প্রেমদ্বন্দ্ব পর্ব-০৯

0
95

#প্রেমদ্বন্দ্ব_৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

রাফাত,আদিত্য, সৃজন, আর তৌহিদের মুখে কোনো কথা নেই আর বলার মতো। তারা হাঁপিয়ে উঠেছে। এতবড় একটা খেলায় তারা মেতেছে এতে একচুলও পরিমাণ ভুলও যদি হয়ে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই। আবছা অন্ধকারময় বৈঠকঘরের চেয়ারে বসে স্ক্রিনে নজর রেখে চুপচাপ বসে রইলো তারা। আহাদ হুডি আর হাতের গ্লাভসটা খুলে বলল,
– আমি চাইনা ভাড়াটে খুনী বাকি খুনগুলোও করুক। আমার শিকার আমার মুখের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আমি এটা মানবো না। তাছাড়া অনা কোথায়? ও বাড়িতে নেই। আপনারা আমাকে এতদিন মিথ্যে বলে আসছেন। অনার ঠিকানা দিন। আমি ওর সাথে লুকিয়ে দেখা করে আসবো। আমি মেক সিউর করছি, কেউ টের পাবে না।
আদিত্য বলল,
– আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল তা আপনি ভুলে যাচ্ছেন। অনন্যা ইয়াসমিনের নিরাপত্তার ভার আমরা যখন নিয়েছি তখন আপনার উচিত আমাদের উপর ভরসা রাখা। আপনি যেভাবে প্রশ্ন দাঁড় করাচ্ছেন বুঝাই যাচ্ছে আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। তাহলে আমরাও মাঝপথে সব ছেড়ে দেই?
রাফাত বলল,
– তর্কে জড়ানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনি আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন অফিসার। ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিন নিরাপদে আছে।
আহাদ বলল,
– আপনারা বারবার অনার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এবং আমাকে আমার প্রশ্নে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন। তবে হ্যা, আমি আপনাদের উপর বিশ্বাস রাখলাম। ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
সৃজন বলল,
– আপনার দ্বারাই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি অফিসার। কারণ রাতে আপনি এতটা হাইপার হয়ে যান যে আপনার হাতে পায়ে শেকল পড়ানো ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো রাস্তা থাকেনা। আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি ডক্টর অনন্যার খোঁজ বেরিয়ে পড়বেন। আর বুঝতে পারছেন এটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? আপনার হাতে আরও পাঁচ জনের মতো বাকি রয়েছে। যদিও দুজনকে আমাদের ভাড়াটে খুনীই শেষ করবে। বাকি তিনজন কিন্তু খুব সতর্ক। সেখানে আপনার চাচাও রয়েছে।
তাদেরকে আগে শেষ করুন, তার আগেই মেজর মেহযেব আর্ভিনের লাশ কিংবা কবরের কথা জেনে নেবেন। এটাই আমাদের শেষ লড়াই।
আহাদ বলল,
– আমাকে বিশ্বাস করার জন্য থ্যাংকস। আমিও আশা রাখছি আপনাদেরকে বিশ্বাস করে ঠকবো না।

তাদের মধ্যকার গোপন বৈঠক শেষে গুপ্তচর খবর দিল এসএসপি কামরুল হাসান দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কথাটা শোনার পর আহাদ বেরিয়ে পড়তে চাইলে তাকে সবাই আটকালো। তৌহিদ বলল,
– ঘড়ির কাঁটা দেখেছেন? আপনি এখন বেরোলে আমাদেরকে আপনার লাশ খুঁজতে হবে।
আহাদ বলল,
– কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই যদি সে দেশ ছাড়ে? আমি তাদেরকে নিজ হাতে খু-*ন করতে চাই। স্বচক্ষে মরতে দেখতে চাই। কঠিন যন্ত্রণার মৃত্যু দেব আমি তাদেরকে।
