প্রীতিলতা পর্ব-০৫

0
339

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#৫ম_পর্ব🍂

মানুষের জীবনে যত রাগ অভিমান থাকুক না কেন সে অভিমানের উচ্চতা যদি পাহাড় সমান হয় তবে কিছু প্রিয় মুখ আছে যা চোখের সামনে জীবন্ত ভেসে উঠলে মুহূর্তের সব রাগ অভিমানের বরফ গলে পানিতে পরিণত হয় এবং মনকে শীতল করে দিয়ে যায়।

একই যুক্তি আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলো। 12 দিনের সমস্ত রাগ অভিমান এই প্রিয় মুখগুলো দেখে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। মাত্র ১২ দিন তাদের সাথে দেখা হয়নি আমার কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে দীর্ঘ 12 দশক পর আমি তাদেরকে দেখতে পেলাম।

চোখের সামনে মা-বাবাকে দেখে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কোথায় আছি, কি করছি, সবাই কি ভাববে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার এখন এই উষ্ণ আলিঙ্গনটার খুব প্রয়োজন ।ব্যাস…

উফ বুকের ভেতর এত শান্তি লাগছে কেন? মনে হচ্ছে যেন এতদিনের খা খা মরুভূমির মাঝে এক পশলা রহমতের বৃষ্টি। যা শরীর ও মনের সকল দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তিকে নিজের মাঝে শুষে নিয়ে সতেজতায় ভরিয়ে দিচ্ছে আমার সারা শরীরকে।

হাউ মাউ করে কাঁদতে পারিনা কিন্তু অতি আবেগে চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হতে ভুল করে না।। চোখ থেকে পানি ঝরছে অবিরাম মাকে জড়িয়ে রেখে বাবার দিকে তাকালাম । বাবার চোখ জোড়াও অশ্রুতে টুই টুম্বুর।

এই চোখের অনেক ভাষা আছে। মেয়ের বাবা হওয়ার ব্যর্থতার ভাষা। মেয়েকে এখন তিনি পাত্রস্থ করেছেন।দেখতে ইচ্ছে করলেই যে যখন তখন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে হানা দেওয়া যায় না। আত্মসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে নাকি।

আব্বু আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,

— খালি মায়ের মাঝে আটকে থাকলে হবে। এদিকে যে আমিও এসেছি তোর ভাইও এসেছে আমাদের দিকে একটু তাকাবি না।

— তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। এতদিন একবারও আমার কথা মনে পড়েনি তোমার তাই না।

— মনে পড়েছে তো আমার আম্মাকে। প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। কিন্তু সত্যিই আমি অনেক কাজে আটকে গিয়েছিলাম। এবারের মত তোমার ছেলেটাকে মাফ করে দাও। আর এমন ভুল হবে না।

বাবা আমার চোখমুখ মুছে দিতে দিতে বললেন,

—এবার তো কান্না থামান। অনেক তো কাঁদলেন। মুখটা একেবারে লাল করে ফেলেছেন। এত দূর থেকে নিশ্চয়ই আপনার কান্না দেখার জন্য আসি নাই। আসছি আপনার হাসি মুখটা দেখতে।

আম্মু ও চোখের পানি মুছে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমার শাশুড়িকে বললেন,

— আসলে এতদিন এভাবে মেয়েটা আমাদেরকে ছেড়ে কখনো থাকে নি তো তাই এমন পাগলামি করছে কিছু মনে করবেন না ভাবি।

আমার শাশুড়ি মা সামনে এগিয়ে এসে বললেন,

— এভাবে বলে আমাদেরকে লজ্জা দিবেন না ভাবি। যেখানে বিয়ের পরের দিনই মেয়েকে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। সেখানে আমরা ওকে বারো দিন আটকে রেখেছি। আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ভেতরে আসুন আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি।

সত্যি বলতে মা বাবাকে আমার পরিবারের সাথে করা আছে আচরণ দেখে প্রতিনিয়ত আমি মুগ্ধ হচ্ছি। আর এতদিনে নিজের মধ্যে গড়া ভুল ধারণা একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে আমার‌।

আমি মনে করেছিলাম এরা আত্ম অহংকারী, সৌন্দর্যের পূজারী, অর্থলোভী কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা আমার ভুল ধারণা। সম্পূর্ণ ভুল কিনা বুঝতে পারছি না। আম্মু আব্বু ভিতরে চলে গেলাম তাদের সাথে।

তখন আমার ভাই প্রীতম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ক্লাস নাইনে পড়ে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। আর

আমার ক্রাইম পার্টনার। আমি যেমন ওর সকল হাঁড়ির খবর জানি। তেমনি ভাবে ও আমার সকল হাড়ির খবর জানে। যখন আমাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া লাগতো তখনই একজন আরেকজনের হাড়ি ফাটানো শুরু হতো।

