প্রেমনদীর মাঝি পর্ব-০৬

0
321

#প্রেমনদীর_মাঝি
#পর্ব_৬
#মুসফিরাত_জান্নাত

সকালে সূর্যের আগমনী বার্তা স্বরুপ জানালার পর্দা গলিয়ে এক ফালি রোদের ফালি আছড়ে পড়লো আমার চোখে মুখে।যা ঘুম ভাঙিয়ে দিলো আমার।চরম বিরক্তি নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ রেখেই পাশ ফিরে শুয়ে সূর্যের গুষ্টি উদ্ধার করলাম।

“ক্যারে ব্যাটা, ওঠার আর সময় পেলি না?রোজ রোজ সকাল সকাল তোর আগমন হতে হয় কেনো?অন্য গ্রহে ভাত পাস না নাকি?প্রত্যেকদিন দুনিয়ার বুকে আশ্রয় খুঁজতে আসিস।আর আমার মতো অবলা নারীদের ঘুম ভাঙাস।তোকে কাছে পাইলে ভিতরের সব বাত্তি ফিউজ করে দিবো,তখন জ্বলে দেখাইস।হুহ, বেদ্দপ কোনহানকার।”

নিজ মনে বিরবির করলাম আমি।এরমাঝে ঘরে এক কাপ সবুজ চা হাতে প্রবেশ করলেন রহিমা চাচি।নিভৃত ভাই প্রতিদিন সকালে সবুজ চা পান করেন।সেই নিয়ম রক্ষার্থেই আগমন হলো চাচির।তা ওনার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম।নিভৃত ভাইয়ের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে আমাকে বন্ধ চোখে বিরবির করতে দেখে রহিমা চাচি বললেন,

“বাবু আপনের বউ ঘুমের ঘোরেও বকবক হরে নাহি?আজব সিস্টেম সেট করা মাইরি।এমন চিজ আর দুখান দেখিনাই।”

প্রতিউত্তরে উনি বললেন,

“নিজের কাজে যান চাচি।অন্যের সিস্টেম নিয়ে ভাবতে হবে না।”

রহিমা চাচি তখনও কথার খেই ধরে বললেন,

“ভাবলাম আর কনে?নিজ চক্ষে দেখলাম।তবে যাই কন, সত্যি আপনার বউ আজব।নইলে কেও পড়ালেহার সুযোগ ছাইড়্যা বিয়া হরে?”

এবার কিছুটা বিরক্ত হলেন উনি। গাঢ় স্বরে বিরক্তি মিশিয়ে বললেন,

“বিয়ে হলে পড়ালেখার সুযোগ চলে যায়, এ কথা আপনাকে কে বলেছে চাচি?”

“ও বলতে হয় নাহি! মাইয়া মানুষের জীবন জানা আছে আমার।বাপের ঘরেই যে পড়ে নাই, হে সোয়ামীর ঘরে পড়বো?”

“হ্যাঁ পড়বে।আপনি এবার কাজে যান।”

গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন উনি।রহিমা চাচি যাত্রাপথে আবারও বিড়বিড় করলো,

“আজব সিস্টেম!”

কথাটা কানে আসতেই চট করে বসে পড়লাম আমি।আমাকে এভাবে বার বার আজব বলে অপমান করা হচ্ছে, আর আমি ঘুমের নেশায় চুপ করে থাকবো?নেভার, আর সহ্য করতে পারলাম না আমি।নিজের অতৃপ্ত ঘুমের ইচ্ছেটুকু দমিয়ে রেখে ঘুম জড়ানো গলায় ত্যারা কথাটা বললাম,

“আপনাদের সিস্টেম তো আরও আজব চাচি।খান নিজের পয়সায় আর লেগে থাকেন অন্যকে বিশ্লেষনে।এইজন্যই আপনারা মানুষের মুখে উচ্চারণ করা কথা কানে না শুনে চক্ষে দেখেন।আপনাদের চোখে হলো ডাবল পাওয়ার।মোটা কাঁথার উপর, নিচ, তল সব জায়গা, এমনকি অন্যের বাড়ির দেওয়ালও ভেদ করে দেখতে পান।তারপর সিসিটিভি ক্যামেরার মতো সব সংরক্ষন করে অন্যের ঘরে চালান দেন।কোনো বেতন ভাতাও না পেয়েও নিজ উদ্যোগে এই কাজ সচল রাখেন।এর চেয়ে আজব সিস্টেম আর কোনটা হতে পারে?”

