াল, সিলিং আর মানুষগুলোকে দেখে বেলা প্রথমেই বুঝলো না সে কোথায় আছে। পরে যখন নিজের মাথার কাছে রেখাকে বসে থাকতে দেখল, তখনই যেন আস্তে আস্তে সব মনে পরতে লাগলো তার। জ্ঞান হারানোর মতো বিশ্রী কাণ্ড ঘটিয়ে ভীষণ লজ্জা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল বেলা। রেখা উদগ্রীব হয়ে তার মাথায় হাত বুলালেন। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—“এখন কেমন লাগছে বেলা? তুমি ঠিক আছো?”

বেলা ক্ষীণ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। আড়চোখে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো আশপাশটা। অনুষ্ঠানের সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সবার কেন্দ্রবিন্দু একমাত্র বেলাই। বেলার লজ্জা বাড়লো। গলার সঙ্গে থুতনি ঠেকিয়ে দৃষ্টি পুরোপুরি ঝুঁকিয়ে বসে রইলো সে। রেখা আবার বললেন,
—“ক্ষুধা লেগেছে বেলা? কিছু খাবে?”
বেলা অতি মৃদুস্বরে জবাব দিলো,
—“খেতে ইচ্ছে করছে না আন্টি—। আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?”

এ কথায় আয়াজ হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,
—“বেশিক্ষণ হয় নি। আধঘণ্টা। তুমি যে আমাদের দুই ভাইকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারাবে, আমরা তো কল্পনাও করিনি। আর কিছুক্ষণ জ্ঞানহীন থাকলেই তো তোমার মাকে ডাকতে যেতে হতো আমার।”

বেলা আরেকদফা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। আয়াজের কথার প্রতিউত্তরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। তবে চোরা দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে তাকালো একবার। আয়াজ আর আদ্র দুজন পাশাপাশিই বসে আছে। তাদের মধ্যিখানে নিশ্চিন্তে বসে বসে আপেল খাচ্ছে বিহান।
বেলা দৃষ্টি সরাতে গিয়েও সরালো না। ক্ষীণ পর্যবেক্ষণ করলো ওদের দুই ভাইকে। আয়াজ থেকে আদ্র একটু স্বাস্থ্যবান। হাতগুলো পেশিবহুল। আয়াজের মতো অত বেশি চিকন না। ওদের গায়ের রঙেও ক্ষীণ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই ফর্সা হলেও আদ্র উজ্জ্বল গৌর বর্ণের অধিকারী। বেলা এবার সরাসরি আদ্রর মুখপানে তাকানো চেষ্টা করলো। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকালো আদ্রও। বেলা হকচকালো, অপ্রস্তুত হলো। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো আবার। গাল দু’টো গরম হয়ে যাচ্ছে তার। ভারী ভারী লাগছে। সেই রক্তিম গালদু’টোর দিকেই একমনে চেয়ে রইলো আদ্র। মেয়েটার চেহারা ভীষণ মায়াবী। পানির ছটায় পাঁপড়িগুচ্ছ ভিঁজে একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। সুন্দর দেখাচ্ছে। আদ্রর চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। মনের খুব গোপনে সে আনমনেই আওড়ালো,
—“শুনো মেয়ে, তোমার চোখ দু’টো অদ্ভুদ সুন্দর। আমার চেয়ে চেয়ে দেখতে ক্লান্তি আসছে না।”

_____

পরেরদিন থেকে ভীষণ বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরপরই সুদূর হতে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক শোনা যাচ্ছে। স্বচ্ছ পানিতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গ্রাম বাংলায় এ দিনে কাঁচা মাটির ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। আকাশে কাক, পক্ষীর সাক্ষাত একেবারেই নেই। বেলা বিরক্ত ভঙ্গিতে ছাতাটা শক্ত করে ধরলো। সকালে বৃষ্টি কম থাকায় ভার্সিটির কাজে বের হয়েছিল সে। এখন মারাত্ত্বক বিপদে পরে গেছে। প্রবল বর্ষণের তেজে রাস্তা পুরো ফাঁকা। রিকশা, সিএনজি যাত্রীতে ভরপুর। মাঝে মাঝে বাস-স্টেশনের ছাউনিতে কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সঙ্গ দিতেই বেলাও দ্রুত পদে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো।

পরনের কামিজের নিচের অংশ ভিঁজে গেছে তার। ছাতা বন্ধ করে সেটা একটু ঝেরে নিলো বেলা। হঠাৎ চেনা এক ভরাট কণ্ঠ কানে এলো,
—“হ্যাঁ, আমি আসছি একটু পর। ওকে বেঁধে রাখ। একটু উত্তম-মধ্যম না খেলে ও সোজা হবে না।”

