প্রেমদ্বন্দ্ব পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
144

#প্রেমদ্বন্দ্ব_১০
#সমাপ্ত_পর্ব
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ঘোর বর্ষা হওয়ায় রোজ নিয়ম মেনে আকাশের মন ভারী হয়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বরঞ্চ অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই।
মায়ের মুখখানা দেখতে পারছিল না জিহা। মা কাঁদছিল না কিন্তু মায়ের ভেতর যে ধ্বংসলীলা চলছিলো তা টের পাচ্ছিলো সে। জেম্মা আর বড় আব্বার সামনে গিয়ে সে আর দাঁড়াতে পারেনি। কোনমুখে দাঁড়াবে? তারা দেখামাত্রই বলতো তোর বাবা আমাদের সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। যাকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছি সেই আমাদের পিঠে ছুরি বসিয়েছে।
জিহা নিজে যতই অস্বীকার করুক, এটাই সত্যি সে আনোয়ার মীর্জার ঔরসজাত সন্তান। পুলিশ কর্মকর্তারা কবর দিয়ে ফেলেছিল মর্গ থেকে আসা আনোয়ার মীর্জার লাশটাকে। ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনের শরীরে তখন কি ভর করেছিলো কে জানে? চোখের পাতায় যতবারই মেজর মেহযেব আর্ভিনের খুনের দৃশ্যগুলো ভাসছিলো ততবারই তারমধ্যে অদ্ভুত একটা শক্তি বিরাজ করছিলো। এসপি আহাদ আলভী যাকে নিজের পিতৃসম জায়গা দিয়েছিলো তার বুকে ছুরি চালাতে নিশ্চয়ই হাত কেঁপে উঠতো তাই তো অনন্যা আহাদকে সেই সুযোগ দেয়নি।

কামরুল আর সাজিদ পালিয়েছিলো মথুয়া সুরঙ্গের ওখানে। মদ খেয়ে দুজনেই হাসতে হাসতে পাহাড়ি জঙ্গলের গোপন আস্তানা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো গহীন বনের ভেতরে। সবাই ব্যস্ত আনোয়ার মীর্জাকে নিয়ে। তাদের কথা কারো মাথায় নেই। সবাই জানার আগেই তারা গা ঢাকা দেবে ওখানে এমন পরিকল্পনা সাজিয়ে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু তারা জানতো না ড্রাইভারটি ছিল স্বয়ং সৃজন কুমার। ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিন আর এসপি আহাদ আলভীর কাছে সিগন্যাল পাঠানোই যার মূল কাজ ছিল। তবে এই বিশ্বাস অর্জন করতে গিয়ে সৃজনেরও অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। শুধু মেজরহত্যার প্রতিশোধ নয় কয়েক বছর আগে এই এসএসপি কামরুল হাসানের জন্য তার নিরপরাধ বোনের স্বামী রাজনৈতিক দলের নেতার হাতে খুন হওয়ার পরও কোনো বিচার পায়নি। তাই সুযোগ পাওয়ায় সৃজন দত্তও মেতে উঠেছিলো এই খেলায়।

এসপি আহাদ আলভী একটি সামান্যতম ভুলের কারণে তিনি অনন্যা ইয়াসমিনের আগে মথুয়া সুরঙ্গে পৌঁছাতে পারেননি। ভুল করে পুলিশ কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে যাওয়ায় পরপর তিনটি গাড়ি দাওয়া করে তার গাড়িটিকে। গুলি ছুঁড়ে গাড়ির চাকা নষ্ট করে দেয়ার পর আহাদকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিলো একটা বস্তি এলাকায়। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে তৌহিদের সাহায্যে নতুন গাড়ি যোগাড় করে মথুয়া সুরঙ্গের দিকে রওনা দেয়ার সময় আকাশ ভেঙে ঝপাঝপ বৃষ্টি নামা শুরু হলো। গহীন জঙ্গলের মধ্যে আটকা পড়ায় সৃজনের পক্ষ থেকে কোনো সিগন্যাল পাচ্ছিলো না তারা।

