প্রেমপ্রদীপ পর্ব-০৭

0
3540

#প্রেমপ্রদীপ
part–7
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সমুদ্র আপাতত ট্রেনে বসে আছে। আজকেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ মানে শুক্রবার রাত। ট্রেন ছাড়তে আরো বিশ মিনিট বাকি। সমুদ্র খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে। কখন ট্রেন ছাড়বে? এভাবে গন্তব্য হীন ভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা। সে জানে না সামনে কি হতে চলেছে।

এই সময় সিগারেট ধরাতে পারলে খুব ভালো হত। কিন্তু সে ঠিক করেছে আজের পর থেকে মানে ঢাকায় যাওয়ার পর সিগারেট খাবে না। তাই সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট নেই। এখন আফসোস হচ্ছে না তার। বাসায় দুই প্যাকেট পড়ে আছে। বাবা কড়া করে বলেছেন, নানা বাসায় এক মাসের মতো থাকতে। এই কয়েকদিনে বাবা তাকে ঢাকার কোন হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করবে। সমুদ্রের চাকরি ঢাকায় হলে খুব ভালো হবে আবেগের জন্য। কিন্তু সমুদ্র চিটাগং ছেড়ে আসতে চায় না।

সত্যি বলতে শহরটার জন্য মায়া জমে গেছে। শহরটার ধূসর মেঘলা দিন গুলো তার খুব আপন লাগে। শহরটার সাথে তার খুব মিল আছে। উভয়ের মধ্যে একটা চাপা বেদনা বিরাজ করে।

এমন সময় শ্রাবণ এসে তার পাশে ধাম করে বসে পড়ে। ধাম করে বসায় খট করে একটা শব্দ হলো। সমুদ্র হালকা বিরক্ত হয়ে গেল।

শ্রাবণ একটা সিগারেট সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, টেক এ বাইট ব্রো!

–থ্যাংকস। এটারই অভাব ছিল।

শ্রাবণ আরেকটা সিগারেট নিজে ধরে তাতে ফুক মারতে মারতে বলে, খুব খুব এক্সাইটেড। ঢাকায় কোন দিন এতো দিন থাকি না। দুই-এক দিন থেকেই চলে এসেছি৷

সমুদ্র লাইটার বের করে সিগারেট জ্বলিয়ে উত্তর দেয়, তোর জন্ম তো ঢাকায়!

— জানি। আমরা কত বছর পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম?

— তোর যখন দুই কি দেড় বছর তখন চিটাগাং এসেছি। চিটাগাং এসে আমি ক্লাস ওয়ানে এডমিট হই।

— ও। বাট ভাইয়া তোমার নানাবাড়িতে এভাবে এতো দিন পড়ে থাকব, আমার খুব লজ্জা লাগছে।

সমুদ্র মৃদ্যু হেসে জবাবে বলে, আমি ওখানে একা থাকতে পারব না। সাফোকেটেট ফিল হবে রে। আর তাছাড়া তোর ছলনাময়ীর শহরে যাচ্ছি। মন্দ কি তাতে?

শ্রাবণ শব্দ করে হেসে বলে, আমি ঠিক করেছি, ছলনাময়ী নারীর বাসার ঠিকানা বের করে ফেলে প্রতিদিন সকালে ওর বাসায় গিয়ে জ্বালাতন করব।

— গুড আইডয়া৷

তখনি হুইশিল বেজে উঠল। ট্রেন ঝিক ঝিক করে চলতে লাগলো।

কিছু মায়া পেছনে ফেলে সামনে আগাচ্ছে ট্রেনটা। এই ঘটনাটাই বুঝি জীবনে বেঁচে থাকার মন্ত্র!

