প্রেমতরী পর্ব-১৪

0
270

#প্রেমতরী
পর্ব :- ১৪
.
–যাও, খাবার রেডি আছে, খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আমার টাকাগুলো উঠিয়ে আসতেছি। আজ কপালটাই খারাপ, ৩৬ টাকা লসস হই গেছে।
মামুন কোনো রকম দেয়ালে হাত দিয়ে নিজেকে সমলায়, কি শুরু হইছে এসব।
–ওঠো বলছি, ঘরটাকে জুয়াখানা বানাই ফেলছে।
–না, তাহলে মাকে বলো আমার ৩৬ টাকা ফেরত দিতে।
–৩৬ টাকা তুমি কই পাইছো হ্যা?
–হেহে, সকালে তোমার পকেট থেকে চুরি করছিলাম, আরো ১৪ টাকা আছে।
–আম্মু দেখো, তোমার বউ টাকা চুরি শিখে গেছে।
–চুরি কিরে? তোর টাকা মানেই তো মিষ্টির টাকা। তোর বাবার পকেট থেকে কি আমি কম চুরি করছি? এটা আমাদের হক।(মা)
–তাইতো বলি আমার টাকা কমে যেতো কেনো। চোর তো আমার ঘরেই।(বাবা)
–কি শুরু হইছে এটা? মিষ্টি ওঠো।
–আর এক গেইম প্লিজ।
–ওঠো বলছি(বলেই মিষ্টিকে টেনে কোলে তুলে নিজের ঘরের দিকে হাটা দেয়)
–ছাড়ো বলছি, আমার ৩৬ টাকা….।
–কোনো কথা নাই, চুপ।
.
সোজা নিজের রুমে গিয়ে মিষ্টিকে নামায়।
–কে শিখাইছে এই খেলা?
–বাবা, আমি আর মা শিখছি।
–হায় খোদা, খাবার দাও।
–শুনো না।
–কি?
–এই দেখো (হাত দেখিয়ে)
–এটা তো আম্মুর চুড়ি।
–হুম।
–তোমাকে কেনো দিলো?
–তোমাকে করলা খাওয়াছি যে, তাই দিছে।
–বাহ, ভালো তো।
–জানো আর কি বলছে?
–কি?
–বলছে যদি আমাদের বাবু হয়, তাহলে মায়ের গলার চেইনটা আমায় দিবে।
–তাই?
–হুম। এখনতো আমার বাবু লাগবেই।
–অ্যাহ? চেইনের জন্য?
–হুম।
–কি মেয়েরে বাবা, চেইনের জন্য বাবু লাগবে শুধু?
–এতো কথা বলো কেনো? যাও তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আসো, আজ অনেক কাজ আছে।
–কিসের কাজ?
–ধুর, বাবু নিতে হবে না?
–তাই? ঠিক আছে আসতেছি।
.
মামুন মিষ্টির এমন বোকা বোকা কথায় খুব হাসে।
মেয়েটা সত্যিই আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। মিষ্টি এখন নিজের মতো নেই। এখন সে সবার মনের মতন।
সে জানে কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে, কার কখন কি লাগবে, কার মুড কেমন।
মিষ্টি যদি এখন কোথাও চলে যায়, তাহলে এই পরিবারটা এখন শূন্যতায় মারা যাবে।
কারন মিষ্টি যে সবার প্রান।
একদিন মামুনের সাথে মিষ্টির কথা কাটাকাটি হয়। কথার এক পর্যায়ে মামুন মিষ্টিকে জোরে একটা ধমক দেয়।
মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে মাকে গিয়ে বিচার দেয়।
মা ঝাড়ু হাতে মামুনকে তাড়াতে তাড়াতে বাড়ির বাহিরে বের করে।
মামুন পুরোদিন বাড়িতে ঢোকার সাহস পায়নি।
সারাদিন খাবার বন্ধ ছিলো।
রাতে মিষ্টি চুপিচুপি দরজা খুলে মামুনকে ভিতরে ঢোকায়।
মামুন ভিতরে ঢুকলে মিষ্টি মামুনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
–খুব কষ্ট হইছে তাইনা?
–ছাড়ো, ন্যাকা কান্না দেখানো লাগবে না।
–এভাবে কেনো বলছো?
–কিভাবে বলবো? আম্মুকে কেনো বিচার দিয়েছো?
–দেইনি, মা আমায় কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে, বললাম যে মামুন বকছে। তাই মা রেগে গেলো। আমি কি জানতাম যে এমন হবে?