তৌহিদ, আদিত্য আর রাফাতের সাথে জিহাও ছিল। পুলিশ কর্মকর্তাদের গাড়িগুলো তাদেরকেও আটক করে ফেললো মাঝরাস্তায়। শুধু তাদের গাড়ি নয় অসংখ্য গাড়িকে তারা আটক করে রেখেছে। কড়া হুঁশিয়ারি জারি হয়েছে শহরের প্রতিটি অলিতে-গলিতে। ততক্ষণ আহাদ শহর ছেড়ে গেছে। পুলিশের একটা গাড়িও তার পিছু পিছু ছুটে গিয়েছে মথুয়া সুরঙ্গের দিকে। একের পর এক ধেয়ে চলা গাড়িগুলো শহর ছেড়ে যাচ্ছিলো তখন পুরো পৃথিবীটাই যেন ক্রমশ অন্ধকারে পতিত হচ্ছিলো। এমন উত্তেজনাকর সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিলো উপরিমহল পর্যন্ত।
আইজিপি স্যার এবং জেনারেলের নির্দেশে সেনা সদস্যরা পর্যন্ত ছুটছিলো মথুয়া সুরঙ্গের উদ্দেশ্য।

টিভির নিউজ চ্যানেলগুলোও একেকবার একেকরকম সংবাদ পরিবেশন করছিলো। বিশিষ্ট সংবাদ কর্মী রাফাতের সাহায্য প্রতিটি টিভি চ্যানেলগুলোতে চাঞ্চল্যকর তথ্য পরিবেশনের দরুন মেজর আর্ভিন হত্যার আসল খুনীদের জানার জন্য দেশের সর্বমহলের মানুষ উদগ্রীব ছিল রেডিওতে। মথুয়া সুরঙ্গটি বহু পুরোনো একটি সুরঙ্গ। বৃষ্টি পানির ঢল ঢুকে পড়ছিলো সেখানে। অন্ধকার সুরঙ্গটির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে গিয়েও অসুবিধায় পড়ে গিয়েছিলো কামরুল আর সাজিদ। তারা জানতোই না এই সুরঙ্গের কথা এখন সমগ্র দেশবাসী জেনে গিয়েছে। সৃজন চেষ্টায় ছিল সিগন্যাল পাঠানোর জন্য। কামরুল আর সাজিদ তখন একটা বিরাট পাথরের উপর বসে মদ খেয়েই যাচ্ছিলো। আজকের দিনটা কোনোমতে গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর আগামীকালই দু’জনই দেশ ছাড়তো। আনোয়ার মীর্জার হত্যাকান্ডে জড়িত থাকা খুনীর একটা লম্বা চুল পাওয়া গিয়েছিলো। সেটার ফরেনসিক হেয়ার এনালাইসিসের পর সেই কিলার ধরা পড়বে আর কেউ তাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। শহর থেকে অদূরে এই সুরঙ্গের ধারেকাছেও কেউ আসবে না এটা ছিল তাদের বিশ্বাস।

সুরঙ্গের পথ বন্ধ করে দিয়ে তারা বিশতম গলির কাছে এসে নিজেদের জন্য বিশ্রামাগার আবিষ্কার করলো । সৃজন দেখলো এটি শুধুই একটি সুরঙ্গ নয়। একটি মৃত্যুফাঁদ। বাঁশের মতো সাইজের একটি মোমবাতির মাথায় আগুন ধরিয়ে সুরঙ্গের ভেতরে যতই যাচ্ছিলো ততই তার মনে পড়ছিলো মেজর মেহযেব আর্ভিনের হত্যাকান্ডে দেখানো ঘরটার দেয়ালের কথা। ঠিক এমনই দেয়াল ছিল সেখানেও। ভূতুড়ে পরিবেশে যেমন গা ছমছম করে উঠে ঠিক তেমনভাবে গা ছমছম করে উঠলো তার।
আর ঠিক তক্ষুণি সুরঙ্গের মুখ বন্ধ করে দেয়া দরজাটাই শব্দ হলো বেশ জোরেশোরে। সৃজন উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কারা এল? দরজাটা খোলার পরপর ফের বন্ধ হয়ে গেল যদিও সে জানতো তাদের সাথে সাথেই ফরেনসিক এনালিস্ট ডক্টর ইয়াসমিনে ঢুকে পড়েছে।

