প্রেমপ্রদীপ পর্ব-১২+১৩

0
3903

#প্রেমপ্রদীপ
part–12
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রাতে বাসায় বেশ বড়সড় আয়োজন চলছে। সমুদ্র আগ্রহ নিয়েই সবাইকে অবলোকন করছে। ছোট বেলা থেকেই সে একা বড় হয়েছে। বাসায় সর্বক্ষন একাই থাকত। বাবা বিকেলে এসে রেস্ট নিয়ে রাতে তার সাথে হালকা-পাতলা কথা বলত। এই যা! এভাবে এতো মানুষ কখনোই তার বাসায় কোন দিন ছিল না।

আজকে সমুদ্রের নানা বাসায় সবাই খুব খুশি। এর পেছনে দুইটা কারন। রোদেলার নানা তালুকদার সাহেবের ডায়েবিটিস নেই। কয়েকদিন ধরে বাসায় সবাই ভাবছিল তালুকদার সাবেহের ডায়েবিটিস হলো না নাকি। কিন্তু টেস্ট করানোর পর সব ঠিকঠাক এসেছে। নানী ও সুস্থই আছেন। এজন্য সবাই খুশি।

এছাড়া আরো একটা কারনে সবাই খুশি তাহলো আয়নার ছোট বোন দুই দিন পর এসেছে এবং আজকে রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর গিফট আনপ্যাক করা হবে যেগুলো রোদেলা বিদেশ থেকে সবার জন্য এনেছে। বাসায় বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে।

অথৈ রান্না করছে আজকে। সঙ্গে রোস্ট আর আলুর চপ।

সমুদ্র কিছুটা আনকমফোর্টেবেল ফিল করছে। সে না থাকতে পারে রুমে আর না বাইরে সবার সাথে বসে থাকতে পারে। শ্রাবণ বাসায় নেই। কোক কিনতে গেছে।

সমুদ্র ড্রয়িং রুমে বসে আছে। আটটার মধ্যেই সবাই বাসায় ফিরে এসেছে। আয়না ওই যে রুমে ঢুকেছে আর বের হয় নি। সমুদ্র খেয়াল করেছে আয়ু খুব একটা রুম থেকে বের হয় না। সবার থেকে দূরে দূরে থাকে।

সমুদ্রের পাশে এসে বসলেন তালুকদার সাহেব সমুদ্র মুচকি হাসল।

তালুকদার সাহেব বলে, আমার নাতীটা কতো বড় হয়ে গেছে।

— জি।

— ভালো আছিস নানাভাই?

সমুদ্র মাথা ঝাকিয়ে বলে, আমি তো ভালোই আছি। কিন্তু আপনাকে আরো ডায়েট মেইনটেইন করতে হবে। ডায়েবিটিস আল্লাহর রহমতে নাই। এটা ভালো লক্ষন। আমার মনে হয় সবচেয়ে বেয়াদব অসুখ হলো ডায়েবিটিস।

তালুকদার সাহেব হেসে উঠলেন। সমুদ্র স্মিত হেসে বলে, আপনাকে একটা ডায়েট চাট দিব। সেটা ফলো করবেন।

— আচ্ছা।

এমন সময় একটা মেয়ে তার সামনে এসে দাড়ালো। মেয়েটাকে সমুদ্র চেনে না। তবে দেখতে কিছুটা মামীর মতো। আয়ুর ছোট বোন নাকি? সে শুনেছিল আয়ুর বোন হয়েছে৷

আলিয়া সমুদ্রের সামনে দাড়িয়ে মুচকি হেসে উত্তেজিত হয়ে বলে, আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন? বলেন তো আমি কে? আর আপনি ডাক্তার তাই না? আমিও কিন্তু ইন্টার্ণ করছি বাংলাদেশ মেডিকেলে।

— ওয়ালাইকুম আসসালাম। একবারে এতো প্রশ্ন করলে কোনটার আগে উত্তর দিব?

আলিয়া আবারো হেসে বলে, সিরিয়ালে দেন।

সমুদ্র আলিয়ার দিকে তাকালো। আলিয়াকে দেখে তার আগের আয়ুর কথা মনে পড়ছে। এরকমই চটপটে ছিল আয়ু। আলিয়ার ও চুল ভেজা। এরা দুই বোন কি সারাদিন গোসল করে নাকি?

