প্রেমতরী পর্ব-১৩

0
274

#প্রেমতরী
পর্ব :- ১৩
.
যেন সব সুখই মিষ্টির জন্য বরাদ্দ ছিলো, শুধু একটা বাবু ছাড়া।
যার জন্য মিষ্টি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায় সময় কান্না করতো।
এভাবে আরো দুটো বছর পার হয়ে যায়।
মামুন, শশুড়, শাশুড়ি কেউই বাচ্চার জন্য মিষ্টিকে কিছু বলতো না।
কিন্তু এর জন্য মিষ্টি নিজেই ভেতর ভেতর জ্বলে পুড়ে মরতো।
একদিন মিষ্টি জোর করেই মামুনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দুজনই নিজেদের পরিক্ষা করায়।
কিন্তু রিপোর্টে নেগেটিভ কিছুই আসেনি।
মিষ্টি একে একে ৫-৬ টা ডাক্তার দেখায়, কেউই নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে পারেনি।
ব্যাপারটা মামুনের কাছেও কেমন যেনো ঘোলাটে মানে হয়।
শেষমেশ মামুন সেই ডাক্তারের শরণাপন্ন যে মিষ্টির এবরশনের দিন মিষ্টির চিকিৎসা করেছিলো।
ডাক্তার নিজের হাতে লেখা সেই রিপোর্ট গুলো নিজে আবার একবার পড়ে।
–আচ্ছা শুনেন, আপনাকে আমি সেদিন একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম, রিপোর্টে ঠিকই লিখেছিলাম। কিন্তু আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
–কি কথা?
–আপনার স্ত্রী যখন বাচ্চা এবরশন করার ঔষুধটা ব্যবহার করে, তখন তিনি না বুঝেই একদিনে ২টা mm-kit খেয়ে ফেলে। যার ফলে ওনার জরায়ুতে ইনফেকশন হয়। সেটা অবশ্য বড় কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু সেই ইনফেকশন এর জন্য ওনার জরায়ুতে ফ্রাকচার হয়ে যায়। এর জন্য উনি সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা ৫০ ভাগ হারিয়ে ফেলেন। তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে উনি সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না। পারবেন, আপনাকে কিছু টিপস দিয়ে দেওয়া হবে। আসা করি আপনাদের দাম্পত্যজীবনে আর কোনো সমস্য হবে না।
এই নিয়ে ডাক্তারের সাথে মামুনের আরো বেশকিছু কথা হয়।
ডাক্তারের সাথে কথা শেষে রিপোর্ট হাতে নিয়ে মামুন বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফেরে।
.
–কোথায় হাওয়া হয়ে গেছেন? কতগুলো ফোন দিয়েছি?(মিষ্টি)
–খেয়াল করিনি। (মামুন)
–কোথায় গেছো?
–কাজ ছিলো বাহিরে, ওটাই শেষ করে আসলাম।
–ওও, আজ মা কোন ফকির বাবার কাছ থেকে আমার জন্য পানি পড়া নিয়ে আসছে।
–কেনো?
–বাবুর জন্য।
–ফকির বাবার পানি খেলে যদি বাচ্চা হতো, তাহলে কেউ আর বিয়ে করতো না। যতসব ফালতু।
–ধুর, এভাবে বলো কেনো? মা আমার কথা ভেবেইতো নিয়ে আসছে।
–ওটা খাওয়া লাগবে না, বাচ্চা হলে হবে না হলে নেই। আল্লাহ যদি আমাদের ভাগ্যে বাচ্চা দেন, তাহলেই আসবে। বাবার পানি খেলে আসবে না। ওটা ফেলে দাও।
–মা কষ্ট পাবেন।
–পাবেন না, ফেলে দাও।
–আচ্ছা। তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো।
–হুম বলো।
–আমি মনে হয় আর কখনোই মা হতে পারবো না।
–আবার শুরু করছো তুমি?
–দেখো, সত্যিই এই বংশের একজন উত্তরাধিকারী প্রয়োজন।
–তো এখন বাচ্চা না হলে আমি কি করতে পারি?