ভোরের দিকে কমলাপুর স্টেশন পৌছে গেল সমুদ্র। হাতে কালো রংয়ের ব্যাগ। বেশি কাপড় আনে না। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র। আর চারটা শার্ট।

ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। স্টেশন থেকে বের হয়ে রিকশা বা টেক্সি নিয়ে মিরপুর যাবে। কথা হচ্ছে এখন অনেক সকাল। এতো দ্রুত ওই বাসায় গেলে মানুষ-জন বিরক্ত হবে? সবে ছয়টা বাজে। এক ঘন্টাও লাগবে না। মানে সাতটার দিকে কারো বাসায় যাওয়াটা উচিত বলে মনে হয় না সমুদ্রের কাছে।

শ্রাবণ বাথরুমে গেছে। তার জন্যই অপেক্ষা করছে সমুদ্র। শ্রাবণ আসতেই একটা সিএনজি ঠিক করল তারা। সিএনজি ওয়ালাকে এডড্রেস বলতেই সে বলল, রাস্তা তার চেনা।ভাড়া চার শ টাকা নিবে৷

সমুদ্র জানে না কমলাপুর থেকে মিরপুরের ভাড়া কত?তাই কিছু না বলে উঠে পড়ে।

সাতটা না সাড়ে ছয়টার দিকে পৌছে গেল সমুদ্র। বুকের মধ্যে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। হাত-পা একটু একটু কাপছে। নার্ভাস লাগছে। এই অনুভূতিটা ফাইনাল প্রফ দেওয়ার সময় হয়েছিল!

একটু একটু পিপাসাও লাগছে তার। ব্যাগে পানি আছে। কিন্তু ব্যাগ খুলে বোতল বের করতে মন চাচ্ছে না। শ্রাবনের হাতে গুগল ম্যাপ অন করা৷

সে বলে উঠে, ভাইয়া দুই মিনিট হাটলেই বাসা। চল যাই।

সিএনজি থেকে নেমে হাটা ধরল। সমুদ্র হাত ঘেমে গেছে বার বার হাতের ঘাম সে প্যান্টে মুছতে লাগলো। মায়ের সাথে তার তেমন কথা হই নি। সে রাগ করেই কথা বলে না।

মা ফোন দেয়৷ সে কথা বলে না এভোয়েড করে। আসলে এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করা যায়। মা সব পন্থাই ব্যবহার করেন। যার দরুন সমুদ্রের ফেসবুক, মোবাইলে রোদেলার একাউন্ট, নাম্বার ব্লক। তারপর ও সমুদ্রের সন্দেহ হয় ফেক আইড দিয়ে ফলো করে নাতো?

এজন্য রাতারাতি দুই হাজার ফ্রেন্ড থেকে দুইশ ফ্রেন্ড লিস্টে রেখেছিল। বাকি সবাইকে ছাটাই করে দেয়। তথ্য প্রযুক্তি আধুনিক হলেই হবে না। অপর প্রান্তের ব্যক্তির ইচ্ছা থাকতে হবে আপনার সাথে কথা বলার তবেই আপনি তথ্য প্রযুক্তির আধুনিকতার সাহায্য নিতে পারবেন।

বাসার সামনে আসতেই আবছা স্মৃতি গুলো তরতাজা হতে লাগলো। এটা তো সেই বাসা যেখানে একসময় আম্মুর সাথে হাত ধরে আসত। আসার সময় একটা কেমন যেন রাস্তা ছিল সেখানে সবাই খুব নিয়ম মেনে চলত। খাকি পড়া পুলিশ থাকত। সম্ভবত ক্যান্টনমেন্ট ছিল –এখন তা বুঝল সমুদ্র।

সেই কালো গেট এখনো আছে! কালো গেটের উপর বড় বড় করে লেখা “গেট বন্ধ রাখুন ”

সমুদ্র গেট খুলল। গেটের সামনে একটা বাগান বিলাস। গোলাপি রঙের ফুল ফুটে আছে। তিন তলায় থাকত নানীরা৷

বাসার ভেতরে ঢুকে সিড়ি বেয়ে যেতে ধরতে দারোয়ান বলে, লিফট আছে।

–লাগবে না।

সমুদ্র আর শ্রাবণ হেটেই তিনতলা উঠল। বেল বাজালো। একবার, দুইবার, তিনবার। বেশ খানিকক্ষন পর একজন গেট খুলে দেয়।