গলা কাঁপছে আমার ভাইয়ের অনেক কষ্টে বলল,

— আমি তোকে অনেক মিস করি আপু। তুই চল আমার সাথে। আমি আর কখনো কোনো কিছু নিয়ে তোর সাথে ঝগড়া করবো না। তোর রুম তোর ই আছে। সবকিছু সেই ভাবে গোছানো। একটা জিনিস আমি নষ্ট করিনি। তুই আবার ফিরে চল না আপু।

নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য হয়নি আমার। এবার সত্যিই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম ভাইকে জড়িয়ে ধরে। পৃথিবীর নিয়মটা এত কঠিন কেন? আর সব নিয়মই কেন মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য।

সৃষ্টিকর্তা তো জানেন মেয়েদের মন কতটা স্পর্শ কাতর কতোটা আবেগপ্রবণ। তারা যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না।

__________🌺🌺_________

ভাইকে নিয়ে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করতেই সে সরাসরি গিয়ে সাফওনের পাশে বসে পড়ল। আতঙ্কে আমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। উনি যদি প্রিতমের সাথে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করেন।

কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে তিনি প্রীতমের সাথে খুব ভালোভাবে কথা বললেন। এখন আবার দুজনের মধ্যে কি ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। দুজনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে স্বস্তি পেলাম।

এগিয়ে গেলাম ডাইনিং টেবিলের দিকে দেখলাম মা সবাইকে সার্ভ করছে। আমি গিয়ে মাকে হাতে হাতে সাহায্য করা শুরু করলাম। সবাইকে সার্ভ করার পর আমি মাকে বললাম,

— মা আপনি এবার বসে পড়ুন খেতে। অলরেডি ৮ টার বেশি বাজে।

— হ্যাঁ বসছি। তুমিও বসে পড়ো। এরপর যার যা প্রয়োজন নিজে নিয়ে নেবে। এখানে তো সবাই আমরা আপন মানুষে বসে আছি তাই না।

আমি মুচকি হেসে বললাম,

— আচ্ছা মা।

আমি আমার আম্মুর পাশে বসলাম। খেতে খেতে হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন,

— ভাইজান বললেন না তো খাবার কেমন হয়েছে?

আব্বু হেসে উত্তর দিলেন,

— জী চমৎকার স্বাদের রান্না হয়েছে।

— আপনার মেয়ে রান্না করেছে। মামনি চমৎকার হয়েছে কিন্তু তোমার হাতের রান্না। তোমার কিন্তু একটা উপহার পাওনা রইল। মক্কা থেকে ফিরে এসে তোমাকে উপহার দেব।

সাকলাইন ভাইয়া ও আমাকে ধন্যবাদ জানালো তাকে তার পছন্দের খাবার গুলো রান্না করে খাওয়ানোর জন্য। ভাবি ও রান্নার প্রশংসা করে বললেন,
— রান্না গুলো অসাধারণ হয়েছে।০

সকলের প্রশংসা শুনে আমার মা-বাবার খুশিতে চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
তারপর আর কোন কথা হলো না। সবাই খাবারে মনোযোগ দিল।

হঠাৎ সাকলাইন ভাইয়া বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,

— বাবা তোমাদের সকাল ন’টার ট্রেন তো ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ঢাকা টু খুলনা গামী এক মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। লাইনে কাজ চলছে ঠিক হলে তারপর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে। কী করবে এখন?

সবার খাওয়া শেষে হয়ে গেছে। হাত ধুতে ধুতে বাবা বললেন,

— এর পরের শিডিউল কয়টায়? তোমার মাকে নিয়ে বাস জার্নি করা যাবেনা।জানোই তো।

— রাত ৯ টায় বাবা।

— তোমার করিম চাচাকে ফোন দাও। ওই দুটো টিকিট ক্যানসেল করে, রাত ন’টার ট্রেনের জন্য দুটো টিকিট কাটতে বলো। রাত নটার ট্রেনে আমরা ঢাকায় যাব।

তারপর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

— চলেন ভাইজান। সময় যখন পেয়েছি। অনেকদিন আপনার সাথে বসে দাবা খেলা হয় না। আজ মনের আয়েশ মিটিয়ে দাবা খেলা যাবে।

শেষ করে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

—চমৎকার রান্না করে খাইয়েছো মা। আর একটু কষ্ট করে দুই কাপ চা বানিয়ে দেবে।

— এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি বাবা।

________🌺🌺______

কতদিন পর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি ,মা আস্তে আস্তে মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। আর মুখে নানা রকম ঘটনা বলছেন। এ কয়দিন বাড়িতে কি হয়েছে না হয়েছে। আর আমি চুপচাপ মায়ের কোলে শুয়ে সবকিছু শুনছি।

হঠাৎ মা বলে উঠলেন,

— রুমির সাথে তোর কোন যোগাযোগ আছে নাকি? রুমির ব্যাপারে জানিস কিছু?