–আরেকটা বিয়ে করো তুমি।
ওমনি মামুন মিষ্টির গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
মিষ্টি ভেজা চোখে মামুনের দিকে তাকিয়ে আছে।
–আমি কি ভুল কিছু বলছি?
–না, তুই সত্য বলে মহাভারত শুদ্ধ করে ফেলেছিস।
–আমি কি করবো বলো, দাদুর মুখের দিকে তাকানো যায় না, মাকে দেখলেও বুঝি ওনার একটা নাতিনাতনি চাই। বাবাতো মাকে কতবার জিজ্ঞেস করছে আমরা কবে বাচ্চা নিবো। আমি আর পারছি না।
মামুন মিষ্টির গালে হাত দিয়ে টেনে ওকে কাছে টেনে নেয়।
–আমার বিয়ের কথাটা বলতে তোমার একটুও কষ্ট হয়নি?

–আমায় ভালোবাসো বলে নিজের পুরো পরিবারটা হারিয়েছো। সব ছেড়ে আমার কাছে আছো। সেই আমাকে অন্যের কাছে দিয়ে দিতে চাচ্ছো? একটুও কষ্ট হলো না তোমার? জীবনে কি বাচ্চাই সব? আমার ভালোবাসায় কি কোনো কমতি রেখেছি আমি? আমি কি তোমায় সুখে রাখতে পারিনি? আমি তো ভাবতাম আমি হলে তোমার আর কিছুই লাগবে না। আমি কি ভুল ভাবতাম?
মিষ্টি মামুনকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।
–আমার ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দাও আমায়। আমি বেচে থাকতে তোমাকে অন্য কারো হতে আমি দেখতে পারবো না, মরেই যাবো।
–তাহলে বললে কেনো? আম্মু কি তোমাকে বাচ্চার জন্য চাপ দিচ্ছে?
–না।
–তাহলে কিসের এত কষ্ট তোমার?
–আমি আর বাচ্চা চাইবো না, লাগবে না আমার বাচ্চা।
–আর একদম বাচ্চা বাচ্চা করবা না। কথা মাথায় গেছে?
–হুম।
–কি রান্না করছো আজ?
মিষ্টি চোখের পানি মুছে হেসে হেসে বলে।
–করলা ভাজি।
–অ্যাহ? আর?
–আর যাই হোক, তুমি ওটাই খাবা।
–কুত্তি, আমি করলা খাই?
–মা বলছে তোমাকে করলা খাওয়াতে পারলে আমাকে একটা গিফট দেবে। খাও না সোনা, যা গিফট দেবে, তোমাকেও ভাগে দেবো।
–একদম না, করলা খেতে গেলেই আমার বমি চলে আসে। আমি পারবো না।
–আজ তাহলে খাওয়া বন্ধ তোমার।
–আমি বাহির থেকে খেয়ে আসবো।
–যা খালি বাহিরে, তোর ঘরে ঢোকাই বন্ধ।
–কি মসিবতে পরলাম। যাও নিয়া আসো।
–আমার লক্ষি জামাই, উম্ম্ম্ম্মাহ।
.
মামুন মিষ্টির পাগলামি দেখে মনে মনে খুব খুশি হয়।
মেয়েটা যখন হাসে, তখন ওর হাসি দেখলে মনের সব দুঃখ কষ্ট গায়েব হয়ে হয় যায়।
সত্যি বলতে মিষ্টির হাসিতে যাদু আছে, যেই হাসিতে পুরো পরিবার মুগ্ধ।
মিষ্টির হাসিতে হাসে পুরো পরিবার,
পরদিন রাতে মামুন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে দেখে আজও মিষ্টি মন খারাপ করে বিছানার এক কোনায় বসে আছে।
–মিষ্টি…..
–আসছি।
বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে মামুনের সামনে আসে।
–কেমন আছে আমার কলিজাটা?
–ভালো।
–এই যে ফুসকা…..।
–দেন।
–বাব্বাহ, এতো ভারি গলা? আজ আবার কি হলো?
–কিছু হয়নি।
মিষ্টির দুবাহু ধরে টেনে এনে বিছানায় বসায়।
–আম্মু বকছে?
–না
–আব্বু?
–না,
–দাদু?
–কেউ বকেনি।
–তাহলে আমার কলিজার মন খারাপ কেনো?
