প্রেমমানিশা পর্ব-১২+১৩+১৪

0
228

#প্রেমমানিশা(১২)

বাড়ি নীরব, চারদিক সুনসান। শোনা যাচ্ছে না কোনো কাক পক্ষির ডাকও। ছুটির দিন হলেও সকলে তাদের কাজেই ব্যস্ত। মিস্টার আমান তার নতুন ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। শায়খ তার অফিসের কাজ নিয়ে বসেছে বহু আগেই। ছুটির দিন বলেই হয়তো তার ব্যস্ততা আরও বেশি। মিস্টার আশরাফ আর সানাহ্ লাইব্রেরী ঘরে বিভিন্ন বই নিয়ে চুল ছেড়া বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে মিসেস রাহেলা রান্নাঘরে রান্না করতে ব্যস্ত।

মিসেস রাহেলার হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে রহিমা আপা। রহিমা আপা সাহায্য করাতে মিসেস রাহেলার কাজ এগোলেও কাজের কোনো শেষ নেই তার। ছুটির দিনে তার কাজ যেন আরও এক ধাপ বেড়ে যায়। এই তো একটু আগেও সবগুলো ঘর রহিমা আপাকে নিয়ে ঝাড় দিয়ে এলেন। ফুলির মাকে ঘরের জানালা মোছার কাজে লাগিয়েছেন আর লিপির মাকে ঘরের ফার্নিচার মোছার কাজে লাগিয়েছেন। তবুও যেন অনেক কাজ এখনও বাকি।

আজ রাহেলার মন যেমন আনন্দে ভরপুর তেমনই আবার বিষণ্ণও। রাহেলার বিষণ্ণতার কারণ হলো তার শাশুড়ি। মানুষটা দুই বছর আগেও তাদের সঙ্গে ছিল। মানুষটা সঙ্গে থাকলে মনে হতো সময় কত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায় আর এখন মনে হচ্ছে জীবন যেন তার আপন জায়গাতেই থেমে আছে।

রাহেলার শাশুড়ি মা ছিলেন মিসেস আঞ্জুমান। মিসেস আঞ্জুমান যখন ছিলেন তখন রাহেলাকে ঘরের কাজকর্মে এতটা জড়িয়ে যেতে হতো না। দুই শাশুড়ি বৌমা মিলে হাতে হাতে কাজ করে ফেলতেন। আবার ঈদ উৎসবে দুজনে মিলে কিছু কাজের মানুষ সঙ্গে করে পুরো বাড়ি ধোয়া মোছার কাজ চালাতেন।
অবশ্য এখন আর এসব হয় না। এখন সব কাজ রাহেলাকেই করতে হয় তবে এসব কাজের মধ্যেও রাহেলা তার আনন্দ খুজে পান। কথায় আছে ‘ সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে। ‘

মা-বাবাহারা মেয়ে রাহেলাকে তার শাশুড়ি আঞ্জুমান বেশ ভালই আগলে রেখেছিলেন। তাদের সংসার চলছিল বেশ অনাড়ম্বরে কিন্তু দুঃখের কালো ছায়া তখনও তাদের পিছু ছাড়েনি তাই হয়তো দুই বছর আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়েই মারা গেলেন মিসেস আঞ্জুমান।

মা বাবার পর শাশুড়িকে হারিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন রাহেলা তবে সেই সময় তাকে আগলে নেন মিস্টার আমান। নিজে মা বাবাহারা হয়েও অনাথ স্ত্রীকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখেন। এটাই হয়তো একজন স্ত্রী হিসেবে রাহেলার পরম পাওয়া।

ভাসুর, দেবর, স্বামী আর সন্তানহীন জীবন এখন রাহেলার বেশ ভালই কাটছে। বলা চলে অনাড়ম্বরে কাটছে। শাশুড়িকে হারানোর দুঃখও কাটিয়ে উঠেছে রাহেলা। তবে মাঝে মাঝে তার কথা হুট করে মনে পড়ে যায়। আর যখন মনে পড়ে তখন বাঁধনহারা চোখের নোনাজল যেন বেড়িয়ে পড়ে নিজ গন্তব্যে।