এটুকু শুনেই চটজলদি পাশ ফিরে তাকালো বেলা। নিজের পাশে আদ্রকে দেখে চমকে উঠলো খুব। কিন্তু বুঝতে পারছে না, এটা কি আদ্রই? নাকি আয়াজ? দ্বিধান্বিত চাহনিতে কিছুপলক সেদিকে চেয়ে রইলো সে। আনমনেই মুখ ফঁসকে প্রশ্ন করলো,
—“আপনি আয়াজ ভাইয়া নাকি আদ্র?”

আদ্র তখনো খেয়াল করেনি বেলাকে। প্রশ্ন শুনে বেলার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে ‘আসছি’ বলে কান থেকে ফোন নামালো। গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আদ্র।”
—“ওহ্! আমি বেলা। আপনার সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল আমার। চিনতে পেরেছেন?”

পকেটে ফোন ভরে আদ্র ঠাট্টার সুরে বললো,
—“চিনেছি। আমাকে দেখে যে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, আপনি সেই বেলা না?”
প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না বেলা। লজ্জাবোধে তৎক্ষনাৎ মাথা নুয়ালো। পরিচিত বিধায় এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীন বলে মনে হয় নি তার। তাই কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে এই লোক কি-না তাকেই অপমান করে দিলো! মনে মনে খুব রাগ হলো বেলার। আদ্রকে অসভ্য উপাধিতে ভূষিত করতে দু’বার ভাবলো না সে।

পরিবেশ তখন অল্প কোলাহল আর অল্প নিস্তব্ধতায় সম্মিলিত। তখনের অপমানের পর বেলা আর একটা কথাও বলেনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে। আদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে তা আবার চাপতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে বেলাকে। সরব খেয়ালে এলো, বেলা হাঁচি দিচ্ছে বারবার। একটু কেঁশে আদ্র প্রশ্ন করলো,
—“বৃষ্টি যখন সহ্য হয় না, তখন বাহিরে বের হয়েছেন কেন?”

বেলা উত্তর দেবে না, দেবে না করেও শেষে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”কাজ ছিল একটু।”
বলতে বলতে আবারও হাঁচি দিলো সে। হুট করে হাসি পেয়ে গেল আদ্রর। ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসলোও সে। তবে তা বেলার অজান্তে। বেলাকে বললো,
—“সেদিন তুমি বারান্দায় কি করছিলে?”

আদ্রের হঠাৎ তুমি বলা খেয়ালে আসেনি বেলার। সে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো,
—“কোন দিন?”
—“পরশু।”
বেলার চোখে একরাশ বিস্ময় এসে হাজিরা দিলো এবার। পিটপিট করে তাকিয়ে সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—“তার মানে, সেটা আপনি ছিলেন?”
—“অবশ্যই। আমি ছাড়া আর কে হবে?”

আদ্র এমন ভাবে বললো, বেলা না হেসে পারলো না। খিলখিল শব্দে বিস্তর হাসলো। আদ্র চেয়ে, চেয়ে দেখলো সে হাসি। নির্নিমেষভাবে, নিভৃতে। তার কেমন গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। মুগ্ধ হলো নেত্র। শান্ত কণ্ঠে আদ্র বললো,
—“বেলা, শুনছো? চোখের পাশাপাশি তোমার হাসিটাও ভীষণ সুন্দর।”

___________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

৩.
বেলা আঁটসাঁট হয়ে বাসের জানালা ঘেঁষে বসে আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। আবহাওয়া শীতল, ঠান্ডা বাতাস বহমান। এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো বেলা। ঠোঁট কামড়ে একবার আড়চোখে আদ্রকে দেখে হ্যান্ডব্যাগটা চেপে ধরলো। আদ্র কপালের চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে প্রশ্ন করলো, “আপনি এখন কোথায় যাবেন? বাসায় নাকি অন্য কোথাও?”

বেলা মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,
—“বাসাতেই যাবো।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো,
—“আপনি আমাকে একটু আগে তুমি বলে সম্মোধন করছিলেন। এখন আবার আপনি বলছেন কেন?”