— ছোট মামার মেয়ে রুমি আপুর কথা বলছো? না ওর সাথে তো আমার কোন যোগাযোগ নেই। সেইতো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চলে গেল। জানিনা কি হয়েছে।

— হ্যাঁ। সেই মেয়ে ফেরত এসেছে বাপের বাড়িতে। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রুমির স্বামী ওকে মেরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে তার ব্যবসা করার জন্য পাঁচ লাখ টাকা না দিলে রুমিকে আর ঘরে তুলবে না।

চেহারার কি বাজে হাল হয়েছে রুমির। চোখ বসে গেছে। সারা গায়ে মারের দাগ। সারাদিন নাওয়া খাওয়া নেই জানালার ধারে বসে থাকে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,

— এমন তো হবেই। বিশ্বাস করে যাকে এত ভালবাসলো, তার জন্য পরিবারের বিরুদ্ধে গেল। সেই যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন তো আর সহ্য করা যায় না।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

👉একটা কথা কি জানিস বর্তমানে ছেলে মেয়েরা বাবা মাকে নিজের সব থেকে বড় শত্রু মনে করে। তারা মনে করে বাবা-মায়েরা শুধু তাদের ভুলই ধরতে পারে। কিন্তু এই ভুল ধরার মাঝেই যে সন্তানকে সঠিক পথ দেখানোর মূল মন্ত্র থাকে,

*এটা তারা বুঝতে পারে না। তারা ভুলে যায় বাবা-মা ই একমাত্র সন্তানদের সর্বময় কল্যাণ কামনা করে‌ কিন্তু তারা তো শুধু বাবা মাকে ভুল ই বুঝতে পারে। আর কেউ কেউ এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বাবা-মার থেকে সন্তানকে আলাদা করে ফেলে। সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে এমন ভাবে আঘাত করে তখন সে আঘাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সেই মেয়ের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।

এদিক থেকে আমি সৌভাগ্যের অধিকারী। আল্লাহ আমাকে আমার মন মত একটা মেয়ে দিয়েছে। দেখিস তোর অনেক ভালো হবে। আমি আর তোর বাবা সবসময় তোর জন্য দোয়া করি। আর আমাদের জামাইও তো খুব ভালো। আর তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও তো খুব ভালো।

আমি মায়ের কোলে আরো আরাম করে শুয়ে বললাম,

— হ্যাঁ মা। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুব ভালো‌। আর জামাই তো আরো ভালো।

_________🌺🌺_________

কিছুক্ষণ পরে ট্রেন ছেড়ে দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাবা মাকে বিদায় জানানোর জন্য আমরা সবাই এসেছি। আম্মু আব্বু আর প্রীতম রাতের খাবার খেয়ে হজ্বের পরে সবাইকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে বাসায় চলে গেছেন। আসতে চেয়েছিল রেলস্টেশনে কিন্তু বাবাই নিষেধ করল।

নজর গেল মায়ের কোলে বসে থাকা পুতুলের দিকে। মেয়েটা আজ একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। যতই মুখে বলুক না কেন হাজার হোক মা-বাবা তার অত দূরে চলে যাচ্ছে মন খারাপ তো স্বাভাবিক। কিন্তু কান্নাকাটি করছে না এটাই অস্বাভাবিক।

পরে ভাবির কাছে শুনলাম এর আগে কয়েকবার বাবা মা পুতুল কে রেখে ১০ দিন পর্যন্ত বাহিরে থেকে এসেছেন।তখন রহিমা খালা আর সাফওয়ান ওকে সামলাতো। এই জন্য সাফওয়ানের জন্য পুতুল এত পাগল।

ট্রেন এখনই ছেড়ে দেবে তাই সকল যাত্রীকে ট্রেনে উঠে বসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। মা শক্ত করে পুতুলকে কিছুক্ষণ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। তারপর ছেড়ে দিলে আমি গিয়ে পুতুলকে কোলে নিলাম। আমাকে বললেন পুতুলের খেয়াল রেখ। বাবা এসে আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— ভালো থাকো। মামনি আমার মেয়েটার খেয়াল রেখ।

বলে পুতুলের গালে একটা চুমু দিলেন তারপর বাবা মা সবার থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলেন। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেন চলছে শুরু করল।হাত নেড়ে আমরা সবাই তাদেরকে বিদায় দিলাম।

পুতুল আমার ঘাড়ে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে সাফওয়ান এসে আমার কাছ থেকে পুতুল কে নিয়ে নিলেন। এবং বাইরে হেটে চলে যাচ্ছিলেন। আমি তার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম।

কিন্তু একটা মেসেজ টোন আমাকে থমকে দিয়েছিল। আর মেসেজটা পড়ে তো আরও বেশি থমকে গেলাম।

চলবে….❣️