প্রেমপ্রদীপ পর্ব-৫৪ এবং শেষ পর্ব

0
4592

#প্রেমপ্রদীপ
Last part ( প্রথম অংশ)
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল থেকে। অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে। থেকে থেকে থামছে কিন্তু আবার কিছু সময় পর বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু করছে৷
পিউ মন খারাপ করে বসে আছে। আজকেই বৃষ্টি হওয়ার দরকার পড়ে? এটা বৃষ্টির মাস নাকি? এটা সামার। সামারে কেন রেইন ফল হবে? স্ট্রেঞ্জ! তবে সে উপভোগ ও করছে বেশ। রেইন জিনিস টা তার কাছে দারুণ লাগে। আজকে যেন বৃষ্টির ফোটা পড়ায় চারিপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য তিন গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সে অবাক নয়নে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷

আলিয়া রুমে ঢুকে বলে, এই যে ব্রাইড! এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে গায়ে যে পানি লাগাচ্ছো? অসুখ বেধে গেল। আসো রুমে আসো।

পিউ প্রায় লাফিয়ে এলো বারান্দা থেকে। তাকে দেখে আলিয়া মুচকি হেসে বলে, তুমি ই মনে হয় একমাত্র বউ যে কিনা নিজের বিয়েতে এতো খুশি!

পিউ এক গাল হেসে বলে, আমি আসলেই অনেক বেশি হ্যাপি আজকে।

— তো পুলিশ সাহেবের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে গেছেন আমাদের ডেন্টিস্ট!

পিউ হেসে বলে, জানো রঙ্গনের দাত না একদম ইদুরের মতো সোজা আর ঝকঝকে সাদা!

আলিয়া হোহো করে হেসে দিল। তখনি আয়না খাবারের প্লেট হাতে ঢুকল।

সে বলে উঠে, পিউ তুমি খেয়ে নাও। একটু পর সাজাতে আসবে তোমাকে। এরপর আর টাইম পাবে না।

পিউ বলে উঠে, ভাবী আমাকে খাইয়ে দাও। আমার বিয়ে এতোটুকু আদর তো আমার প্রাপ্ত!

আয়না পোলাও মাখিয়ে পিউয়ের মুখে তুলে দিয়ে বলে, তোমার আদর তো সবসময়ই সেইম থাকবে। বিয়ের আগেও যা বিয়েত পর ও তা!

পিউ ভাবীর হাতে খেতে নিল। এ কয়েকটা দিনে ভাবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে! ভাবী অসাধারণ একজন মেয়ে। ভাবীর এতো গুন! যে পিউ অবাক হয় এই গুনবতী মেয়েটা তাদের ঘরের মানুষ! আপন মানুষ! পিউয়ের বিয়ের সব ডালাই আয়না ভাবী আর আলিয়া তৈরি করেছে। কি সুন্দর ডিজাইন! কি সুন্দর আকা সব নকশা! ভাবী তো কালকে রাত জেগে এক গাদা পিঠা-পুলি বানিয়েছে।

পিউকে খাইয়ে দিতে দিতে আয়না বলে উঠে, জানো ফুপু না একটু আগে চোখের পানি মুছতেছিল। আমি দেখতেই অন্য দিকে তাকালো। পিউমনি খাওয়া হলে তুমি একটু ফুপা-ফুপুর সঙ্গে সময় কাটাও।

পিউ বলে, আচ্ছা।

আজকে শুক্রবার। দেখতে দেখতে সাত দিন কেটে গেছে। এই সাত দিনে পিউয়ের মধ্যে তুমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে।এখন তার সবকিছুতেই রঙ্গন নিরব ভূমিকা পালন করছে। এই যে লাল বেনারসি শাড়িটা আজকে যেটা সে বিয়েতে পড়বে এটা রঙ্গন ই তো পছন্দ করে দিল৷ পিউ খেতে খেতেই লাল শাড়িটা হাত দিয়ে আদর করল। এই সাত দিনে প্রায় সারা রাত জেগেই সে রঙ্গনের সঙ্গে গল্প করেছে। সে খুব সুন্দর জোক্সস মারতে পারবে। এমন এমন জোক্সস মারে যে পিউয়ের হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়৷

এই তো সাত দিন আগেও মানুষ টা তার পছন্দের মানুষের তালিয়ায় ছিল। কিন্তু আজকে এই মূহুর্তে এই ব্যক্তিটা তার ভালোবাসার মানুষ দের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। পিউ লাজুক হাসছে। সে জানে রঙ্গন তাকে খুব সুখে রাখবে! ভরসা হয়ে গেছে তার মানুষটার প্রতি! হুট করে এতো ভালোবাসা কিভাবে যে রঙ্গনের প্রতি হয়ে গেল সে বুঝল ও না। ভাবীকে প্রশ্ন করেছিল এই বিষয়ে। ভাবী বিজ্ঞদের মতো করে উত্তর দিল, বিয়ে শব্দটাই নাকি এমন! বিয়ের মধ্যে নাকি ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। ভাবী নাকি বিয়ের আগ অব্দি ভাইয়াকে ভালোবাসত না৷ কিন্তু বিয়ের পর তার কি যে হলো। একদন্ডের মধ্যে সে ভাইয়াকে ভালোবেসে ফেলে। বিয়ের মাধ্যমে নাকি ভালোবাসা মজবুত হয়! পিউ সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল।

খাওয়া শেষ করেই সে মায়ের রুমে গেল। মা কাজ করছেন। কি কাজ করছে তা পিউ বুঝল না কিন্তু সে পেছন থেকে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে৷

রোদেলা হালকা কেপে উঠে। সে জানে এটা পিউ। ছোটকাল থেকেই পিউয়ের ঠিক এভাবে জড়িয়ে ধরার অভ্যাস আছে৷

সে পিউয়ের দিকে না ঘুরেই তার হাত চেপে ধরে বলে, আমার মেয়েটা কতো বড় হয়ে গেছে টেরই পেলাম না! সেদিন ই তো তুমি তোমার বার্বি ডলের বিয়ে দিতে অথচ আজ তোমার বিয়ে আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না!

পিউ হাসতে গিয়েও কেদে দিল। হুট করে তার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল।

রোদেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হুস! একদম কাদবি না রে মা। তোর জন্য তো কাদা বারং! যার জন্য যেটা বারঙ তাকে সেটা করতে হয় না।

পিউ কান্না থামিয়ে মায়ের মুখে মাথা রাখল। মায়ের গায়ের গন্ধ নাকে আসতেই সে চোখ বন্ধ করে। মায়ের গন্ধটা কতো আপন!