‘ এই কোথায় আপনারা ? যে যা করছেন সব ছেড়ে ছুড়ে এখন খেতে আসুন…… দেরী করলে আমি সব ফ্রিজে রেখে ফ্রিজ লক করে দিবো ‘ মিসেস রাহেলা খাওয়ার টেবিল সাজাতে সাজাতে বললেন।

খানিকক্ষণ বাদে সকলে একে একে নিজেদের জায়গায় এসে বসলো। রাহেলা নিজ হাতে সকলের পাতে খাবার দিয়ে নিজেও খেতে বসলো। আজ দুপুরের খাবার ভুনা খিচুড়ি আর আলু মুরগির তরকারি, সানার এই তরকারি বেশ পছন্দ।

সানাহ্ বাঙালি খাবারদাবার খুব কম খায় কেননা ছোটো থেকেই খানিকটা বিদেশি কায়দায় বড় হয়েছে সে। সানার মা আমরিন সানাহ্কে বিভিন্ন ধরনের বিদেশি কায়দায় তৈরি হওয়া খাবার খাইয়ে অভ্যাস করেছিলেন। কিন্তু রক্ত আসলে কথা বলে। তাই হয়তো সানার বাবা আফজাল সাহেবের খিচুড়ি পছন্দ করার অভ্যাস সানাহ্ও পেয়েছে।

‘ কিরে সানাহ্ খিচুড়ি কেমন হয়েছে বললি না ? ‘ মিসেস রাহেলা অবাক হয়ে বললেন।

‘ ভালো হয়েছে মামী…… ঠিক আগের মতো ‘ সানাহ্ আলতো হেসে বললো।

সানার কন্ঠে থাকা মলিনতা সকলের কাছেই ধরা পড়লো । কেউ আর কিছু বলে সানার মনের বিষণ্ণতা বাড়ানোর চেষ্টা করল না। অতঃপর সকলেই খাওয়ায় মন দিল। তবে ভাগ্নির এহেন বিষণ্ণতা মিসেস রাহেলাকে ক্রমশ চিন্তিত করে তুলছে। সানাহ্কে এমন বিষণ্ণ আগে কখনও দেখেননি তিনি। হ্যাঁ, সানাহ্ আগেও হুটহাট এরকম কাউকে কিছু না বলে মামার বাড়ি এসেছে ঠিকই কিন্তু কোনোদিন এরকম মনমরা হয়নি। সানার আজকের বিষণ্ণতা যেন জগতের সকল বিষণ্ণতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।

মিসেস রাহেলার একবার মনে হলো কায়নাতকে ফোন করে সবটা জানা দরকার। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো মেয়েটা একটু শান্তিতে সময় কাটাবে বলে এসেছে। এখন সেই শান্তির মাঝে ব্যাঘাত অন্তত রাহেলার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যা করার সানার মামারাই করবে। তাই কায়নাতকে ফোন করে সানার রাজশাহীতে থাকার ব্যপারটা জানানোর চিন্তা মিসেস রাহেলা তার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন।

পৃথিবী যেমন সৌরজগতের আপন কক্ষে ঘুরে ঘুরে জায়গা বদল করে, জীবনও তেমনই ঘুরে ঘুরে একেক সময় একেক রূপ নেয়। জীবনের এই গতি হঠাৎ কঠিন নিয়মের শিকলে বাঁধা পড়া মানুষকেও বদলে দেয়। সানাহ্ সবসময় কঠিন নিয়মের বেড়াজালে জড়িয়ে থাকলেও কখনও কখনও সেও নিয়মের জাল ভেঙে বেরিয়ে আসে। উড়ে যায় মুক্ত পাখির মতো। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রকৃতির নিয়মে।

সানার চিরায়ত স্বভাব বলে বিপদে পড়ে এরকম পালিয়ে যাওয়ার মানুষ সানাহ্ নয়। তবুও সানাহ্ তার স্বভাব বদলে কখনও কখনও বিপদে শক্ত থাকার পরিবর্তে নরম কাচের চুরির মতো হালকা চাপে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। পালিয়ে যায় কাপুরুষের মতো….কখনও কাছের মানুষদের কাছে কিংবা কখনও দূর দূরান্তে এক রাশ অচেনা মানুষদের মাঝে।

