প্রিয় বেলা পর্ব-০৪+০৫

0
511

প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৪.+.৫

মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পরে আছে। শীতল বাতাসের আগমন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কাকেরা কারেন্টের তারে বসে আবহাওয়ার এই পরিণতি দেখে অভিযোগ করে যাচ্ছে অবিরাম। আদ্রর ঠান্ডা হাত এখনো স্থীর হয়ে ছুঁয়ে আছে বেলার রক্তিম গাল। তার দৃষ্টি অস্বাভাবিক শান্ত। নরম গালদুটোয় আলতো চাপ দিয়ে বেলার মুখশ্রী নিজের মুখোমুখি আনলো সে। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে আপনার খারাপ মনে হয় বেলা?”

বেলার হুট করেই ভীষণ শীত, শীত লাগছে। পরনের মোটা চাদরেও শরীরের কম্পন বন্ধ হচ্ছে না। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। আদ্রর চোখ মুহুর্তেই বেহায়া হয়ে উঠলো। নিমগ্ন হয়ে সে চেয়েই রইলো সেই কাঁপা কাঁপা অধরের পানে। বেলা থেমে থেমে বললো,
—“আমার শীত লাগছে—। আমি ঘরে যাবো।”

আদ্রর ঘোর কাটল। মুচকি হেসে সরে দাঁড়ালো সে। প্রশ্ন করলো,
—“আপনার ফুল পছন্দ বেলা?”
—“হ্যাঁ, খুব।”
—“কোন ফুল পছন্দ?”
—“পদ্ম।”

বেলার কালো, ধূসর মিশেলের চুলগুলো অত বড় না। পিঠ অব্দি। তবে বেশ ঘন, মোটা আর লতানো। খোপা করে সেগুলো ঘোমটার আড়াল করে রেখেছে সে। পাতলা ওড়নার ভেতরে ক্ষীন দৃশ্যমান সেই খোপার দিকে চেয়ে আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
—“মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিন তো বেলা।”
বেলা যেন বুঝলো না। জিজ্ঞেস করলো, “জি?”
আদ্র ভ্রু কুঁচকালো। এগিয়ে এসে নিজেই সরিয়ে দিলো ঘোমটা। একটানে ক্লিপ খুলে ফেলতেই অনাবৃত হলো চুলগুলো। শোভা পেল পিঠজুড়ে। আদ্র অভিযোগের সুরে বললো,
—“আপনি বেশি কথা বলেন বেলা। কথা শুনেন না।”

এহেন আচরণে বেলা ভীষণ ভাবে ভড়কালো। বিমূঢ় হয়ে পিটপিট করলো তার নেত্রপল্লব। সিঁড়ি ঘরের ওপাশে যেতে যেতে আদ্র আদেশী কণ্ঠে সাবধান করে উঠলো, “জায়গা থেকে এক পাও নড়বেন না বেলা। আমি এক্ষুণি আসছি। আর খবরদার, চুল বাঁধবেন না।”

বেলা তৎক্ষণাৎ বলতে চাইলো,
—“কিন্তু আমার ক্লিপটা তো দিয়ে যান!”
কিন্তু ততক্ষণে আদ্র চলে গেছে ওপাশে। ক্ষুদ্র কণ্ঠে বলা বেলার কথাটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি তার। যাওয়ার প্রায় দু’মিনিটের মাথায় আদ্র আবারও এলো বেলার সম্মুখে। হাতে টকটকে লাল রঙের দু’টো পদ্ম। পদ্মগুলোর দিকে প্রফুল্ল চোখে চেয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“পদ্মগুলো কোথায় পেলেন আপনি? কি সুন্দর এগুলো!”

বেলার আনন্দ দেখে দূর্বোধ্য হাসলো আদ্র। সরব বেলার চুল গলিয়ে ঘাড়ের কাছে হাত নিয়ে গেল সে। দূরত্ব কমিয়ে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। বেলার হাসি উবে গেছে। বিমূঢ়তায় আঁখিদুটি বিশাল আকার ধারণ করেছে। হৃদযন্ত্রের ধকধক শব্দ আদ্রও শুনতে পাচ্ছে বোধহয়। বেলা ভীতু স্বরে বললো,
—“কি করছেন আপ—?”

