প্রেমদ্বন্দ্ব পর্ব-০৮

0
95

#প্রেমদ্বন্দ্ব_৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তৌহিদুর রহমানের বাড়িতে আজও এসেছে জিহা। গতকালকে এসেছিলো সে। তখন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে সে অফিসে যেতে পারছেনা। তাই বাধ্য হয়ে তৌহিদুর রহমানের বাসভবনে আসতে হয়। একজন কাজের লোক ছাড়া সেখানে কেউ থাকেও না। একজন মানুষের এত বড় বাড়ি কিসের দরকার জিহা জানেনা। জানার প্রয়োজনও মনে করেনা। সে এখানে এসেছে ভাবির খোঁজ নিতে। তৌহিদুর রহমান বলেছেন অনন্যা ইয়াসমিনকে তিনি খুঁজে পেতে চলেছেন। আর তা না হলে তিনি তাকে ফোন করবেন না। ফোন সে দু’দিন আগে পেয়েছে অবশ্য কিন্তু আসার কোনো সুযোগ পায়নি। জেম্মার গায়ে তীব্র মাত্রায় জ্বর উঠেছিলো। মা একা সামলাতে পারছেন না। বাবাও এখনো সেড়ে উঠেনি। তাছাড়া ডিটেকটিভ তৌহিদুর রহমান বারবার করে বলে দিয়েছেন সে এখানে আসছে একথা যেন সে ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি না জানে। বান্ধবী রিয়ার বাড়িতে যাচ্ছে বলে সে এখানে এসেছে। ভাবির খোঁজ পেলে তৌহিদুর রহমানের উপর পাকাপোক্ত ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবে সে। এছাড়া উনার কথা মেনে চলার মতো কোনো কারণ নেই। কাজের লোকটা ফোন করার পর ফোনের ওপাশ থেকে উনি বললেন,
– বসতে বলো। আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি।
কথা রেখেছেন উনি। বিশ মিনিটের মধ্যেই হাজির হলেন। বাড়িতে ঢুকামাত্রই তাকে হেসে বললেন,
– এসেছেন? বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
জিহা মৃদু হেসে বসে রইলো।
তৌহিদ ফ্রেশ হয়ে চলে এল। কাজের লোকটাকে বলল,
– চা দাও। আপনি কি চা খেতে পছন্দ করেন?
জিহা দু’পাশে মাথা নাড়লো।
– না কিছু খাব না।
– তা কি করে হয়? আমার সাথে চা খান। কাকা খুব ভালো চা বানায়।
বলেই জিহার সামনের সোফায় বসলেন।
– আপনার বাড়ির কেউ জিজ্ঞেস করেনি কোথায় যাচ্ছেন?
– করেছিল। বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি বলে এসেছি। ভাবির কোনো খোঁজ পেলেন?
– তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে জিহা।
– জ্বি বলুন।
– প্রথম প্রশ্ন আপনার বাবা আনোয়ার মীর্জা রাজধানীতে ছিলেন। সেখান থেকে চট্টগ্রামে আসার পরপরই কেন তিনি এসএসপির বাসভবনে গেলেন এই উত্তরে তিনি বললেন, উনাকে এসএসপি কামরুল হাসান ফোন করেছেন এসপি আহাদ আলভী হাইপার হয়ে গিয়েছিলেন বলে। এইকথার সাথে আপনি একমত?
জিহা সংকুচি স্বরে বলল,
– বাবা তো তাই বললো। বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই।
– স্পষ্ট করে বলার জন্য ধন্যবাদ। আনফরচুনেটলি আপনার বাবার সমস্ত জবান মিথ্যা। কারণ আপনার বাবার কললিস্ট আমরা চেক করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে সেই সময়ে তিনি এসএসপি সাহেবের একটা ফোনও পাননি। তারমানে তিনি মিথ্যে বলছেন। তিনি ইচ্ছে করেই ওই বাসভবনে গিয়েছেন।
– কিন্তু বাবা কেন মিথ্যে বলবেন?