দিন গড়িয়ে আঁধার নেমে এসেছে ধরণীতে। চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন। রাতের আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সম্পূর্ণ অন্ধকারের মাঝ দিয়ে শোনা যাচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক সেই সঙ্গে দূরে কোথাও বেজে চলেছে এই রাত তোমার আমার। রাতের আকাশে চাঁদও দেখা দিয়েছে খানিকটা ছোট হয়ে, আভাস দিচ্ছে সামনেই পূর্ণিমার রাতের।

দিন পেরিয়ে আঁধার নেমে এলেও ফারহান আর মিস্টার কবিরের অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘটেনি,তাদের অনুসন্ধান এখনও চলমান। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সানাহ্কে খোঁজা হয়নি । পুরো ঢাকা শহরের ওলি গলি সব খোঁজা হয়েছে। সানাহ্দের ঢাকা শহরে যত আত্মীয় স্বজন আছে সবার বাসায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। তবে সকলেই বিরস মুখে নেতিবাচক উত্তর জানিয়েছেন। দুই দিন পরপর সানাহ্কে নিয়ে খোঁজাখুঁজিতে আত্মীয় স্বজনেরাও বেশ বিরক্ত।

অবশেষে সারা শহরে খোঁজা শেষেও যখন সানাহ্কে কোথাও পাওয়া যায়নি তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই প্রকৃতির নিয়মে বাড়ি ফিরে এসেছেন মিস্টার কবির আর ফারহান। দুজনেই বড় ক্লান্ত সারাদিনের ব্যস্ততায়। এইদিকে মিসেস কায়নাত নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছেন, আশপাশে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তবে ফলাফল শুন্য।

এর মধ্যে বাড়িতে আরেক প্রস্থ চিরুনি তল্লাশি হয়েছে যার ফলে সানার ঘরে একটা চিঠির খাম পাওয়া গেছে যার উপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘ মিস্টার ফারহান ছাড়া কারোর জন্য পড়া স্ট্রিকটলি প্রোহাইবিটেড ‘। এই লেখা দেখে আর কেউ খামের ভিতরে কি আছে পড়ে দেখার সাহস করেনি। তবে সকলে এটা বুঝে গেছে খামে নিশ্চই ফারহানের জন্য চিঠি আছে যেটা আর সবার জন্য পড়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

বাড়ি এসে যখন ফারহান আর মিস্টার কবির সোফায় বসে জিরিয়ে নিতে ব্যস্ত তখন অতসী এলো দুই গ্লাস শরবত নিয়ে। শরবত দুটো ফারহান আর মিস্টার কবিরের কাছে দিয়ে সে অন্তর্ধান। খানিক বাদে অতসী ফিরে এলো হাতে একটা খাম নিয়ে। বাদামী রঙের কাগজী খাম……

অতসী খামটা এনেই ফারহানের দিকে বাড়িয়ে দিল। ফারহান সোফার গাঁয়ে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিল কিন্তু অতসীকে দেখেই উঠে বসলো। অতসীর বাড়িয়ে দেওয়া খামটা হাতে নিল।ফারহানের দৃষ্টি হাতে থাকা খামের উপর। অতসী ফারহানের এহেন দৃষ্টি লক্ষ্য করে বললো ‘ আপাই আপনার জন্য চিঠি রেখে গেছে ‘।

চিঠি দেখে যে ফারহান বড়ই অবাক হয়েছে সেটা তার চোখ মুখের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ফারহান তার অবাক ভাব কিছুক্ষণের মধ্যেই কাটিয়ে উঠে ধীরস্থির হাতে খাম খুলে চিঠি জোড়া বের করল। খামে একটা নয় দুটো চিঠি, জোড়া চিঠি। সানাহ্ ফারহানকে কি এমন লিখেছে যে দুটো পাতা ভরে গেছে। কৌতূহল মেটাতে ফারহান চিঠি খুললো….

