#প্রেমদ্বন্দ্ব_৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
মেমোরিটা হাতে পাওয়ার পরদিন থেকে তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার থেকে ফোন আসা শুরু করলো। অনন্যা বুঝে গিয়েছিলো যে তার কাছে মেমোরিটা আছে সেটা জেনে গিয়েছে খুনীরা। তাকে কোনো পদক্ষেপ নিতে না দেখে তারা আরও বিচলিত হয়ে পড়েছে। অনন্যা এমন ভাব করলো যেন তার কাছে কোনোকিছুই নেই। কিন্তু খুনীরা দমে যায়নি।
তারা অনবরত একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের জাল বুনা শুরু করেছে। এও জানালো ওই মেমোরি কার্ডটা যদি সে পেয়েও থাকে তাহলে সেটা আহাদ আলভীর কাছে অব্দি যেন না পৌঁছায়। নইলে আহাদ আলভীর মধ্যে বিদ্যমান মেহযেব আর্ভিনের দ্বিতীয় মৃত্যু হতে বেশি দেরী হবে না। এমনকি ফোনালাপের মধ্যে ভিডিওতে ধারণা করা খুনের বিবরণ দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তারা।
এ কয়েকমাসে অনন্যার সর্বস্ব হয়ে উঠেছে আর্ভিনরূপী আহাদ। নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও সেই স্বত্বাকে চিরঞ্জীব রাখার জন্য সে লড়ে যাবে। আর্ভিনরূপী আহাদের সান্নিধ্যে থেকে তার অসুস্থপ্রায় মস্তিষ্ক তখন আহাদের লড়াইয়ের কথা প্রায় ভুলেই বসেছে। এখন তার নিজের মধ্যে লড়াই। খুনীদের সাথে তার একটা ডিলও হয়েছে। সে যদি মেমোরি কার্ডটা চুপিসারে ফিরিয়ে দেয় তাহলে তারা থাকে মেজর মেহযেব আর্ভিনের লাশের খোঁজ দেবে। এমনকি সেই জায়গার ঠিকানাও দেবে। সুস্থ অনন্যার কাছে এটা লোভনীয় প্রস্তাব। অসুস্থ মস্তিষ্ক মেহযেব আর্ভিনের লাশ কথাটা মানতে না পারলেও সুস্থ মস্তিষ্কের অনন্যা ইয়াসমিন বরাবরই চেয়েছে আহাদ আহাদ হয়েই বাঁচুক। লাশ পেয়ে গেলে খুনীদেরও অব্দি পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগবেনা আহাদ আলভীর। খুনীদের পেয়ে গেলে আহাদ আলভীর মধ্যে বিদ্যমান আর্ভিনরূপ হারিয়ে যাবে। অনন্যা এটা কখনোই হতে দিতে পারেনা। যে স্বত্বার কাছে এসে সে শান্তি পায়, স্বস্তি পায়, ভালোবাসা পায়, যার মায়ার মোহনজালে আটকা পড়ে নিজের অস্তিত্ব অব্দি বিলীন হওয়ার পথে তাকে সে কোনোকিছুর বিনিময়ে হারিয়ে যেতে দেবেনা।
অদ্ভুত একটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিন কাটতে লাগলো অনন্যার। আহাদ আলভীর মতোই তার কল্পনার জগতটা এখনো আর্ভিনময়। অন্ধকার করে রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে তার কল্পনার জগতেও আর্ভিনরূপীর আবির্ভাব হয়। সবশেষে অনন্যা বুঝতে পারলো মেমোরি কার্ডটা আহাদ আলভীর কাছে পৌঁছে যাওয়া মানেই আর্ভিনরূপী আহাদ বিলীন হয়ে যাওয়া। আহাদ আলভীর কল্পনার জগত থেকে, এমনকি তারও।
অনন্যা সেটা কখনোই হতে দিতে পারেনা। কিছুতেই না।
তার পরের দিন অনন্যা ডিউটি থেকে ফেরার পথে খেয়াল করলো দুটো গাড়ি তার গাড়িটাকে ফলো করছে। তার গাড়িটাকে ঘিরে ফেলবে তার আগেই কোথাথেকে আহাদের গাড়ি চলে এসেছিলো। আহাদকে দেখে গাড়ি দুটো আর এগোনোর সাহস পায়নি। আহাদকে পেয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেললো অনন্যা। আহাদ তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,
– অনা শান্ত হও। তুমি কাকে ভয় পাচ্ছ?
অনন্যা ফুঁপিয়ে উঠে ধীরেধীরে মাথা তুলে তাকে দেখলো। আহাদ তার মুখের উপর হতে চুল সরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
– বলো। কাকে কাকে ভয় পাচ্ছ?