আদ্র কপালে দৃঢ় ভাঁজ ফেলে তাকালো। মনে করার ভান করে বললো,
—“বলেছিলাম কি? মনে পরছে না তো!”
বেলা কথা বাড়ালো না। তার অস্বস্থি হচ্ছে। আদ্রের লম্বা হাতের সঙ্গে তার ছোট্ট কাঁধটা ক্ষীণ বারি খাচ্ছে বারবার। বাতাসের ঝাপটায় শিরশির করে উঠছে অনাবৃত হাত আর মুখশ্রী। আদ্রের তীক্ষ্ণ চোখ তা এড়াতে পারলো না। অনেকটা আদেশী স্বরে সে বললো,
—“জানালাটা বন্ধ করে দিন বেলা।”

বেলা অবাধ্য হতে পারলো না। হাত বাড়িয়ে জানালা শক্ত করে ধরলো। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে জানালা আটকানোর চেষ্টা করতেই অসফল হলো সে। বার দু’য়েক চেষ্টার পরও জানালা আটকাতে পারল না। শেষে করুণ চোখে আদ্রের দিকে তাকালো। আদ্র কপাল কুঁচকে তাকেই দেখছিল। বেলা আমতা আমতা কণ্ঠে বললো,
—“জানালাটা আটকে গেছে। আমি লাগাতে পারছি না।”
তবুও আদ্রের দৃষ্টি পরিবর্তন হলো না। হঠাৎ বেলার অতি নিকটে ঝুঁকে এলো সে। বেলা ভড়কে গেল। তৎক্ষণাৎ তটস্থ হয়ে চোখ খিঁচে নেত্রপল্লব বুজলো। নাসিকারন্ধ্রে আঘাত হানলো এক কড়া পুরুষালী পারফিউমের ঘ্রাণ। বেলার অস্থিরতা বাড়ার আগেই সরে এলো আদ্র। পরমুহুর্তে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে? এভাবে চোখ বন্ধ করে আছেন কেন?”

শুনে তাড়াতাড়ি চোখ মেলে তাকালো বেলা। আদ্র জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। আগের থেকে কম ঠান্ডা লাগছে এখন। তবে কম্পয়মান দেহটা আগে শীতের কারনে কাঁপলেও এখন আদ্রের কারনে মৃদু মৃদু কাঁপছে। ঢোক গিলে নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক করার প্রয়াস করলো বেলা। বললো,
—“কিছু হয়নি।”

আদ্রের সন্দেহ কমেনি। চেহারার গাঢ় ভাবটাই তা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। বেলা অপ্রস্তুত ভাবে আবার বললো,
—“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
আদ্র দৃষ্টি সরালো। অল্প হাসলো যেন। অদৃশ্য সেই হাসি বেলা চেয়ে থেকেও দেখল না। ফোনের স্ক্রীনে লাগাতার চাপ দিতে দিতে আদ্র বললো,
—“টাক মাথার, ভুড়ি ওয়ালা লোকটা আপনার বাবা না?”

হঠাৎ এহেন প্রশ্নে চোখ বড় বড় করে তাকালো বেলা। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“জি?”
—“আমি কাল আপনার বাবাকে দেখেছিলাম। রোদে নিজের টাক মাথা আরও উজ্জ্বল করছিলেন।”

বেলা মুহুর্তেই রেগে গেল। এই লোক কি বলছে এসব? তার সামনে তার বাবাকেই কেমন অপমান করছে! কঠিন গলায় সে ঘোর দিরুক্তি করলো,
—“আমার বাবার মোটেও টাক মাথা না।”

প্রতিউত্তরে আদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো মাত্র। জবাব দিলো না। পরের স্টপেই বাস থেমে গেল। বেলা অনেকটা তড়িঘড়ি করে হ্যান্ডব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে পরলো। অতি ক্ষুদ্র কণ্ঠে আদ্রকে বললো, “সরুন।”
আদ্র নিজেও দাঁড়িয়ে গেল। বেলা বাস থেকে নামতেই সেও পিছু পিছু নামলো। বেলা পাশে তাকালো একবার। আদ্র তার সাথে সাথেই হাঁটছে। ঠোঁট কামড়ে সে প্রশ্ন করলো,
—“আপনি কি আমার সাথে যাচ্ছেন?”