সমুদ্র প্রশ্ন করে, এতো রাতে চুল ভিজিয়েছো কেন?

আলিয়া বলে, দুই দিন ধরে গোসল করিনি। ডিউটি ছিল। একদম টাইম পাইনি।

সমুদ্র বললো, ইন্টার্ণের ক্যান্ডিডেট দিয়েই হাসপাতাল চলে।

— ভাইয়া আপনি কিন্তু উত্তর দিলেন না? বলেন আমি কে?

— আয়ুর বোন।

আলিয়া ভ্রু কুচকে বলে, আয়ু?

সমুদ্র কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তারপর বলে, আয়নার বোন তুমি।

— জি। আমি আলিয়া। পুরা নাম আলিয়া নূর জাহান।

— নামটা সুন্দর । এর মানে কি জানো?

আলিয়া আগ্রহ নিয়ে বলে, আলিয়ার নামের মানে হলো উচু, উন্নত কিংবা মর্যাদাপূর্ণ।

সমুদ্র কিছুটা অবাক হলো। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই নিজের নামের অর্থ জানে না। এক্ষেত্রে আলিয়া ভিন্ন।

হুট করে বেল বেজে উঠল। আলিয়া গেট খুলতে গেল। গেট খুলে দিতেই সে চমকে উঠে। গেটের বাইরে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে কোক হাতে নিয়ে।দুই হাতে দুইটা কোক। মাথা নিচু করে সে কোকের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাথা নিচু করে রাখার পরও আলিয়ার শ্রাবণ কে চিনতে এক দন্ড সময় লাগেনি। এই সাপ উরফ শ্রাবণ এখানে কি করছে?

শ্রাবণ কোকের মেয়াদের তারিখ দেখছিল। গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায়। আলিয়া! শ্রাবণের চোখ বড় হয়ে এলো। ঠিক বাসায় এসেছে তো সে? ভুল বাসায় এসে পড়েনি তো আবার?

দ্রুত বাসা চেক করল। নাহ এটাই তো বাসা। শ্রাবণ আলিয়াকে দেখে এতোটাই হতবাক হলো যে হাত থেকে কোকের বোতল পড়ে গেল এবং আলিয়ার পায়ে গিয়ে লাগলো।

আলিয়া চিৎকার দিয়ে উঠে। শ্রাবণ কেপে উঠে। তার মনের অবস্থা এখন যায়-যায়। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

আলিয়ার চিৎকার শুনে অথৈ মেয়ের কাছ আসল। সমুদ্র ও তালুকদার সাহেব এগিয়ে এলেন। এদিকে শ্রাবণ ঘামছে দরদর করে।

আলিয়া ব্যথায় কুকিয়ে উঠায় তার মনের এক কোনে চিনচিনানি ব্যথা অনুভূত হলো।

সমুদ্র কোকের বোতল টা আলিয়ার পা থেকে সরিয়ে দিল।

অথৈ মেয়েকে নিয়ে রুমে চলে গেলেন। শ্রাবণ বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

।সমুদ্র বললো, কি রে? ভেতরে আয়!

শ্রাবণ না চাইতেও ভেতরে ঢুকে বলে, মেয়েটা কে?

— আমার কাজিন। মামাত বোন।

— ওহ।

শ্রাবণ মনে মনে বলে, তার মানে এটা আলিয়ার বাসা? ওহ শিট! শেষ মেস কাল নাগিনীর বাসায় ঢুকে গেলাম? কামড়-টামড় মারবে না তো?

শ্রাবণ বাসার ভেতরে ঢুকল। সব কিছুই ঠিক আছে। বাসার পরিবেশ অনুকূলে ।

★★★

অথৈ আলিয়াকে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে, ব্যথা কি বেশি লেগেছে?