তৌহিদ বলল,
– কাল অব্দি আমরা চেষ্টা করব তিনি যেন দেশ ছেড়ে না যেতে পারেন। তাছাড়া আপনি ভোররাতে স্বাভাবিক থাকেন। তখন বেরিয়ে পড়তে পারবেন যদি পজিটিভ সিগন্যাল পান তো।
আহাদ তাদের সায় দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
তারা সারা শরীরে ব্যাথা। সেদিন গুলি খাওয়ার পর গোয়েন্দা তৌহিদুর রহমানই ছিল তার একমাত্র ভরসা। একটা প্রাইভেট হসপিটালের কেবিনে তার চিকিৎসা হয়। গুলি বের করার পাঁচ ছয়দিনের মধ্যে হাত এক আধটু নাড়তে পারলেও শরীর চলছিলো না তার। বাম হাতটা অক্ষম হলেও ডান হাতটার সাহায্য জীবনে প্রথম কারো গলায় ছু**রি চালায় সে। তার আগেই স্কোপালামিন এবং চেতনানাশক ঔষধের সাহায্য নেয়।
তৌহিদ চাইলেই তার জন্য কাউন্সিলর নিয়ে আসতে পারতো কিন্তু বাড়তি ঝুঁকি নিতে ইচ্ছে হয়নি। তবে আদিত্য পরিচিত একজন কাউন্সিলরের সাথে আলোচনা করার পর জানতে পেরেছে আর্ভিন স্বত্ত্বা যেটা চাইছে সেটা না পেলে ধীরে নিজেকে কন্ট্রোল করতে শিখবে। তার ধারণাগুলি ভুল প্রমাণ হলেই সে চুপ হয়ে যাবে। আর তার হার মানেই আহাদ আলভীর জয়। মানসিক প্রশান্তি পেলে আহাদ আলভি ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন যদিও প্রথম থেকেই বলা আছে ডিআইডি রোগ পুরোপুরি নির্মূল হয় না। সুস্থ সবল হলেও দুই স্বত্বার বৈশিষ্ট্য নিয়েই সারাজীবন পার করে যেতে হবে তাকে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সেই রোগের উপসর্গ আর দেখা যাবেনা।
আর্ভিন স্বত্বায় রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্মণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে তার হাতে পায়ে শিকল পড়িয়ে দেয়া হতো। আজও তাই করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তৌহিদ আর বাকিরা। কিন্তু তার আগেই আর্ভিনরূপী আহাদ তার ঘরের পাশ দিয়ে একজন হুডিপড়া লোককে হেঁটে যেতে দেখলো। লোকটা পাশের ঘরে ঢুকামাত্রই দরজা বন্ধ করে অনবরত গলগল করে বমির করতে শুরু করলো। আর ভেসে এল একটা চাপা আর্তনাদ। আর সেটা নারীকন্ঠ ছিল। একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে দরজায় কড়া নাড়াশেষে অনবরত দরজা ধাক্কানো শুরু করলো আহাদ। বলতে লাগলো,
– অনু দরজা খোলো। তুমি আমাকে দেখা দিচ্ছ না কেন? তুমি অসুস্থ? দরজা খোলো।
ততক্ষণে তৌহিদ, আদিত্য এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে ফেললো। বলল,
– ওখানে আপনার অনু নেই। চলুন ঘরে। চলুন।
সর্বশক্তি দিয়ে তাদেরকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আবারও দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো সে।
তৌহিদ, রাফাত আর আদিত্য তাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। সে এবার গর্জন করতে লাগলো। তৌহিদ বলল,
– কি করব এখন? উনাকে খবর দে ।
রাফাত বেরিয়ে গেল। আদিত্য আর তৌহিদ তার হাতে শিকল পড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলো কিন্তু পেরে উঠছিল না। আর অবাক হচ্ছিলো এই ভেবে একজন সুস্থ সবল মানুষ চোখের পলকেই এমন উন্মাদের মতো হয়ে যায় কিভাবে?