পিউ মায়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে সাজার জন্য চলে গেল। তাকে সাজাতে পালার থেকে আর্টিস্ট এসেছে। তার হাত ভতি মেহেদী। ডান হাতের মাঝে রঙ্গন লেখা। সে চেয়ারে বসতেই মেকাপ আর্টিস্ট তার চেহারায় ফাউন্ডেশন দেওয়া শুরু করে দিলো।

★★★

রঙ্গন চুপচাপ নিজের ড্রয়িং রুমে বসে আছে। পরনে তার বিয়ের পাঞ্জাবি। মাথায় পাগড়ি পড়ে আছে সে।কেন যে সে খুব ঘামছে। কপাল ঘামছে, গা ঘামছে তার। পাঞ্জাবির পেছনের অংশ ভিজে গেছে তার৷ সে এক গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে নিল। পিউয়ের বড় ভাই তাদের ডিপার্টমেন্টে খোজ নিয়েছে। ভাগ্যিস সে কিছু জানতে পারেনি। রঙ্গন যা যা জানাতে চেয়েছে সেসবই জেনেছে সমুদ্র।

রঙ্গন উঠে দাড়ালো। কিছুক্ষনের মধ্যে সে বের হবে। তার বুকটা হাহাকার করছেন।তার বিয়ে অথচ তার ছোট বোনটা নেই! এই মেয়েটা তাকে যে খুব সম্মান করে সেটা সে বুঝে। ভালোও বাসে খুব। অথচ সে শুধু বকা-ঝকাই করে। সে ঠিক করল, বিয়ের পর রুশা আর বাবাকে এখানে এনে রাখবে। রুশার ক্লাস অনলাইনে চলছে৷ কোন সমস্যা হবে না। হুট করে পিউয়ের পরিবার দেখে তার নিজের পরিবারের কথা ও খুব মনে পড়ছে।

সে রজব আলীকে কল লাগায়। এ কয়েক দিনে রজব আলীর সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেছে। রঙ্গনের একটা দিক খুব ভালো সে যেকারো সঙ্গে খুব দ্রুত ভাব জমাতে পারে৷

রজব আলী আসতেই রঙ্গন বেরিয়ে পড়ে। বরযাত্রী হিসেবে তার কয়েকজন বন্ধুও আসবে। মোট সাত-আট জন মানুষ তারা।

★★★

সমুদ্র আবেগকে কোন কাজ ই করতে দিচ্ছে না। সে একা হাতে সবটা সামলাচ্ছে।

আবেগ ধমক মেরে বলে, সমুদ্র বাবা তুমি একা পারবা না৷ সব সামলাতে। তুমি নিজেই ছোট! কি করে সামলাবে?

ওপাশ থেকে শ্রাবণ বলে উঠে, মামা ভাইয়া আর ছোট নাই। দুই দিন নিজেই বাবা হবে।

সমুদ্র কড়া চোখে শ্রাবণের দিকে তাকালো। আবেগ কিছুটা থ হয়ে যায়। শ্রাবণের কথা কিন্তু ঠিক। সমুদ্র যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তার কাছে এখনো ছেলেকে ছোটই মনে হয়। তার চোখে ছেলে কোন দিন বড় হবে না। সমুদ্র ক্যাটানিংয়ের লোকের সঙ্গে কথা বলে বিল মেটালো। ছেলে পক্ষ চলে আসবে। সমুদ্র ও এখন রঙ্গনকে নিয়ে নিশ্চিত। ছেলেটা ভালো। এই সাত দিনে তার ব্যবহারে সে মুগ্ধ। তার বন্ধু এখনো রঙ্গনের পরিবার নিয়ে কোন খবর দিতে পারেনি। ইন ফ্যাক্ট তার ফোনই অফ। যাক গে, পিউয়ের খুশির কাছে এসব খুব তুচ্ছ। রঙ্গনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ায় পিউ অন্তত খুশি। এটাই তো সে চায়। বোনের সুখ!

সমুদ্র কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। হুট করে আয়না এসে দাড়ালো তার সামনে।

সমুদ্র বিরক্ত হয়ে বলে।,কি হয়েছে? এভাবে মুখের সামনে এসে দাড়ালে কেন?

আয়না এক গ্লাস জুস সমুদ্রের সামনে এনে ধরে বলে, সকাল থেকে তো কিছু খাওনি। এবারে জুসটা খেয়ে নাও।

সমুদ্র জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে বলে, স্বামীর কথা তাহলে মনে আছে তোমার! আমি ভেবেছি তুমি আমাকে চেনোই না। কেউ যদি এসে বলে,, আপা সাদবিণ রহমান সমুদ্র কে? আমার বিশ্বাস তুমি বলবে, হু ইস হি?

আয়না হেসে দিল। কালকে রাতে আয়না পিউয়ের সঙ্গে ছিল জন্য সমুদ্র তার সঙ্গে রেগে আছে। আয়না সমুদ্রের চুল এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল। সমুদ্র তখনো জুস খাচ্ছে৷

জুসের গ্লাস টেবিলে রাখতেই তার বন্ধুর কল। সমুদ্র ফোন ধরতেই সে ওপাশ থেকে বলে উঠে, দোস! তোকে ভুল তথ্য দিসিলাম। ওই রঙ্গন বিরাট বড় প্রতারক। ওর বাবা গাজীপুরে থাকে। নাম রিশাদ আহমেদ। রজব আলী না।

সমুদ্রের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। সে কি বলবে বুঝে পাচ্ছেনা।

তার ফ্রেন্ড বলে উঠে, আমাদের চোখে পট্টি বেঁধে রেখেছে ও। তুই জলদি বনানি আয়।

— এখন আসব?

–হ্যা। আয়৷ এখনি।

সমুদ্র সব ফেলে বেরিয়ে পড়ে।

আয়না অবাক হয়ে গেল। সমুদ্রকে কিছু জিজ্ঞেস করার ও সুযোগ পেল না সে। এখনি বরযাত্রী আসবে। আর কণের ভাই বাইরে চলে গেল?

সমুদ্র বের হয়ে যাওয়ার আধ ঘন্টা পর রঙ্গন উপস্থিত হয়৷ আয়নার ঘাম ছুটতে লাগে। কি করবে সে? সবাই সমুদ্র কে খুজছে। ফুপু তিন বার সমুদ্র কে খুজেছে।এদিকে তার ফোন অফ। আয়না বেশ চিন্তায় পড়ে যায়৷

আয়নার বাসা থেকে ও সবাই এসে গেছে। পিউ ও রেডি। কাজী চলে এসেছেন। আয়না খুব বুদ্ধি করে কাজী সাহেবকে খেতে বসিয়ে দিয়েছেন। সমুদ্র আসা অব্দি কিভাবে সে এতো সব ম্যানেজ করবে?

পিউকে আলিয়া বাহিরে নিয়ে এলো।পিউকে দেখা মাত্র রঙ্গনের মনে হতে লাগে, কেউ তার বুকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। সে বড় বড় করে দম ফেলে মুগ্ধ চোখে পিউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। পিউকে তার পাশেই বসানো হলো। রঙ্গনের তো যায় যায় অবস্থা! সে ঢোক গিলে বলে, পিউ আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ!
পিউ মুচকি হেসে বলে, আই লাভ ইউ টু!
এই তিন শব্দ শুনেই রঙ্গনের কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। তার খুব করে মন চাচ্ছিল পিউয়ের নরম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতে। কিন্তু কেমন যেন এক দ্বিধায় এটা সম্ভব হলো না।

বিয়ে পড়ানোর সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও সমুদ্রের কোন খোজ নেই। লাপাত্তা সে। সবাই সমুদ্রের জন্য অপেক্ষা করছে। কাজী সাহেব ও বসে আছে৷ রঙ্গনের বন্ধুরা বলে উঠে, বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে।

কিন্তু পিউ না বলে আপত্তি করে। সে ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে কিছু করবেনা। ভাই আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। রঙ্গন জোর করেনি। কেন যেন তার মনে কু ডাকছেন।অস্থিরতায় তার চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে৷ ঘন ঘন শুকনা ঢোক গিলছে সে৷

আরো পনের মিনিট পর সমুদ্র ফিরল। তাকে আসতে দেখে রঙ্গন স্বস্তি পেল। সমুদ্র এসেই সোজাসাপটা তাকে প্রশ্ন করে, রঙ্গন তোমার বাবা কোথায়?

