প্রেমপ্রদীপ পর্ব-০৬

0
4666

#প্রেমপ্রদীপ
part–6
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সমুদ্র বিছানায় আধমরা হয়ে শুয়ে আছে। কালকে সারা রাত জ্বরে ভুগে পার করেছে সে।এখন সকাল। তবুও উঠতে ইচ্ছা করছে না তার। মাথাটা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে তার। গায়ে জ্বর নেই। তারপর ও উঠতে ইচ্ছা করছেনা। বিছানাটাকে অসহ্য লাগছে তার। এই বালিশ, চাদরে জ্বরের ছোয়া আছে। সমুদ্র বিরক্ত হলো। তার মন চাচ্ছে এখনি বিছানার চাদর চেঞ্জ করে একটা শান্তিময় ঘুম দিতে। কিন্তু তাকে উঠতে হবে৷ ঔষধ নিতে হবে তাকে। কালকে সকাল বেলায় সেফ থ্রি খেয়েছিল। একটা খেতেই জ্বর সেরে গেছে। কিন্তু তিন দিন পর্যন্ত ঔষধ খেতে হবে৷

সমুদ্র তবুও কাথাটা জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকল। সে চোখ বুজে রেখেই বুঝতে পারছে, কেউ একজন তার রুমে এসেছে৷ এবং বই-পুস্তক গুছিয়ে রাখছে৷

সে চোখ খুললোনা। সেই কেউ একজন এসে তার কপালে হাত দিল এবং খানিকটা জোড়ে শব্দ করে বলে, এই জ্বর নাই তো!

সমুদ্র চোখ খুলল। তার সামনে ফুপু দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র মুচকি হেসে বলে, হু। ভোরের দিকে জ্বর সেরে গেছে৷

–যাক। ভালো। কি যে টেনশন হচ্ছিল। এতো অসুস্থ কেন হস তুই?

–জানি না তো!

— আয়। নাস্তা খা। শুকনা রুটি আর সবজি করছি। চা খাবি?

–না। কয়টা বাজে?

–নয়ট বাজতে চলল।

সমুদ্র লাফ দিয়ে উঠে বসে এবং ফুপুকে উদ্দেশ্য করে বলে, এতো বেলা হয়ে গেছে!

–হ্যা।

–ডাক দাও নি কেন?

— তোর জ্বর এজন্য ডাকিনি৷

সমুদ্র দ্রুত উঠে বাথরুমে গেল এবং ফ্রেস হয়ে এসে বলে, আজকে হাসপাতালে ইমার্জেন্সি কাজ আছে। দশটায় সব ডাক্তার কে উপস্থিত থাকতে বলছে। আর ওলরেডি নয়টার বেশি বাজে। তার উপর কালকে এক বিষ খাওয়া রুগী আসছিল। ওনার জ্ঞান ফিরছে কিনা জানি না।

ইভানা কিছুটা নরম গলায় বলে, আজকে যাস না রে। তোর শরীর ভালো না।

সমুদ্র শার্ট ঠিক করতে করতে বলে, আজকে না গেলে চাকরি থেকে বের করে দিবে। আমি নাস্তা খাবনা। রুচি নাই। ঔষধ খাব। পানি দাও তো এক গ্লাস৷

— খালি পেটে ঔষধ খাবি?

–আচ্ছা। নাস্ত দাও।

সমুদ্র নাস্তা খেয়ে বের হলো। বর্তমানে সে চিটাগং এ থাকছে। বর্তমানে না। প্রায় অনেক বছর ধরেই চিটাগং এ থাকে সে। এখানেই পড়াশোনা করেছে । ক্লাস ওয়ানে এসে ভর্তি হয়েছিল আর এখন ডাক্তার হয়ে এখানেই চাকরি করছে। চিটাগং এর একটা প্রাইভেট মেডিকেলে ডাক্তারি পড়েছে সে। সরকারি তে চান্স পায় নি!

তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে পৌছালো সমুদ্র। দেরি হয় নি। পাচ মিনিটের মতো সময় আছে। দশটায় বাজে নি এখনো। সে মিটিং রুমে গিয়ে তার চেয়ারে বসল।

মিটিং চলাকালীন প্রচুন্ড ঘুম পাচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল ডেস্কে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে যেতে পারবে সমুদ্র। বহু কষ্টে জেগে আছে সে৷

মিটিং শেষে রুম থেকে বের হলো। এখন ওয়ার্ড ভিজিট করতে হবে তাকে। বিষ খাওয়া রোগীটাকে দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করছে৷ এক বিশেষ মায়া কাজ করছে ওই মেয়েটার জন্য। একবার গিয়ে দেখা করতে হবে। যদিও আসার পর পর নার্সের কাছে শুনে নিয়েছে যে রোগীর জ্ঞান ফিরেছে কিনা৷

নার্স তো বলেছে সকালেই জ্ঞান ফিরেছে। এখন ঠিক আছে। তাও একবার দেখা করতে মন ব্যাকুল হয়ে আছে। আচ্ছা মেয়েটার চেহারা কি তার পরিচিত কারো সঙ্গে মিলে? এই মূহুর্তে মনে আসছে না তার৷

সমুদ্র এপ্রোনটা গায়ে ঠিক ভাবে জড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো৷

★★★

ইভানা সমুদ্রের রুম গুছাচ্ছিল। তখনি বেল বেজে উঠল। সে রুম গুছানো বাদ দিয়ে গেট খুলতে গেল৷

গেটের বাইরে একটা যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় এক গোছা চুল। কিন্তু খুব সুন্দর করে ছাটাই করে কাটা। পরনে মেরুন টিশার্ট।

ইভানা ছেলেকে দেখে বলে, তুই! আজকে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলি?

— আমি কি চাকরি করি যে নয়টা টু পাচটা অফিস করে বাসায় ফিরব।

ইভানা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, চুল কাটছিস নাকি?

— হ্যা। সেলুনের ওই দিকে যাচ্ছিল। চুল কেটে আসলাম। মাথায় খুসকি হইসে। চুলকায়।

ইভানা ছেলেকে এক গ্লাস লেবু পানি দিয়ে বলে, শ্রাবণ, চাকরি-বাকরি কিছু করবি না তুই? বেকার থাকবি? তোর বাবা প্রতি দিন আমাকে কথা শোনায়৷

— চাকরি না পাইলে আমি কি করব? বল তো! কেন সিএসসি পড়াইলা? এখন চাকরি নাই৷

ইভানা কঠিন গলায় বলে, সিজিপিএ দুই পাইলে চাকরি পাবি কেমনে? কতো করে বলতাম পড় ভাল করে। না কথা কানে যায় না। প্রেম করায় ব্যস্ত ছিলি। এখন বেকার থাক। ডাক্তার হইতি।তা না কি ইঞ্জিনিয়ার হইতে গেলি।

— মেডিকেল পরীক্ষায় তো আমি ফেল করছিলাম। ২৫ পাইছিলাম।ডাক্তার কেমনে হবো? (হেসে জবাব দেয় শ্রাবণ।)

ইভানার রাগ পড়ে গেল। তার ছেলেটার হাসি কি সুন্দর। দেখলেই মায়া কাজ করে৷ এখন দ্রুত ছেলেটা একটা চাকরি পেলেই ঘরে টুকটুকে লাল বউ আনবে ছেলের জন্য।

শ্রাবণ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, উফ আম্মু । কিছু দিন ফূর্তি করি তারপর চাকরিতে ঢুকব। আর আমার বাপ চাইলে সারা জীবন আমাকে খাওয়াইতে পারবে। এতো প্যারা কিসের?