গুলির শব্দ শুনে সাজিদ আর কামরুল সতর্ক হয়ে গেল। সৃজনকে একা রেখে তারা কোথায় হারিয়ে গেল সৃজন টেরও পেল না। সে নিজেও অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইলো। সতর্কবার্তা, সিগন্যালের শব্দ আসছিলো আগত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। মথুয়া সুরঙ্গ অব্দি পৌঁছাতে তাদের ঢের দেরী।
তারপরের ঘটনাটা লোমহর্ষক।
সুরঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়া আহাদ আলভি আর ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনের হাতের চাপাতির কোপ খেতে খেতে সুরঙ্গের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে খেয়ে আঁছড়ে পড়ছিলো কামরুল আর সাজিদ তার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সৃজন। তাদের মৃত্যু পথযাত্রাটা তারা নিজের হাতে সাজিয়েছিলো শহর থেকে নিয়ে আসা টুয়েলভ ইঞ্চি সাইজের মোমবাতি দ্বারা। হুডিপড়া ছায়াটির হাতের কোপ খেয়ে অন্য পথ দিয়ে পালাতে যেতেই আবারও সেই একই হুডিপড়া একটি ছায়ার সামনে গিয়ে পড়ে তারা। আর তারপরই খ্যাঁচখ্যাঁচ করে পড়া কোপ, আর সাথেসাথে নেমে আসা রক্তের ঢল কাঁদায় মিশে যাওয়া।

যখন মৃত্যুর কোলে তারা ঢলে পড়ছিলো প্রায়, শরীরের একেকটি অংশ যখন হারিয়ে যাচ্ছিলো একেকটি কোপে তখন তারা আবিস্কার করেছিলো একজন নয় বরঞ্চ দু দু’জন একেকদিক হতে একসাথে কুঁপিয়ে যাচ্ছিলো তাদের। যেন এভাবে কুঁপিয়ে মজা পাচ্ছিলো তারা। যেভাবে মেজর মেহযেব আর্ভিনের প্রতিটি আর্তচিৎকারে এই প্রকান্ড সুরঙ্গটি কাঁপছিলো ঠিক তার চাইতে শতগুন আর্তচিৎকারে সুরঙ্গটি কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো তখন।
অনন্যার হাতের শেষ কোপটা দেয়ার পর যখন কামরুল আর সাজিদের আর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া গেল না তখন গর্জাতে গর্জাতে ভাইয়ের কুড়িয়ে পাওয়া ঘড়ি আর মাথার টুপিটা ধরে চিৎকার করে সশব্দে কেঁদে উঠেছিলো এসপি আহাদ আলভী। যেই কান্নার প্রতিটা শব্দে থমকে গিয়েছিলো পুরো পৃথিবী আর তার একেকটা বেদনার স্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো এই বলে ” ভাই, দেখ তোর শরীর থেকে নির্গত প্রতিটি রক্তের দাম আমি দিয়েছি। ”
চারিদিকে অন্ধকার দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগমুহূর্তে অনন্যার শতক্ষত মিশ্রিত মুখটা কাছ থেকে দেখেছিলো সে। দু’পাশে ঘনঘন মাথা নেড়ে,
– না না তুমি নও, আমি খুনী।
বলতে বলতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো আর সৃজনের গায়ে ঢলে পড়লো।

আর তারপর অনন্যার কথামতো অসুস্থপ্রায় আহাদ আলভীকে কাঁধে তুলে নিয়ে সৃজন কুমার লুকিয়ে পড়লো সুরঙ্গ থেকে বহুদূরে একটা ডেরায়।