— না।

— আচ্ছা। তাও আমি বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি।

— লাগবে না।

— অবশ্যই লাগবে।

বলে আলিয়ার পায়ে বরফ লাগিয়ে দিতে দিতে
বললো, বাসায় দুইটা ছেলে আছে। তাদের থেকে দূরত্ব বজায় চলবে।

— আচ্ছা।

— আর আরেকটা কথা! আয়নার দিকে নজর রাখবে। ও যেন রুম থেকে বের না হয়।

আলিয়া মাকে প্রশ্ন করে, মা আপা তো এম্নিই রুমের বাইরে বের হয় না কোন প্রয়োজন ছাড়া।

— তার পর ও। ওর দিকে নজর রাখবে।

আলিয়া চুপ হয়ে গেল। মাকে সে খুব ভয় পায়। ভীষণ রাগী স্বভাবের। বাবা থাকলে মা কোন দিন এমন কথা বলত না। আলিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। কেন যে মা আপাকে চোখে চোখে রাখে। আপার জায়গায় সে হলে দম বন্ধ হয়ে মরে যেত।

অথৈ মেয়েকে রুমে বসিয়ে বেরিয়ে গেল। আলিয়া পায়ে ব্যথা নিয়ে আপার রুমের দিকে গেল।

আয়নার রুমে আলিয়াই শুধু আসে। বাবা আর নানা আসেনা আপার রুমে। মা তো একেবারেই আসেনা। নানী এক কি দুবার আসে। বাসায় এতো মানুষ থাকা সত্ত্বেও আপা একদম একা।

আলিয়া গেট খুললো চাবী দিয়ে। আপার দরজা লক থাকে। তাই লক খুলে রুমে ঢুকে দেখে আয়না গভীর ঘুমে মগ্ন। আলিয়া বোনের পাশে বসল।

আপার বোধহয় আবার জ্বর এসেছে। প্রতি সপ্তাহেই আপার জ্বর আসে। আলিয়া বোনের কপালে হাত রাখল। হালকা জ্বর। সে বোনের গায়ে কাথা জড়িয়ে দিল এবং কপালে চুমু দিল। আলিয়া তার বড় আপাকে খুব ভালোবাসে।

একবার আপার টানা জ্বর ছিল। মা রেগে গিয়ে বলেছিল, এতো ঔষধ কিনে আনতে পারব না। এজন্য এখন আপার অসুখ হলেও সে কাউকে বলেও না,ঔষধ ও খায় না। আলিয়া থাকলে জোড় করে হলেও খাওয়ায়। কিন্তু না থাকলে আপা ঔষধ মুখে নেয় না। মাও জোর করেনা।

মায়ের উপর আলিয়া অনেক বেশি রেগে আছে। মা কেন যে এমন করে? আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে মশার এরোসোল রুমে ছিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলো।

শ্রাবণ যে তার বাসায় বসে আছে আলিয়া ভুলেই গিয়েছিল। আপার রুম থেকে বের হয়ে দেখল, শ্রাবণ খাওয়ার টেবিলে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছে খুব তৃপ্তি করে। তাকে দেখেই আলিয়ার গায়ের রক্ত টগবগ করতে লাগলো।

শ্রাবণ আলিয়াকে দেখে একটা ঢেকুর তুলে বলে, আমাকে আরেক টুকরো রোস্ট দেন নানী।

ফাতেমা বেগম খুশি মনে শ্রাবণ কে রোস্ট তুলে দিল। এই ছেলেটাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর নানী বলে ডাকে। কি ভদ্র একটা ছেলে।

খাওয়া শেষ করে পিউ আর আলিয়া মিলে ব্যাগ খোলা শুরু করল। পিউ আর আলিয়া প্রায় সমবয়সী জন্য বেশ ভাব জমে গেছে। দুইজন ই খুব মিশুক। শ্রাবণ থাকতে চাচ্ছিল না কিন্তু পিউ জোর করে তাকে ধরে এনেছে। সমুদ্র আর শ্রাবণ পাশাপাশি বসা। নানা নানী আর মামী একপাশে বসে আছে। রোদেলাও আছে। কিন্তু সমুদ্রের থেকে খানিকটা দূরে।

ছেলেকে তার এখন একটু ভয় ও লাগে। কি অদ্ভুত! আগে সমুদ্র ন্যাংটা হয়ে সারা বাসায় ঘুরে বেড়াত। সেই বাচ্চাকে তার এখন একটু ভয় একটু ভয় লাগে। তার কোন কাজে যদি রেগে গিয়ে চলে যায়? এই ভয়টা রোদেলাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

পিউ গিফট খুলে সবার আগে নানা আর নানীকে দিল। আলিয়া এতোক্ষন হাসি-খুশিই ছিল কিন্তু শ্রাবণ আসায় সে মিইয়ে গেল। যা নজর এড়ায় নি শ্রাবণের। এজন্য শ্রাবণ আরো বেশি অস্বস্তি বোধ করছে।