বাক্যটি শেষ হওয়ার পূর্বেই হাতের একটি পদ্ম বেলার কানে অতি যত্নে গুঁজে দিলো আদ্র। পরক্ষণেই সরে এলো সে। অন্য পদ্মটি বেলার হাতে ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
—“ভয় পেলে আপনাকে দারুণ লাগে বেলা।”

বেলা হতবাক, চমকিত। কিছুপলক আদ্রের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বললো,
—“আপনি আধপাগল।”
—“একদম না। আমি পুরোপাগল।”

__________

বেলার ফুফা আইয়ুব এহতেশাম। বেলার বাবা সায়েদ থেকে চারগুণ ভালো অবস্থাপূর্ণ তিনি। তার ছেলে আমেরিকার কোন ব্যাংকে চাকরি করে। তাদের টাকার যেমন অভাব নেই, অহংকারেরও তেমনি ঘাটতি নেই। বিকালের প্রথম ভাগে হঠাৎই তার আগমন ঘটে সায়েদ সাবেহের বাড়িতে। এসেই তুমুল ঝগড়া শুরু করে দেন তিনি। চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে বেলা দৌঁড়ে ড্রইংরুমের কাছে আসে। আইয়ুব এহতেশাম তখন চেঁচিয়ে বলছিলেন,
—“আর অপেক্ষা করা সম্ভব না আমার পক্ষে। আমার টাকা কখন দিবি তুই? নেওয়ার সময় তো ঠিকই ড্যাংড্যাং করে নিয়েছিলি।”

সায়েদ সাহেব লজ্জায়, অপমানে মাথা হেট করে বসে আছেন। নম্র স্বরে তিনি অনুরোধ করলেন,
—“আর কয়টা দিন সময় দেয় আমায়। আমি জলদিই দিয়ে দিব।”
আইয়ুব এহতেশাম এবার দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলেন,
—“কিসের কয়টা দিন? বাড়ি বানাবি বলে টাকা নিয়েছিলি তিন লাখ। দেড় বছর হচ্ছে, এখনও টাকা দেওয়ার নাম নেই। তুই কি চাস আমি পুলিশ ডাকি? অথবা তোর এই সাধের বাড়ি নিজের নামে লিখে নেই?”

বেলা তার বাবার অসহায় মুখখানা দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। আইয়ুন এহতেশামের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
—“বাবা বলেছে না টাকা দিয়ে দিবে? তবুও এত চেঁচাচ্ছেন কেন? ভুলে যাবেন না, আপনার দূঃসময়ে আমারই কিন্তু সাহায্য করেছিলাম আপনাকে। আর রইলো তুই-তুকারির কথা। আমার বাবা আপনার চেয়ে অনেক বড়। সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।”

আইয়ুব এহতেশাম তেঁতে উঠলেন,
—“এত পাকনামি করবা না বেলা। টাকা দিতে পারো না আবার এত তেজ আসে কোথা থেকে তোমাদের? আমার ছেলে তোমারে পছন্দ করতো। একমাত্র হৃদের কথায় তোমাদের দয়া করে টাকা দিছিলাম আমি। ভাবছিলাম তোমার বাবা আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিবে। কিন্তু এ পল্টিবাজ তো নিজের মেয়ের মতামতের বিরুদ্ধেই যাবে না। মেয়েরে পড়ালেখা কইরা বেয়াদব বানাবে।”

বেলা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“আপনি যান এখান থেকে। আপনাকে যেন এ বাসায় দ্বিতীয় বার আর না দেখি। যখন সময় হবে আমরা টাকা দিয়ে দেব।”
আইয়ুব এহতেশাম আর বসলেন না। চলে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
—“কাজটা ভালো করলা না বেলা।”

আইয়ুব এহতেশাম চলে যেতেই সায়েদ সাহেবের দিকে তাকালো সে। তিনি মলিন মুখে মাথা নিচু করে আছেন। তা দেখে সূদীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা।

__________

আকাশে আজ রোদ উঠেছে। রাস্তায় রিকশার আনাগোনাও বেশি। তবুও রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে না বেলার। ফুটপাতে হাঁটার মজাই আলাদা। চারপাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার মাঝেই হঠাৎ ভরাট কণ্ঠের ডাক শুনতে পেল সে, “বেলা।”