সে ঘাবড়ে গিয়ে রজব আলীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ওই যে উনি! সোফায় বসে আছে ভাইয়া।

সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গনের শার্টের কলার চেপে ধরে উঠে দাড় করিয়ে বলে, উনি তোর বাপ ।হলে রিশাদ কে? তোমার চাচা লাগে রিশাদ আহমেদ তাহলে? এতো বড় প্রতারণা?

রঙ্গন চুপ হয়ে যায়। সে খেয়াল করল, হুইল চেয়ারে করে রিশাদ আর রুশা বাসার ভেতরে ঢুকল।
তাদের দেখে রঙ্গন চোখ বন্ধ করে বলে উঠে, শিট!

সমুদ্র এলোপাতাড়ি ভাবে রঙ্গনকে মারতে লাগে। পিউ উঠে দাড়ালো এবং ভাইয়াকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগে।

সমুদ্র পিউকে ধমক দিয়ে বলে, পিউ তুই চুপ থাক! এই ছেলে আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছে!তোকে ফাসাচ্ছিল আর তুইও ফেসে যাচ্চিলি৷

পিউ কাদো কাদো হয়ে বলে, ভাইয়া। ও কেন এমন করবে? ও আমাকে ভালোবাসে,,,,

আবেগ বলল, এসব কি করছো তুমি সমুদ্র? ছাড়ো ওকে!

সবাই সমুদ্র কে দোষারোপ করলেও রোদেলা স্তব্ধ। কারন সে রিশাদকে দেখেছে ৷

সমুদ্র হুংকার দিয়ে বলে উঠে, আব্বু! রঙ্গন রিশাদ আহমেদের ছেলে। রজব আলী কেউ হয় না তার। এই ছেলে আমাদের সঙ্গে মিথ্যা অভিনয় করেছে। বিশ্বাস না হলে রঙ্গনের বাবার সঙ্গে কথা বলো।

রিশাদ হুইল চেয়ারে করে রঙ্গনের সামনে এসে অবিশ্বাস ভঙ্গিতে বলে উঠে, এসব কি? তুমি নিজের বাবার পরিচয় লুকিয়ে বিয়ে করতে এসেছো? বাবা তুই বিয়ে করবি অথচ নিজের জন্মদাতা বাবাকে ও জানালি না? এতো অধপতন হলো কিভাবে তোর?

সে মাথা নিচু করে ফেলে। সমুদ্রের চিৎকারে তার ছোট বোন রুশা কেদে ফেলেছে। সে বেশ শব্দ করেই কাদছে। রঙ্গনের মুখে কোন কথা নেই। এভাবে যে সবার সামনে এক্সপোস হবে কেন জানত? বাবা এসে হাজির হলো কিভাবে? আজকের পর থেকে সে বাবাকে মুখ কিভাবে দেখাবে?

রোদেলা রিশাদের সামনে গিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বলে, রঙ্গন তোমার ছেলে?
রিশাদ মাথা নেড়ে বলে, হ্যা।

— তাহলে রজব আলী কে?

— জানি না।

রোদেলা এবারে রঙ্গনের কাছে গিয়ে বলে, রঙ্গন তুমি আমাদের মিথ্যা কেন বলেছো? এভাবে চিট করে বাটপারি করার মানে কি?

রঙ্গন মাথা নিচু করে রাখলো।
রোদেলা ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠে, চুপ করে মাথা নিচু করে রাখলেই তুমি পার পাবে না।কেন এমন করেছো? রিশাদ তোমার পিতা হওয়া সত্ত্বেও তুমি মিথ্যা বললে কেন,? আমাদের সঙ্গে তোমার সমস্যাটা কি?, কি চাও তুমি,?

রঙ্গন চোখ তুলে বলে, প্রতিশোধ নিতে চাই৷
তার মুখে এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলে স্থির হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায়।

সে বলে উঠে, আপনার জন্য আমার মা বেচে নেই। আপনার জন্য আমার বোন মারা গেছে। আপনার জন্য আমার বাবা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল।

রিশাদ তাকে ধমক দিয়ে বলে, এসব কি বলছো তুমি?

–ঠিকই বলছি আমি। এই সেই মহিলা না যার জন্য আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যার জন্য আপনি আমাদের রেখে থাইল্যান্ড গেলেন। উনিই সেই রোদেলা যার সাথে আপনি আমার মায়ের তুলনা করতেন। উনি সেই মহিলা যার সেই আপনার পরক্রিয়া ছিল,,,,,
এতোটুকু বলতেই সমুদ্র তার শাটের কলার চেপে ধরে বলে, খবরদার আমার মায়ের নামে একটা বাজে কথা বললে এক্ষুনি তোকে জানে মেরে ফেলব।

সে চুপ করে যায়। কিন্তু চোখে আগুন। বুকে ঝাঝালো ব্যথা!
রিশাদ বলে উঠে, রঙ্গন চল বাসায় চল। এসব করার আগে সত্যটা যাচাই করে নিলে তাহলে আর এমন লজ্জিত হতে হত না।

রোদেলা চিৎকার করে বলে, আর কোন দিন আমার মেয়ের ধারে কাছেও আসবে না।

রঙ্গন একবার পিউকে দেখে নিয়ে পাগড়িটা ফেলে দিয়ে একটা শ্বাস নিলো। এরপর টলমল চোখে পিউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, পিউ ট্রাস্ট মি আই লাভ,,,,,,

পিউ ভীষণ জোরে চেচিয়ে বলে উঠে, সাট আপ! জাস্ট সাট আপ! আমার বাসা থেকে এক্ষুনি এই মূহুর্তে চলে যাও। আমার সামনে তুমি কিভাবে আমার আম্মুর অসম্মান করো? হাউ ডেয়ার ইউ?

— আমার কথা শুনো!,

— তোমার কোন কথা শুনতে আমি বাধ্য নই!

— তুমি আমার বউ!

— বিয়ে হয় নি আর কোন দিন এটা সম্ভব ও হচ্ছে না।

রঙ্গনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে আমতাআমতা করে বলে, পিউ এসব কি? প্লিজ! আমার কথা শুনো,,,,

পিউ রঙ্গনের দেওয়া নেকলেস খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে যায়৷ আলিয়া তার পিছনে ছুটতে লাগে।

সমুদ্র রঙ্গনকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়৷ রিশাদ আর রুশা বিষ্ময়কর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রঙ্গন তাদের উপেক্ষা করে একা একা বিয়ের পাঞ্জাবি পড়ে হাটতে লাগে।

আবেগ রোদেলা থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কি বিপদ তাদের মাথায় ছিল! যদি পিউয়ের বিয়ে হয়ে যেত ছেলেটার সঙ্গে! তাহলে তো তাদের মেয়ের জীবন নরক হয়ে যেত। রোদেলা বা আবেগ কেউই রিশাদের ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারবে না৷

★★★
রঙ্গন প্রায় ঢুলতে ঢুলতে বাসার সামনের ফুটপাতে বসে পড়ে। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে তার। হাতে ভাংগা নেকলেসটা শক্ত করে ধরা। এটাই তার মায়ের শেষ স্মৃতি অথচ পিউ এক মূহুর্তে ভেঙে দিল এটা। রঙ্গন প্রায় কেদে ফেলল। তার বুকে ব্যথা করছে বেশ। সে বিড়বিড় করে বলে উঠে, যে মেয়ে তার মায়ের সম্মান করতে জানে না তাকে সে কোন দিন ভালোবাসবে না!
রঙ্গন হুংকার দিয়ে বলে উঠে, হে কুরণাময় জগৎ থেকে ভালোবাসা তুলে নাও! এই ভালোবাসা পোড়ায় অনেক।