পিউ এবার চারটা বক্স বের করল। সমুদ্র আগ্রহ নিয়ে দেখছে বক্সে কি আছে। পিউ বক্স আনপ্যাক করতেই সমুদ্র হতভম্ব হলো। চারটা আইফোন ছিল বক্সে। পিউ আলিয়াকে একটা বক্স দিল।

তারপর সমুদ্রের কাছে যেতে গেলে সমুদ্রের দাঁড়িয়ে তার রুমের দিকে হাটা ধরল।

পিউ কিছুটা ঘাবড়ে গেল।

সমুদ্র যাওয়ার সময় রোদেলা তার সামনে আসল। সমুদ্র মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে, দয়া করে আমাকে টাকার গরম দেখাবেন না প্লিজ।

রোদেলা কেপে উঠে। ছেলে কি রেগে গেছে?

চলবে৷

#প্রেমপ্রদীপ
part–13
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আবেগ অফিসে এসেই গা এলিয়ে দিয়েছিল
বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। সামনে অর্ধেক খাওয়া লেবুর শরবত পড়ে আছে। এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে। আবেগের ঠান্ডা লেগেছে। গলা ব্যথা সঙ্গে সর্দি। আবেগ ভেবে কুল পাচ্ছে না তার হয়েছেটা কি? জ্বর আসবে কি?যদি আসে তাহলে আগে-ভাগেই প্যারাসিটামল নেওয়া উচিত। আবেগ অন্য ঘোরের মধ্যে আছে। আচ্ছা সে যদি মারা যায় তবে কি হবে? সমুদ্র তো বড় হয়ে গেছে৷ একা একা চলতে পারবে। মেয়েও তার ডেন্টিস্ট। বাচ্চাদের নিয়ে কোন চিন্তা নেই। আবেগের কেন যেন মনে হচ্ছে তার শরীরে অনেক বড় কোন রোগ বাসা বেধেছে। যার চিকিৎসা হলো মৃত্যু। আবেগের গা শিউরে উঠল। রক্তবমি করার পর থেকে আবেগ ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয়ে আছে।

রক্তবমি ভালো লক্ষন না! তার যে কি হয়েছে সে বুঝে পাচ্ছে না। তবে সে চায় না এই ব্যাপার টা আর কেউ জানুক। নিজের ভেতরই ব্যাপার টা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাচ্ছে।অন্য কেউ তার জন্য পেরেশান হোক এটা আবেগ চায় না।

আচ্ছা সে কি টেস্ট করাবে? টেস্ট করালেই ধরা পড়বে কিছু একটা। তার চেয়ে অধরাই থাক।

জীবনে এমন একটা মোড় আসে যখন কোন কিছু করার আর আগ্রহ থাকে না। আবেগের মনে হচ্ছে জীবনের এই মোড়ে সে পা রেখে ফেলেছে৷ তাই তো কিছু করার না পায় শক্তি আর না পায় অগ্রহ।

এই মোড়টা কি জীবন আর মৃত্যুর মাঝের সেতু?কে জানে?

আবেগ টেবিল থেকে লেবুর শরবত টা হাতে নিয়ে দুই ঢোকে শেষ করল বাকিটা। তারপর আবারো গা এলানো চেয়ারে৷

মিনিট পাচেক পর আবেগের মনে হতে লাগলো, তার নাড়ি-ভূড়ি সব বের হয়ে আসছে। সে দ্রুত বাথরমে গিয়ে হড়বড় করে মুখ ভর্তি করে দিল। বমি করার পর টের পেল সাদা বেসিনটা লাল হয়ে গেছে। আবেগ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে এবং দ্রুত কল ছেড়ে দেয়। মুখ কুলি করে চোখ খুলে আয়নায় তাকালো। এক দিনেই তার বয়স কয়েক বছর বেড়ে গেল নাকি! কালকে যখন রক্তবমি করেছিল তখন থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে সে। ইদানিং তার খাওয়ার রুচি নেই বললেই চলে। সকালে খুব কষ্ট করে একটা শুকনা রুটি চা দিয়ে ভিজিয়ে খায়। একটা রুটি তাকে জোড় করে খেতে হয়। অথচ আগে রোদেলার বানানো মোটা মোটা তেলে ভাজা মচমচে দুইটা পরোটা কতো ইজিলি খেতে পারত সে!