আদ্র কিছু বলবে তার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়ে ফোন কানে রাখলো সে। গম্ভীর গলায় বললো,
—“আসছি আমি। এতবার ফোন করার কি আছে?”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আসছি।”
তারপর বেলার দিকে তাকালো শান্ত চাহনিতে। বেলার কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
—“দাঁড়াও এখানে। আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি।”
বেলা মাথা নাড়ালো,
—“না, না। তার দরকার নেই। আর একটুই তো। আমি হেঁটে যেতে পারবো।”

আদ্র অসীম অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকালো। গাম্ভীর্যে ভরপুর গলায় শীতলতা নিয়ে শুধু এটুকু বললো, “বেশি কথা পছন্দ না।”

দু’তিনবার ডাক দিতেই রিকশা এসে থামলো বেলার সামনে। সে বিনা উচ্চবাক্যে উঠে বসলো রিকশায়। আদ্র পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করলো। রিকশা চালককে ভাড়া দিতে চাইলে বাঁধা দিতে নিলো বেলা। কিন্তু আদ্রের কড়া চাহনির নিষেধাজ্ঞায় আবার চুপ হয়ে গেল সে। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা চালকের দিকে এবার ঘুরে দাঁড়ালো আদ্র। বললো,
—“চাচা, উনাকে সাবধানে পৌঁছে দেবেন। কিছুক্ষণের জন্য উনার দায়িত্ব আপনাকে দিচ্ছি কিন্তু!”

মধ্যবয়স্ক রিকশা চালক তার পান খাওয়া ফোকলা দাঁতগুলো বের করে মুখ ভরে হাসলো। মাথা দুলিয়ে সায় দিতে লাগলো অনবরত।

__________

বাসায় ঢোকার আগ-মুহুর্তে আয়াজের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বেলার। তাকে দেখেই আয়াজ প্রসন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কেমন আছো বেলা? কালকে যে আমাকে আর ভাইকে ভয় পেয়ে বাসা থেকে বের হলে! তারপর তো আর দেখাই দিলে না।”

বেলা মনে মনে বিরক্ত খুব। এ দু’ভাই পেয়েছে কি তাকে? কালকের ঘটনার জন্য জায়গা নেই, স্থান নেই, যেখানে ইচ্ছে সেখানে অপমান করে যাচ্ছে। বেলা মুখটা একটুখানি করে জবাব দিলো,
—“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
—“খুব ভালো আছি। ইনফেক্ট একটু বেশিই ভালো আছি আজকে। তুমি বলো, এই বৃষ্টির মাঝে কোথা থেকে আসলে?”
—“ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম একটা কাজে।”

বলতে বলতে তার খেয়ালে এলো, আয়াজকে আজকে একটু বেশিই পরিপাটি লাগছে। চেহেরায়ও দারুণ খুশি খুশি ভাব! সেদিকে কয়েক পলক তাকিয়ে বেলা প্রশ্ন করলো,
—“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন আয়াজ ভাইয়া?”
আয়াজ যেন একটু লাজুক হাসলো,
—“হ্যাঁ।”
বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“আচ্ছা, আপনার আর আদ্র ভাইয়ার মাঝে কে বড়? আপনি?”
—“না। আদ্র ভাই বড়। তিন মিনিটের।”

বলে আরও একটু হাসলো আয়াজ। বেলা হাসফাস করতে লাগলো। আয়াজের সঙ্গে এখন দেখা হওয়ার পর থেকেই একটা প্রশ্ন খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তার। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভীষণ ইতস্তত করে বেলা বললো,
—“ভাইয়া, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”
—“বলো।”
—“আসলে, আমি আদ্র ভাইয়াকে কাল মারপিট করতে দেখেছিলাম। তাই– মানে, উনি কি সবসময় এভাবে মারপিট করেন?”

আয়াজের মুখাবয়ব মুহুর্তেই অল্প গম্ভীর দেখালো। গম্ভীর কণ্ঠে সে বললো,
—“আমরা দু’জনেই পড়ালেখায় খুব ভালো বেলা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও কেউ-ই ওই পেশায় যাই নি। এই যেমন, পড়ালেখা শেষ করে আমি এখন বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছি। আর ভাই রাজনীতি। আর রাজনীতিতে একটু আধটু মারপিট তো হয়ই। এটা স্বাভাবিক।”

বেলা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। আদ্র রাজনীতি করে? কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না তার। তার বিস্ময়কে আরেক দফা বাড়িয়ে আয়াজ হাসি-মুখে বললো,
—“তাহলে আবার পরে দেখা হবে তোমার সাথে। আমার গার্লফ্রেন্ড আসলে অপেক্ষা করছে তো! পরে দেড়ি হলে রাগ করবে।”
বেলা পিটপিট করে তাকালো। অবাক স্বরে বললো,
—“আপনার গার্লফ্রেন্ডও আছে?”