এদিকে সমুদ্রের বুক ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে সামনের দিনে এমন কিছু হবে যা তার পুরা জীবনটাকে তছনছ করে দিবে। এখানে কোন সর্বনাশীর বিচরণ আছে! অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে।

গেট খুলল একজন মাঝ বয়সী মহিলা এনাকে চেনে না সমুদ্র৷

তাই বিনীত গলায় সালাম দিল।

— আসসালামু আলাইকুম।

মহিলা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে, দাড়ান একটু আপাকে ডেকে আনি।

–আচ্ছা।

গেটের বাইরে বেশ খানিকক্ষন দাড়িয়ে থাকার পর স্বয়ং নানী আসল। নানীকে এক দেখায় চিনে ফেললো সমুদ্র।

নানী এসে বলে, কে তুমি?

কিছুটা ভড়কে গেল সমুদ্র। এই প্রশ্নের উত্তর কি দিবে? আমি আপনার মেয়ের এক্স ছেলে? আজকে অনেক দিন পর দেখা করতে এলাম। এমন মজা মুরুব্বি মানুষের সাথে করা উচিত না।

তাই সমুদ্র অতি নরম গলায় বলে, আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন? আমাকে চিনতে পারেন নি? আমি ডা.সাদবিণ রহমান সমুদ্র।

ফাতেমা বেগম হা হয়ে গেলেন। সমুদ্র! এটা তার নাতী সমুদ্র! চোখে চশমা নাই তার এজন্য চিনতে পারেন নি। কিন্তু এই খারাপ চোখে তিনি যা দেখতে পাচ্ছেন তাহলো এই ছেলেটা কোন রাজ্যের রাজপুত্র। সাধারণ মানুষ হতেই পারেনা।

ফাতেমা বেগম সমুদ্রের গা ছুয়ে দেখতে চাইলে সমুদ্র সরে আসে।

ফাতেমা বেগম বেশ কষ্ট পেলেন এবং বলল, আয় ভেতরে আয়।

–জি।

সমুদ্র আর শ্রাবণ ভেতরে আসল।

সমুদ্র নানীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ও হলো আমার কাজিন। আমার সাথে এসেছে। আপনাদের সমস্যা হবে? হলে বলেন আমরা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা নিব।

–ছিঃ ছিঃ! সমস্যা হবে কেন? ও আমার আরেকটা নাতী৷ কোন সমস্যা নাই।

— ধন্যবাদ। ফ্রেস হব।

— হ্যা। হ্যা।

সমুদ্র নানীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি উত্তেজিত হবেন না৷ এখন অনেক সকাল। আপনার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনার প্রেসার বেড়ে গেছে৷ আপনি রেস্ট নেন। বাকি টা আমি ম্যানেজ করে নিব।

ফাতেমা বেগম হতভম্ব হয়ে গেল। আসলেই তার প্রেসার কালকে রাত থেকে আপ-ডাউন করছে।

সমুদ্র আর শ্রাবণ কে এক রুমেই থাকতে দেওয়া হলো। এই রুমটায় আগে বিছানা ছিল না। কিন্তু এখন একটা সুন্দর বেড আনা হয়েছে। দামী চাদর দেওয়া। বেডটা দেখে মনে হচ্ছে নতুন। বেডের পায়ায় হাটিলের সিল লেগেই আছে। রুমে একটা নতুন ফার্নিচারের গন্ধের সুভাস পাওয়া যাচ্ছে।

ফ্রেস হয়ে ঘুম দিল সমুদ্র আর শ্রাবণ।

★★★

রোদেলার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে কিচিরমিচির পাখির আওয়াজ। রোদেলার গা ঘেষে শুয়ে আছে পিউ। গভীর ঘুমে আছন্ন তার মেয়ে। রোদেলা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। তার ঘুম ছুটে গেছে। আর ঘুম আসবে না। সে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে উঠে পড়ে।