সে চোখ মুছে বাড়ির পথ যাত্রা শুরু করে। আজকে থেকে পিউ নামক শব্দটা তার জীবন অভিধান থেকে মুছে গেছে।

রঙ্গন যে কিনা প্রেমপ্রদীপ গল্পে এক পশরা বৃষ্টির ন্যায় এসেছিল সে আজ এই শেষ যাত্রায় এক ঝিরিঝিরি আষাঢ়ে বৃষ্টি মতোনই গায়েব হয়ে গেল। রঙ্গন তোমার জন্য রইল অঢেল শুভকামনা।

★★★

পিউ রাতে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই রুম থেকে বের হয়ে এলো। খুব নরমাল সে। যেন কিছুই হয় নি। সে সবাই কে নিয়ে টেবিলে বসে বলে উঠে, আজকে আমি অনেক খুশি। এর পেছনে দুইটা কারন।

সবাই অবাক হয়ে যায়। মেয়েটার কিছু ঘন্টা আগে বিয়ে ভাংলো অথচ সে কিনা হ্যাপি।

পিউ বলে উঠে, আমি আমেরিকার টপ টেন হসপিটালে ডেন্টিস্ট হিসেবে জব অফার পেয়েছি।নেক্সাট মান্থ জয়েনিং আর সেকেন্ডে রিজন হলো আল্লাহ আমাকে খুব ভালোবাসে এজন্যই এতো বড় একটা পরীক্ষা নিল। আমি কিন্তু আল্লাহর উপর হতাশ না। বরং শুকরিয়া আদায় করছি একটা ঝড় আসতে গিয়ে থেমে গেল।

আবেগ হাসল। তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না তার মেয়ে এতো স্ট্রং! সে বলে উঠে, আমি চাই আমার মেয়ে যেন নামকরা ডেন্টিস্ট হয়! সে কি আমার এই ইচ্ছা পূরণ করবে?

পিউ জোর করে এক গাল হেসে বলে, অফ কোস আব্বু।

কেবল পিউ জানে এই মিথ্যা হাসি টানতে তার বুকে কতোটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে।তার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস উঠে গেছে। এই জীবনে আর কাউকে সে ভালোবাসবে না। পিউ আড়ালে চোখ মুছে নিল। কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না সে যন্ত্রনার সাগরে ডুবে মরছে।

রোদেলার চোখে জল চলে এলো৷ সমুদ্র পিউয়ের পাশে বসে ছিল। সে পিউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সে তার পুতুল কন্যাকে সকল ঝড় থেকে রক্ষা করবে। ভাগ্যিস তার বন্ধু ঠিক সময়ে সঠিক তথ্য বের করে দিয়েছিল। শুধু তাই না পিউকে নিজের বোন ভেবেই সে রিশাদ কে গাজীপুর থেকে ডেকে এনেছিল বনানি স্টেশনে। ডিউটি থাকায় আর বাকি পথ আসতে পারছিল না তার পুলিশ ফ্রেন্ড এজন্য সমুদ্র কেই কল দিয়ে ডাকল।

★★★

আবেগের শরীর দিনে দিনে অবনতি হচ্ছে। প্রায় পনের দিন হয়ে গেছে পিউয়ের বিয়ে ভাংগার।

ডাক্তার আজকে জানান দিলো, যদি সামর্থ্য থাকে তারা যেন বাইরে যায় পেশেন্ট নিয়ে। কম্পলিকেট সিচুয়েশনে আছে আবেগ।

রোদেলা আবেগের কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে প্রস্তাব দিল, চল আমরা থাইল্যান্ড যাই। যাবে আবেগ?

আবেগ এক গাল হেসে বলে, ওইখানে তো তুমি জব করতে তাই না,?

— হু।

— এক্সট্রা সুযোগ পাব আমরা?

— হ্যা। আবেগ প্লিজ!

— অবশ্যই যাব আমি। বরং গর্ব করেই যাব। আমি আমার স্ত্রীর টাকায় চিকিৎসা করব। এটা লজ্জার বিষয় না বরং অহংকারের বিষয়।

রোদেলা চমকে উঠে, আবেগ তাকে তার পাশে বসিয়ে বলে, জানো রোদেলা! বিদ্যুৎ আবিষ্কার হওয়ার পর পৃৃথিবীতে বিরাট বিপ্লব এসেছিল। আরেকবার এমন বিপ্লব ঘটবে যেদিন মানুষ গর্ব করে বলবে আমার বউ চাকরি করে সেই টাকায় আমাদের সংসারে কন্ট্রিবিউট হয়ে আমরা বেটার লাইফ লিড করছি। আরো একটা বিপ্লব সেদিন ঘটবে যেদিন একটা মেয়ে একটু দেরিতে ফিরলে তাকে বেশ্যার সঙ্গে তুলনা না করে প্রশ্ন করব, তুমি কি ক্লান্ত? এক কাপ চা খাবে?

আরো একটা বিপ্লব ঘটবে যেদিন প্রতিটা শ্বাশুড়ি বলবে, ও আমার বউমা না! বরং আমার মেয়ে!
কারেন্ট আবিষ্কার হয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলেও আমাদের মন-মস্তিষ্কে এখনো মোমবাতি আলোয়ই জ্বলছে। যেদিন আমাদের সমাজে, মনে, ব্রেইনে ইলেকট্রিসিটি চলে আসবে সেদিন অনেক।বড় একটা পরিবর্তন ঘটবে। এখনো এই সময় টা আসেনি। তবে আসবে। খুন দ্রুত আসবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিন আসতে আর বেশি দেরি নেই!

রোদেলা কেদে দিলো। আবেগ বলে উঠে,

জানো প্রেমপ্রদীপ মানে কি??

রোদেলা না বলে । সে জানে না প্রেমপ্রদীপ মানে কি।

–আমাদের প্রত্যকের মনে একটা করে প্রদীপ থাকে। যখনি আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে দেখি তখনি এই প্রদীপ আমাদের মনে জ্বলে উঠে!! এই প্রদীপ টা কেবল মাত্র ভালোবাসার মানুষের ঘৃণার কারনে দপ করে নিভে যায়!! আমার মিনে তোমার জন্য এখনো একটি প্রদীপ ঢিপঢিপ করে জ্বলছে আজীবন তা জ্বলতে থাকবে। এই প্রেমপ্রদীপ হলো কিছুটা জীবাশ্ম জ্বালানির মতো! মরনের পর ও হারিয়ে যায় না। শুধু লুকিয়ে থাকে!

চলবে।

#প্রেমপ্রদীপ
Last part (শেষ অংশ)
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

ভর রাত নাকি কাদার করার শ্রেয় সময়– এমনটাই শুনেছে রোদেলা। আজকে সে এই।ভর রাতে কাদছে। নিরবে কাদছে সে৷ পাশে শুয়ে থাকা মানুষ টা গভীর ঘুমে আছে। তাকে বিরক্ত করতে চায় না রোদেলা। সে মুখ চেপে কিছুক্ষন কান্না করে নিল। আগামী বুধবার তাদের থাইল্যান্ড যাওয়ার ফ্লাইট। রোদেলার দৃঢ় বিশ্বাস থাইল্যান্ডে অপারেশন হলেই আবেগ সুস্থ হয়ে যাবে। অবশ্যই সুস্থ হবে সে। তাকে সুস্থ হতে হবেই! এতো এতো মানুষের দোয়ার জোর কি এতোটাই কম যে সে সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবে না? তবে বাংলাদেশের ডাক্তাররা নেগেটিভ সাইন দিয়েছে। রোদেলা তা সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করেছে। আবেগ সুস্থ হবে। অবশ্যই তাকে সুস্থ হতে হবে।

