প্রেমদণ্ড পর্ব-০৫

0
135

#প্রেমদণ্ড (০৫)❤

সকাল থেকে অনুজা ইজহানকে একপ্রকার ইগনোর ই করছে। ইজহান অবলা শিশুর মত যখনই সুযোগ পাচ্ছে অনুজার সাথে কথা বলার ব‍্যার্থ চেষ্টা করছে। কোচিং থেকে এসে সকালের ব্রেকফাস্ট শেষে পড়তে বসেছিল অনুজা। দুপুরে গোসল, খাওয়া শেষে আবারও পড়তে বসেছিল। পনেরো তারিখ থেকে এসএসসি পরিক্ষা। শান্তি মত নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুসরত নেই। বেলা গড়িয়ে এখন শেষ বিকেল। অনুজা বইপত্রের পাট চুকিয়ে ব‍্যালকনিতে গিয়ে বেতের সিঙ্গেল সোফাটাতে হাত পা ছড়িয়ে বসেছিল। একটানা চেয়ারে বসে বইয়ে চোখ লাগিয়ে পড়তে পড়তে মস্তিষ্ক ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে। এখন এককাপ আগুন গরম চা হলে মন্দ হত না। নিজের বাড়ি হলে নিজে গিয়ে চা করে নিয়ে আসতো। কিন্তু সদ‍্য বিবাহিত শশুর বাড়িতে সে ইচ্ছে মাটি চাপা দিতে হল। সন্ধ্যায় সাত তলার ছাদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ফ‍্যামিলি গেটটুগেদার। আজ আইরিন রহমান ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবেন। অনুজা পুনরায় মায়ের সামনে দাড়াতে ভয় পাচ্ছে। বাবা গত হওয়ার পর থেকে মা ই সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এজন্য ছেলেমেয়ের মা হওয়ার পাশাপাশি বাবা হতে গিয়ে আইরিন রহমান কিছুটা গম্ভীর, কঠোর ধাচের হয়ে গিয়েছেন। তাই তো মেয়ের নামে প্রতিবেশিদের মুখ থেকে মন্দ কথা শুনে নিজেকে একদম ই সামলাতে পারেননি। অনুজা বয়সে ছোট হলেও বুদ্ধিতে একেবারে কাঁচা নয়। মায়ের কষ্ট ঠিকই তার চোখে পড়েছিল। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে অনুজা অন‍্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ইজহান কখন পাশের বেতের সোফাটা দখল করে বসেছে সে খেয়াল ই করেনি। তার দৃষ্টি তখন পাশের বাড়ির ছাদে পোষা উড়ন্ত কবুতরগুলোর দিকে। কি সুন্দর উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো জোড়ার সাথে ভালোবাসা বিনিময় করছে। অনুজা হেসে উঠল। ইজহান অনুজার দৃষ্টি অনুসরণ করে হাসির কারণ বুঝল। তার নিজের ঠোঁট কোলেও মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। হালকা কে’শে ইজহান অনুজার দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হল। ইজহানের মুখ হাসি হাসি ভাব বিরাজমান। সে ধোয়া ওঠা মগ ভর্তি গরম চা অনুজার দিকে বাড়িয়ে দিল। অনুজা বিনা বাক‍্যব‍্যায়ে চায়ের মগটি হাতে নিল। পূনরায় উড়ন্ত কবুতরগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করল। শেষ বিকালের এক ফাঁলি তেজহীন রোদ অনুজার মুখমণ্ডলের ওপর দখল করে নিয়েছে। মাঘের শীতল পরিবেশে অনুজার ভালোই লাগছে। আবেশে চোখ বুজে ফেলল।

অন‍্যদিকে মুগ্ধ নয়নে অনুজার দিকে তাকিয়ে আছে ইজহান। যেন কতদিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। অনুজা চোখ খুলতেই দুজনার দৃষ্টি বিনিময় হল। অনুজা ভ্রু উচিয়ে শুধাল, “কি হয়েছে?”