– সেটা আপনার বাবাই জানেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন আপনি বলেছেন এমন একটা মেমোরি কার্ড যেটার কথা ডিএসপি সাজিদ আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলো। এমনকি আহাদ আলভীও সেই মেমোরি কার্ড পাওয়ার প্রচন্ড পরিমাণে উত্তেজিত ছিলেন। আপনি কি জানেন মেমোরি কার্ডটাতে কি ছিল?
জিহা বলল,
– না। আমি পাওয়ামাত্রই ভাইয়াকে ফোন দিয়েছি। ভাইয়া সেটা আমার কাছ থেকে নেয়ার পর দরজা বন্ধ করে ঘরে বসেছিল।
– আপনি কি সন্দেহ করছেন যে ওই মেমোরি কার্ডে এমন কিছু ছিল যেখানে মেজর মেহযেব আর্ভিনের খুনীদের কথা উল্লেখ ছিল?
জিহা অবাক হয়ে বলল,
– আমি জানিনা কিছু। আপনারা কি কেউ মেমোরি কার্ডটা উদ্ধার করতে পারছেননা? তাহলে তো সব বেরিয়ে আসবে।
– আমাদের কাছে নেই। থাকলে আহাদ আলভীকে এভাবে পালিয়ে থাকতে হতো না। আমাকে আরও একটা বিষয় ক্লিয়ার করুন, যদি আপনি জানতে পারেন আপনার ভাইদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের নামের মধ্যে আপনার বাবার নামটাও থাকে তাহলে আপনি কি করবেন?
জিহা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। বুঝাই যাচ্ছিলো সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে জানতো বাবা ভাইয়াদের পেশা নিয়ে বিরক্ত ছিল। সবকিছু উনার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। মায়ের কাছে শুনেছে বাবা আগে মদ খেত প্রায়সময়। জুয়া খেলতো। বড়আব্বা বাবাকে ব্যবসার হাল ধরিয়ে দিয়ে মাকে বাড়িতে বউ করে নিয়ে আসার পর বাবা ধীরেধীরে ওইসব ছেড়ে দেয়। বড়আব্বা বাবার নামে অনেকগুলো জায়গাজমি লিখেও দিয়েছেন। ব্যবসায়ে বিনিয়োগ দিয়েছেন। যখন যা লেগেছে ভাইয়ের জন্য দুহাত মেলে খরচা করেছেন। এতে তো বড়আব্বার প্রতি বাবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। সে তো সেটাই জানতো। বাবা তার দুই ভাইপোকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন বলে নিজের একটা পুত্রসন্তান নেই বলে কখনো আফসোস করেননি। কিন্তু এখন এসব কেন তাকে শুনতে হচ্ছে? সে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
– আপনারা ডিটেকটিভদের একটাই কাজ। যার-তার দিকে সন্দেহ ছুঁড়া। বাবা ভাইয়াদের ভালোবাসতো। বড় ভাইয়ার মৃত্যুতে বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। এমনকি ব্যবসা দেখভাল করতে না পারায় অনেক লসও খেয়েছিলো।
তৌহিদ হেসে বলল,
– ওহ ইয়েস। আপনি এখন মূল পয়ন্টে চলে এসেছেন। লস। এই লসটা উনি খেয়েছিলেন এসপি আহাদ আলভীর জন্য। ডিএসপি সাজিদ ভিকে ঔষধ কোম্পানির সিল মারার পাশাপাশি এমএ ঔষধ কোম্পানিতে যখন জাল ঔষধ তৈরির কাজকারবার দেখলেন তখন তিনি বেশিরভাগ কাঁচামাল রাতারাতি সরিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করেছিলেন যে কাঁচামালগুলো অনেক টাকায় ইমপোর্ট করেছিলেন আপনার বাবা। এসপি আহাদ আলভী যাতে জানতে না পারে বিষয়টা, তার জন্য তিনি ডিএসপি সাজিদকে কড়া ঘুষও দিয়েছিলেন। আপনি কি আমার কথায় খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছেন? এই যে চা চলে এসেছে। খেয়ে নিন।
বলেই তিনি কাজের লোকটার হাত থেকে চা নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। জিহা শক্ত হয়ে বসে রইলো। তৌহিদ লক্ষ করলো, তার চোখ টলমল করছে। কিন্তু অজানা অচেনা এই বাইরের লোকটার সামনে সে দুর্বল হতে প্রস্তুত নয়।