ইভানা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, বাপের টাকা আছে জন্য তুই চাকরি করবি না? চাকরি না করলে কেউ তোর কাছে মেয়ে দিবে? বিয়ে করবে কোন মেয়ে তোকে৷

শ্রাবণ মুখ বাকিয়ে বলে, একবার ছ্যাকা খাইছি। শিক্ষা হইসে। আর না ভাই। দোয়াও চাই, মাফ ও চাই। আমি আর বিয়ে করব না। বিয়ে দিতে চাইলে সমুদ্র ভাইয়ার বিয়ে দাও। ওর বয়স হয়ে যাচ্ছে তো! বুড়া বয়সে ভালো মেয়ে পাবে না ও। কিছু দিন পর দুই বাচ্চার মাও বলবে আল্লাহ ছেলের বয়স বেশি।

শ্রাবণ উঠে গেল। তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। ইভানা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। আসলেই তো সমুদ্র, শ্রাবণ দুজন ই অনেক বড় হয়ে গেছে। সমুদ্রের ডাক্তারি পড়া শেষ। তিন বছর ধরে চাকরি করছে। বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়ে গেছে। সমুদ্রের বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। ভালোই হয়েছে, আজ ভাই আসবে।

শ্রাবণ রুমে গিয়ে জোড়ে শব্দ করে গেট লাগালো। তার মেজাজ আপনা-আপনি গরম হচ্ছে। বারবার ওই কালনাগিনীর কথা মনে পড়ছে। এই মূহুর্তে তার কান্না করতে মন চাচ্ছে। যখনি ওই ছলনাময়ী নারীর কথা মনে পড়ে তার কান্না পায়।

শ্রাবণ বিছানায় চিটপাটাং হয়ে শুয়ে মোবাইলে একটা স্যাড সং ছাড়লো। সামস ভাইয়ের গান।

“তোরে ভুলে যাওয়ার লাগি আমি ভালোবাসিনি
সব ভেঙে যাবে এভাবে ভাবতে পারিনি।”

এই গানটাই তার ব্রেক আপের পর নিত্যদিনের সাথী।

★★★

রাত দশটা নাগাদ আবেগ বোনের বাসায় পৌছালো। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে৷ এই বৃষ্টির দিন গুলোতে খুব বিরক্ত থাকে আবেগ। কেন যেন তার বৃষ্টি পছন্দ না। আবেগের চার বছর আগে ঢাকার ডিজি অফিসে প্রোমোশন হয়েছে। এডি বাজেট হিসেবে। মহাখালীতে অফিস তার৷ এজন্য ছেলেকে রেখেই চিটাগং থেকে ঢাকায় শিফট হতে হলো। সমুদ্রের তখন ইন্টার্ণি চলছিল। ইন্টার্ণ শেষ হতেই আবেগ বারবার বলেছিল সমুদ্র কে ঢাকায় আসতে কিন্তু সমুদ্র চিটাগং ছেড়ে আসতে চায় না। আবেগ ও আর জোড় করেনি। ছেলে বড় হয়ে গেছে। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কে প্রাধান্য দিতে হবে।

আগে আবেগ ইভানার বাসার পাশের ফ্লাটে ভাড়া থাকত৷ এখন বাসা ছেড়ে দিয়েছে এজন্য সমুদ্র ইভানার বাসায় থাকছে। আজকে সমুদ্র কে খুব কঠিন কিছু কথার সম্মুখীন হতে হবে। আবেগ কিভাবে ছেলেকে এসব কথা বলবে তাই ভেবে পাচ্ছে না।

বাবা এসেছে শুনে সমুদ্র ঘুম থেকে উঠে বসল। হাসপাতাল থেকে এসে ঘুম দিয়েছিল। এখনো তার ঘুম কাটে নি। সে উঠে বাবার কাছে গেল।

সমুদ্র কে দেখে আবেগ হালকা হাসল।সমুদ্র ও বিনিময়ে একটা হাসি দিয়ে বাবার বিপরীতে বসল৷

আবেগ ছেলেকে দেখে বলে উঠে, মানুষ মাত্র অসহায়!