রোদেলা টের পেলে আবেগ ঘুমের মধ্যেই গোঙ্গাচ্ছে। হাসফাস করছে। যেহুতু রোদেলা জেগেই ছিল কাজেই সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে লাইট অন করতেই জোড়ে করে চিৎকার দিয়ে উঠে। আবেগ ঘুমের মধ্যেই কেমন যেন করছে। মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে।

রোদেলা আল্লাহ! ও আল্লাহ বলে চেচাতে লাগে।

সে আবেগের কাছে গিয়ে দেখে আবেগের চোখ সামান্য খোলা, টকটকে লাল চোখ। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। সে নিশ্বাস নিতে পারছেনা এজন্য মুখ হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে।রোদেলা কেদে কেদে বাসার সবাইকে ডাকতে লাগে।

সমুদ্রের মাত্র চোখ লেগে এসেছিল। মায়ের চিৎকার শুনে সে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।

মা-বাবার রুমে যেতেই সমুদ্র থমকে যায়। হতভম্ব হয়ে যায়। বাবার করুণ পরিনতি দেখে তার হৃদয় গুড়গুড় করে ভাংতে লাগে। সে ভ্রু কুচকে চোয়াল শক্ত করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। কি হচ্ছে চারিপাশে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এই ভারী শরীর টেনে নিয়ে বাবার কাছে যাওয়া শক্তি তার নেই।

শ্রাবণ আয়না পিউ তিনজন একসঙ্গে রুমে ঢুকে আবেগের কাছে ছুটে গেল। রোদেলা চিৎকার দিয়ে কাদছে।

পিউ বাবার বুক মালিশ করতে লাগলো। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। আবেগ কেমন করে যেন গোঙ্গাচ্ছে।শ্রাবণ উপস্থিত বুদ্ধি ঘাটিয়ে বলে, ভাবী মামাকে এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে।

আয়না একথা শুনে কেদে ফেলে। খারাপ কিছু হওয়ার ভয় তাকে আকড়ে ধরে আছে৷

সমুদ্র ধীর পায়ে বাবার কাছে গেল। সে দাতে দাত চেপে কান্না আটকাচ্ছে। সে আর শ্রাবণ মিলে আবেগকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সঙ্গে আয়না গেল। পিউও খুব কাদছে। বাসায় ইভানা রোদেলা আর পিউ রয়ে গেল।

আয়না সুযোগ বুঝে তার বাবাকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলেছে। ফুপুকে দেখে রাখার জন্য।

হাসপাতালে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। ভাগ্যিস ডাক্তার ওয়ার্ডে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রা আবেগকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু হলো।

সমুদ্র শ্রাবণের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে, বাবা সুস্থ হবে তো? বুধবারে তার অপারেশনের জন্য থাইল্যান্ড যেতে হবে।

শ্রাবণ অভয় দিয়ে বলে উঠে, ইনশাআল্লাহ মামা সুস্থ হবে।

সমুদ্র তার ফোন সঙ্গে আনেনি। তাই সবাই বারবার শ্রাবণ কেই কল দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে বলে, উনি তো স্টোক করেছেন।

একথা শোনা মাত্র সমুদ্রের পা থেকে মাটি সরে আসে। সে ভর্য়াত চোখে ডাক্তারের দিকে তাকালো। ডাক্তার বলে উঠে, আইসিইউতে রাখার ব্যবস্থা করছি। ধৈর্য ধরুন।

সমুদ্র ধপ করে বসে পড়ে। চোখে পানি চিকচিক করছে। সে নিজেকে সামলানোর।চেষ্টা করেই যাচ্ছে। এভাবেই আস্তে আস্তে সকাল হয়ে এলো।

সকাল হতেই বাড়ির সবাই চলে আসে। মাকে দেখেই সমুদ্র চমকে উঠে। তাকে পাগল পাগল লাগছে। চোখে কালি জমে গেছে। সমুদ্র চুপচাপ বসে থাকলো। আসলে তার উঠার শক্তি নেই।

সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এলো। ডাক্তার কোন আপডেট দিচ্ছেনা। এদিকে মায়ের প্রেসার বেড়ে একাকার । সে কেদেই যাচ্ছে আর বিলাপ পেড়ে কি যেন বলছে।

সমুদ্র মায়ের কাছে গিয়ে তাকে শক্ত করে চেপে ধরে বলে, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন আম্মু। কেদে শরীর খারাপ করবেননা।
প্লিজ শান্ত হন।

রোদেলা শান্ত হলো না। আরো জোড়ে কাদতে লাগে। সমুদ্র ঠিক করে নেয়, মাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিবে। কিন্তু মা কিছুতেই ঔষধ খেতে চাচ্ছেনা।

দুপুরের দিকে ডাক্তার এসে বলল, রোগীর সঙ্গে আত্মীয় রা দেখা করতে পারবেন।

সবার আগে রোদেলা আর পিউকে পাঠানো হলো। এরপরে একে একে সবাই দেখা করে নিল। সবার শেষে সমুদ্র গেল। আইসিইউ তে ঢুকতেই তার শীত করতে লাগলো। হুট করে ঠান্ডা কেন লাগছে তার!

সে আবেগের কাছে গিয়ে বসতেই আবেগ হালকা হেসে বলে, সমুদ্র বাবা! কেমন আছো তুমি ?

সমুদ্র আর পারলো না কেদে দিল।

আবেগ সমুদ্রের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, যার কাধে দায়িত্ব থাকে, তার চোখে পানি থাকে না। কান্না পেলেও আড়ালে কাদতে হয়। এখন থেকে তোমার উপর অনেক দায়িত্ব রে বাপ। অনেক দায়িত্ব।

— আমি কোন দায়িত্ব নিতে পারব না বাবা।

আবেগ মুচকি হেসে বলে, দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না কিন্তু সবাইকেই পালন করতে হয়। শোন একটা গল্প বলি? আমার আর তোমার মায়ের প্রথম বিবাহ বার্ষিকির দিন আমি কমলা রঙের একটা শাড়ি কিনে আনলাম। তোমার মা খুব রাগ করলেন। তার শাড়ি পছন্দ হয়নি। সে শাড়িটা পড়েনি৷ একবারের জন্য ও। এতে আমি খুব মন খারাপ করি। সাত দিন তার সঙ্গে কথা বলি
এ অব্দি গল্প শুনে তুমি নিশ্চয়ই তোমার মাকে বদরাগী, স্বেচ্ছাচারী ভাবছো?