এই মেয়েই তার সম্বল। ছেলে তো থেকেও নেই। রাগ, জেদের বশে কথাই বলতে চায় না। রোদেলা ফ্রেস হয়ে বের হলো। আজকে সমুদ্রের আসার কথা। আবেগকে অনেক কনভিন্স করে সমুদ্র কে নিজের কাছে আনতে সক্ষম হয়েছে সে।

রোদেলা ঠিক করল, আজকে সব তার ছেলের প্রিয় খাবার, সে নিজ হাতে রান্না করবে।

চুলে খোপা করে আবেগকে কল লাগালো। কিন্তু আবেগের ফোন বন্ধ। রোদেলা বুঝতে পারছে না সমুদ্র কখন আসবে।

ঘড়িতে দশটা বাজে। খুব ক্লান্ত সে। কালকেই সে আমেরিকা থেকে এসেছে। টানা চব্বিশ ঘন্টা জার্নি করে অনেক ক্লান্ত। চোখে ঘুম নেই তার। ছেলে আসবে তার। কতো দিন ধরে দেখেনি বাবুকে নিজ চোখে।

রোদেলা রুম থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেল। মা ড্রয়িং রুমে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

রোদেলা বিচলিত হয়ে গেল এবং চিন্তিত গলায় বলে, আম্মা, তোমার শরীর কি খুব খারাপ? ডাক্তার ডাকব?

ফাতেমা বেগম হাসি হাসি মুখ করে বলে, ডাক্তার তো বাসায় ই চলে এসেছে৷

–মানে।

ফাতেমা বেগম বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে, সমুদ্র এসেছে। অনেক সকাল বেলায় এসেছে৷ ঘুমাচ্ছে ও।

রোদেলার গায়ে মৃদ্যু শীতল হাওয়া বয়ে গেল। ছেলেটা কয়েক হাতের মতো দূরের রুমটায় আছে!!!

রোদেলার চোখের কোনে পানি চলে আসল।

ফাতেমা বললেন, আমার নাতী রাজকুমারের মতো দেখছে হয়েছে। কত লম্বা! কি সুন্দর দেখতে! ওকে দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায়।

মায়ের কাছে সমুদের কথা শুনে রোদেলার মন চাচ্ছে এখনি ছেলের কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু ছেলেটা তার ঘুমাচ্ছে৷ এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

ফাতেমা বেগম হরেক রকমের পদের রান্নায় ব্যস্ত। এগারোটা বাজতে চলল। রোদেলা অস্থির হয়ে বসে আছে। সমুদ্র উঠছে না কেন? এতো দূর জার্নি করার জন্য খারাপ লাগছে নাকি?

প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে সমুদ্র রুমের গেট খুলল। সমুদ্রের রুমের পাশেই ডাইনিং রুম। এই রুমের গেট খোলা মানে ডাইনিং রুমের সব দেখা যাবে।

সমুদ্র চমকে গিয়ে কেপে উঠে। ঠোঁট দুটো আপনা-আপনি ‘আম্মু’ বলে উঠে। কিন্তু খুব আস্তে।

রোদেলা সমুদ্র কে দেখে থমকে গেল। পাথর হয়ে গেল সে। রোদেলা তো ভেবেছিল সেই ছোট্ট সমুদ্র দৌড়ে তার কোলে ঢুকে যাবে। কিন্তু এমন কিছু হলোনা। রোদেলা থ মেরেই বসে রইল আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখতে লাগলো। বুকটা হুহু করে উঠছে তার।

ডাইনিং রুমের সবাই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এতে বেশ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে।

রোদেলার চোখ বেয়ে পানি ঝড়তে লাগলো। সে দ্রুত চোখ মুছে নিল।

সমুদ্র দাতে দাত চেপে রোদেলাকে সালাম দিল। তার মায়ে দেখা মাত্র রাগ লাগতে শুরু করল। কিন্তু বাবাকে কথা দিয়েছে কাউকে অসম্মান করবেনা সে। কথা দিয়ে কথা রাখবে সমুদ্র।

চলবে।