–সকালে ফুফু এসেছিলো দাদুকে দেখতে।
–হু, তারপর?
–আমাকে জিজ্ঞেস করলো বাচ্চা কবে নিবো।
–ও আচ্ছা, এই ব্যাপার?
–শুধু এটা না, ফুফুর ননদ ও এসেছিলো। সেও জিজ্ঞেস করলো।
–কি?
–বললো, এতদিন হয়ে গেছে, এখনো কেনো বাচ্চা নিচ্ছি না। কোনো সমস্যা নেই তো।
–পরবর্তীতে কেউ যদি বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবা যে মামুন এখন বাচ্চা নিতে চাচ্ছে না। যদি বলে কেনো? তাহলে বলবে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করতে। এরপরের উত্তর আমি দেবো।
–এত কথা বলার দরকার নাই, বাদ দাও তো।
–আমার বউ, আমার বাচ্চা। আমার চিন্তা হয় না, আর অন্যদের চিন্তায় ঘুম হয় না। কি আজবরে বাবা। এসব কোনো প্রশ্ন? মানুষ কেনো এরকম প্রশ্ন করে? বাচ্চা নেওয়ার হলে ১ বছরের মধ্যেই তো নিতাম। ৪ বছর হয়ে গেছে, এখনো বাচ্চা নেই নি। এর মানে তো বোঝা উচিত যে কোনো একটা কারনে বাচ্চা নিচ্ছি না।
–থাক না, যা বলার মা বলেছে ওনাদের।
–আম্মু আবার কি বললো?
–ফুফুর ননদকে বকেছে।
–কি বলো? কি বলছে?
–বললো যে আমাদের ব্যক্তিগত বিষষে যেনো পরবর্তীতে কোনো প্রশ্ন না করে। এতে ফুফুর ননদ মনে হয় রাগ করেছে।
–বেশ করেছে, দেখতে হবে না কার মা।
–আমার মা।
–এহ, আমার আম্মু তোমার হয়ে গেলো?
–তোমার ছিলো, কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমার হয়ে গেছে।
–বললেই হয়ে গেলো?
–হুম, জলদি যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো। খাবার দিচ্ছি।
–আম্মু আব্বু খেয়েছে?
–হুম, ওনারা খেয়ে শুয়ে পড়েছেন।
–তুমি?
–বলদ, তোমাকে ছেড়ে আমি কেমনে খাবো? জলদি যাও, আমার খুদা লেগেছে।
–আচ্ছা।
.
পরদিন সকালবেলা মিষ্টি আর শাশুড়ি মা রান্না করছিলো।
এমন সময় একটা লোক এসে ২ প্যাকেট মিষ্টি রেখে যায়।
মিষ্টির প্যাকাটগুলো মিষ্টির ফুফুর বাড়ি থেকে এসেছে।
সাথে সাথে ও বাড়ি থেকে ফোন আসে।
ফুফু জানায় নিশি মা হতে চলেছে। অর্থাৎ মিষ্টির ফুপাতো বোন নিশি মা হতে চলেছে।
৬ মাস হলো নিশির বিয়ে হয়েছে।
খবরটা মিষ্টির বুকে যেনো তীরের মত এসে আঘাত করে।
মিষ্টির শাশুড়ি সাথে সাথে মিষ্টির প্যাকেটগুলো ফিরিয়ে দেন।
এবং ফোনে বলে দেন এই মিষ্টি তাদের লাগবে না। মিষ্টিগুলো যেনো তারা নিজেরাই খায়।
মিষ্টির শাশুড়ি ভালো করেই বুঝতে পারেন যে এই মিষ্টিগুলো পাঠানো হয়েছে গতকাল করা অপমানের প্রতিশোধ নিতে।
–মা, ফুফু কষ্ট পাবে এভাবে মিষ্টিগুলো ফিরিয়ে দিলে।
–তোর ফুফু এত নিচ মানসিকতার মানুষ তা আমি আগে জানতাম না। গতকালের বদলা নিতে আজ মিষ্টি পাঠিয়েছে।
–বদলা নিতে যাবে কেনো?