সমুদ্র হ্যা ও বলল না, না ও বলল না। চুপ থাকে।

আবেগ নিজে থেকেই বলে উঠে, পরবর্তীতে আমি খোজ নিয়ে জানতে পারলাম, তোমার মা সেই ছোট্ট কাল থেকে কমলা রঙ একেবারেই সহ্য করতে না। তার এই রঙের কোন কাপড় নেই। অথচ আমায় দেখো! এক বছর তার সঙ্গে থেকেও এই ব্যাপার টা আমি খেয়াল করিনি। কেমন হ্যাসবেন্ড আমি তাহলে! ভেবে দেখো! স্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দই জানি না। তার ছোট্ট কাল থেকে অপছন্দ করা রঙের শাড়ি কিনে আনলাম। পৃথিবীটা এমন যে তুমি চাইলেই সব এক পাক্ষিক হয়ে ভাবতে পারবে, এক পাক্ষিক হয়ে বিচার করতে পারবে। পৃথিবীর সবকিছু এক চোখ বন্ধ করে, একটা চোখ খোলা রেখেই সব দেখতে পারবে চাইলে, কিন্তু আল্লাহ আমাদের দুইটা চোখ দান করেছেন৷ কেন জানো? যেন আমরা দুচোখ দিয়েই পৃথিবী দেখতে পারি, দুচোখ দিয়েই বিচার করতে পারি। দুই পাক্ষিক হয়েই যেন সব ভাবি। কিন্তু তারপর ও আমরা এক চোখা হয়ে যাই। এক পাক্ষিক হয়ে পড়ি।

সমুদ্র নিরব কান্না কাদছে।

আবেগ তার হাত আরো শক্ত করে ধরে বলে,আমাদকে যদি প্রধানমন্ত্রী ভালো মানুষের তালিকার লিস্ট তৈরি করার কাজ দিত।আমি সবার আগে তোমার মায়ের নাম লিখে রাখতাম। তোমার মা মানুষটা মাটির মানুষ। খুব ভালো একজন মানুষ। তোমার মা বিদেশে যাওয়ার কারনের পেছনের সত্যটা তোমাকে জানাতে দেয়নি। সে চায় না তুমি সব জেনে তাকে ক্ষমা করো! এটাও তার এক ধরনের ছেলেমানুষী। আমার নিষেধাজ্ঞা আছে তাই বলতে পারলাম,,,,

— বাবা। চুপ করো। অনেক কথা বলেছো রেস্ট নাও।

— আমি আর তোমার মা দুইজনেই ভুল করেছিলাম। শাস্তিও পেয়েছি। শোন বাবা, একটা সময় বাবা-মায়েরা সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে যাই। তোমার মাকে বোঝা বানাবে না। তার যত্ন নিবে, মমতায়, স্নেহে ভরিয়ে রাখবে। সম্মাম দিবে। আমরা দুইজনের কেউ ই ভালোবাসা পাইনি। আমরা দুইজনে ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখি। তুমি তাকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখবে। বোনকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে। এই সংসারের দায়িত্ব আজকে থেকে তোমার৷

সমুদ্র কেদে দিল। ডাক্তার এসে তাকে বেরিয়ে যেতে বলে। সে বেরিয়ে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আয়না তার পাশে এসে দাড়ালো এবং কাধে হাত রেখে বলে, ফুপা সুস্থ হয়ে যাবে।

সমুদ্র এক ধ্যানে আইসিইউর রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট ফুটা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, ডাক্তার অতিরিক্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে কি যেন করছে। আরে! অক্সিজেন মেশিনটার সুইচ অফ করে দিল নাকি? বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট ভাবে।

সমুদ্র চোখ নিচে নামিয়ে নিল।

পরিবেশ অতিরিক্ত চুপচাপ। ঠান্ডা। বিকেলের দিকে ডাক্তার এসে সমুদ্র কে ডেকে এক কোণে নিয়ে গিয়ে বলে, আপনি ভালো আছেন ডাক্তার সাহেব?

সমুদ্র মাথা নিচু করে বলে, নাহ৷

হার্ট সার্জন আবুল কাশেম বলে উঠে, আমরা মানুষ খুব অসহায়। আল্লাহ কেন যে আমাদের অসহায় করে পাঠালেন? জানো আমার বাবা হার্ট এটাক করে বাসায় সাড়ে তিনটা ঘন্টা পড়ে থেকে মারা গেলেন, অথচ আমি তার ছেলে ঢাকার নামকরা হার্ট সার্জন।বাস্তবতা এমনই! যা আমরা ভেবে রাখি এটা কোন দিন বাস্তবতা না। বরং বাস্তবে কি হতে পারে আমরা তার আংশিক ধারনাও মাথায় আনতে পারব না৷

— খারাপ কিছু হয়েছে কি?

— তোমার বাবা আর নেই। আম এম সর‍্যি মাই ডিয়ার। তুমি আমার ছেলের বয়সী। তোমার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি। একটা সময় আমিও তোমার জায়গায় ছিলাম। টাইল হিল এভ্রি পেইন মাই সন।

সমুদ্রের কানে বাজতে লাগলো তোমার বাবা আর নেই। এই কথাটা এতো ভারী কেন? সে ঢোক গিলতে পারছেনা। নিজেকে মনে হচ্ছে শূন্য ভাসছে সে। উফ! বুকে এতো জ্বলছে কেন?

সে ঢুলতে ঢুলতে মায়ের কাছে গেল।

রোদেলা কলিডোরে চুপচাপ দোয়া পড়ছিল। পেছন থেকে কেউ তার কাধে হাত রাখায় সে পেছনে ঘুরে দেখে উদ্ভ্রান্তের মতো সমুদ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলার ছেলের চেহারা দেখে কষ্ট বেড়ে গেল।

সমুদ্রের চোখে ভাসছে একটা জিনিস তাহলো, মায়ের আলমারি তে আজো সেই হলুদ শাড়িটা খুব সুন্দর করে ইস্ত্রী করে ল্যাপথলিন দিয়ে ভাজ করে রাখা।

সমুদ্র মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আম্মু! আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ টা হারিয়ে গেছে। আজকে শুধু আমি -তুমি না সমগ্র পৃথিবী কাদবে। আজকে কান্না দিবস।

রোদেলা কিছুই বুঝতে পারছেনা। ওপাশ থেকে ইভানা আর পিউয়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার গা কাটা দিয়ে উঠে।

সমুদ্র মাকে আরো ঝাপ্টে ধরে বলে, আম্মু আমায় ক্ষমা করে দিও।

বাইরের পরিবেশ মূহুর্তে ঘন হয়ে এলো। ঝড় আসবে কি? কালবৈশাখী ঝড়? রোদেলা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। স্থির হয়ে।

— আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা । জীবন শব্দটার অর্থ বুঝতে বুঝতেই এক জীবন পাড় হয়ে যায়। মা! আমি তোমাকে আর নিজের কাছ থেকে যেতে দিবনা। বাবাকে হারিয়ে আমি পাগল প্রায়। তুমি না থাকলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব। আজ থেকে তুমি আমার তত্তাবধানে থাকবে৷ তোমাকে কোথায় যেতে দিব না।

এ-সব বলেই সমুদ্র বেরিয়ে পড়ল। হাসপাতালে এক মুহূর্ত থাকা দায় তার জন্য। ইশ এতো ব্যথা কেন হচ্ছে তার।

সমুদ্র এলোমেলো পায়ে হাসপাতাল থেকে খানিকটা দূরে চলে এলো। ফুটপাতে ধপ করে বসে পাগলের মতো হাউমাউ করে কাদলে লাগে।
চারপাশের রাস্তা ফাকা। ভীষণ বাতাস বইসে। ঝড় হবে। ঝড় হলে হোক। তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলে যাক!

সমুদ্র খেয়াল করে, একজন মধ্যবয়ষ্ক লোক বাজারের ব্যাগ হাতে প্রায় ছুটে যাচ্ছে। তার ব্যাগে লাউ উকি মারছে। নিশ্চয়ই আজকে তার বাসায় এই লাউ রান্না হবে। সে ছেলে-মেয়ে নিয়ে খেয়ে পর দিন আবার অফিস যাবে। তার বাবাও এতো অফিস শেষ করে বাজার করে আনত। এই সময়ই তো বাবার অফিস ছুটি হত। সমুদ্র লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বাবা হেটে যাচ্ছে। সে চোখ কচলে দেখে নাহ! আসলেই তো বাবা!