বেলা দাঁড়িয়ে গেল। নিমিষেই ভরাট কণ্ঠের মালিককে চিনে ফেললো সে। ব্যক্তিটি তার অতি পরিচিত একজন। পেছনে ফিরে আদ্রকে দেখে তার ধারণা যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিলে গেল। আদ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশাপাশি দাঁড়ালো। বেলার অনাদৃত হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রশ্ন করলো,
—“কোথায় যাচ্ছেন?”
বেলা তার হাত ছাড়াতে চাইলে ছাড়লো না আদ্র। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
—“থাকুক।”
তারপর আবার একই প্রশ্ন করতেই বেলা মৃদু স্বরে বললো,
—“টিউশনে।”
—“এভাবে হেঁটে হেঁটে?”
—“হ্যাঁ।”

আদ্র বেলাকে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
—“তবে চলুন। আপনাকে পৌঁছে দেই।”
—“তার প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো।”
আদ্রের একরোখা উত্তর, “কিন্তু আমার প্রয়োজন আছে।”
—“আপনি শুধু শুধু কষ্ট করছেন।”

আদ্র দাঁড়িয়ে গেল। তার গভীর চোখ দুটো বেলার মুখপানে স্থির করলো। মাথার ঘোমটাটি টেনে চোখ, নাক ঢেকে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আমারটা আমি বুঝে নেব। আপনার বুঝতে হবে না।”

__________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

৫.
ল্যাপটপে টানা কয়েক ঘণ্টা কাজ করে আদ্রর ঘাড়টা ব্যথায় টনটন করে উঠলো যেন। পরনের হালকা পাওয়ারি চশমা খুলে ঘাড় এদিক-ওদিক নাড়ালো সে। শেষের ই-মেলগুলোয় একদফা চোখ বুলিয়ে ল্যাপটপটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো। টেবিলে এখনো কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে। যাক! ঠান্ডা হয় নি এখনো। টেবিল থেকে কফি নিয়ে বারান্দায় পা বাড়ালো আদ্র। আজকে একটু রোদ উঠেছে। বৃষ্টির দেখা নেই সকাল থেকে। আশপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ পাশের ছাদে চোখ আটকে গেল তার। আদ্রর বারান্দা থেকে ছাদটি সরাসরি দেখা যায়। রেলিংয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে, বেলা উদাস মনে চেয়ে আছে আকাশ পানে। আঁখিজোড়ায় একরাশ বিষণ্ণতা কিংবা যন্ত্রণা। আদ্র চেয়েই রইলো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেল এ ফাঁকে। খাওয়া আর হলো না।

আয়াজ তখন আদ্রের রুমে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচানো গলায় বললো,
—“ভাই তোর ল্যাপটপ একটু নিচ্ছি। আমারটায় চার্জ নেই।”
আদ্র শুনলো। ঘোর কেটে গেল তার। জবাব দিলো,
—“টেবিলে আছে। নেয়।”
ওমনি আগের ন্যায়ই আয়াজের কণ্ঠ ভেসে আসলো, “পেয়েছি।”

আদ্র ভাবলো আয়াজ চলে গেছে। বেলার দিকে আবারও আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কফির মগে চুমুক দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললো। কফি না, এ যেন ঠান্ডা পানসে পানীয়। বিচ্ছিরি স্বাদ। কোনোমতে মুখেরটুকু গিলে ছোট্ট টেবিলটায় কফির মগটা রেখে দিলো সে। সরব পেছন থেকে আয়াজ বলে উঠলো,
—“ভাই, ওটা বেলা না?”

আদ্র ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুই যাস নি?”
আদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে আয়াজ উত্তর দিলো,
—“না। তুই কি করছিস দেখতে এলাম। এখন আবার বেলার সাথেও দেখা হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? দাঁড়া ডাক দেই।”

বলে ডাক দিতে নিলেই তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র, “সমস্যা কি? নিজের কাজে যা।”
আয়াজ অবাক হলো খুব, “সমস্যা মানে? আর তুই আমাকে এভাবে ধমকাচ্ছিস কেন ভাই? ভুলে যাস না, তুই আমার মাত্র তিন মিনিটের বড়।”
আদ্র বিরক্ত গলায় বললো,
—“তোর নটাংকি শেষ হয়েছে? নাকি যাবি?”
—“শেষ হয় নি। আমি এখন বেলাকে ডাকবো এবং তোর সামনেই ওর সাথে কথা বলবো।”
—“মার খেতে না চাইলে এখান থেকে যা আয়াজ।”