প্রতিত্তোরে ইজহান বলল, “কিছু না। দেখছি, আমার একান্ত ষোড়শী কিশোরীকে।”

ইজহানের সুন্দর কথার পিঠে অনুজা ভেংচি কেঁ’টে বলল, “রাখুন আপনার একান্ত ষোড়শী কিশোরী। আসছে আমার প্রেমিক পুরুষ। ডজন ডজন রমনীর প্রেমিক পুরুষ হয়ে আমাকে একান্ত কিশোরী বলতে লজ্জা করে না? বান্ধবীদের সামনে আমার মুখটা কোথায় গেল বলতে পারবেন?”

ইজহানের মুখ থেকে পুরোপুরি হাসি উবে গিয়েছে। মুখখানা বাংলার পাঁচের মত ঘুচিয়ে গিয়েছে। ইতস্তত করে বলল, “আমার কি দোষ বল? সব তো জানোই। মনটা বড় তাই দয়াকরে সবাই জায়গা দিই। এতে কি আমার দোষ?”

ফুঁসে উঠল অনুজা। অগ্নিঝরা কন্ঠে বলল, “লজ্জা করে না একমাত্র বউয়ের সামনে এসব কথা বলতে?”

“আমি কি এসব কথা উঠিয়েছি? তুমিই তো আগে শুরু করলে। দোষ টা কার?”

“অবশ্যই আপনার। ক্লাসমেটরা যখন বলল আরে ইনি রুজমা আপুর বয়ফ্রেন্ড, আমাদের পাড়ার সাবিহা আপুর বয়ফ্রেন্ড তখন আমার মুখটা কোথায় গেল বলতে পারেন? প্রেম করবেন ভালো কথা। কিন্তু গনহারে কেন?”

“ওরা আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল না। ওরা আমার ক্লাসমেট। একই ভার্সিটিতে পড়ি। একসাথে চললেই কি গার্লফ্রেন্ড হয়ে যায়? আজকালকার মেয়েগুলো এত এডভান্স!আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল শুধু উমা। ওইযে লাল দালান দেখতে পারছো ওখানেই থাকে ও। মেয়েটা সুবিধার না দেখেই তো তোমাকে নিয়ে গেলাম ব্রেকআপ করাতে। ভুলে গিয়েছ?”

অনুজা মুখ ভোঁতা করে বলল,
“ভুলব কেন। বলেছিলেন আপনার কাজটা করে দিলে মেট্রোরেলে চড়াবেন। তাই তো রাজি হয়েছিলাম। নাহলে আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই অন‍্যের ব্রেকআপ করাতে যাব।”

অনুজা-ইজহানের কথোপকথনের মাঝে মাগরিবের আজান ভেসে আসল। দুজনই ব‍্যালকনি ছেড়ে রুমে চলে আসল। ইজহান গায়ে পাঞ্জাবী পড়তে পড়তে বলল, “নামাজটা পড়ে ফেল। সব গেস্টরা আসতে শুরু করবে। আমি মসজিদে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

ইজহান যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে অনুজার চোখেমুখে কয়েকটা চুমু দিয়ে বলল, “সুন্নত। বউকে চুমু দেওেয়া সুন্নত বুঝলে? আমাকে আবার খারাপ ভেব না। সুন্নত আদায় করতে হবে না? চলি হ‍্যাঁ?”

অনুজা পিছন থেকে বলে উঠল, “আমি তো জানতাম শুক্রবারে স্ত্রীর কপালে চুম্বন করা সুন্নত। কিন্তু মাগরিবের সময়ও দিতে হয় তাতো জানা ছিল না।”

ইজহান তার হেলে পড়া টুপিটা ঠিক করতে করতে জবাবে বলল, “যত দিব তত সুন্নত। আমাদের মহানবী (সাঃ)কখনও বলেছেন শুধু জুম্মাবারে চুমু দিতে হবে? বাকি সময় নিষিদ্ধ? বলে নি তো। তাহলে? এদিকে এগিয়ে আসো আরেকটা দিয়ে যায়।”

অনুজা দ্রুত হাতে ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনিটা হাতিয়ে নেয়। দাঁতে দাঁত চেঁপে ইজহানকে উদ্দেশ্য করে বলে, “যাবেন নাকি চিরুনি ছুড়ে মা’রব? ইকামত শুরু হয়ে গেল বোধহয়।”