শ্রদ্ধাস্পদেষু কবি সাহেব,
অবাক হচ্ছেন ? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনি কি জানেন আপনারা যেদিন আমাদের বাড়ি আপনার আর আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এলেন সেদিন আপনি আমাকে যেই প্রশ্ন করেছিলেন তার উত্তর আমার জানা ছিলো ? জানার কথা নয় কারণ আমি আপনাকে বলিনি। আমার ব্যাপারে এমন অনেক কিছুই আছে যা আপনি জানেন না আর হয়তো জানবেনও না। আপনি আমাকে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে যতটা অজ্ঞ মনে করেন ততটা আমি নই। হয়তো আপনার থেকে কম জানি কিন্তু জানি……যতটা জানলে একজন সাধারণ মানুষ হওয়া যায়।

একটা কথা বলবো ? অনুমতি দেওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই বলছি। আপনার কাছে আমাকে বিয়ে করার যেমন অনেক কারণ আছে তেমনই আমার কাছেও আপনাকে বিয়ে না করার অনেক কারণ আছে। এখন ভাবছেন তো আগে কেন রাজি হয়েছিলাম ? তার পিছনেও কারণ আছে। কারণটা হলো যে আমি…না থাক বলতে ইচ্ছা করছে না। এখন হঠাৎ বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণটা বলি ? না এটা আপনার অজানা থাকবেনা কারণ এটা আমি আপনাকে বলবই।

আপনি কি জানেন পুরো দুনিয়া এমনকি আপনিও যাদের আমার মা বাবা হিসেবে জানেন তারা আমার বাবা মা নন ? জানার কথা নয়, আশা আন্টিও জানেন না। আমার বাবা মা হলেন স্বর্গীয় আফজাল করিম এবং আয়াত আমরিন । মানে আমার বর্তমান বাবার পরলোকগত ভাই এবং ভাবী। আমার বর্তমান মা বাবা একইসাথে আমার চাচা-চাচী ও খালা-খালু। অবশ্য আমার মামণি (আয়াত আমরিন) থাকতে মাকে আমি মিমি বলে ডাকতাম আর বাবাকে ছোট বাবা। আশা আন্টির যদি মাঝে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হতো তাহলে আন্টি জানতে পারতেন যে আমি মায়ের নিজের সন্তান নই,বোনের সন্তান। এটা হলো প্রথম কারণ আপনাকে বিয়ে না করার।

ও এখানে একটা উপমা ভুল হতে পারে। স্বর্গীয় কথাটা কি মুসলিমদের ক্ষেত্রে খাটে ? জানা নেই আমার……এমনকি উপমা কথাটাও সঠিক কিনা আমার জানা নেই। উহ গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে সব। আসলে জ্বরের ঘোরে লিখছি তো তাই। লিখতে পারছিনা তবুও লিখতে হচ্ছে।

বাবা কি আপনাকে আমার অসুস্থতার কথা বলেছে ? বলতেও পারে আবার নাও বলতে পারে। অবশ্য আমার অনুমান ক্ষমতা বলছে বাবা হয়তো নিজেকে দোষ দিচ্ছে নয়তো মাকে। যার বহিঃপ্রকাশ হয়তো খুব তাড়াতাড়ি ঘটবে।দেখলেন কি লিখতে কি লিখছি..… যতসব আননেসেসারি কথাবার্তা।

আমি হঠাৎ হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। এই অসুস্থতা যেই সেই অসুস্থতা নয়, মারাত্মক অসুস্থতা এই সময় মা বাবা না পারতে আমাকে ঘরবন্দী করে রাখে পাছে আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাই। এই সময় আমার খুব জ্বর উঠে, চোখ লাল হয়ে বিভৎস আকার ধারণ করে। কপালের রগ ফুলে উঠে আর অন্ধকার আরও প্রিয় হয়ে উঠে। এই জ্বর আমার যত বাড়ে, পাগলামিও আমার তত বাড়ে। অবশ্য এসব মায়ের কাছ থেকে শোনা। আমি যে অসুস্থ আমি যদি সেটা বুঝতেই পারতাম তাহলে আমার অর্ধেক রোগ আগেই সেরে যেত। এটা হলো আমার আপনাকে বিয়ে না করার দ্বিতীয় কারণ।