কথা বলার মাঝে বেলার দিকে না চাইতেও চোখ চলে গেল আদ্রর। বেলা তখন কেন যেন হাসছিল। মলিন হাসি। তবুও কি অপরুপ লাগছিল! আদ্র তার দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না। বেলায় স্থির হয়ে গেল। আটকে গেল খুব বাজে ভাবে। বুঝে পেল না, মেয়েটাকে তার এত কেন ভালো লাগে? মেয়েটা তো স্বাধারণ। খুবই সাধারণ। ভাবনার অকুল পাথারেই আয়াজ নাক কুঁচকে ঠাট্টার স্বরে বললো,
—“এই তুই বেলার দিকে এমন কুদৃষ্টি দিচ্ছিস কেন? মেয়েটাকে তো অসুস্থ বানিয়ে দিবি। তাড়াতাড়ি নজর সরা। সরাচ্ছিস না কেন?”

আদ্র মোটেও বিরক্ত হলো না এবার। বরং শান্ত চাহনিতে আয়াজের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“কেন বিরক্ত করছিস?”
আয়াজ উত্তর দিলো না। আড়মোড়া ভাঙ্গার ভঙ্গিতে হাত দুটো মেলে চলে গেল সেখান থেকে।

__________

রাস্তার একপাশে এক আধবয়সী মহিলা ঝাঁড়ু দিচ্ছে। অনলে ধূলোবালির সংমিশ্রণ। রোদের তেজ প্রখর। নিজ এলাকায় ঢুকতেই মহিলাটির দিকে নজর পরলো বেলার। সেমুহুর্তে উনিও তাকালেন। অমায়িক হেসে বললেন,
—“ক্যান আসো বেলা মা? টিউশনের থেইকা আসছো নাকি?”
বেলাও হেসে জবাব দিলো,
—“জি খালা। কিন্তু আপনি এসময় ঝাড়ু দিচ্ছেন যে? ঝাড়ু তো সবসময় সকালে দিতে দেখেছি আপনাকে।”
—“কি আর কমু মা। আমার বউ পোয়াতি ছিল। কাল রাইতে পোলা হইছে একখান। ওইহানে ছিলাম কাল রাইত থেইকা। মালিকরে ফোন কইরা কইছিলাম আইজকা আইতে পারুম না। হেয় কয়, তাইলে টাকা কাইটা নিবো। দিতো না। তাই আইতে হইছে এই বিহালে। আমরা গরিব মানুষ। কি আর করমু।”

বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। উনার গায়ের শাড়িটি বেলা কালকেও পরে আসতে দেখেছে, আজও একই শাড়ি পরে এসেছেন তিনি। মুখটা শুকিয়ে কাঠ। শরীরের একেকটা হাড্ডি গোনা যাবে। বেশ জীর্ণশীর্ণ। বেলার খুব মায়া হলো। মলিন গলায় সে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কিছু খেয়ে এসেছেন খালা?”
তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন যেন। ঝাড়ু দিতে মনোযোগী হয়ে বললেন, “আর খানা! বউয়ের পিছেই সব টাকা চইলা যাইতেছে। খাওয়ানের টাকা পামু কই।”

বেলার ব্যাগে দুই’টা কলা ছিল। টাকা অত নেই। ব্যাগ থেকে কলা দু’টো নিয়ে মহিলাটির দিকে এগিয়ে গেল সে। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ডান পায়ে চাপ দিতে পারছে না। পাটা আলগা করে হাঁটতে হচ্ছে। তা দেখে খালা অবাক হয়ে বলে উঠলেন,
—“এভাবে হাঁটতাছো ক্যান বেলা? তোমার পাও থেইকাও তো অনেক রত্ত পরতাছে। ছিলছে কিভাবে?”
বেলা একটু করে হাসলো,
—“রিকশা থেকে নামার সময় আঁচড় কেটে গেছে খালা। ঠিক হয়ে যাবে। আপনি এ কলা দু’টো রাখুন। কাজ শেষে খেয়ে নিবেন। নিন।”