বৃষ্টির ভারী ঝমঝম শব্দের সাথে আর্মি সেনা সদস্যদের পায়ের শব্দ ঘন হয়ে এল। বাতাসের সাথে সাথে ছুঁড়ে পড়া গুলির শব্দ মিশে একাকার হয়ে গেল। সুরঙ্গের দরজা ঠেলে দলেদলে আর্মিসেনারা আর পুলিশ কর্মকর্তারা ঢুকে পড়লো সুরঙ্গের মধ্যে। তাদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগলো ভেতরে। সৃজন আহাদকে নিয়ে সন্তপর্ণে বেরিয়ে এসে সেই ডেরার পাশে চলে এল। আদিত্যর সাহায্যে হুডিটা খুলে কাঁদার নীচে লুকিয়ে ফেললো তারা। বৃষ্টিজলে রক্ত ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে আহাদের গায়ে নতুন শার্ট জড়িয়ে দিল। খুনীর কোনো চিহ্ন রাখলো না তারা আহাদ আলভীর গায়ে।

_________________

মেজর মেহযেব আর্ভিনের খুনের পর সেই দৃশ্যটা উনার মেমোরি কার্ডে পাঠিয়ে সমস্ত প্রমানসহিত যে ভিডিওগুলো ছিল সেইসব নিয়ে জব্বার পালিয়ে গিয়েছিলো ঠিকমতো তার কাজের নায্যমূল্য পায়নি বলে। আর মেমোরি কার্ডটা এসপি আহাদ আলভীর হাতে তুলে দেয়ার ভয় দেখিয়ে সে নাস্তানাবুদ করে এসএসপি কামরুল হাসানকে।
যারা যারা খুনের সাথে যুক্ত ছিল তারা সবাই তার পেছনে লেলিয়ে দেয় জহর সিং, নারায়ন সিং নামের দুই কুখ্যাত গুন্ডাকে। জব্বার তাদেরকে খুন করে পালিয়ে যায়। অপরাধ জগতের সাথে যুক্ত থাকার দরুন স্কোপালামিন কেমিক্যালটার সাহায্য নিয়েছিলো সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে লস্কর সিংয়ের হাতে আটকা পড়ে। উপরি মহলের কথায় স্কোপালামিন কেমিক্যালটা প্রয়োগ করে জব্বারকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে এসে তাকে মেমোরি কার্ডটা গিলে ফেলতে বলা হয়। জব্বার কথামতো তাই করে। আর পরে ছটপট করতে করতে একটা আবাসিক এলাকায় গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা পড়ে সে। পুলিশ সাধারণ লাশ ভেবে তাকে মর্গে পাঠিয়ে দেয় আর পোস্টমর্টেমের করার সময় মেমোরি কার্ডটা অনন্যার হাতে এসে পৌঁছায়। মেজর মেহযেব আর্ভিনের গায়ে চাপাতির কোপ দিতে থাকা লোকদুটোই ছিল সাজিদ আর এসএসপি কামরুল হাসান। পেছনে দাঁড়ানো ছিল আনোয়ার মীর্জা। বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলো।

সুরঙ্গের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কামরুল আর সাজিদের ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করে পর্দা দিয়ে ঢেকে বের করার পরেই কামরুলের লাশের পাশে মেমোরি কার্ডটা পেয়ে যায় আর্মি সেনারা। আর ভিডিওগুলো পাঠিয়ে দেয়া হয় । সেই ভিডিওগুলোর ছোট ছোট ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে দেশের আপামরসাধারণের কাছে। খুন, খুনের রহস্য, খুনের কারণ, আর খুনী সবকিছুরই সন্ধান দিল এই মথুয়া সুরঙ্গ।