ঘড়ির কাঁটা টিংটিং করে ঘুরছে ক্রমাগত। বাইরে চলছে ঝড়ের তান্ডব। কাল তাদের সবার জন্য একটা বিশেষ দিন। তাই আজকের দিনের সমস্ত ঝঞ্জাট চুপচাপ সয়ে নিতে হবে। স্ত্রীকে চোখে দেখার জন্য পাগলাটে আহাদ আলভীর গর্জন এই ঝড়ের রাতে বেশিদূর পৌঁছাচ্ছেনা তা তাদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু তাদের চেষ্টা পণ্ডশ্রম ছিল তা প্রমাণ হয়ে গেল যখন আহাদের আর্তচিৎকার সহ্য করতে না পেরে দরজা ঠেলে উন্মাদের মতো ছুটে এল এতদিন আহাদ আলভী কিংবা মেহযেব আর্ভিনের কাছে গা ঢাকা দিয়ে থাকা ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিন। ঘরে ঢুকেই একদৃষ্টে চেয়ে রইলো আহাদ আলভীর রূপ তথা মেহযেব আর্ভিনের দিকে। শত্রুদের আঘাতে ক্ষত হওয়া মুখ, নির্ঘুম রাত জাগার দরুন কালি জমা চোখের কোটর, ভেঙে আসা শরীর, রুক্ষ চুল, খুনচাপা মস্তিষ্কে ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনের মধ্যে থেকে নারীসুলভ সমস্ত বৈশিষ্ট্য উদাও হয়ে দেখা দিয়েছে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত সাইকোর বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাকে চিনতে একমুহূর্তও দেরী হয়নি আর্ভিনরূপী আহাদের। তাকে দেখার পর তৌহিদ আর আদিত্যর আর কিছু বলারও ছিল না। তারা বেরিয়ে পড়লো দরজা বন্ধ করে দিয়ে।
আর তখনি তার শুকনো কাঠির মতো শরীরটা তুলে নিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো আর্ভিনরূপী আহাদ আলভী। সারামুখে অজস্র চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এতদিন কোথায় ছিলে? আর কখনো চলে যাবে না তো। আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা প্লিজ। ওরা আমায় কষ্ট দেয় খুব।
খুনের উপর খুন করতে গিয়ে শক্ত হয়ে আসা অনন্যার দৃষ্টিতে এবার বর্ষার প্লাবন নেমে এল । আর্ভিন তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
– তুমি চলে গিয়েছ দেখে ওরা আমাকে অনেক মারধর করেছে সবাই মিলে।
বলেই গুলি লাগার স্থানে দেখিয়ে দিল। অনন্যা সেখানে হাত ছুঁয়ে বলল,
– সরি।
তার গাল ছুঁয়ে দাগগুলো দেখে আর্ভিনরূপী আহাদ জিজ্ঞেস করলো,
– এখানে কে মেরেছে?
অনন্যা বলল,
– পরে বলব। এখন ঘুমাবো। খুব ঘুম পাচ্ছে।
বলেই আর্ভিনকে তার পাশে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেল। আর্ভিন তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,
– চলো এখান থেকে চলে যাই। ওরা ভালো না। তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বেঁধে রাখে। খুব খারাপ।
অনন্যা বলল,
– না এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। ক্ষত দেখি। গুলি তো দুই জায়গায় পড়েছিল না?
অনন্যা তার ক্ষততে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঝুঁকে ঠোঁটের উপর দীর্ঘ চুমু খেয়ে বলল,
– সেড়ে যাবে। তাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে আহাদ বলল,
– তুমি বলো আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। তোমার সাথে আমাকে নিয়ে যাবে। ওরা কেউই বিশ্বাস করতে চায়না আমি অনেক বড় সৈনিক। আমার হাতে যদি একটা রাইফেল থাকতো!
অন্যন্যা তার বুক থেকে মাথা তুলে তাকালো। হেসে বলল,
-তাহলে আগে নিজেকে শেষ করতে।
বলেই সারামুখে চেপে চেপে চুমু খেয়ে বলল,
– আমাদের একটা বাবু আসছে।
আর্ভিন বড়বড় চোখ করে তাকালো। অনন্যা হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বালিশে শুয়ে পড়ে আর্ভিনরূপী আহাদের গাল টেনে দিয়ে বলল বলল,
– এটার মতো বাবু। এটা বড়বাবু। যে আসছে সে ছোট বাবু।
বলেই আবারও হাসলো।
– কোথায়?
