প্রেমপ্রদীপ পর্ব-০৯

0
4465

#প্রেমপ্রদীপ
part–9
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সমুদ্র অদ্ভুত মুগ্ধ নয়নে আয়নার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে কিছুক্ষন। তার ভ্রু কুচকে গেছে। আয়নাকে চিনতে বেগ পেতে হয়েছিল তাকে!

আগের সেই বাচ্চা চেহারার সাথে এখন পরিপূর্ণ বয়সের আয়নার কোন মিল নেই। এছাড়া সমুদ্র নিজেও আয়নার ছোট বেলার চেহারা ভুলে গেছে। কিন্তু চোখ দেখে চিনতে পেরেছে এটা আয়নাই হবে।

চোখের মণিগুলো কালো কুচকুচে। চোখের পাপড়িগুলো ঘন বেশ। কিন্তু আয়না কেদে দিল কেন? সমুদ্রের মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আয়না কি তাকে চিনতে পারেনি? না পারারই কথা! চিটাগং যাওয়ার পর আর একবার ও সে আয়ুর সাথে কথা বলেনি। তার উচিত ছিল নিজের একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ রাখা। কিন্তু সে রাখেনি। মায়ের উপর রাগের এক অংশ আয়নার উপরও ঝেড়েছে সে।

সমুদ্র চুলা বন্ধ করে দিল। সে বুঝে পাচ্ছে না এতো রাতে আয়না চা কেন খাবে? আর সারাদিন কই ছিল? একবার ও দেখলোনা তাকে। সে ভাবতে ও পারেনি এভাবে আয়নার সাথে দেখা হবে!

এই নিস্তব্ধ মধ্য রজনীতে কোন মায়াবিনীর সাথে সাক্ষাৎ কি শুভ?

সমুদ্র রুমে চলে আসল। আজকে আর ঘুম হবে না। মাথায় অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সবকিছুর মধ্যে একবার হলেও মস্তিষ্কের মধ্যখানে আয়নার ভীত হরিণীর মতো মায়াময় চেহারাটা ভেসে আসছে।

আচ্ছা আয়নার কি বিয়ে হয়ে গেছে? সে কি নববিবাহিতা? নাহলে এতো রাতে চুল ভেজা কেন? এই কথা চিন্তা করতেই সমুদ্রের হাসফাস লাগতে শুরু করল।

★★★

আয়না তার নিজের রুমে এসে গেট আস্তে করে লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। সে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। বুকে হাত দিয়ে বসে আছে। একটা শুকনা ঢোক গিলে আয়না বিড়বিড় করে বলে, স,,,সমুদ্র!

চোখ-মুখে এক অজানা উল্লাস তার। তার নিজের চোখ কে বিশ্বাস হচ্ছেনা। ছেলেটা কি আসলেই সমুদ্র ছিল? বুঝতে পারছে না সে। দাদী দুপুরে খাবার দিতে যখন রুমে এসেছিল তখন বলেছিলেন সমুদ্র নাকি সকালে এসেছে। তাহলে ছেলেটা নিশ্চয়ই সমুদ্রই।

ঠান্ডায় আয়না থরথর করে কাপছে কিন্তু সেদিকে নির্বিকার সে। সে জড়সড় হয়ে বসে রইল নিষ্পলক চোখে।

সমুদ্রের উপর একটা চাপা অভিমান কাজ করছে তার। এতো বছরে একবার ও যোগাযোগ করল না? সমুদ্রের কি তার কথা মনে আছে? সে নাকি সমুদ্রের একমাত্র বন্ধু ছিল! তাহলে কি মনে আছে তার কথা?

আয়না কম্বল জড়িয়ে নিল। সে হুহু করে কেদে দিল। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আজকে যদি সমুদ্র তার জীবনে আগে থেকেই থাকত তাহলে কি তার জীবনটা সুখকর হতো?নাকি এখনকার মতোই জঘন্য স্বপ্নের থাকত?