এসপি আহাদ আলভির জ্ঞান ফেরার পর মুখ দিয়ে আর্তনাদ বের হচ্ছিলো শুধু। তার অনেক আগেই বৃষ্টি থেমে গেছে। মথুয়া সুরঙ্গের সামনে দেখলো প্রচুর ভীড়। আর্মি সেনা আর পুলিশ কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে। আহাদ আলভীকে ধরার জন্য যারা এতক্ষণ উদগ্রীব ছিল ভিডিওগুলো দেখার পর সবাই চুপসে গিয়েছে। সুরঙ্গের ভেতরে এখনো তল্লাশি চলছে। আহাদ টলতে টলতে চলে এল সেখানে।

কামরুল আর সাজিদ হত্যার খুনী আর অস্ত্রগুলো এখনো পাওয়া যায়নি। সংবাদকর্মীরা এসে ঘিরে ফেলেছিলো জায়গাটা। আর্মি সেনাদের উপস্থিতিতে ভীড় জমাতে না পারলেও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসপি আহাদ আলভীর কাছে বারংবার তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে যাচ্ছিলো,
– স্যার আপনি খুন করেননি? তাহলে কে করেছে?
আহাদের মুখে তখনও কোনো কথা নেই। জিহা এসে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে কেঁদেকেঁদে বলল,
– ডক্টর সুনাইরা জানিয়েছে ভাবির প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল।
কথাটা শোনার পর বোধহয় একবার পলক পড়েছিলো আহাদের। সাথে সাথে চোখ থেকে একফোঁটা গরম নোনতা জল। জিহা বলল,
– বাবুটা বোধহয় আর নেই। সব শেষ হয়ে গেল। সব।
জিহার কান্না থামে না।
তৌহিদ তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আহাদকে বলল,
– আহাদ প্লিজ রেসপন্স করুন। এখনো অনন্যাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আদিত্য আর সৃজন তাকে বুঝিয়েছে খুনী হিসেবে অনন্যার অনেকগুলো প্রমাণ ইতোমধ্যে উপরিমহল অব্দি পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু তার একটা প্রমাণও কেউ পায়নি। তাই অনন্যার সাথে সাথে নিজেকেও আইনের হাতে তুলে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অনন্যার এখন তাকে দরকার। সেও যদি আইনের হাতে বাঁধা পড়ে তাহলে অনন্যার জন্য আর কেউ থাকবে না।
ভেতরটা কষ্টে জখম হয়ে থাকায় মুখফুঁটে একটা শব্দও করলো না আহাদ। লেফটেন্যান্ট কর্নেল তায়েব ওসমান সব সত্যিটা জানে তাই আহাদের দিকে আঙুল তোলার কোনো কারণ খুঁজতে জাননি।
– স্যার স্যার সুরঙ্গের শেষে একটা ঘর আছে। আসুন আসুন। খুনীকে পেয়ে গেছি।
সবাই ধুপধাপ পা ফেলে ছুটে গেল সুরঙ্গের ভেতর।

আহাদকে নিয়ে তৌহিদ, আদিত্যরা যখন সেখানে উপস্থিত হলো তখন ওই ঘরটার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। যে ঢুকেছে সে বেরিয়ে এল মাথা নাড়তে নাড়তে। ধীরপায়ে হেঁটে টলতে টলতে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আহাদ দেখলো একটা কবর। যার নীচে শুয়ে আছে তার ভাই।
কবরের উপর পতাকা বিছিয়ে দিয়েছে আর্মি সেনারা। আর মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া তার ভাইয়ের রক্তের কালো দাগ। অদূরেই দুইটা চাপাতির পাশেই ঢলে পড়ে থাকা অনন্যা ইয়াসমিন। কাঁদায় মাখা মুখটা চেনা যাচ্ছেনা। ঘরটাতে পা দিতে না দিতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল আহাদ। অনন্যাকে বলল,
– এটা তুমি কি করলে? কেন করলে অনা? আমি আর কত হারাবো? আর কত?
তার চিৎকারে বোধহয় ফট করে চোখদুটো খুলে ফেলেছিল ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিন। আহাদ দেখলো চোখ খোলার পরও সে সেভাবেই পড়ে আছে। শুধু চোখ বেয়ে রক্তজলের মতো ধারা বয়ে যাচ্ছে অনর্গল। নড়ার শক্তিটুকুও নেই তার মধ্যে।