আর্ভিনরূপী আহাদের প্রশ্নে অনন্যা আবারও হাসলো। আর্ভিনের কড়াপড়া হাতটা পেটের উপর রেখে বলল,
– এখানে।
কেমন আলাভোলা হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো আর্ভিন। অনন্যা হাসতে হাসতে তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঁজে বলল,
– পাগল একটা। ও তো এখনো খুব ছোট। যখন একটু বড় হবে তখন আসবে। কেমন ঘোরের মধ্যে কেটে গিয়েছিলো বাকিসময়টুকু। তখন রাতের শেষভাগ। ঝড়ের তান্ডব শেষে পৃথিবী নির্জীব।
সিগন্যাল পাওয়ার সাথে সাথে আর্ভিনরূপী আহাদের বুক থেকে নিজেকে ধীরেধীরে ছাড়িয়ে নিল অনন্যা। কিন্তু সে সরার সাথে সাথে আর্ভিনের চোখ ছুটে গেল। অনন্যাকে ঝাপটে ধরে রেখে সে আর্তনাদ করে উঠলো। অনন্যা বলল,
– আমি আবারও আসবো। ছাড়ো।
– না তুমি আসবেনা জানি।
অনন্যা যতই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে লাগলো আর্ভিনরূপী ততবারই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাখলো। অনন্যা শুয়ে পড়ে বলল,
– ওকে যাচ্ছি না। শান্ত হও।
আর্ভিন তাকে বুকের নীচে লুকিয়ে রাখলো। অনন্যা ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
– আই হেইট ইউ। তোমাকে ভালোবাসিনা আমি।
আর্ভিন তাকে চেপে ধরে রেখে বলল,
– তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো।
বলতে বলতে সে ঘুমিয়ে পড়লো।
আর্ভিনের চোখ বুঁজে আসতেই অনন্যা নিজেকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে নিয়ে তার গালে কপালে চুম্বন করে সরে পড়লো দ্রুত। সে দরজার বাইরে পা দিতে না দিতেই আর্ভিন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
– মিথ্যেবাদী। ছলনাময়ী। অনু আই হেইট ইউ। তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ।
বলেই দরজার কাছে ছুটে এল সে। ততক্ষণে তৌহিদ এসে দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর্ভিন চিৎকার দিয়ে বলল,
– তুমি ফিরে এসে আমাকে আর পাবেনা। আমি তোমাকে সবচাইতে বেশি ঘৃণা করি। তুমি কেন এটা করলে?
বলতে বলতে সে চারিদিকে তাকালো। পানির গ্লাস চোখে পড়লো তার। সেটা তুলে দেয়ালে ছুঁড়ে মেরে তার ভাঙা টুকরো হাতের বিঁধে দিয়ে ধীরেধীরে নিস্তেজ হতে হতে বলল,
– অনু প্লিজ কাম ব্যাক। আমাকে কেন ভালোবাসলে না?
অনন্যার বিদায়ের পর তৌহিদ, আদিত্য আবিষ্কার করলো খাটে হেলান দিয়ে ধসে পড়া থাকা আহাদ আলভীকে। যার হাতে বিঁধে থাকা ভাঙা কাঁচ। রক্ত গড়াচ্ছেই। দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে গেলে হয়ত সেইদিনই উনার শেষদিন হতো।

________

নিজের প্রাণ অবশিষ্ট থাকার আগঅব্দি আহাদ আলভী কখনো চাইতো না অনন্যা হাতে অস্ত্র তুলে নিক। জঙ্গলের একটা ঝোঁপের সামনে থেকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা অনন্যা ইয়াসমিনকে উদ্ধার করার পরপরই তৌহিদ আর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে পরিকল্পনাটা সাজিয়েছিল অনন্যা নিজেই। এসপি আহাদ আলভীও যেমন চাইতেন না অনন্যা হাতে অস্ত্র নিক তেমন অনন্যাও চায়নি আহাদ আইন নিজের হাতে তুলে নিক। ফাঁসির দড়ি নিজে পড়তে রাজী ছিল সে তবুও আহাদ নয়।
মেহযেব আর্ভিনের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিটি ক্লিপ দেখার পর অনন্যার মস্তিষ্কে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিলো। তাইতো আহাদের আড়ালে নিজের হাতে সে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো। যদিও সাক্ষী ছিল তৌহিদুর রহমান এবং মেজর মেহযেব আর্ভিনের সবচাইতে কাছের একজন সহকর্মী লেফটেন্যান্ট কর্নেল তায়েব ওসমান। আর্ভিন হত্যার পেছনের আসামীদের উনি সন্দেহ করলেও যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় অনন্যার কথাও বিশ্বাস করতে রাজী ছিলেন না তিনি। আইনও হাতে তুলে নেয়ার পক্ষে রায় দেননি।