অনন্যা ঝরঝরে কেঁদে উঠে বলল,
– তোমাকে।
আহাদ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।
__________
কাউন্সিলরের কথা অনুযায়ী আহাদ বিশ্বাস করেছে রাতে তার মধ্যে অন্য একটা স্বত্বা বিরাজ করে। আর তার সাথে অনন্যার একটা ভালো বন্ডিং তৈরি হয়েছে। সেহেতু অনন্যাকে সময় দিতে না পারার জন্য তারমধ্যে যে গ্লানিটা কাজ করে সেটা নেহাতই একটা ভুল ধারণা। সন্ধ্যার থেকে বাকিটা সময় সে অনন্যার সাথেই কাটায়।
আগে যদিও সন্ধ্যার পরের নিজের অবস্থানটা মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারতো না আহাদ কিন্তু এখন ঝাপসা ঝাপসা দৃশ্যপটের মতো মনে পড়ে তার। কাউন্সিলর বললেন, যখন সে সেই দৃশ্যপট গুলো স্পষ্ট আকারে মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারবে তখন সে সুস্থ। তবে তারমধ্যে আর্ভিন স্বত্বার অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই রয়ে যাবে।
অনন্যাও যে স্বাভাবিক নেই এটা আহাদ বুঝতে পেরেছে। কাউন্সিলরের মতে, আর্ভিনরূপীর সান্নিধ্যে থেকে অনন্যা আর্ভিনের কল্পনার জগতের সাথে নিজের জগতটাকে মিলিয়ে ফেলছে। তাই ওই স্বত্বটাকে জিইয়ে রাখার জন্য সে যা খুশি করতে পারে। সে আর অনন্যা ইয়াসমিন এখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। একজন জিতলে অপরজন হেরে যাবে।
______
কাল আহাদ আর আর্ভিন দুই ভাইয়ের জন্মদিন। সারাটাদিন আমেনা বেগম কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছেন দুই ছেলে আর ভরা সংসারটার কথা ভেবে। গতবছর আনোয়ার মীর্জা দুই ভাইয়ের জন্মদিন পালন করেছিলো একসাথে। বর্ডারের দায়িত্বে নিযুক্ত মেজর মেহযেব আর্ভিন ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলো শুধুমাত্র কেক কাটার জন্য তাকে এতদূর আসতে হয়েছিলো বলে। পরে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর পর মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো তার।
কারো মাথায় ছিল না দিনটা উদযাপন করা যায়। অনন্যা ডিউটি থেকে আসার পথে ছোট্ট একটা কেক এনেছিল কিন্তু সেটা কাউকে জানায়নি। এমনকিও জিহাকেও না। রাতের খাবারদাবার সেড়ে, আর্ভিনকেও খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল সে। তারপর নিজ হাতে বেলুন ফুলিয়ে ঘরটা হালকা ঘরে সাজিয়ে ফেললো। আর্ভিনরূপী আহাদ যেহেতু আলো পছন্দ করেনা তাই কম আলোর মধ্যে কেকটা কাটবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ঠিক রাত বারোটার ঘরে যখন ঘড়ির কাঁটা গিয়ে পৌঁছালো অনন্যা ঘুমন্ত আর্ভিনের মুখের উপর গিয়ে ফিসফিস করে ডাকলো,
– মেজর স্যার?
আর্ভিনের ঘুম বরাবরই পাতলা। চোখ কচলাতে কচলাতে সে ঘুম থেকে উঠে গেল। অনন্যা হেসে ফেললো। বলল,
– শুভ জন্মদিন। আপনার প্রতিটা জন্মদিন অনন্যাময় হোক।
কেক, মোমবাতি, সাথে হাস্যোজ্জ্বল প্রিয় মুখ। আর্ভিনরূপী আহাদের জীবনে এমন খুশি এই প্রথম। অনন্যা যদিও রোজ অল্পস্বল্প সাজে, আজকের সাজে তাকে সত্যিই অনন্য লাগছিলো। মেজর আর্ভিনের পছন্দের রঙ সাদা, অনন্যা তাই সাদাটে একটা শিফন শাড়ি পড়েছিলো, স্টোনের কাজ ছিল শাড়িটাতে। আর্ভিন জিজ্ঞেস করলো,
– কেকটা আমার জন্য?
অনন্যা তার দিকে বাড়িয়ে দেয়া কেকের টুকরো নিজে খেয়ে নিয়ে বলল,
– না আমার।
দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। তারপর একে অপরকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।
অন্যান্য রাতের মতোই মধুময় ছিল সেই রাতটাও। কেকের বড়সড় টুকরোটা যখন মুখে ধরে রেখেছিলো অনন্যা, সেখান থেকে একটু একটু করে কেকটা পুরোটা খেয়ে নেয়ার পর প্রলম্বিত কয়েকটা চুম্বন কেকের কৃত্রিম মিষ্টির চাইতে বেশি মিষ্টি আর তৃপ্তির ছিল। গলদেশের ভাঁজে পুরুষালি ধারালো গালটার ঘর্ষণে খলখলিয়ে হেসেছিলো অনন্যা। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুটো অসুস্থ মানুষই নিজেদের প্রবলভাবে অনুভব, একে অপরের আত্মার অস্তিত্ব হয়ে উঠার দরুন, দুজনের প্রগাঢ় ভালোবাসায় মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়েছিল সুন্দর একটি নিষ্পাপ প্রাণ। কিন্তু সেই সুসংবাদ শুধুই গর্ভধারিণী জেনেছিল, প্রিয় পুরুষটিকে জানানোর আগেই তাকে অপহরণ করা হয় বাড়ি ফেরার পথে।
চলমান…..