_______

মেজর মেহযেব আর্ভিনের কবরটা রাজধানীতে স্থানান্তরিত করার সমস্ত কার্য সমাধি আর ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনকে উদ্ধার করার পরই তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলো সবাই।
মেজর মেহযেব আর্ভিনের লাশের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার পর কবরটা তারা তুলে নিয়ে গেল রাজধানীতে। সেখানে সম্মানের সাথে উনার লাশ দাফন করা হলো। জানাজায় অসংখ্য মানুষ উপস্থিত ছিল সেদিন। আহাদ আলভীও ছিল।

নেট দুনিয়ায় বিক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো অনন্যা ইয়াসমিনের মুক্তি চেয়ে। যখন একজন আইনের রক্ষকদের দ্বারাই যাবতীয় সকল অপকর্ম সৃষ্টি হয়, আর তখন তারা নায্য বিচার পায়না। এসএসপি কামরুল হাসানের চাপা পড়ে থাকা সমস্ত কুকীর্তি একেরপর এক প্রকাশ পেতে থাকে এরপর। আর এতে জনসাধারণ আইনের উপর অবিশ্বাস এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে।
এদিকে ডাক্তাররা শনাক্ত করে ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিন গুরুতর মানসিক অসুস্থতা সাইকোসিসে ভুগছেন। যার ফলে তিনি হ্যালুসিনেশন এবং ডিলিউসনে ভুগছিলেন এবং বাস্তব জগতের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছেন। সেনাবাহিনীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং আইজিপির সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ আদালত এই মর্মে উপনীত হয় যে মানসিক রোগী ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনকে চিকিৎসার আওতায় রাখা হলো।
উনার দ্বারা আর কারো ক্ষতি হবে না এটা নিশ্চিত হওয়ার পর আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য তাকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।
আহাদ ততদিনে র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন তথা র‌্যাবের ডেপুটি ডিরেক্টর পদে যোগদান করেছিল। অনন্যাকে সে সপ্তাহে দুবার করে দেখতে আসে। আর দেখে সাদা কয়েদি শাড়ি পড়ে বাগানের আশেপাশে সে একটি বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে। তাকে দেখামাত্রই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়ে বলে,
– ও তার বাবাকে খুব মিস করে। আমাদেরকে নিয়ে যাও প্লিজ।
ওর কোলের বাচ্চাটাতে কোনো প্রাণ নেই। গতবার আসার সময় একটা মানুষরূপী রাবারের পুতুল নিয়ে এসেছিলো আহাদ। ওটাকেই ও নিজের সন্তান মনে করে।
ওর গর্ভের বাচ্চাটা মেজর মেহযেব আর্ভিনের দাফনের পরেরদিন দাফন হয়ে গিয়েছিলো মায়ের গর্ভ থেকে। সাথে আহাদ আলভীর মধ্য থেকে আর্ভিনস্বত্বাও। সেদিন অনন্যাকে যখন এম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন এম্বুল্যান্সের পিছু পিছু অনেকদূর অব্দি ছুটে গেল আর্ভিনরূপী আহাদ । জিহা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছিল,
– তোমার অনু আর বেঁচে নেই। তোমার বেবিটাও না। তুমি ওদেরকে মেরে ফেলেছ। ওই যে কবরটা দেখেছ ওটা তোমার। ওরা তোমার কাছে চলে গিয়েছে।
– তাহলে আমি কে?
– তুমি মৃত মেহযেব আর্ভিন।
ওর কথাটা শোনার পর আহাদ প্রতি রাতে প্রতিদিনের মতো অসুস্থ হয়ে যেত ঠিকই কিন্তু আর কখনোই নিজেকে আর্ভিন দাবি করেনি। অনু অনু বলে কাউকে ডাকেনি। নিজেকে মেহযেব আর্ভিন দাবি করা মানুষটাকে জিহাও ওই বন্ধ দরজার বাইরে আর দেখতে পায়নি। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর কয়েকঘন্টা সে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত থাকতো। তখন কি হতো ওর কে জানে? হয়ত অনুবিহীন নিজেকে মেহযেব আর্ভিন বলে দাবি করতে চাইনি আর। তাই তো অনু না থাকায় নিজের অস্তিত্ব সে অস্বীকার করেছিলো।
দুমাসের মাথায় কাউন্সিলর তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল, সে বিদায় হয়ে গেছে। আহাদ আলভী সম্পূর্ণ সুস্থ।
এই একটা কথা শুনে খুশি হওয়ার বদলে জিহা কেঁদেছিল খুব। তার মনে হয়েছিলো, যেন সত্যি সত্যি আহাদ আলভীর মধ্যে এতদিন মেহযেব আর্ভিন বিরাজ করছিলো। অথচ সবকিছু আহাদ আলভীর মনস্তাত্ত্বিক কল্পনার জগত বৈকি অন্যকিছু ছিল না। সেই জগতের মেহযেব আর্ভিন আর অনুর মৃত্যুটা অদৃশ্যমান হলেও জিহা যেন এই অদৃশ্য মৃত্যুটার আবিষ্কারক ছিল। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যেত সেই আর্ভিনরূপীর ডাকে। সে ডেকে ডেকে বলতো,
– এই জিহা অনুকে ডেকে দে। ওকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না।