সৌজন্যেতার খাতিরে চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দেয়ার পর তৌহিদ পুনরায় বলল,
– ডিএসপি সাজিদের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছেন আপনার বাবা। আর একারণেই হবু শ্বশুরের সকল অপকর্ম ঢাকার জন্য সবসময় প্রস্তুত ডিএসপি সাজিদ।
জিহা চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে বলল,
– আমি আজ আসি।
তৌহিদ হেসে উঠলো। বলল,
– এটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে জুবাইদা মীর্জা।
জিহা আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল।
– আপনাকে আবারও আসতে হবে এটা লিখে রাখুন।
জিহার কোনো সাড়াশব্দ আর পাওয়া যায়নি। সারারাস্তা সে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরলো। তৌহিদুর রহমান যা বলছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বাবার অনেক বড় শাস্তি পাওয়া উচিত। বাবা কেন এটা করলো? কি পেল এতে?

আনোয়ার মীর্জা হাসপাতাল থেকে এসেছে। ডিএসপি সাজিদ উনার সাথে দেখা করার জন্য বাড়িতে এলেন। জিহা দরজা খুলে তাকে দেখামাত্রই বলল,
– আপনি? এখন?
সাজিদ বলল
– অবাক হলে? আসতে পারিনা?
– না এমনিই বললাম। আসুন।
সাজিদ আনোয়ার মীর্জার সাথে দেখা করতে চলে গেল। জিহা চা আনার জন্য রান্নাঘরে যেতেই জাকিয়া বেগম বলল
– হ্যা রে আহাদের কোন খোঁজ পায়নি সাজিদ?
জিহা দু’পাশে মাথা নাড়লো। চায়ের পানি বসিয়ে বলল,
– শিউলি আপা কাজে আসছেনা কেন?
– কি জানি। বাড়িটা ভূতের বাড়ি হয়ে আছে। বউটাও কোথায় গেল আল্লাহ মালুম।
জিহা বলল,
– আমার মাথা ব্যাথা করছে। চা টা তুমি দিয়ে এসো। আমি ঘরে যাই।
জিহা ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বাবা হাসপাতাল থেকে ফেরার পর নিশ্চিত করেছে ভাইয়া আর ভাবিকে খোঁজার জন্য যা করতে হয় তিনি করবেন। ভাইয়াকে ফিরে পাওয়ার পর সমস্ত অভিযোগ তুলে নেবেন। ওর চিকিৎসা দরকার শাস্তি নয়। বাবার কথা শুনে জিহার মনে হলো তৌহিদুর রহমান সব ভুলভাল কথা বলে তাকে পরীক্ষা করছিলো। কিন্তু তার সব ভুল ভেঙে গেল যখন সে নিজের কানে বাবা আর ডিএসপির সমস্ত কথোপকথন শুনে ফেলেছিলো। মা এসে বলল, ওরা নাকি ছাদে বসেছে। আমি ছাদ বাইতে পারছিনা। যা চা টা দিয়ে আয়।
জিহা বিরক্ত হয়ে চায়ের ট্রে নিয়ে ছাদে গিয়েছিলো। আর কথাগুলো খুব বেশি স্পষ্ট না হলেও কথার ফাঁকে ফাঁকে দুজনের হাসাহাসি দেখে জিহার পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিলো। বাবা বলছিলো,
– আরেহ আমি ওর প্রাণভিক্ষা দিয়েছি বলতে পারো। নইলে আমার হাতে কি ওকে মারার সুযোগ ছিল না? ও যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন ওকে মেরে ফেললে কেউ জানতে পারতো? এখন আফসোস করছি।
তার উত্তরে সাজিদ বলল,
– এখন আর আফসোস করে কি হবে। বাদ দিন। যাইহোক আজ উঠি। সিসিটিভি ফুটেজটা উদ্ধার করতে পারলে বখতিয়ার সাঈদির বাসভবনে কে ঢুকেছিল সেটা জানতে পারবো। তারপর নিশ্চিত হবো। আপনি চিন্তা করবেন না আমি সব আপডেট জানাবো। বারবার এখানে আসাটা আমার জন্য রিস্কি হয়ে যাবে।
আনোয়ার মীর্জা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
– ঠিক আছে। এসো। জিহার সাথে দেখা হয়েছে?