যদিও অনন্যা ভুল করে আইন হাতে তুলে নেয় সবশেষে তাকে সারেন্ডার করতে হবে। এদিকে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই আহাদের দ্বারা প্রথম খুনটা হয়ে যায়। কর্নেলের সন্দেহ এসে পড়ে অনন্যার উপর। আহাদের দিকে সন্দেহ আসার পূর্বেই তৌহিদুর রহমান এবং উনার টিম মিলে অনন্যা একটা পরিকল্পনা সাজায়। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে থাকে। তাই আহাদ পৌঁছে যাওয়ার আগেই অনন্যার হাতে খুনগুলো সংঘটিত হয়েছে অনেকবার। তৌহিদ আর তার টিম আহাদের সামনে অনন্যাকে দাঁড় করিয়েছে একজন ভাড়াটে খুনী হিসেবে। অনন্যা শুধু খুন করেছে কিন্তু সবটা কৃতিত্ব তৌহিদুর রহমান আর তার টিমের ছিল। শত্রুর অবস্থান, পারিপার্শ্বিক নিরাপত্তাগুলো তারা নিশ্চিত না করলে ঠান্ডা মাথায় এমন সুনিপুণভাবে কেউ হত্যাকান্ড ঘটাতে পারেনা। তাছাড়া দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ফরেনসিক বিভাগের ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনের কাছে মানুষ কাটাকাটির ব্যাপারগুলো খুব বেশি ভয়ংকর নয়। শুধু পার্থক্য মর্গে মৃত দেহ, আর এখানে একটা তরতাজা প্রাণ।

অক্ষত ডান হাতটাতে তীক্ষ্ণ ব্যাথার আঁচ বুঝতে পেরে সদ্য জেগে উঠা আহাদ আলভীর প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া তৌহিদ আর আর তার টিম নানান গল্প সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু এসপি আহাদ আলভী বিশ্বাস করেছে কিনা তা বুঝে উঠতে পারেনি তারা।
তারপরেই চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটে গেছে। জিহা ছুটতে ছুটতে এসেছিলো তৌহিদুর রহমানের বাড়িতে। আহাদ সবেমাত্র বেরোতে যাচ্ছিলো। জিহা তাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
– ভাইয়া বাবা মরে গেছে। বাবার গায়ে সাতটা চাকু গেঁথে আছে।
আহাদের চোখজোড়ায় রক্তআগুন দপদপ করে জ্বলছিলো। কাঠকাঠ গলায় সে বলল,
– তোর বাবা আমার ভাইয়ের খুনী।
জিহা চেঁচিয়ে কেঁদে বলল,
– উনি আমার বাবা নন। আমার বাবা তো ওরকম নয়।
আহাদ শক্ত গলায় বলল,
– হ্যা উনি তোর বাবা নন। কারণ তোর বাবাকে চাকচিক্যের লোভ অনেক আগেই মেরে ফেলেছে। এটা শুধু তার দেহ’র মৃত্যু ঘটেছে। রাফাত ওকে সামলান। আমি আসছি।
জিহা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো। তারপর ধীরেধীরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। জ্ঞান ফেরার পর তৌহিদ বলল,
– আপনার বাবার লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেজর মেহযেব আর্ভিনের কবর দেখবেন?
জিহার মুখে বাকশক্তি ততক্ষণে হারিয়ে গেছে। কেঁদে উপর-নীচ মাথা দুলালো সে। তৌহিদ বলল,
– তাহলে নিজেকে শক্ত রাখুন।
জিহা কান্না গিলতে গিয়ে আবারও কেঁদে ফেললো। বাবার চেহারাটা ভাসছে তার চোখে। না না উনি তার বাবা নয়। বাবারা কখনো খারাপ হয় না। অন্যের কোলের সন্তানকে মারতে যে দুবার ভাবেনা সে কখনোই কারো বাবা হতে পারেনা। উনি তার বাবা নন, একজন খুনী। একজন বীর সৈনিকের খুনী। তার ভাইয়ের খুনী। যে ভাই বর্ডার থেকে ফেরার পর জিহারাণী বলে চেঁচিয়ে পুরোবাড়ি মাথায় তুলতো, যে তার জন্য ডার্ক কম্পাউন্ড চকলেট বার ছাড়া বাড়ি ফিরতো না, যে সুদূর বর্ডারে মিশন চলাকালীন তার জন্মদিনের উইশ করতে ভুলেনি।

চলমান…….