আমার কথায় ভড়কে গেলেন চাচি।পরক্ষণেই সুক্ষ্ম অপমান ধরতে পেরে মুখ শুকিয়ে ফেললেন।তারপর চলে গেলেন ঘর ছেড়ে।

মানুষের এই এক গুন।অন্যের দোষ খুঁচিয়ে বের করে যখন খুব মজা পায়, তখন মুখে মধু ঝরে।অতপর যখন তার জবাব দেওয়া যায় তখন মুখে যেন করলার রস পড়ে।মুখ ভোতা করে চলে যায় তখন।রহিমা চাচিও ওই দলে যোগ দিয়েছেন।

আমার ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে।আজ আর ঘুম হবে না তাই ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে।প্রায় আধা ঘন্টা সময় লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি উনি ওভাবেই বসে রয়েছেন।মনে মনে অবাক হলাম আমি।রোবট নাকি?কখন থেকে এক ধ্যানে বসে আছে।কেমনে থাকে ভাই?আমি চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলাম।আমাকে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন,

“এভাবে দেখার কিছু নেই।ফুরিয়ে যাচ্ছি না আমি।চাইলেও তোমার চোখের সামনে আজীবন পড়ে থাকবো, না চাইলেও থাকবো।”

কথাটা উনি এমন ভাবে বললেন যেনো ওনার দিকে তাকানোতে অস্বস্তি হচ্ছে ওনার।অস্বস্তির কি আছে রে ব্যাটা? আমি কি তোর প্রেমে পড়ছি নাকি? যে অস্বস্তি হবে।ভাব দেখে বাঁচি না।যত্তসব ঢং।সাথে সাথে দৃষ্টি ফেরালাম আমি।তারপর ওষ্ঠ দ্বয় নাড়িয়ে আওড়ালাম,

“বয়েই গেছে আপনাকে দেখতে।আমি তো ভাবছি এতো সময় এক ভাবে বসে আছেন কেমনে?হাও?পাছা লেগে যায় না আপনার?”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়ার সাথে সাথে ওনার কণ্ঠ নালী ছিটকে বের হলো দুটি শব্দ,

“হোয়াট রাবিশ!”

তড়িৎ জিভ কা’টলাম আমি।মনে মনে বললাম,

“পুষ্প তুইও না।আসলেই আজব।কোথায় কি বলিস, বুঝে পাস না।উনি কি তোর বান্ধবী লাগে যে এতো খোলামেলা কথা বলিস?এখন কি ভাবছেন উনি!”

ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছেন।খুব অস্বস্তি হলো আমার।দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।এমন কথার পর আর ওনার সামনে থাকা যাবে না।আজ সারাদিনের মনে লাপাত্তা হবো আমি।এই নিয়তে কক্ষ ত্যাগ করলাম।
_____
এই অলস সকালে নিজ ঘর রেখে কোথায় সময় কাটাবো বুঝতে পারছি না।তড়িঘড়ি করে আসার সময় নিজের ফোনটাও সঙ্গে আনিনি।তাছাড়া সময় কাটানো নিয়ে চিন্তাই থাকতো না।পাঁচ মিনিট ফোন চালালে দেখা যায় এক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে।আমি না হয় বড়জোর আধা ঘন্টা ফোন স্ক্রল করে ওনার হসপিটাল যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতাম।কিন্তু তা আর হলো কই?

ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়লাম আমি।খালামনি রহিমা চাচির সাথে কিচেনে রান্না করছে।আমি সেখানটায় উঁকি দিয়ে নিশিদের ঘরে পা বাড়ালাম।নদী আপু আজ বাড়ি নেই।কাল বান্ধবীর বাড়িতে তার বিয়ে খেতে গিয়েছে।ফিরবে তিন দিবস পর।ঘরে একমাত্র নিশির অবস্থান। আমি মনে মনে পরিকল্পনা করলাম চুপি সাড়ি পৌঁছে ওকে একটু ভয় দেখাবো।তাই পা টিপে টিপে ওর ঘরে প্রবেশ করলাম।দেখি নিশি টেবিলে বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিছু একটা পড়ছে।আমার আরও একটু সুবিধা হলো।খুব সতর্ক থেকে ওর পিছে গিয়ে ভাও দিয়ে চমকে দেওয়া যাবে।কিন্তু ওকে চমকানোর আগেই চমকে গেলাম আমি।নিশি কারো লেখা পত্র পড়ছে।তাও সাধারণ কোনো পত্র নয়, ডাইরেক্ট প্রেমপত্র।যা দেখে চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার।ও যে কারো সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হতে পারে তা ধারণাই করা যায় না।এই মেয়ের মেধা প্রচুর।তার ভাইয়ের রেপ্লিকা হয়েছে যেনো।প্রত্যেক ক্লাসে ফার্স্ট হয়।সব সময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।সেই মেয়ে প্রেম করে এটা বিশ্বাস করি কি করে?এই বয়সে প্রেম করলে তো মানুষ ফাঁকিবাজি হয়ে যায়।পড়ালেখায় কম সময় দিয়ে প্রেমে বেশি সময় দেয়।ফলাফল পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ।কিন্তু নিশির ক্ষেত্রে তা হয়নি।ও দুটো সমান তালে সামলাচ্ছে কি করে?
এজন্যই কি কয়েকদিন হলো লেখাপড়ার বাইরেও একটু এদিক সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে ও?এই যেমন নিজের ফ্যাশন সেন্সের পরিবর্তন করেছে। আগে কোনো রকমে দুই বেনী বেঁধে কলেজ যেতো সে।ইদানীং বেশ যত্ন নিয়ে চুল বাঁধে , মুখে হালকা সাজসজ্জাও করে।যদিও প্রাকৃতিক ভাব বজায় রাখায় তা দৃষ্টিতে পড়ে না, তবে বেশ আকর্ষনীয় লাগে দেখতে।আবার আগে ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়লেও ইদানীং বাঙালি মেয়েদের পোশাক গায়ে জড়াচ্ছে।তাছাড়া আবার সেদিন কেমন মিষ্টি করে এসে ক্ষমা চাইলো।সেদিন তার আমাকে ওভাবে বলা উচিৎ হয়নি আরও কত কি বলে ক্ষমা চাইলো।এই ব্যাপার গুলো ওর মাঝে আগে দেখা যেতো না।মেয়েটা যেনো হুট করেই বড় হয়ে গেলো।অনেক কিছু আড়াল করতে শিখলো।মেয়েরা প্রেমে পড়লে কি এভাবেই বদলে যায়?

অন্যের পত্র অনুমতি বিহীন পড়া নিষেধ।এছাড়া অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে হুট করে ইন্টারফায়ারও করা উচিৎ নয়।কিন্তু এই মুহুর্তে উচিত অনুচিত বিবেচনা বোধ কাজ করছে না আমার।নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে চিঠির সম্বোধন দেখতে লাগলাম।সম্বোধনীতে ছেলেটি লিখেছে,
প্রিয় বাবুর আম্মু,আর সমাপ্তি স্থানে ইতি তোমার বাবুর আব্বু।এটা দেখেই মাথা ঘুরতে লাগলো আমার।সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠলো ও।এই বয়সে কিনা এমন সম্বোধন! ও কি সত্যি প্রেগন্যণ্ট নাকি?প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মাথা আরও চক্কর দিলো।কোনো মতো নিজেকে সামলে ধপ করে খাটে বসে পড়লাম আমি।আমাকে দেখে তড়িঘড়ি করে চিঠি আড়াল করলো নিশি।যদিও সে বুঝে ফেলেছে আমি ওর পত্র দেখেছি, তবুও লুকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর কি।অতপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্যাবলাকান্ত মার্কা হাসি দিলো ও।আমিও ওর হাসির বিপরীত ক্রিয়ায় বললাম,