সমুদ্র পাগলের মতো ছুটে যায় বাবার কাছে।জোড়ে জোরে চিৎকার করে ডাকে বাবা বলে।বাবার কাছে যেতেই সমুদ্র বুঝে যায় এটা বাবা না। উনি অন্য কারো বাবা।

সমুদ্র ভেঙে পড়ে।সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সামনে তাকিয়ে দেখে লোকটা হেটে হেটে বাড়ি ফিরছে। সমুদ্রের কাছে মনে হলো, দিন শেষে বিকেল বেলা বাবার অফিস করে বাসার ফেরার মতো দৃশ্য দেখাও খুব ভাগ্যের বিষয়। এটা সে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করার সময় উপলব্ধি করল।

সময় কি আর থেমে থাকে নাকি? সময়ের যদি মন থাকত তাহলে অবশ্যই অবশ্যই সমুদ্রের জন্য এক দন্ড থেমে। বলত, মাই সন! স্টে স্ট্রং! বুধবার চলে এলো। আজকে বাবা বেচে থাকলে তারা থাইল্যান্ড যেত! শুধু বুধবার নয় দেখতে দেখতে এক মাস ও হয়ে যায়। পিউয়ের জয়েণিং ডেট কাছে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে। পিউ কিছুতেই যাবে না। কিন্তু সমুদ্র চায় সে যেন যায়! তার জীবন যেন খুব সহজ আর সুন্দর হয়। সে পিউকে অনেক বুঝিয়ে আমেরিকা ফেরত পাঠায়! যাওয়ার আগে পিউ এয়ারপোর্টে সমুদ্রকে জড়িয়ে কাদলো।
সেদিন প্রায় এক মাস পর মা বাসা থেকে বের হলো। মা শুকিয়ে গেছেন। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় খুব করে আদর করে দিলেন তিনি। আজকাল সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা হয়ে গেছে রোদেলার।

★★★

সমুদ্র বসে আছে। মন তার খারাপ। আজকে রাতে আয়নার ফ্লাইট। আয়না জাপানে যাচ্ছে। পিএইচডির অফার পেয়েছে সে। আয়না খুব খুশি। বিয়ের পর পরই সমুদ্র তাকে মাস্টার্স এ এডমিট করায়। মাস্টার্সের রেজাল্ট দেওয়ার পর দেখা যায় আয়না ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হয়েছে৷ এরপরই জাপানে পিএইচডি অফার পেল। সমুদ্রের খুব করে কড়া গলায় বলতে মন চাচ্ছিলো, এসব পিএইচডি করতে যাওয়ার দরকার নাই। আমার বউ আমার কাছে থাকবে। তুমি জানো না তো আমার একটা অসুখ আছে। সেই অসুখের নাম আয়না বিহীন ফোবিয়া। তুমি পাশে না থাকলে আমার জ্বর চলে আসে। তোমার যাওয়া হবে না এই কথা বলতে গিয়ে সে মুখ ফসকে বলে দেয়, অবশ্যই যাওয়া উচিত। এখন নিজের মাথা নিজের ই ফাটাতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল! বাবা নেই কিন্তু বাবার স্মৃতি পুজি করে তারা বেচে আছে। দিব্যি ভালোও আছে। কেউ যদি খারাপ থাকেন তাহলে সেটা হচ্ছে মা। সমুদ্র ভাবে আয়না না থাকলে মায়ের কি হত? মায়ের দেখা শুনা, তাকে সঙ্গ দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু তেই মাকে আয়না সাহায্য করে। । সেই আয়ুই নাকি আজ চলে যাবে! সমুদ্রের বুক ভার করে উঠে। সে আয়নাকে বলতে পারছেনা। আর কেন বলবে? আয়ু কি বুঝে না? না বুঝলে সমুদ্র ও কিছু বলবে না। হুহ। গেলে যাক বিদেশ! পড়ুক কতো পড়বে। পড়তে পড়তে বিদ্যাপুকুর হয়ে যাক। তার কি?

আয়না লাগেজ গুছাচ্ছে।সে বলে উঠে, শ্রাবণ আর আলিয়া কি আসবে দুপুরে?

— আলিয়ার না আসাই ভালো। ও অসুস্থ ।

আয়না বলে উঠে, প্রেগ্ন্যাসি অসুস্থতা না ডাক্তার সাহেব!

সমুদ্রের খুব করে মন চাচ্ছে আয়নাকে ধমকিয়ে বলতে তোমার কাছে জ্ঞান চাই না বিদ্যাপুকুর।তোমার জ্ঞান গুলো জাপানে রপ্তানি করো।

গতবছর ধুমধাম করে শ্রাবণ আলিয়ার বিয়ে হয়েছে। আর এই ইয়ারেই আলিয়া মা হতে যাচ্ছে! অথচ তাকে দেখো? বিয়ের তিন বছর হয়ে গেল! কিন্তু বউ যায় পিএইচডি করতে!

আয়নাকে রোদেলা ডেকে উঠে। আয়না চুলে খোপা করে চলে গেল। সমুদ্র তার দিকে তাকিয়ে থেকে খালি গা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

— ফুপু ডাকলেন?

রোদেলা বসেছিল তার রুমে। আয়নার মুখে ফুপু শুনে সে আহত হয়। বিয়ের তিন বছর হলো মেয়েটা এখনো তাকে ফুপু বলেই ডাকে।

রোদেলা বলল, মা এক কাপ চা দাও।

— আচ্ছা।

— কখন বের হবে তুমি?

— দেরি আছে মা। রাতে আটটায়।

— ওহ।

রোদেলা চায়ের অপেক্ষায় থাকল। মেয়েটাকে তার ছেলে খুব ভালোবাসে৷ বউ ছাড়া এক দিন ও থাকতে চায় না তার ছেলে। কিভাবে যে দুই বছর আয়নাকে ছাড়া থাকবে সমুদ্র সেটাই ভেবেই অস্থির সে।

রোদেলা বারান্দায় গেল। বারান্দায় আবেগের লাগানো এলোভেরা গাছটা হাত দিয়ে বুলিয়ে সে আকাশের পানে চেয়ে রইল। উদাসিনী চোখে। যেন এই আকাশের কাছে তার শত অভিযোগ! শত অভিমান!

যখন আমরা একা হয়ে যাই তখন এই বিশাল আকাশের বুকে অভিমান জমাই!

★★★

আলুভর্তা! এই আলুভর্তা! কই গেলা? দ্রুত আসো?

আলিয়া আস্তে আস্তে হেটে আসল। পাচ মাসের ভারী পেট তার। জোড়ে জোড়ে হাটা বারং৷ আলিয়া ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে শ্রাবণ টাই-সুট পড়ে একটা ছোট বেবিদের জামা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আলিয়াকে দেখেই বলে উঠে, অফিস যাচ্ছিলাম। জ্যামে আটকা পড়তেই একটা বেবিশপের এই জামার দিকে নজর গেল। সঙ্গে সঙ্গে কিনে নিলাম। এরপর ভাবলাম আজ অফিস করব না। বাসায় আসতেই মায়ের অভিযোগ তুমি নাকি নাস্তা করো? এমন করলে হবে? আমার জুনিয়র তো খিদায় কেউ কেউ করে কাদবে।

আলিয়া হেসে দিলো। শ্রাবণ তাকে বসিয়ে নিজ হাতে যত্ন করে তুলে খাওয়াচ্ছে।

— তোমার না মিটিং আছে?

— আব্বু সামলাবে।

— বাপের অফিসে চাকরি করার এটাই ফয়দা তাই না সাপ?

শ্রাবণ বলে উঠে, বাবু হওয়ার পরও তুমি আমাকে সাপ বলে ডাকবে?