– হ্যা
বলেই সাজিদ ঘুরে দাঁড়ানো মাত্রই জিহাকে দেখে ফেলে অপ্রস্তুত হাসলো। নিজের বিস্মিত মুখখানা জিহা আড়াল করতে না পেরে কান্নায় ফেটে পড়লো। ট্রেটা নিয়ে ছুটতে গিয়ে হাত থেকে সেটা ছিটকে পড়ে গেল। তারউপর দিয়ে দৌড়ে জিহা ছুটে গেল। পেছন পেছনে সাজিদ ডাকলো।
– জিহা আমার কথা শোনো।
আনোয়ার মীর্জা চেঁচিয়ে বললেন,
– জিহা শোন। থামতে বলেছি আমি। এই জিহা।
জাকিয়া বেগম কিছুই বুঝলো না। শুধু দেখলো জিহা তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। উনি দরজা ধাক্কা দিয়ে বললেন,
– জিহা দরজা খোল মা। আমার কথা শোন।
জিহা চেঁচিয়ে বলল,
– আমার ভালো চাইলে এক্ষুণি দরজার সামনে থেকে সরে যাও। একটা কথাও বলবেনা।
আনোয়ার মীর্জা চুপসে গিয়ে বললেন,
– আচ্ছা সরে যাচ্ছি। আমি আর কিচ্ছু বলছিনা।
জাকিয়া বেগম বললেন,
– ওর আবার কি হলো?
আনোয়ার মীর্জা কর্কশ গলায় বললেন,
– কিছু হয়নি। ওকে একা থাকতে দাও। ওর কানের কাছে প্যানপ্যান করবে না।
জাকিয়া বেগম চলে গেলেন। জিহা দরজা খুললো প্রায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে। জাকিয়া বেগম তার ফোলা চোখমুখ দেখে অবাক হয়ে বলল,
– এভাবে কাঁদলি কেন? বিয়ের কথা শুনেছিস বলে?
জিহা মাকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কেঁদে উঠলো। তার মা’টা বড্ড সহজসরল। আর বাবা সেই সরলতার সুযোগ নিয়ে মাকে ঠকিয়ে এসেছে। স্বামীর প্রতি অন্ধবিশ্বাসী এই মহিলা যখন জানতে পারবে তার স্বামী তার সন্তানতূল্য একটা ছেলেকে খুন করার পেছনে দায়ী, অন্যজনকেও খুন করার চেষ্টা করেছে তখন কি করবে? জাকিয়া বেগম বলল,
– পাগল মেয়ে। মেয়ে যখন হয়েছিস তখন বিয়ে তো করতেই হবে। সাজিদ কিন্তু ছেলে ভালো। আহাদের সাথে তার কত ভাব। আমি ওকে বলে দিয়েছি আমার মেয়ে ওকালাতি করবে। ওকে ওকালতি করাতে পারলেই তবে বউ করে নিয়ে যাও। এত পড়াশোনা করে ও ঘরে বসে থাকবে না। ওর ভাইরা কত বড়মাপের মানুষ, ভাবিও একজন ডাক্তার। ও কি শুধু হাঁড়ি ঠেলবে?