জবাবে বিস্তর হাসলো আয়াজ। কিছু বললো না। সে চলে যেতেই বেলাও পা বাড়ালো নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।

__________

গতকালের বৃষ্টির দরুণ রাত থেকে ভীষণ জ্বর বেলার। ১০২ ডিগ্রি। রবিবার জ্বর হওয়ার পর সোমবার এবং মঙ্গলবার রুম থেকে আর বের হয় নি বেলা। আজ জ্বরটা একটু সেরেছে। তবুও শরীরটা ক্ষীণ দূর্বল। আজ পরিবেশটাও মনোমুগ্ধকর। ছাদে দাঁড়িয়ে দক্ষিণা বাতাসের ছোঁয়া উপভোগ করতেও দারুণ লাগছে। হঠাৎ পাশের ছাদে নজর যেতেই আদ্রকে দেখতে পেল বেলা। তাদের বাড়ি থেকে আদ্রদের বাড়ির দূরত্ব খুবই কম। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদ সহজেই ডিঙিয়ে আসা যাওয়া করা যায়।
আদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে, সে জোড় করেই ঘুম থেকে জেগে এসেছে। পা দু’টো অল্প নড়বড়ে। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো এলোমেলো, চেহারায় ঘুমু ঘুমু ভাব থাকায় কি আদুরে দেখাচ্ছে! চোখ দুটোর সাদা অংশ লাল শিরায় ভরে গেছে। বেলা আদ্রকে দেখে আর ছাদে দাঁড়াতে চাইলো না। পাছে সে যদি তাকে আবারও অপমান করে?

যাওয়ার জন্য দু’কদম সামনে এগোতেই পেছন থেকে আদ্রের উচ্চকণ্ঠের ধমক শোনা গেল, “এই মেয়ে, দাঁড়ান।”
বেলা থমকে গেল। পেছন ফিরে আদ্রের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আদ্র তাকে আপাদমস্তক দেখে আবারও বললো,
—“এদিকে আসুন।”
না চাইতেও কয়েক পা এগোলো বেলা। আদ্র কড়া চোখে তাকালো, “আপনাকে এদিকে আসতে বলেছি বেলা। রেলিংয়ের কাছে আসুন।”

বেলা মুখ ফুলিয়ে রেলিংয়ের কাছেই দাঁড়ালো। আদ্র হুট করে কোনো কথা ছাড়া তার হাতের উলটো পিঠ ছুঁয়ে দিলো বেলার কপালে। পরক্ষণেই আবার ধমকে উঠলো,
—“জ্বর তো কমেনি। ঠান্ডার মধ্যে এখানে কি করছেন?”
বেলা ভাঙ্গা গলায় বললো, “ঠিক আছি আমি।”
আদ্র বেলার চোখের দিকে চাইলো। কুঁচকানো ভ্রুযুগল আরেকটু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আপনি মিথ্যে বলছেন বেলা। আপনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। আর বেলা কখনো ফ্যাকাশে হয় না। তাদের সতেজ-ই মানায়।”

বেলা ভারী নেত্রপল্লবে পিটপিট করে তাকালো। আদ্রর থুতনির দিকে দৃষ্টি আটকে গেল তার। থুতনিতে সদ্য ছোট্ট কাটা দাগ। দাগটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে আদ্রর গৌরবর্ণের মুখশ্রীতে। সৌন্দর্যের ঘাটতি এতটুকুও হয় নি। বরং আরও বেড়ে গেছে যেন। থুতনিতে চেয়ে থেকেই বেলা প্রশ্ন করলো,
—“আপনি কি রাজনীতিবিদ?”
—“হ্যাঁ, কেন?”

বেলা কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নেয়। ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছে রাজনীতিবিদরা খারাপ হয়। আদ্রও কি তাদের মতো খারাপ? হতেও পারে। রাজনীতিবিদদের বাহিরে কিছু আর ভেতরে অন্য কিছু। তাদের সহজে বিশ্বাস করতে নেই।
আদ্রর হাত এখনো বেলার কপাল ছুঁয়ে আছে। হাতটা আস্তে আস্তে কপাল থেকে গালে এনে রাখলো সে। বেলার চোখের ঠিক নিচে একটা পাঁপড়ি পড়ে আছে। বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে সেই নিকষকৃষ্ণ পাঁপড়িটি ফেলে দিলো আদ্র। তার চোখের চাহনি গভীর হলো। হলো মাদকতাপূর্ণ। কোমলস্বরে সে বললো,
—“আমি রাজনীতিবিদ হলেও খারাপ নই বেলা।”

___________________

চলবে~