আয়নার চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। সে শীতে থরথর করে কাপছে।

★★★

রাতের শেষ প্রহরবেলায় রোদেলা চুপিসারে সমুদ্রের ঘরে প্রবেশ করল। ছেলেটা তার কতোবড় হয়ে গেছে! মায়ের সঙ্গে রাগ করে আছে। রোদেলা ছেলের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কপালে চুমু খেল। মন ভরে দেখছে তার বাবুকে। রোদেলার চোখ থেকে আপনা-আপনি পানি পড়ছে। সে চোখ মুছে একা একা আস্তে আস্তে ছেলের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে লাগলো। কি মায়া তার ছেলের মুখটায়। রোদেলা ভেবেই কুল পাচ্ছে না কিভাবে সমুদ্রের রাগ ভাঙ্গাবে? ছেলে তার বড়ই নিরব ঘাতক! নিরবে কুড়ে কুড়ে শেষ করে দিচ্ছে রোদেলাকে।

রোদেলা কি আবেগের বাসায় ফিরে যাবে? তার আর আবেগের তো ডিভোর্স হয় নি। সেপারেশন হয় নি। বরং আবেগ দুইবার থাইল্যান্ড গিয়েছিল মেয়েকে দেখতে। পিউ যে আবেগের নিজের সন্তান তা আবেগ অস্বীকার করেনি। কেন করেনি তা অজানা রোদেলার কাছে। রোদেলা থাইল্যান্ড যাওয়ার পর প্রথম তিন মাসে একবার ও আবেগের সাথে কথা হয় নি। ট্রেনিং শেষ করে সে যখন বাংলাদেশে ফিরে আসে সমুদ্র কে নিয়ে যেতে তখন রোদেলা বার কয়েক আবেগের সাথে সব ঠিক করার জন্য নিজে থেকে আবেগের পিছনে পিছনে ঘুরেছে। তখন গর্ভকালীন ছুটি চলছিল রোদেলার। আবেগ মেয়ের জন্য হলেও রোদেলার সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু সমুদ্র চিটাগং এ ছিল। রোদেলা প্রেগন্যান্ট জন্য তাকে চিটাগং যেতে দেয়নি জাবেদা খাতুন।

পিউ বাংলাদেশেই হয়েছে। আবেগ ছিল রোদেলার সাথে পিউয়ের জন্মের সময়। পিউয়ের যখন দুই মাস রোদেলা থাইল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওই সময় আবেগ ঝামেলা শুরু করল। সমুদ্র কে যেতে দিবে না। আবেগের ভাষ্যমতে, পিউ থাকবে রোদেলার সাথে আর সমুদ্র থাকবে আবেগের সাথে। রোদেলা এই সিদ্ধান্ত শোনামাত্র ভেবে নেয় ডিভোর্স ফাইল করবে, কেসের মাধ্যমে সমুদ্র কে নিজের কাছে রাখবে। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত তে পারিবারিক সাপোর্ট পায় নি। এদিকে সমুদ্র মায়ের কাছে থাকবে না। ফোনে কথা হয়েছিল সমুদ্রের সাথে রোদেলার৷