আবেগ মুখ ধুয়ে বের হলো। শার্টের কলারে রক্ত ভরে গেছে৷ কিভাবে মুছবে বুঝে পাচ্ছে না। আবেগের খুব ক্লান্ত লাগছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে৷ এক রক্তবমিই তাকে কাহিল করে দিল।

আবেগের কেন যেন মনে হচ্ছে তার বড়সড় ধরনের অসুখ হয়েছে।

বড় বড় অসুখ গুলোই কোন উপসর্গ ছাড়াই শরীরে বাসা বাধে। এই অসুখের মধ্যে ভালোবাসা ও আছে। কারো জন্য আমাদের মনে এভাবই কোন উপসর্গ ছাড়াই ভালোবাসা বাসা বাধে। আমরা টের পাই যখন লাস্ট স্টেযে অসুখ টা চলে আসে।

আবেগ তার চেয়ারে গিয়ে বসল। সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। আধো কল্পনা, আধো বাস্তবতা!

আবেগের সব কল্পনা জুড়েই রোদেলার বিচরণ।কল্পনার বিষয়বস্তু সেই দুই-তিন টাই দৃশ্য ই। এর চেয়ে বেশি কল্পনা করার ক্ষমতা আবেগের মতো সাধারণ মানুষের নাই।

আবেগ ঘোরের মধ্যেই দেখছে, রোদেলা লাল টুকটুকে বউ সেযে বসে আছে। মাথা নিচু করে। সে সবে মাত্র রোদেলাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে। বাইরে প্রচুন্ড বৃষ্টি। এই বছর এতো বৃষ্টি এর আগে হয় নি। আজকে মুষুল ধারে বৃষ্টি পড়ছে। জুনের শুরু কেবল। আবেগ রুমে ঢুকে দেখে, রোদেলা বিয়ের শাড়ি পড়ে নেই। বরং তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে আবেগের দেওয়া আড়ং থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে কেনা কমলা রঙের সেই শাড়িটা। কি আশ্চর্য! বিয়ের রাতেই রোদেলা বিয়ের এক বছর ফূর্তি হওয়ার শাড়ি কিভাবে পেল? কল্পনায় সব সম্ভব।

শাড়িটা আবেগ খুব শখ করে এনেছিল। কিন্তু রোদেলার পছন্দ হয় নি। রংটা নাকি খুব ক্যাটক্যাটে। রোদেলা কমলা রঙ পছন্দ করেনা। এটা জানার পর আবেগ এই রঙের শাড়ি কিনে এনেছিল। তার মনে হত, রোদেলাকে কমলা রঙের শাড়ি পড়লে অন্যরকম লাগে!

যাইহোক কল্পনা কিংবা স্বপ্নে আবেগ দেখল, রোদেলা মাথায় কাপড় দিয়ে বসে আছে। সে রোদেলার পাশে গিয়ে বসল। এবং রোদেলার নরম হাতটা তার হাতে তুলে নিল। রোদলা মৃদ্যু কেপে উঠে। এবং বলল, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?

রোদেলা লাজুক বধুর ন্যায় উত্তর দিল, উহু!
আবেগ মুচকি হেসে বলে, আমি মারা গেলে কি তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?

কথাটা শোনামাত্র রোদেলা আবেগের দিকে বিষ্ফরিত চোখে তাকালো এবং হুট করে হুহু করে কেদে দিল। তা দেখে আবেগ হোহো করে হেসে দিল। আচমকা কিছু একটা হলো আবেগের। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। রোদেলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবেগ খুব করে চাচ্ছে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, খুব ভালোবাসি!

কিন্তু পারল না! এর আগেই অদেখা কেউ তার মুখের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল এবং জোরজবরদস্তি হাতটা আবেগের গলায় ঢুকাচ্ছে৷ আবেগ কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে। খুব চাচ্ছে রোদেলাকে শেষ বারের মতো ভালাবাসি বলতে! কিন্তু পারছেনা। তার আগেই সে,,,,,,,,

আবেগ ধড়ফড় করে উঠে যায়। ভাগ্যিস স্বপ্ন ছিল। ভয়ে সে ঘেমে গেছে। শার্ট ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। আবেগ ভাবতে লাগে, রোদেলা কি জানে সে রোদেলাকে কতোটা ভালোবাসে?