“তুই প্রেম করিস নিশি?”

আমার কথা শুনে এক গাল হাসলো ও।তারপর বিবৃতি দিয়ে বললো,

“আরে নাহ, প্রেম করতে যাবো কেন দুঃখে?একটা ছেলে কিছু দিন হলো পিছু নিয়েছে।রোজ একটা করে চিঠি দেয়।এটা কাল দিয়েছে।”

কথাটা বলে দাঁত কপাটি করে হাসলো সে।আমি চোখদুটো সরু করে বললাম,

“ভাওতা মা’রার জায়গা পাও না, না?এই বুঝাও আমাকে?প্রেম না থাকলে বাবুর আম্মু ডাকে?এ সত্যি সত্যি কি খালা হব আমি?”

কথাটা ওর দিকে ঝুঁকে বললাম আমি।তড়িৎ প্রতিবাদ করলো ও,

“আস্তাগফিরুল্লাহ! এসব কিধরনের কথা বার্তা আপু?ভাইয়ার লগে বিয়া হইতে না হইতেই ভাবি বনে গেছাও।এই তোমার বিচার!বাহ!”

“হ বনছি ভাবি।তুই যে তলে তলে টেম্পু চালাইয়া আমাগো থেকে লুকাস, তার বেলায় কি?”

“শোনো, এসব ফালতু কথা বলবা না।আমি টেম্পু কেন রিকশাও চালাই না।ওই ব্যাটাই চিঠি দিতে দিতে চিঠির মধ্যে সংসার পেতে বসছে।আগে তো চিঠিতে সঠিক সম্বোধন করতোই না, তারপর একদিন চিঠিতে বাবুর কথা লিখলো।তখন হয়তো ওনার নাম লুকাতে আরও সুবিধা হলো।তখন থেকে বাবুর আম্মু, আব্বু, খালা, খালু এসব লেখা ধরছে।অথচ ওই বাবুর আব্বুর মুখটাই এ অবধি দর্শন করিতে পারিলাম নাহ।রোজ গেটে বিদ্যুৎ বিল দেয়ার বক্সে ঠুকে দিয়ে যায়।”

“সত্যি?”

দ্বিধা ভরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।ও পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,

“তিন সত্যি।”

“তাহলে তুই ওই চিঠি এনে পড়িস কেন?”

সন্দিহান হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলাম আমি।এবার ও খানিকটা ঝুঁকে এসে বললো,

“আরেকটা সত্যি বলবো?”

“হু।”

“আমার না ওনার দেওয়া চিঠি পড়তে ভালোই লাগে।”

বলে লাজুক হাসলো ও।আমি সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠলাম,

“হায় আল্লাহ! তুই তো শ্যাষ গেদী।তোদের প্রেম হলো বইলা!”

“আরে আপু আস্তে চেঁচাও, আম্মু শুনবে।”

সাবধানী হয়ে কথাটা বলে আমার মুখ চেপে ধরলো নিশি।আমি দুই চোখ দিয়ে তখন বিষ্ময় প্রকাশ করতে লাগলাম।হটাৎ এই বিষ্ময়ের ঢেউ নিশির চোখেমুখেও ছড়িয়ে পড়লো।সাথে তটস্থও হলো সে।ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি দরজায় নিভৃত ভাই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন।তবে কি উনি আমাদের কথা শুনে ফেললেন?এবার নিশির কি হবে?

চলবে