–কি তাবিজ করছো আমার মাকে? যে তোমাকে বকাও যায় না।
–তাবিজ করবো কেনো? আমি মায়ের লক্ষ্মী মেয়ে, তাই মা আমায় খুব ভালোবাসে।
–আমিতো সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে দুনিয়ায় এসেছি, আমার কপালে ভালোবাসা নাই।
–কে বললো নাই? আমি বাসি না?
–তাই নাকি? তাহলে খাবার থাকলে একটু দেন, খুদায় আমায় জান যায় যায় অবস্থা। বাচলে ভালোবাসতে পারবেন।
–আমি এক্ষুনি আনছি।
–দয়া করেন।
মিষ্টি দৌড়ে গিয়ে মামুনের জন্য খাবার নিয়ে আসে।
.
এর প্রায় ৪ মাস পর একদিন মামুনের ফুফাতো বোন নিশি ও তার স্বামী আদি মামুনদের বাড়িতে বেড়াতে আসে।
তবে হ্যা, সাথে তাদের ছোট্ট একটা বাবুও ছিলো। নিশির ছেলে।
কানাডায় একই কলেজে পড়ালেখা করতো আদি আর নিশি। সেখান থেকেই তাদের প্রেম।
পড়ালেখা শেষে দুজন নিজের পায়ে দাড়িয়ে তাদের সম্পর্কের কথাটা পরিবারের কাছে জানায়।
এবং পারিবারিক ভাবেই আদি আর নিশির বিয়েটা হয়। আর বিয়ের একবছরের মাথায় নিশির একটা ফুটফুটে পুত্রসন্তান হয়।
মিষ্টি আনমনে নিশির কথাটা ভেবে যাচ্ছে, আর মনে মনে নিজেদের করা ভুলটার কথা ভাবছে।
সেদিন যদি সবকিছু বাবা আর মাকে খুলে বলতাম, তাহলে হয়তো মামুনের সাথেই বাবা আমায় বিয়ে দিতেন। আর আজ আমার বাবা-মা আর আমার বাবুটাও বেচে থাকতো।
মিষ্টির চোখ দুটো পানিতে ভরে ওঠে।
আড়াল থেকে মিষ্টি মামুনকে খেয়াল করে, মামুন নিশির বাচ্চার সাথে খেলা করছে। কত আদর করছে, ওকে কোলে নিয়ে পুরো বাড়িতে দৌড়াচ্ছে।
বুক ফেটে মিষ্টির কান্না আসে।
নিজের ঘরে গিয়ে বালিশ জড়িয়ে ধরে মিষ্টি কান্না করতে থাকে।
একটু পর মামুন মিষ্টি মিষ্টি ডাকতে ডাকতে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
মামুনকে দেখে মিষ্টি দ্রুত চোখটা মুছে নেয়।
–তুমি কাঁদছিলে?
–নাতো।
–আমাকে কি বোকা মনে হয়? কেনো কাঁদছিলে?
–আমি কেনো কাঁদবো? পাগল একটা। এটা নিশির বাবু তাইনা? দাও আমি একটু কোলে নেই। কত্ত কিউট বাবুটা।
–আমি বুঝতে পারছি তুমি কেনো কাঁদছিলে।
–ওরকম কিছু না, তুমি এত বিষয় নিয়ে ভাবো কেনো হ্যা? যাও তো, বাবুটা আমার কাছে থাক কিছুক্ষণ।
–নিশি ডাকছে ওর বাবুকে দেওয়ার জন্য।
–কিছুক্ষণ রাখি না আমি।
–ভাইয়া, ভাইয়া, আমার ছেলে কই?(পেছন থেকে নিশি রুমে প্রবেশ করে)
–এই তো।
–তোমাদের সাথে খেলতেছে?
–হুম
–দাও, ওকে একটু খাইয়ে দেই, একটুপর ওর বাবা এসে নিয়ে যাবে, পরে আর খাওয়ানোর সুযোগ পাবো না। পরে দেখা যাবে আমার ছেলেটা কান্না করতেছে।
–ওও আচ্ছা, নিয়ে যা।
–ওর বাবাতো ওকে ছাড়া কিচ্ছু বুজে না। সারাক্ষণ ছেলের কাছে পড়ে থাকে। ছেলে পাগল বাবা।
–ওও
মিষ্টি পেছন থেকে মামুনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে।
নিশি বাচ্চাটা নিয়ে চলে যায়।
মামুন পেছন ফিরে দেখে মিষ্টি মামুনের এক হাত চেপে ধরে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। কিন্তু চোখ পেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে।
মামুন মিষ্টির মাথাটা টেনে এনে বুকে জড়িয়ে নেয়। ওমনি মিষ্টি হু হু করে কেঁদে ওঠে।
সেদিন সারারাত মিষ্টি কান্না করে, মামুন মিষ্টিকে অনেক বোঝায়। কিন্তু মিষ্টি এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে রাতটা পার করে।
.