— অবশ্যই ডাকব।

★★★

রঙ্গন মাত্র একটা ছবি আপলোড দিল। ঢাকা ভার্সিটির এলাকার সাদা বেড়া দেওয়া বাগানের সামনে এক ঝাক বাগান বিলাস ধরে আছে, সেখানে দাঁড়ানো তার ছবি। সে ক্যাপশনে লিখলো,
তোমার শহরের জোনাকিরা কি জানে?
আমার শহরের বাগান বিলাসেরা তোমার খোজে তপ্ত!

রঙ্গনের পরীক্ষা চলছে। কঠিন পরীক্ষা। পিউয়ের জন্য অপেক্ষা করার পরীক্ষা।তার ভালোবাসার পরীক্ষা চলছে।

পিউ চলে যাওয়ার দিন সে ইমিগ্রেশমনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পিউয়ের কাছে লাস্ট চান্স চেয়েছিল।

পিউ সেদিন বলে উঠে, A girl is like a butterfly! Beautiful to see but hard to catch!

মেয়েদেরকে কেবল ভালোবাসা দিয়ে বন্দী করা যায়। তোমার ভালোবাসার যদি জোর থাকে আমি ফিরব তোমার কাছে। কিন্তু এতো সহজে না। তোমার পরীক্ষা হবে। কঠিন পরীক্ষা। যেখানে তোমাকে পাশ করতে হবে৷

রঙ্গন গান ছাড়লো। বেশ জোড়েই গান বাজল।

বুক চিনচিন করছে হায়
মন তোমায় কাছে চায়।

‌তার চোখ ভিজে উঠতে থাকে। সে অনেক বড় ভুল করেছে। না বুঝেই রোদেলাকে দোষী ভাবত। তার ভুল ধারণা বাবা ভেঙে দিয়েছে। সে রোদেলা আন্টির কাছে পা ধরে ক্ষমাও চেয়েছে। মাঝে মাঝে রোদেলা আন্টির সঙ্গে তার কথা হয় ফোনে। দাওয়াত দিয়েছিল তিনি। সে যায়নি।

সেদিন পাশের বাসার এক সুন্দরী মেয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। সে সঙ্গে সঙ্গে মানা করতেই মেয়েটা বলে উঠে, Are you taken Rongon?

— No I am not taken but I am given!

রঙ্গনের মন বলে, এক দিন তার পরীক্ষা শেষ হবে। সেদিন পিউ এসে বলবে, তোমার এক্সাম শেষ রঙ্গন। এবং ফলাফল ও বেশ ভালো। ওয়েল ডান।

— এর মানে কি? তুমি ফিরবে আমার বুকে?

–হ্যা।

রঙ্গন আশায় আছে। আশায় আছে, প্রতীক্ষায় আছে একদিন পিউ ফিরবে।

আজকে একটা বিশেষ দিন। এই দিনটা কি পিউমনির মনে আছে? আজকে তাদের হলেও হলে পারত হ্যাপি এনিভারসিরি।

বৃষ্টি থেমে গেলেও কিন্তু গাছে গাছে ঝাকি মারলে বৃষ্টির ফোটা ঝড়ে পড়ে! এজন্য ও হয়তোবা আরো একবার রঙ্গন এলো!

★★★

সবার কাছ থেকে বিদাই নিয়ে আয়না এয়ারপোর্ট ঢুকে যায়। ঢোকার আগে সমুদ্রের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে, সকালে তিনটা এলাম দিয়ে রাখবে। ঢোল পেটালেও ও উঠোনা। এজন্য তিনটা এলাম সেট করবে। আর হ্যা গরুর মাংস কম খাবে৷ ওকে?

সমুদ্র চুপ থাকে। খুব করে আয়ুকে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে তার। কিন্তু এতো মানুষের সামনে তা ঠিক হবে না!

মাকে মামার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে সমুদ্র ফুটপাত ধরে হাটছে। তার অসহ্য লাগছে। শেষ বার সে আয়ুকে জড়িয়ে অব্দি ধরতে পারেনি। কিভাবে আয়না কে ছাড়া সে দুই বছর থাকবে! সেবার আয়না বাপের বাড়ি গেল। সমুদ্র দিনে থাকলেও রাতে আর পারলো না। রাত বারোটার দিকে আয়নার কাছে গিয়ে উপস্থিত! নানী কতো হাসলো তাকে নিয়ে। হি ডিডেন্ট ইভেন কেয়ার!

সমুদ্র ফুটপাতে বসে পড়ে৷ এই ফুটপাত হলো তার দুঃখের সঙ্গী। সমুদ্রের চোখে পানি। আচ্ছা আয়না যদি আর না আসে? তাদের ম্যারিড লাইফ যদি বাবা-মায়ের মতো হয়! আজীবন দূরে দূরেই থাকবে তারা? সমুদ্রের বুক হুহু করে উঠে।

রাত একটা বাজে এখন। আয়নার প্লেন ফাই করেছে কিছুক্ষন আগে মেবি!

সে বিকট জোরে আয়না বলে চিল্লিয়ে উঠে।

সমুদ্র নিজেই নিজের চুল এলোমেলো করতে লাগলো। আয়ু তার চুল এলোমেলো করতে পছন্দ করে।

পেছন থেকে কেউ বলে উঠে, কি? ডাকলে কেন?

সমুদ্র ভড়কে গেল। এটা তো,,,,,,,

সে পেছনে তাকাতেই অবাক। আয়না দাঁড়িয়ে আছে। জিন্স আর লাল শাট পড়া৷ একেবারে অন্য লুকে অন্য আয়না যেন!

সে মুখ হা করে দাঁড়িয়ে যায়। বিশ্বাস হচ্ছে না তার! সোডিয়াম আলোয় সে ভুল দেখছে নাতো? এই শহরের পথিকরা বারে বারে ভ্রম দেখে। সে কি ভ্রম দেখছে?

আয়না হাসি হাসি মুখে বলে, কি ডাক্তার সাহেব? আমাকে দেখে খুশি হলেন না বুঝি? আমি না থাকলে অন্য মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতে সুবিধা হত বুঝি?

সমুদ্র হাসল। বিশ্ব জয়ের হাসি তার মুখে।

— তুমি গেলে না?

— না৷

— কেন?

— আমি গেলে এই পাগল টাকে কে সামলাবে? উনি তো সকালে না উঠে অফিস না গিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাবে। তাকে ডেকে তুলার জন্য ফিরে এলাম বলে

আয়না ভিসাটা ছিড়ে ফেললো। সে সমুদ্র কে জড়িয়ে ধরে বলে,

জানো ভালোবাসা হলো মৌলিক মৌল! একে যতো ভাগই করবে কেবল ভালোবাসার টুকরা পাবে। কিন্তু যখনি এতে অভিমান যুক্ত হবে তখনই এটা যৌগিক মৌল হয়ে যাবে তখন একে ভাংলে কেবল ভালোবাসা না প্রতি অংশে অভিমান ও পাওয়া যাবে৷ এই অভিমান নষ্ট করার এন্টিলোড হলো আরো বেশি বেশি ভালোবাসা অপরজনকে। দেখি! সব অভিমান ঝেড়ে ফেলো তো!

সমুদ্র আয়নাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তার মনের সব অভিমান কে ফেলে দিল। এখন বুকে কেবল ভালোবাসা আর ভালোবাসা। প্রেমপ্রদীপ দাউদাউ করে জ্বলছে। উফ!

Why life is so peaceful!

The End.

[ আসসালামু আলাইকুম। সবাই সুস্থ থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। সবার জন্য অনেক দোয়া ও ভালোবাসা এবং অঢেল শুভকামনা সকলের জন্য। ভালোবাসা অবিরাম। আল্লাহ হাফেজ। ]