মায়ের মুখের হাসি শেষবারের মতো দেখে জিহা নিজেও হাসলো। জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,
– তুমি এমন কেন মা?
– কেমন? বাপের মতো বল খুব খারাপ আমি।
জিহা কান্না চেপে বলল,
– না না। তুমি খুব ভালো মা। কিন্তু এত ভালো হতে নেই। জেম্মা আর বড়আব্বাকে কখনো পিছ দেবে না। ওরা না থাকলে তোমার আমার কোনো অস্তিত্ব নেই মা।
জাকিয়া বেগম সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল,
– ওমা এভাবে বলছিস কেন? ওদের দেখভাল তো করছিই। একথা বলছিস কেন?
জিহার কাছে কোনো উত্তর তিনি পাননি। কাউকে না বলেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তৌহিদুর রহমান উনার অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ছিলেন। সেক্রেটারি এসে বলল,
– একটা ম্যাডাম অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন স্যার। নামধাম বলতে চাইলেন না।
তৌহিদ বলল,
– মিটিং শেষ হওয়ার পর আসতে বলুন।
– জ্বি স্যার।
মিটিং শেষ অব্দি বসে রইলো জিহা। শেষ হওয়ার পর অফিসে ঢুকতেই তৌহিদ চোখ তুলে তাকে দেখামাত্রই হেসে বলল,
– কথা মিললো তো?
জিহা বলল,
– আপনি আমার ভাইয়া আর ভাবির খোঁজ জানলে আমাকে বলুন।
তৌহিদ চেয়ার হেলান দিয়ে বড়সড় শ্বাস ফেলে বলল,
– কেন? আপনার বাবাকে গিয়ে বলবেন?
জিহা ক্ষেপাটে স্বরে বলল,
– না। আমার ভাইয়ার খোঁজ থাকলে বলুন। ও অনেক অসুস্থ। আমাকে ওর প্রয়োজন। এভাবে মজা নেবেন না।
তৌহিদ বলল,
– আপনার ভাই ভাবির খোঁজ নেই আমার কাছে।
জিহা বলল,
– মিথ্যে বলছেন। আমি জানি আছে।
– কিভাবে জানেন?
জিহা অস্থির গলায় বলল,
– প্লিজ এমন করবেন না। আমার ভাইয়ার আমাকে খুব দরকার। একবার দেখা করিয়ে দিন। ও কেমন আছে আমি দেখতে চাই।
তৌহিদ বিচলিত হয়ে বলল,
– আরেহ আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি একটা কাজ করুন। আমার বাড়িতে চলে যান। আমাদের একসাথে বেরোনোটা রিস্কি।
জিহা বলল,
– আপনার বাড়িতে আমার ভাইয়া আছে?
– না নেই।
– তাহলে কেন যাব?
– তৌহিদুর রহমান এমনি কোনো কথা বলে না।
জিহা একা একা তৌহিদুর রহমানের বাসভবনে চলে এল। মন্তু কাকা বললেন,
– তুমি আবার এসেছ? বলো কি খাবে? চা না কফি?
জিহা উনার প্রশ্ন শুনে বুঝলো তিনি এই “চা না কফি” কথাটা বলতে অভ্যস্ত। জিহা কিছু খাবে না বলে বসে রইলো। একসময় খেয়াল করলো উপরের ঘর থেকে কেমন একটা আওয়াজ আসছে। মন্তু কাকাকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন,
– স্যার বেড়াল পালেন। তারাই এমন করে।
জিহা “ওহহ” বলে চুপটি করে বসে রইলো। তৌহিদ ব্যস্ত গতিতে বাড়িতে ঢুকে মন্তু কাকাকে কি যেন বলে জিহাকে বলল,
– উপরের ঘরে আসুন।
জিহা তার পিছুপিছু উপরের ঘরে যেতেই দেখলো ঘরের ভেতর হতে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। সাথে লোহার শিকলের। ঘরের দরজা খুলে টেনে জিহাকে ঘরে ঢুকিয়ে আবারও দরজা বন্ধ করে দিল তৌহিদ। জিহা আঁতকে উঠে বলল-
– দরজা কেন বন্ধ করলেন?