— জি।

— তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব। মনোযোগ দিয়ে শুনো৷

— আচ্ছা।

— তোমার মা আগামী মাসে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে আসছে। সে চায় এই কয়েকমাস তার ছেলে তাকে সময় দিক।

সমুদ্র বিষ্ফরিত চোখে বাবার দিকে তাকালো।

আবেগ অন্য দিকে তাকিয়ে বলে, আমি এতে দোষের কিছু দেখছি না।

সমুদ্র নির্লিপ্ত গলায় বলে, বহু বছর আগে যখন বাবা-মায়ের মধ্যে কাউকে চুস করতে বলা হয়েছিল আমি আমার বাবাকে বেছে নিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল আমার বাবা অনেক দায়িত্বশীল একজন মানুষ। আজকে এভাবে আমাকে অন্যকোথাও পাঠানোর মানে কি?

আবেগ স্মিত হেসে বলে, তোমার বাবা সর্বদাই দায়িত্ব বান। আমি তোমাকে কোথাও পাঠাচ্ছি না। তুমি এখন যেই বয়সে পা দিয়েছো সেই বয়সে কেউ বাবা-মায়ের সাথে থাকা নিয়ে দ্বন্দ করেনা।বরং নিজেই বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করে। তোমার মা তোমাকে নয় মাস পেটে রেখেছে এর জন্য তো তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ঘুরে আসো। তোমার ছোট বোন ও আছে। ওকে তো সরাসরি দেখো নি। বোন বোন হয়। আপন মানুষ।

— ওনার প্রতিটা কথা আপনি কেন শুনেন?

আবেগ সমুদ্রের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এই প্রশ্নের উত্তর প্রথমেই দিয়েছি। আমি তোমার সাথে তর্কে যাবনা। তর্ক করা আমার অপছন্দ। আগামী শুক্রবার তোমার মা আসবে বাংলাদেশে। তুমি শনিবারের মধ্যে তোমার নানা বাড়ি উপস্থিত থাকবে। আরো একটা কথা, এমন কিছু করবে না যেন তোমার মা এবং তার আত্মীয় আমার শিক্ষায় আঙুল তুলে। তোমার যত্ন, ভালোবাসা, আদর এবং পারিবারিক শিক্ষা কোনটায় কমতি রাখিনি। তোমার উচিত তোমার মায়ের সম্মুখীন হয়ে তাকে দেখিয়ে দেওয়া তাকে ছাড়া তোমার চলতে কোন সমস্যা হয় নি৷

সমুদ্র বাবার দিকে তাকালো। মা নামক নারীর উপর তার কোন মায়া কাজ করেনা। কিন্তু তবুও সে সিধান্ত নিল যাবে নানাবাসায়। এর পেছনে দুইটা কারন।

১) সমুদ্র কোন দিন বাবার কথার অমত পোষণ করেনা৷

২) সত্যি মা নামক মহিলাটাকে হাতে-আঙুল বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, তাকে ছাড়া সমুদ্রের থাকতে এক বিন্দু কষ্ট হইনি। চুল পরিমাণ প্রয়োজন নেই মায়ের।

–তাহলে শুক্রবার রাতে আমি ঢাকার পথে রওনা দিব।

–আচ্ছা।

সমুদ্র চিন্তা করতে লাগলো, নানা বাসা কোথায় যেন? মিরপুর এগারোর পিছনে? কোন জানি এক স্কুলের সামনে বাসা। সম্ভবত মনিপুর স্কুল হবে। মনে নাই। নাকি পুলিশ স্মৃতি স্কুল? ছোট থাকতে ঢাকা ছেড়েছে তাই ঢাকার পথ-ঘাট কিছুই চেনে না সে।

চলবে।