আচ্ছা অনেক বছর আগে যখন রোদেলাকে সে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর দিন রোদেলার বাসায় গিয়েছিল তখন যদি রাগ না করে গেলে গিয়ে বরং বসে থাকত এবং রোদেলা ফিরে এলে যদি, সব ভুলে শুধু অতি মহা মূল্যবান শব্দ ভালোবাসি বলত তবে কেমন হত?

★★★
রোদেলা অস্থির হয়ে বসে আছে। তার কিছুই ভালো লাগছে। কোন কিছুতেই মন নেই। সমুদ্র রাতে তার সাথে রাগ করে সেই যে রুমে গিয়ে গেট লাগালো। আর একবার ও খুলে নি। এখন দুপুর। ছেলে তার সকালে কিছুই খায় নি। এখন দুপুর। ফাতেমা বেগম বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন গেট খোলানোর। কিন্তু সমুদ্র কোন রেসপন্স করেনি। রোদেলা একটু হাক পেরে পিউকে ডাক দিলো। পিউ সবে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। মায়ের আওয়াজ পেয়ে বের হলো।

মায়ের রুমে যেতেই রোদেলা অস্থির হয়ে বলে,পিউ মনি, তোর ভাইকে গিয়ে ডেকে এনে দুপুরে খাওয়া।

— আচ্ছা।

— শোন।

— বল!

— তুই বেশি ঘাটাবি না সমুদ্র কে। তুই এমনি বাচাল। কিন্তু সমুদ্র বেশি কথা বলা পছন্দ করেনা৷

— ওকে। ওকে।

পিউ তার ভাইয়ের রুমে গিয়ে নক করে বলে, ভাইয়, আমি পিউ। তোমার একমাত্র ছোট্ট বোন। প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর। আই হামবেলি ইনসিস্ট!

খট করে গেট খোলার শব্দ এলো। পিউ খুশি হয়ে গেল। সে উত্তেজিত হয়ে ভাইয়ের রুমে ঢুকে পড়ে। তারপর রুমের দিকে চোখ বুলালো এবং চিল্লিয়ে বলে, ও মাই গড! তুমি তো অনেক গোছানো!

সমুদ্র অবাক হয়ে বলে, কেন তোর গোছানো ছেলে পছন্দ না?

পিউ ভাবুক চেহারা বানিয়ে বলে, গোছানো রুম পছন্দ কিন্তু ছেলে না!

— মানে?

— ছেলে হবে অগোছালো, আনপ্রেডিক্টেবল, একটু রাগী, কোল্ড হার্টেড।

— এমন ছেলে তো হিন্দি সিরিয়ালে কাজ করে।

পিউ হেসে দিল এবং বলল, ভাইয়া আমাকে ঘুরাতে নিয়ে যাবে?

— না।

না বলার সঙ্গে সঙ্গে পিউয়ের মুখ কালো হয়ে গেল।

এতে সমুদ্রের ও খারাপ লাগছে। মেয়েটা বড় আশা নিয়ে ভাইয়ের কাছে আবদার করেছিল আর সে এভাবে মুখের উপর না করে দিল! উচিত হলো না। মেয়েটা বিদেশ থেকে এসেছে। আগ্রহ তো বেশি হবেই। এভাবে মুখের উপর সোজাসাপ্টা ‘না’ না বলে, সে বলতে পারত আচ্ছা দেখি!

বাঙালীদের জন্য না এর অপর নাম আচ্ছা দেখি।

পিউ এর মুখ দেখে সমুদ্র বলে উঠে, আচ্ছা। বিকেলে নিয়ে যাব।

— সত্যি?

— হুম।

পিউয়ের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সে বলে উঠে, থ্যাংক ইউ ভাইয়া। লাভ ইউ!

সমুদ্র বিরক্ত হলো। সে এভাবে ভালোবাসা প্রকাশে বিশ্বাসী না। তার মতে,

ভালোবাসা বলে-কয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াবার জিনিস না। বরং অতি যত্নে সিন্দুক বন্দী করে রাখার মতো মহা মূল্যবান এক অনুভূতির নাম হলো ভালোবাসা !