আমার ভয়ংকর অতীত আর অসুস্থতার কথা জানার পর কোনো ছেলেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে,তাই আপনি আমাকে রিজেক্ট করবেন আর সানাহ্ রিজেক্ট হওয়া পছন্দ করে না তাই আমিই আপনাকে রিজেক্ট করলাম। একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছেন ? লক্ষ্য না করলে আমিই বলে দেই, প্রথমে আপনি আমাকে রিজেক্ট করলেন আর এখন আমি আপনাকে। মামলা শোধ বোধ হয় গেছে। ওহ্ হ্যাঁ এটা কিন্তু আপনাকে বিয়ে না করার তৃতীয় কারণ।

মা আমার অতীত আর অসুস্থতা লুকিয়ে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এটা মায়ের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হলেও ঘটনার ভয়াবহতা তাকে বুঝাতে পারিনি।কিন্তু আমি আপনাকে ঠকিয়ে বিয়ে করতে চাইনা আর এটাই আমার আপনাকে বিয়ে না করার শেষ কারণ।

আজ আপনাকে আমার মামনি বাবাইকে নিয়ে দুটো মজার কথা বলবো । আমার যখন জ্বর উঠে তখন আমি বারান্দায় বসে থাকি। বিশ তারিখ রাতে আমার যখন জ্বর উঠেছিল সেদিনও বসেছিলাম। সেদিন বাবাই এসেছিল। আমার জ্বর হলে প্রায়ই বাবাই আর মামণি আসে অথচ আমি সুস্থ থাকলে আসেনা। সেদিনও বাবাই এসেছিল আর আশ্চর্যজনকভাবে এর আগের বারও বাবাইই এসেছিল। বাবাই এসে আমার কানে কানে তার প্রিয় গানটা গেয়েছিল,

এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের

এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে
এই রাত তোমার আমার….

আরও আছে তবে পুরোটা লিখলাম না। গানটা ইন্টারনেটে সার্চ করে শুনে নিবেন। আশা করি আপনি নিরাশ হবেন না। এবার আমার মামণিরটা বলি। মামনি যখনই আসতো তখনই একটা ছড়া কাটত। ছড়াটা আমার বেশ পছন্দ। অবশ্য এটা ছড়া না ছন্দ আমার জানা নেই। আপনাকে বলছি, আপনি বুঝে নিবেন। মামণি এই ছড়া তার বেচেঁ থাকাকালীনও শোনাত।

‘ মায়ের পরে স্থান যার
সে যে আমার দুটো মায়ের সমান,
তার ঋণের বোঝায় ক্লান্ত আমি
সে যে মায়েদেরই হৃদয় সমান।। ‘

এই ছড়া মামণি কাকে উদ্দেশ্য করে বলতো সেটা আগে জানা ছিলনা তবে এখন জানি। কিন্তু আমি আপনাকে বলবো না। পারলে নিজে বের করে নিন।

দেখেছেন চিঠি লিখতে লিখতে কত কি লিখে ফেলেছি। আমার এটাই প্রথম চিঠি। এর আগে কখনও কাউকে চিঠি লিখিনি। চিঠি লেখা নেশার মত। একবার শুরু হলে বন্ধ হতে চায়না, অনবরত চলতে থাকে কলমের কালি। এটাই কিন্তু আপনার কাছে আমার শেষ চিঠি নয়। মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করলে হুট করে আপনাকে চিঠি লিখে চমকে দিবো তবে আপনার থেকে চিঠির উত্তর আমি প্রত্যাশা করি না।

এভাবেই চিঠি লিখতে লিখতে বছর ঘুরবে। আপনি বিয়ে করে ঘরে আমার থেকেও সুন্দরী বউ আনবেন। আপনাদের ঘর আলো করে সন্তান হবে। ঘরে ঢুকলেই বাচ্চার দুধের গন্ধ পাওয়া যায় এমন অবস্থা। এর মাঝেও আমার চিঠি লেখা চলবে।