খালা কলাগুলো নিলেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল টলমল করে উঠলো উনার। মুখ ভরে হেসে মাথা দুলালেন।

__________

পায়ের ব্যথা বাড়ছে। হাঁটতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে বেলার। এই বিপদের মুহুর্তে পথটাও যেন শেষ হচ্ছে না। একটু দূরেই আয়াজকে দেখতে পেল সে। আদ্রও ছিল। সে গাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগী মুখশ্রীতে ফোনে কথা বলছে খুব উচ্চস্বরে। যা বেলা অতদূরে থেকেও ক্ষীণ স্পষ্ট শুনতে পারছে।
আয়াজ একদম সামনে পরে যাওয়ায় তাকে না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে পারলো না বেলা। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বললো,
—“কেমন আছেন আয়াজ ভাইয়া?”

আয়াজ মিষ্টি হেসে বললো,
—“ভালো আছি। কিন্তু তুমি কিভাবে চিনলে আমি আয়াজ?”

বেলা অপ্রস্তুত হলো। চোখ পিটপিটালো বেশ কয়েকবার। থেমে থেমে বললো,
—“আপনি আদ্র ভাইয়া থেকে চিকন। ওভাবেই চিনেছি।”
আয়াজ দুষ্টু হাসলো। ভ্রু নাঁচিয়ে বললো,
—“কিন্তু তা তো আমরা একসাথে থাকলে বুঝবে। অত দূরে দাঁড়ানো আদ্র ভাইকে আমার সঙ্গে পার্থক্য করা, আমার মতে একদেখায় অসম্ভব। কেউই এ পর্যন্ত করতে পারেনি। তাই— আমাকে আসলে কিভাবে চিনলে তা সত্যি সত্যি বলে দাও তো বেলা।”

বেলা ভড়কালো, হকচকালো। ভীষণ বাজে ভাবে ফেঁসে গেল যেন। লজ্জায় গাল রক্তিম হচ্ছে। তার আভাস তীব্র ভাবে পাচ্ছে সে। জবাবে কিছুই বলতে পারলো না বেলা। শুধু হাসফাস করতে লাগলো। আয়াজ ঠোঁট চেপে হেসে আবার বললো,
—“বলছো না যে? তাড়াতাড়ি বলো বেলা। কুইক!”

বেলা আড়চোখে একবার আদ্রর দিকে তাকালো। ফোন কানে সে ওরদিকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। বেলার অস্বস্থি হতে লাগলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আয়াজ আবারও তাগাদা দিতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে বেলা একনিশ্বাসে বলে ফেললো,
—“আদ্র ভাইয়ার বাম চোখের পাশে একটা কাটা লাগ আছে। ওটা আপনার নেই।”

হাসির প্রবল আওয়াজ কানে ঝংকার তুলতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। লজ্জায় এবার মাথা একদম নিচু করে ফেললো। আয়াজ নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে সশব্দে হাসছে। বেলা তার অস্বস্থি বাড়তে দিলো না। চলে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েক কদম আগাতেই পেছন থেকে আদ্রের ভরাট কণ্ঠ আটকে দিলো তাকে।

—“দাঁড়ান। ব্যথা পেয়েছেন কিভাবে বেলা?”

বেলা দাঁড়াতে চাইলো না। কোনোমতে উত্তর দিলো,
—“রিকশা দিয়ে নামতে গিয়ে।”
এরপর আবারো হাঁটতে নিলে ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র,
—“আপনাকে দাঁড়াতে বলেছি বেলা।”
বেলা মৃদু কেঁপে উঠলো। পেছনে ফিরার আগেই আদ্র তার পাশাপাশি এসে হঠাৎ বুকে আগলে নিলো তাকে। একহাতে কোমড় আঁকড়ে ধরলো। অন্যহাতে মাথা চেপে ধরলো বক্ষস্থলের ঠিক বা’পাশটায়। আকস্মিক হওয়ায় বেলা ভয় পেল খুব। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে বলতে চাইলো,
—“কি করছেন আদ্র ভাইয়া?”

কিন্তু আদ্র বলতে দিলো না সেকথা। আরও শক্ত করে ধরে কোমলস্বরে বললো,
—“ওড়না দিয়ে মুখ ভালোভাবে ঢেকে নিন বেলা। রোদে তাকাতে পারছেন না আপনি।”

__________

চলবে~