সমুদ্র পিউকে বলে, সবাই মিলে যাব।

— আচ্ছা৷ খেতে আসো।

সমুদ্রকে নিয়ে পিউ খেতে বসল। সমুদ্র বোনের সাথে খাচ্ছে৷ এমন সময় শ্রাবণ আসল। শ্রাবণ কে দেখেই পিউ বলে, হেই ব্রো! তোমার ছলনাময়ী নারীর কি খবর?

সমুদ্র মুচকি হেসে শ্রাবণ কে উদ্দেশ্য করে বলে, তোর না কাল নাগিনীর বাসার সামনে গিয়ে বসে থাকার প্লান? কই গেল সেই প্লান?

শ্রাবণ ধপ করে বসে পড়ে এবং মনে মনে বলে,আমার ভাগ্য এতো ভালো যে কাল নাগিনীর বাসার সামনে না ডিরেক কাল নাগিনীর গর্তে উফ সর‍্যি বাসায় বিসে আছি। মানে আমি কতো লাকি! এক্সের বাসায় খাই-দাই আর চিল মারি।
কিন্তু মুখে বলে, প্যারায় আছি।

সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, তোর আবার কি হলো?

— চাকরি হচ্ছে না। যেখানে রিটেন দেই, টিকি না। ভাইবায় ডাক পড়েনা।

— তোর বাবার অফিসে ঢুকে যা। মালিকের ছেলে তুই। সোজা এমডি হবি৷

— ধুর! আব্বু সোজা বলছে আমাকে তার অফিসে চাকরি দিবে না। কেমন হার্টলেস বাপ আমার!

সমুদ্র হেসে ফেললো। পিউ বলে উঠে, এসব প্যারাময় কথা বাদ। আমরা আজকে ঘুরতে যাব।

শ্রাবণ বলে, কই যাবা?

সমুদ্র খেতে খেতে উত্তর দিল, ধানমন্ডি।

–ও৷

পিউ আগ্রহ নিয়ে বলে, ধানমণ্ডি তে কি আছে?

শ্রাবণ মজা করে বলে, ইয়া বড় বিড় ধান আছে।
পিউ উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, সত্যি?

শ্রাবণ আর সমুদ্র দুইজন ই হোহো করে হেসে দেয়৷ পিউ বোকা চোখে দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

★★★
আয়না তার রুমে বসে ভাত খাচ্ছে। তার মা কিছুক্ষন আগে খাবার দিয়ে গেছে। তার ভাত খেতে মন চাচ্ছে না। আজকে খুব ভাত ভাজি খেতে ইচ্ছা করছে৷ আগে মা প্রায় প্রায় আগের রাতের ভাত বেচে গেলে, সেই ভাত গুলো পিয়াজ-মরিচ,হলুদ দিয়ে ভেজে সকালে নাস্তায় খেতে দিত। ভাত ভাজি আর ডিম ভাজি। অসাধারণ লাগত আয়নার কাছে।

আয়না ভাতের সাথে ভর্তা মিশিয়ে খেতে লাগলো। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের নিজে কোন ইচ্ছা-সাধ-আল্লাদ থাকতে নেই। আয়নাও সেই সম্প্রদায়ের কেউ একজন।

আয়নার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কালকের জ্বর সেরে গেলেও সর্দি লেগেছে। সে নাক টেনে খেতে লাগলো।

খাওয়া শেষ করে আয়না তার আলমারি খুললো। আলমারি তেমন কিছু নেই। কয়েকটা জামা। আসলে অনেক দিন ধরে নতুন কাপড় কেনা হয় না তার! তাই সব জামাই পুরাতন। আয়না ড্রয়ার থেকে তার চুড়ির বক্স বের করল। বেশ কয়েক ডজন কাচের চুড়ি। লাল, নীল, সাদা, কালো, হলুদ, সবুজ, কমলা, হরেক রকমের কাচের চুড়ি। আয়নার কাচের চুড়ির প্রতি টান অনেক। সে চুড়ি গুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। বিশেষ করে লাল চুড়ি গুলো কে নাড়ছে। আয়নার প্রিয় রঙ হলো লাল। তাই লাল রঙের বেশ কয়েক সেট চুড়ি আছে তার৷ সেগুলোই নেড়েচেড়ে দেখছে কিন্তু হাতে নিয়ে পড়ছে না। আয়না একটা দম নিয়ে বক্সটা আলমারি তে রাখল। তার তলপেটে চিনচিন ব্যথা করে উঠে। আয়না আলমারি বন্ধ করে দিল। তার ছাদে যেতে মন চাচ্ছে কিন্তু মা স্পষ্ট মানা করে দিয়েছে যেন সে ছাদে না যায়। হুট করে গেটে কারো নক করার আওয়াজ শুনল আয়না। সে কেপে উঠে। কে এলো তার রুমে?