তারপর আবার বছর ঘুরবে। আপনার বয়স হবে। আমি তখনও চিঠি লিখবো। এই চিঠি লিখা চলবে অনন্তকাল,আমার মৃত্যুর আগ অব্দি। যেদিন চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন বুঝবেন আমি আর নেই।
পূর্বের কথায় আবার ফিরি। একদিন আপনার বিবি ঘর গোছাতে গিয়ে আমার আপনাকে লেখা চিঠিগুলো পাবে। আপনাকে জিজ্ঞেস করবে কে এই সানাহ্। তখন আপনি বলবেন আমার প্রাক্তন প্রেমিকা যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল কিন্তু বিয়ে হয়নি।

আমাকে কিন্তু প্রাক্তন প্রেমিকা বলেই পরিচয় দিবেন। কেন? বলবো ? আমার সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাই বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি আপনার প্রেমিকা।বিয়ে যেহেতু আমাদের হবে না তাই আমি আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা। প্রেমিকা না হলাম প্রাক্তন প্রেমিকাই সই। কারোর প্রাক্তন প্রেমিকা হতে হলেও যোগ্যতা লাগে।

পুনশ্চ: হুট করে আবার চিঠি লিখে চমকে দিবো।

ইতি,
সানাহ্

~ চলবে ইনশাআল্লাহ….

#প্রেমমানিশা(১৩)

সানার লেখা চিঠি পড়ে ফারহানের দৃষ্টি চিঠির উপরেই স্থির হয়ে গেছে। চিঠির লেখাগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। জানান দিচ্ছে চোখের কোণে জমে থাকা নোনাজলের অস্তিত্ব। চিঠির প্রত্যেকটা শব্দ তার হৃদয়ে ঝড় তুলছে। চিঠি পড়ে সানাহ্কে হারানোর ভয় যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ফারহান তো চায়নি সানাহ্কে তার প্রাক্তন প্রেমিকা করতে। চেয়েছিল চিরদিনের জন্য প্রেমিকা করতে……

এতদিন তো রাজি ছিল না কিন্তু এখন তো রাজি । তাহলে বাঁধা কোথায় ? সানার পিতৃ পরিচয় আর তার অসুস্থতাই কি তার সবচেয়ে বড় বাঁধা ? তাহলে উচ্ছন্নে যাক এই বাঁধা। এসব বিধি নিষেধের ধার ধারে না ফারহান। সে চলে আপন মর্জিতে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তার এই আধ পাগল প্রেমিকাকে সে খুঁজে বের করবেই এট এনি কস্ট। হারাতে দিবে না সে সানাহ্কে।
কিন্তু কোথায় খুঁজবে ? সানাহ্ কি চিঠিতে কোনো হদিস দিয়েছে সে কোথায় ? প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ফারহান চিঠির লেখায় আরেকবার চোখ বুলালো কিন্তু হতাশ হলো। নাহ সানাহ্ কিছুই উল্লেখ করেনি।

ফারহানের মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে কোথায় সানাহ্।
হঠাৎ কি মনে পড়তে ফারহান চিঠিটা আরেক নজর দেখল। চিঠিটা দেখেই ‘ ওহ শিট ‘ বলে লাফিয়ে উঠলো। সকলে ফারহানকে এভাবে রিয়েক্ট করতে দেখে চমকে ওর দিকে ফিরল। ফারহান কিছুক্ষণ কপালে হাত রেখে কিছু একটা ভেবে তারপর মিসেস কায়নাতের উদ্দেশ্যে বললো ‘ আন্টি আপনার ভাইদের বাড়ি কোন বিভাগে যেন ? ‘

‘ বরিশাল ‘ কথাটা বলে যেন কায়নাতও চমকে উঠলো। অবাক দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান এবার সবার উদ্দেশ্যে বললো ‘ সবাই রেডি হয়ে নিন…… আমরা আজ রাতেই বরিশাল যাচ্ছি। সানাহ্ ইজ এট হার আঙ্কেলস হাউজ। কারোর সানার মামাদের ফোন করে বলার দরকার নেই যে আমরা বরিশাল যাচ্ছি। সানাহ্ সন্দেহ করলে আবার পালাবে…. ‘