পরদিন সকালে নিশি চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো।
–শুনছো?(মিষ্টি)
–হুম(মামুন)
–নিশি তো একটু পরই চলে যাবে।
–হ্যা, কেনো?
–বলছিলাম কি, ওর বাবুটাকে একটু এনে দেবে?
–কেনো?
–একটু কোলে নিতাম।
–আচ্ছা, দাড়াও
মামুন বাচ্চাটাকে এনে মিষ্টির কোলে তুলে দেয়।
মিষ্টি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে খেলা করতে থাকে, আদর করতে থাকে।
মামুন মিষ্টির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে।
মিষ্টির এমন পাগলামি দেখে মামুনের নিজের চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করে।
একটু পরই নিশি বাচ্চাটা নিতে আসে।
–ভাইয়া, দাও। আমাদের গাড়ি চলে এসেছে।
–নিয়ে যাবি?
–হুম।
–আর কিছুক্ষণ থাক না।
–ওর বাবা গাড়িতে বসে আছে। দেরি হলে বকবে।
–ওওও, মিষ্টি, বাবুটাকে দিয়ে দাও।
মিষ্টির মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিতে হয়।
নিশি চলের যাওয়ার পেছন পেছন মিষ্টি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
সবাই ধরাধরি করে মিষ্টিকে বিছানায় শোয়ায়, এবং ডাক্তারকে খবর দেয়।
ওমনি মামুন তার মায়ের সাথে রেগে যায়।
–আমি আগেই বলছিলাম নিশিকে দাওয়াত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। জানোই যে ওর ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে। মিষ্টি কি পারবে এটা সহ্য করতে? কেনো ওকে দাওয়াত দিতে গিয়েছো?
–আমি ভাবলাম নিশির বাচ্চাটাকে দেখে মিষ্টি হয়তো একটু খুশি হবে।
–কাল সারারাত ও কান্না করেছে, একটুও ঘুমায়নি, আজ আমাকে বললো যেনো নিশির বাচ্চাটাকে একটু ওর কাছে এনে দেই। আমার কাছে ও ভিক্ষা চাচ্ছিলো। নিশি দিতে চাচ্ছিলোনা ওর বাচ্চাটাকে, একপ্রকার জোর করেই বাচ্চাটা নিয়ে আসি। আমার পেছন পেছন নিশি এসে বাচ্চাটা নিয়ে যায়।
–মেয়েটা ভেতর ভেতর কতটা কষ্ট পাচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। একটা সন্তানের জন্য কোনো সুখই মিষ্টিকে সুখি করতে পারছে না। তুই ওকে একটু বোঝা বাবা।
–আমি আর কি করবো? সারাক্ষণই ওকে বোঝাই।
.
একটু পর ডাক্তার আসে মিষ্টিকে দেখতে।
ডাক্তার আসার সাথে সাথেই মিষ্টির জ্ঞান ফেরে।
–ডাক্তার সাহেব, কাল থেকে আজ পর্যন্ত শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। কিছু খাচ্ছেও না।(মামুন)
–হুম বুঝতে পারছি। আচ্ছা আমাকে একটু দেখতে দিন।
–আচ্ছা ডাক্তার, কোনো বিষয়ে যেনো আর চিন্তা করতে না পারে, এরকম কোনো ঔষুধ নেই?
–না ভাই, এমন ঔষুধ নেই।
মিষ্টি মামুনের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।
বেশ কিছুক্ষন ডাক্তার মিষ্টিকে চেকাপ করে।
মামুন মিষ্টির মাথার পেছনে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
–ডাক্তার, আমার মেয়ে ঠিক আছে তো?(মা)
–জ্বি, উনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
–তাহলে এভাবে পড়ে গেলো যে?
–এই সময় থেকে থেকে মাথা চক্কর দিতে পারে, তাই ওনাকে একটু দেখে শুনে রাখবেন।
–কেনো কেনো? কি হয়েছে ওর?(মামুন)
–উনি তো মা হতে চলেছেন।
মিষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ে।
মামুন ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে হ্যা হয়ে আছে।
মা তো সাথে সাথে মিষ্টিকে টেনে কাছে নিয়ে নেয়।
–কি বলছেন ডাক্তার?
–জ্বি আমি ঠিকি বলছি। ওনার একটু যত্ন নিন।
মিষ্টির চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।
আর মামুন মাথায় হাত দিয়ে ডানে বামে মোড় নিতেছে, কি না কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
মামুন দ্রুত ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে আসে।
এক দৌড়ে আবার নিজের রুমে।
মা মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মিষ্টি বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে যাচ্ছে।
.
.
.
চলবে………
.
.
লেখক #A_Al_Mamun