আরেকবার সে একটি ছোট বাচ্চাকেও দেখেছিলো স্বপ্নে। দেখেছিলো সেনাবাহিনীর পোশাক গায়ে পোড়খাওয়া আর্মি অফিসার মেজর মেহযেব আর্ভিনের কোলে একটা ফুটফুটে শিশু। উনি হাঁটছিলেন বাচ্চাটিকে উপরে ছুঁড়ে আবারও ধরে। বাচ্চাটি খিলখিল করে হাসছিলো। তার সাথে খিলখিল করে হাসছিলো তাদের পাশাপাশি হাঁটতে থাকে সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলাটি। যাকে বারবার অনু বলে সম্বোধন করছিলো মেজর আর্ভিন। চাঁদের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে কোন এক সুশোভিত উদ্যানের পথ ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছিলো তারা।

মাঝরাতে চিৎকার দিয়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ার রোগে অনেকদিন ভুগেছিলো জিহা। নিজেকে কেমন জানি অপরাধী মনে হয়েছিলো অনেক। তারপর একদিন ডিটেকটিভ তৌহিদুর রহমানের হাতে তাকে তুলে দিয়ে র‌্যাবের ডেপুটি ডিরেক্টর আহাদ আলভী বলেন, তদন্ত করে অমন অদ্ভুত রোগের আবিস্কার করার ক্ষমতা একমাত্র ডিটেকটিভদেরই থাকে। তৌহিদুর রহমানের সান্নিধ্যে এসে সে সুস্থ হয়েছিলো ঠিক কিন্তু ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনের মুক্তির দুই বছরের মাথায় যখন তাদের কোলে একটা ফুটফুটে সন্তান এল। স্বপ্নের সেই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যটা পুনরায় ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। সে দেখলো ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে মিশন ছেড়ে ছুটে আসা র‌্যাবের পোশাক পরিহিত ডেপুটি ডিরেক্টর আহাদ আলভীর কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা হাসছে, সাথে সাথে হাসছে তার স্ত্রী, সন্তানটার মা। জিহার চোখে জল নেমে এসেছিলো তখন। তৌহিদ জিজ্ঞেস করলো,
– বউ কাঁদে কেন?
জিহা অস্ফুটস্বরে বলল,
– ওরা মরেনি। ওরা ওইতো। মেহযেব আর্ভিনের জায়গায় আহাদ আলভী আর অনুর জায়গায় অনা। ওরা বেঁচে আছে।

সমাপ্ত….