–কারন নিশির প্রেগন্যান্ট হওয়ার ব্যাপারটা আমি আরো ১ সপ্তাহ আগে থেকে জানি। তোর দাদুকে ফোন করে বলেছিলো, কিন্তু আমাকে বলেনি। তাহলে আজ একসপ্তাহ পর কেনো মিষ্টি পাঠালো?
–জানি না।
–তোর জানতে হবে না। শুধু আমার সময় আসুক, এক ট্রাক মিষ্টি পাঠাবো।
–আমার বাবু হবে তো মা?
–হবে হবে। দিন রাত আল্লাহর কাছে এটাইতো চাচ্ছি, একটু ধৈর্য ধর।
মিষ্টি ছলছল চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে রান্না করেই যাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, এই জনমে এমন কোন পুণ্য করেছি যে এমন একটা শাশুড়ি পেয়েছি। যে নিজের সন্তানের মতো আমায় এত ভালোবাসে।
বিয়ের এই ৪ বছরে এখন পর্যন্ত মা আমায় কখনো বকাও দেয়নি।
–মিষ্টি, তরকারীতে লবন যেনো বেশি না হয়।
–কেনো হবে মা?
–তোর চোখের পানি সব তরকারীতে যাচ্ছে। যা ঘরে যা, পাগলি কোথাকার। কিছু হলেই চোখের পানি নাকের পানি সব বের হয়ে আসে। যা ফ্রেস হয়ে আয়।
–যাহ, আমার নাকের পানি কবে দেখছো তুমি?
–ছোট থেকেই দেখে আসছি। আর তুই কি বড় হয়ে গেছিস নাকি? সেই ছোটটাই তো আছিস।
–আমি তোমার ছেলের বউ, এখনো ছোট মনে হয়? তুমি বুড়ি হই গেছো, আর আমি ছোট তাই না?
–বুড়ি কাকে বললি?
–তোমাকে, বুড়ি।
–একটা দিমু এখন। তুই জানিস আমি মেকাপ করলে এখনো তোর ছেয়ে আমাকে বেশি সুন্দর লাগে।
–বাব্বাহ, বুড়ির ঢং দেখে বাচিনা। করো মেকাপ, তোমারে আরেকটা বিয়া দিমু।
–তবেরে……..
.
মিষ্টি আর তার শাশুড়ির রোজকার দুষ্টুমি এসব।
মিষ্টির যখন মন খারাপ করে, শাশুড়ি মা তখন এভাবেই মিষ্টিকে হাসায়। মিষ্টিও খুব উপভোগ করে।
মিষ্টি আর মিষ্টির শাশুড়ির সম্পর্কটা এমন যে, বাহিরের কেউ দেখলে মনে করবে এরা দুজন বান্ধবি অথবা বোন।
সেদিন তো মামুন কাজ শেষে ঘরে ঢুকেই চোখ কপালে।
মিষ্টিকে নিজের রুমে না পেয়ে মায়ের রুমে যায়।
গিয়ে দেখে মিষ্টি, মা আর বাবা ৩জন বসে একসাথে তাস খেলতেছে।
মিষ্টিকে আনার চেষ্টা করলে সে কিছুতেই আসতে রাজি না।
–এই আমি কার পাল্লায় পড়লাম, আম্মু এটা তোমার তাস খেলার বয়স?
–আমি কি একা খেলি? তোর বাবাও তো খেলে।
–আব্বু এসব কি? ওঠো সবাই। এই মিষ্টি, ওঠ।
–দাড়াও তো, আজ অনেক লসস হই গেছে। আরো পরে যাবো, তুমি যাও।
–কিসের লসস?
–বাজি খেলতেছি, ডিস্টার্ব করো নাতো।
–হায় খোদা, জুয়া খেলাও শুরু করে দিসো? আম্মু তুমিও?
–আমার কি দোষ? মিষ্টিই তো জোর করে বসালো।
–মিষ্টি, উঠবি নাকি আমি চলে যাবো?
–যাও, খাবার রেডি আছে, খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আমার টাকাগুলো উঠিয়ে আসতেছি। আজ কপালটাই খারাপ, ৩৬ টাকা লসস হই গেছে।
মামুন কোনো রকম দেয়ালে হাত দিয়ে নিজেকে সমলায়, কি শুরু হইছে এসব……
.
.
.
চলবে………..
.
.
লেখক #A_Al_Mamun