উত্তরটা তৌহিদকে দিতে হলো না। লাইট জ্বালানো-মাত্রই হাতে শিকল পড়িয়ে রাখা এসপি আহদ আলভিকে দেখে জিহা তার উত্তর পেয়ে গেল। ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে জিহা না কেঁদে পারলো না। ছুটে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে উঠলো সশব্দে। তৌহিদ তাকে টেনে এনে বলল,
– কান্না করার জন্য এখানে নিয়ে আসিনি আপনাকে। একথা যেন কেউ জানতে না পারে। উনি এই সময়টায় অনেক হাইপার হয়ে যান তাই উনার পরামর্শে এটা করেছি আমি।
জিহা জিজ্ঞেস করলো,
– কার পরামর্শে?
তৌহিদ কথা ঘুরিয়ে বলল,
– সে কথা থাক। আপনি কি এখানে থাকতে চান?
জিহা উপরনীচ মাথা দুলিয়ে বলল,
– হ্যা।
– কিন্তু এটা আমাদের জন্য রিস্কি। কারণ আপনাকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশ এখানে চলে আসবে। যেটা উনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আপনি বড়জোর একঘন্টা থাকতে পারবেন। তারপর চলে যেতে হবে।
বলেই তিনি চলে গেলেন। আর্ভিনরূপী আহাদ শিকল পড়া হাতদুটো নাড়তে নাড়তে বলল,
– অনুকে বল আমাকে ওরা বেঁধে রেখেছে। ওদের এতবড় স্পর্ধা কি করে হয়। ও আসছেনা কেন?
জিহা কাছে গিয়ে ওর গাল মুছে দিয়ে বলল,
– ভাবি একটা কাজে গেছে। শীঘ্রই চলে আসবে। তুমি কিছু খাবে?
– না না। অনুকে নিয়ে আয়।
জিহা চোখ মুছে বলল,
– তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। অনু তারপর চলে আসবে।
– এটা মিথ্যে।
– এটা সত্যি। ঘুমাও। দেখবে অনু চলে এসেছে।
পা খোলা থাকায় পা দিয়ে জোরে জোরে লাথি মারলো সে খাটে। তারপর বসে পড়লো। জিহা তার অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগলো। তৌহিদ এসে বলল,
– চলে আসুন। উনি রাতে খান না। আপনি বাড়ি ফিরে যান। আর আমার সাথে যোগাযোগ আছে এটা গোপন রাখবেন। সন্দেহজনক কোনো বার্তা পেলে আমাকে জানিয়ে দেবেন। আমার কাছ থেকে অনেককিছু লুকোচ্ছি যা সময়ের সাথে সাথে আপনি জেনে যাবেন।
জিহা সেদিন বাড়ি আসার পর আনোয়ার মীর্জার হাতে অনেক মার খেল কোথায় গিয়েছে তা না বলায়। মার খেলেও সত্যিটা বললো না জিহা। সে বাড়ি ফেরার পরই আরও একটি চমকপ্রদ নিউজ শুনতে পেল টিভিতে। বেলা দুটো নাগাদ অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রীতম চক্রবর্তী নিজ বাসস্থানে আত্মহত্যা করেছেন। চাপাতি দিয়ে নিজেই নিজেকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়ালে লিখে গেছেন ” আমি মেজরহত্যাকান্ডের একজন আসামী “।
আর পোস্টমর্টেমের পর এনালিস্টরা শনাক্ত করেছেন উনার রক্তে স্কোপালামিন কেমিক্যাল পাওয়া গিয়েছে বাকি কেসগুলোর মতোই। এবং দেয়ালের রক্তে উনারই ফিঙ্গারপ্রিন্টস পাওয়া গিয়েছে।