আয়না মানুষ-জন কে ভয় পায়। দূরে দূরে থাকে সবার চেয়ে। বাহির থেকে রোদেলার ফুপুর শব্দ শুনছে সে। কিন্তু গেট না খুলে মাথা করে চোখের পানি ফেলায় সে।

নিজের প্রতি তার ঘৃণা লাগে! এজন্য তো এই অপয়া, অলুক্ষনে মুখ কাউকে দেখায় না। সবার আড়ালে অগ্রচরে থাকতে পছন্দ করে। আয়না তলপেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

★★★

রোদেলা আয়নার সাথে দেখা করার জন্য তার রুমেই এসেছে। কিন্তু আয়না গেট খুলছে না। রোদেলার অনেক কিছু। সব সে আয়নার জন্য নিজ হাতে পছন্দ করে এনেছে। এর মধ্যে সাজ-সরঞ্জামই বেশি। মেয়েটা সেই ছোট্ট বেলা থেকেই সাজ-গোজ পছন্দ করে। তাই জন্য বিভিন্ন সাজ-সরঞ্জাম কিনে এনেছে। কিন্তু মেয়েটা একবারো রুম থেকে বের হলো না। দেখা ও হলো না। রোদেলা আয়নার নাম ধরে ডাক দিল। তখনি অথৈ এসে রোদেলাকে বাধা দিল। রোদেলা কিছুটা অবাক হলো অথৈকে দেখে।

অথৈ বলে, কোন সমস্যা?

রোদেলা মুচকি হেসে বলে, সমস্যা কেন হবে? আয়নার সাথে কথা বলতে এলাম। ওর জন্য গিফট এনেছি। ফোন ও এনেছি।

অথৈ বলে, ও তো ঘুমাচ্ছে। আর আয়নার এসব লাগবে না। ফো দিয়ে ও কি করবে?

রোদেলা অবাক হলো। এই যুগে ফোন দিয়েই তো সব।

রোদেলা আর ঘাটালো না। মা যখন মানা করেছে তখন আর কি করার? আচ্ছা আয়নার কি কিছু হয়েছে? এমন কিছু যা সর্ম্পকে সে অবগত না? রোদেলা রুমে চলে গেল।

পিউয়ের শাড়ির আচল ঠিক করে দিল আলিয়া। পিউ খুব খুব খুশি। শাড়ি পড়তে পারায় তার এতো ভালো লাগছে! তাকে একদম নায়িকার মতো সুন্দর লাগছে! পিউয়ের উল্লাস দেখে আলিয়ার ও খুব যেতে মন চাচ্ছে কিন্তু মা সাফ মানা করে দিয়েছেন। আপাকে তো যেতে দিবেন ই না সাথে তাকে যেতেও মানা করেছেন। আলিয়া পিউকে সাজিয়ে দিল। পিউ খুটে খুটে নিজেকে দেখছে৷

তখনই সমুদ্র এলো রুমে৷ পিউকে দেখে সে হাসল। এবং আলিয়াকে দেখে বলে, আলিয়া নূর জাহান তুমি রেডি হলে না যে?

আলিয়া মন খারাপ করে বলে, যাব না ভাইয়া৷

— মামী যেতে দিবে না?

–হুম।
— আয়না আর তুমি রেডি হও। তোমাদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার।

সমুদ্র নানার কাছে গিয়ে পারমিশন নিল। আলিয়া খুব খুশি হয়ে আয়নার রুমে গিয়ে বলে, আপা আমরা বাইরে যাব৷

আয়না বোনের দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলে, আমি বাসার বাইরে যাই না। এটা তো জানার কথা৷ আমি যাব না।

পেছন থেকে সমুদ্র আয়নার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। আয়না বাসার বাইরে যায় না মানে? এসব কেমন কথা?

চলবে।