“যাচ্ছি, যাচ্ছি। বাবাহ! কি দজ্জাল বেডি!” ইজহান আর দাড়াল না। দ্রুতগতিতে বেড়িয়ে পড়ল।
_______________
অনুজার মাগরিবের নামাজ শেষ হতেই হাতে কিছু শপিং ব‍্যাগ নিয়ে মুশফিকা হাজির। মুশফিকা এসেই বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। হাপাতে হাপাতে বলল, “বুঝলে অনু আজ সারাদিন যা খাটনি গিয়েছে। ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তাতেও কত কাজ। ডেকোরেটরের সাথে এটা ওটা এগিয়ে দেওেয়া, দিকনির্দেশনা দেওেয়া সবই তো আমারই করতে হয়েছে। ইজহানের নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান কোথায় একটু তদারকি করবে তা না বাইক নিয়ে ফুরুৎ। শাড়ি পড়ে একটু সাজগোছ করতে হবে বনু। হাতমুখ ধুয়ে এস। ড্রয়িং রুমে, ছাদে অথিতিরা গিজগিজ করছে। চলো তোমাকে রেডি করে দিই।”

“আপু, আম্মু অনিশা, ইয়াশ ওরা সবাই এসেছে?” ইতস্তত করে বলে উঠল অনুজা।

মুশফিকা স্মিথ হেসে বলল, “আন্টিরা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। কেবলই আসলেন। এসো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। যেতে হবে তো নাকি!”

“জি আচ্ছা আপু।”

মুশফিকা অনুজাকে সাজাতে বসল। গতদিনের আনা গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি আর হালকা মেকআপের ছোঁয়া। তখনই ফাতিমা বেগমের উপস্থিতি। হাতে কাঠের ছোট সিন্দুক। মুশফিকার দিকে সিন্দুকটি বাড়িয়ে দিলেন। তারপর অনুজার উদ্দেশ্য বললেন, “ইচ্ছে তো ছিল একমাত্র ছেলের বউকে গয়নায় মুড়িয়ে দিব। কিন্তু কিভাবে কি হল সবটাই বুঝতে পারছো। এগুলো আমার শাশুড়ি মায়ের গহনা। তিনি নাতি বউয়ের জন্য এগুলো আলাদা করে রেখে গিয়েছিলেন। আমি যত্ন করে এই সিন্দুকে গুছিয়ে রেখেছিলাম। মুশফিকার জন্য যেগুলো দিয়েছিলেন ওগুলো ওর বিয়ের সময় দিয়ে দেওেয়া হয়েছে। এগুলো তোমার। নিজে খুলে দেখ তো!”

মুশফিকা সিন্দুকের তালাটা খুলে দিয়ে অনুজার হাতে দিল। অনুজা অস্বস্তি নিয়ে গহনাগুলো খুলে খুলে দেখছিল। পুরোনো আমলের খাঁটি স্বর্ণের গহনা। একটা কন্ঠ চিক, হাতের দু জোড়া মোটা বালা আর শঙ্খের কারুকাজ খচিত আংটি। পুরোনো দিনের হলেও বেশ চকচক করছে। দেখতেও সুন্দর লাগছে। অনুজার পছন্দ হল। অনুজা ছোট করে বলল, “সুন্দর!”

ফাতিমা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি হাতে মোড়ানো কাপড়টা অনুজার হাতে দিয়ে বললেন, “খুলে দেখ।”

কানের দুল। মাঝারী সাইজের এক জোড়া সুন্দর কানের দুল কাপড়ে মোড়ানো ছিল। ফাতিমা বেগম আবার বললেন, “স্বর্ণগুলো পলিশ করতে গিয়ে রেডিমেড কিনে নিয়ে এলাম। আমি স্বর্ণ সাধারণত রেডিমেড কিনি না। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করে রেডিমেড ই কিনতে হল। তোমার পছন্দ হয়েছে মা?”