সমুদ্র বলেছিল, সে নাকি ব্রাশ করা শিখে গেছে। আম্মু নাকি পচা। খুব খারাপ। তাকে ভালোবাসেনা। এজন্য আম্মুর সাথে যাবে না। আম্মু নাকি তাকে একা রেখে বাইরে বাইরে ঘুরবে সে যাবে না মায়ের সাথে৷ এইসব যে জাবেদা খাতুন সমুদ্রের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে তা বুঝতে সময় লাগে নি। কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানে রোদেলা।রোদেলা ভেবেছিল, এক-দুই মাস পর সমুদ্র নিজে থেকেই মায়ের কাছে যেতে চাইবে। সমুদ্র কে হারানোর ভয়ে আর ডিভোর্সর কথা ভাবে নি রোদেলা। কারন ডিভোর্সের পর সন্তানের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হবে এটা একটা সময় পর সন্তানের উপর নির্ভর করে। সমুদ্র তার কাছে থাকতে চাচ্ছেনা। এর মধ্যে ডিভোর্স নিলে চিরতরে ই হারিয়ে ফেলতে পারে সমুদ্র কে জন্য রোদেলা আবেগকে ডিভোর্স দেয় নি। তাদের সম্পর্ক আগের মতো নেই। ভালোবাসা ও নেই। শুধু প্রয়োজনীয় কথা-বার্তা হয়। আবেগ মেয়ের সাথে কথা বলে প্রতিদিন। কিন্তু সমুদ্র তার সাথে কথা বলেনা। রোদেলা চাইলে পিউকে আবেগের কাছ থেকে দূরে সরাতে পারত। কিন্তু এমন কিছু ই করেনি।বরং আবেগ তার সাথে কি কি করেছে কিছুই জানে না সমুদ্র-পিউ। সে চায় না তার সন্তান তার বাবাকে খারাপ মানুষ হিসেবে জানুক। রোদেলার মনে আবেগের প্রতি কোন রাগ নেই।

সমুদ্রের দিকে এভাবেই কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে গেল রোদেলা।

সাতটা বাজতে চললো। রোদেলা নিজের রুমেই বসে আছে৷ পিউ ঘুমাচ্ছে। রোদেলার মনটা অস্থির হয়ে আছে। সমুদ্র কবে তাকে ক্ষমা করবে? ছেলেটা কি কোন দিন মায়ের দিকটা ভাববে না?

রোদেলা কিছু একটা ভেবে আবেগকে কল লাগালো।

আবেগ সাতটার দিকে উঠে পড়ে। তাই রোদেলার ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে রোদেলা বলে উঠে, কেমন আছো?

আবেগ হচকচিয়ে উঠে বলে, ভালো। সমুদ্র কেমন৷

আবেগ ভাবতেও পারেনি এতো সকাল সকাল রোদেলা কল দিবে।

রোদেলা কিছুটা জোড়ে বলে উঠে, আমরা দুইটা মেয়ে মানুষ কালকে রাতে আমেরিকা থেকে আসলাম আর তুমি একটা বার কল দিয়ে শোনার প্রয়োজন বোধ করলে না? ঠিক ভাবে পৌছেছি কিনা জানার ইচ্ছাটাও নাই?

আবেগ বিরক্ত হয়ে বলে, তোমাকে কল দিয়েছিলাম। ধরোনি। পিউয়ের কাছ থেকে খবর নিয়েছি। আর তোমার তো আমার কোন প্রয়োজন নাই। বরঙ আমিই তোমার কাছে জিম্মি। তোমার সব কথা শুনতে হবে। তাই না রোদেলা?

রোদেলা পালটা জবাব দিবে আর আগেই আবেগ ফোন কেটে দিল।

রোদেলা হতাশার নিশ্বাস ফেললো। তার জীবন টাই অগোছালো আর ছিন্নছাড়া। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরি না করলেই ভালো হত। অন্তত ছেলেটা তো তার কাছে থাকত।

আফসোস ও হয়! একটা মেয়ের কাছে অবশ্য ই তার স্বামী-সংসার, ছেলেই সব। রোদেলাও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তাই বলে স্বামীর কাছে কোন বস্তু হয়ে থাকা সম্ভব না রোদেলার কাছে। লাথ-গুতা, হাজারটা কথা শুনার ও পড়ে থাকাটা অর্থহীন। রোদেলার আফসোস এক জায়গায় সেইটা হলো সমুদ্র তার উপর রেগে আছে। রোদেলা ভেবে রেখেছে যেকরেই হোক না কেন ছেলের অভিমান ভাঙ্গাবে। সে মা। চাইলে অবশ্যই পারবে। হয়তো কঠিন হবে কিন্তু অসম্ভব নয়৷

চলবে।