সংবাদের শিরোনামটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে বিপরীত হয়ে। সবাই মনে করেছে যারাই মেজরহত্যাকান্ডে জড়িত তারাই প্রীতম চক্রবর্তীকে খুন করেছে। এবং এসব তারাই করছে যারা পরিকল্পনা করে মেজর হত্যাকান্ড ঘটানোর পরপর একেকটা হত্যাকান্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে । এই হত্যাকান্ডের কোথাও এসপি আহাদ আলভীর নামধাম পর্যন্ত কারো মাথায় আসেনি আর্ভিনের হত্যাকারীরা ছাড়া। এসএসপি কামরুল হাসানও চুপ আছেন। কারণ এসপি আহাদ আলভীর দিকে আঙুল তুললেই উনি হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। কেন আহাদ আলভী প্রীতম চক্রবর্তীকে মেরেছেন তার কারণ উদঘাটন করতে গেলে উনার নামও চলে আসবে তাই উনার মনে হয়েছে চুপ থাকা শ্রেয়। কিন্তু শান্তি পাচ্ছেন না এই ভেবে যদি সেই কিলারটা আহাদ আলভী হয়ে থাকে তাহলে উনারও নিস্তার নেই। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছুদিনের জন্য দেশ ছাড়বেন।

তারপরের দিনগুলিতে মেজর মেহযেব আর্ভিনের খুনের সাথে জড়িত থাকা বাকি আসামীগুলোর মৃত্যুগুলোও হয়েছিলো বেশ রহস্যময় ভাবে। মধ্যেরাত্রিরে। এমন কোনো ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি যার দ্বারা প্রমাণ হয় এই খুনের সাথে আহাদ আলভী জড়িত আছে। রাতের মধ্যভাগে আহাদ আলভী পরিণত হয় মেজর মেহযেব আর্ভিনে সুতরাং তার দ্বারা তখন খুন করা সম্ভবও না।

নামকরা শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের খুন একনাগাড়ে হতে থাকায় উপরি মহল একটু নড়েচড়ে বসেন। এতবড় কেসটার দায়িত্বে প্রাইভেট গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পান স্বয়ং তৌহিদুর রহমান।
এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ডিটেকটিভ তৌহিদুর রহমানই বরঞ্চ এতদিন যাবত হয়ে আসা খুনগুলোর আসল রহস্য ধামাচাপা দিয়ে খুনের আসল উদ্দেশ্য ও রহস্য আড়াল করে আসছেন। এমনভাবে তিনি কেসটাকে প্রেজেন্ট করে আসছেন যাতে করে এই খুনগুলোর পেছনে রহস্য কেউ ধরতে না পারে। উনার বন্ধু সংবাদকর্মী রাফাত কবির, কম্পিউটার সাইন্সল্যাবের স্পেশালিস্ট সৃজন কুমার, ফরেনসিক বিভাগের ডক্টর আদিত্য শর্মা যারা কিনা অপরাধ জগতের সমস্ত কুকীর্তি জনসাধারণের সামনে নিয়ে আসার জন্য প্রানপণে লড়াই করে যায় তারাই এই প্রথম সাক্ষী ছিল দশ দশটা খুনের। এবং খুনগুলো সংঘটিত হয়েছিলো তাদের সাহায্যে। গুপ্তচর লাগিয়ে অপরাধীদের নজরে রাখা, তাদের প্রত্যেকের ডেইলি এক্টিভিটিস নোট রাখা, তারপর সুযোগমতো ঝাঁপিয়ে পড়ার সিগনাল দেওয়া প্রভৃতি কাজগুলো তারা দায়িত্ব নিয়ে করে যাচ্ছিলো আড়ালে।
আইনের রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়, তখন আইন নিজের হাতে নেয়া ছাড়া অপরাধ প্রবনতা কমানোর আর কোনো রাস্তা থাকে না। এসএসপি কামরুল হাসানের ঢিলেমি এবং এসপি আহাদ আলভীর উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখার পর তাদের সামনেও আর কোনো রাস্তা ছিল না।

_________________

চলমান