অনুজা মাথা দুলাল। অর্থাৎ পছন্দ হয়েছে। না চাইতেই কত কি পেয়ে যাচ্ছে সে। অপছন্দ হয়েছে এমন কথা কি করে বলতো সে! তাছাড়া গহনাগুলো বেশ সুন্দর ডিজাইনের।

ফাতিমা বেগম যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনি হঠাৎই চলে গেলেন। মুশফিকা দরজা লক করে এসে মনোযোগ দিয়ে অনুজাকে সাজাতে বসল।

সাজানো শেষে মুশফিকা অনুজাকে বলল, “আয়নার সামনে যাও দেখি।”

অনুজা ড্রেসিং টেবিলের সাথে লাগোয়া আয়নার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল নিজেকে দেখে। কি সুন্দর লাগছে তাকে। কেমন বড় বড় ভাব ফুটে উঠেছে মুখে। কে বলবে এই মেয়ের বয়স সবে ষোলো।

মুশফিকা পাশে এসে দাড়িয়ে বলল, “মাশা আল্লাহ, মাশা আল্লাহ। আমার ভাইয়ের একান্ত ব‍্যাক্তিগত সম্পদে কারো নজর না লাগুক।”

অনুজা লজ্জা পেল ননাসের কথায়। কিঞ্চিৎ হেসেও ফেলল সে।

“মেয়ে দেখি লজ্জাও পায়।” মুশফিকার কথায় লজ্জায় অনুজার ফোলা গালদুটো আরেকটু ফুলে উঠল। এরা ভাইবোন এত লাগামছাড়া কেন আল্লাহ জানেন!

অনুজাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই আইরিন রহমানের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হল অনুজার। মা’কে দেখতেই অনুজার ডাগর ডাগর চোখদুটোতে অশ্রুকণা ভর করেছে। টুপ করে চিবুক গড়ানোর আগেই আইরিন রহমান হাত দিয়ে মুছে দিলেন। ছলছল নয়নে হাসিমাখা মুখে বললেন, “বড্ড সুন্দর লাগছে। কান্না মানায় না মোটেও।” বলেই অনুজা জড়িয়ে ধরলেন। অনুজাও মাকে ঝাপটে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। মায়ের ওপর জমানো অভিমান, অভিযোগ আজ চোখের জলে বিসর্জন দিচ্ছে মেয়ে। দুপাশ থেকে অনিশা, ইয়াশ এসে মা বোনকে ঝাপটে ধরল। উপস্থিত ফাতিমা বেগমে চোখদুটোও কখন যেন পানিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কত অল্প বয়সে মেয়েটা বিধবা হয়েছে। স্বামী হারিয়ে কত দুঃখ, কষ্টের মধ্যেই না জীবন পাড় করছে আইরিন রহমান। ছোট বোনের বান্ধবীকে নিজের বোনের মতোই দেখেন তিনি। আইরিন রহমানের দিকে তাকালে নিজের বোনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান ফাতিমা বেগম। তাইতো ভাড়াটে হওয়া একমাত্র সত্বেও আইরিন রহমানের সাথে তার দারুণ সখ্যতা।

পাশ থেকে মুশফিকা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, “চলুন এবার। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সব গেস্টরা চলে এসেছেন। আব্বা রাগারাগি করবেন দেরি করলে। আম্মা, আন্টি চলুন তো।”

এমন সময় হুড়মুড়িয়ে ইসরাতের প্রবেশ। সবার দিকে লজ্জায় পড়ে গেল বেচারি। তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে লম্বা ঘেরের গাউনে পা বেধে পড়ে যেতে নিয়েছিল সে। ভাগ‍্যিস এক পুরুষালি হাতের শক্ত বন্ধনে পড়তে গিয়েও পড়ল না। ইসরাত সোজা হয়ে দাড়াতেই শ‍্যামবর্ণের সেই শক্ত বন্ধনের পুরুষটার মুখ দেখতে পারল না। সে যেমন দ্রুত এসে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। তেমনি মিনিটেই নাই হয়ে গেল। ইসরাত সেসব পাত্তা না দিয়ে অনুজার ডান হাত মুঠোয় পুড়ে নিয়ে বলল, “চল। এবার সত্যি দেরি হয়ে যাবে নাহলে।”

অনুজার অনেকদিন পরে খুব ভালো লাগছে। একপাশে মা অপর পাশে বেস্টফ্রেন্ড, ননাস, শাশুড়ি সবাইকে হাসিখুশি দেখে অনুজার নিজের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। হাসিমুখে ছাদের দিকে রওনা হল সে। সেখানে যে তার চুমুখোর জামাইটা অপেক্ষা করছে।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..