—-

‘ মামা আসবো ? ‘ বলেই সানাহ্ দুবার নক করলো শায়খের দরজার গায়ে।

তবে নক করার পরও যখন কোনো সাড়া শব্দ পেলনা তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই দরজা খুলে ভিতরে উকি দিল। দেখল শায়খ তার চিরাচরিত রুপেই কানে ইয়ারফোন দিয়ে ল্যাপটপে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। সানাহ্ গুটি গুটি পায়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে শায়খের পিছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বোঝার চেষ্টা করলো শায়খ কার সঙ্গে কথা বলছে। শায়খ তার কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে বুঝতে পেরে বিরক্তিতে সানার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।

ল্যাপটপে ইহসানের সঙ্গে কথা বললেও ঘরে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ফিরল শায়খ। ভাগ্নিকে দেখে ইহসানকে বললো ‘ ব্রো আই উইল টক উইথ ইউ লেটার ‘ । কথাটা বলেই কল কেটে দিয়ে ঘুরে বসে বললো ‘ কথা বলতে এসেও কথা না বলে ফিরে যাচ্ছিস কেন ? ‘

শায়খ তাকে লক্ষ্য করেছে বুঝতে পেরে নিজের বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে শায়খের মুখোমুখি সানাহ্ তার বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বললো ‘ তো কি করবো ? তোমার ঐ দূর সম্পর্কের ভাইয়ের সঙ্গে মেকি হাসি হেসে মধুর আলাপ করবো ? ‘

‘ আহা মধুর আলাপ করতে কখন বললাম ? তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন ? আত্মীয় স্বজনদের দুই চোখের বিষ ভাবা স্বভাব তোর বদলায়নি না ? ‘ শায়খ বললো।

‘ স্বভাব তো আর টিসু পেপার নয় যে ইউজ করে ফেলে দিবো। ওটা আমার স্বভাব, অভ্যাস নয় যে বদলে ফেলবো। ‘ নিরস মুখে একগুঁয়ে ভাবে উত্তর দিল সানাহ্।

‘ ভ্রূ সোজা কর তোর আর তোর চেহারার ভঙ্গি ঠিক কর। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আমার সামনে থাকবি না। আমার গা জ্বলে….আমি বুঝি না আমাদের আত্মীয় স্বজনের উপর তোর কিসের রাগ ? ‘ শায়খ রাগী গলায় বললো।

‘ তাদের উপর আমার মোটেই রাগ নেই। ফ্যাক্ট হলো এরকম গা জ্বালানো আলগা ভাব দেখানো লোক আমার পছন্দ না। এরা শুধু উপর দিয়েই ফিটফাট,ভিতর দিয়ে সদরঘাট। তোমার সঙ্গে আজ খাতির করছে। কাল তুমি বিপদে পড়লে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও একবার ভাববে না। এরা নামকা ওয়াস্তে আত্মীয়। আসল কথা তাদের সঙ্গে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্কই নেই। এই লোকটা তোমার বড় মামার ছোটো ছেলে ইহসান না ? এই খবিস ব্যাটা না তোমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনি ? তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলো কেন ? ‘

‘ মাম্মি মারা যাওয়ার আগে বলেছিল তার ভাই বোনদের সঙ্গে আর তাদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে যেন অন্তত সংযোগ রাখি,তাদের ভুলে যেন না যাই। সেই জন্যই…তাছাড়া সম্পর্ক থাকলে এমন হবেই। ‘ শায়খ বললো।

‘ আমার মনে হচ্ছে লোকটার কোনো ধান্ধা আছে। তুমি ওর থেকে দূরে থাকো। বলা যায়না এত মধুর আলাপের পিছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। ‘

‘ আচ্ছা বাবা আমি ওদের থেকে দূরেই থাকবো। এখন তুই এত রাতে আমার ঘরে কেন এসেছিস সেটা বল ? তুই তো সহজে আসার মেয়ে নস। অনেক দিন পর আমার ঘরে তোর পায়ের ধুলো পড়লো। ‘ শায়খ হাসিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বললো।

‘ ঘরে শুয়েছিলাম কিন্তু ঘুম আসছিলো না তাই ভাবলাম তোমার ঘরে এসে তোমাকে বলে দুজনে মিলে ড্রয়িং রুমে একটা জোস মুভি দেখি। এই জন্যই এসেছিলাম.…কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি তোমার সো কল্ড ভাইয়ের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। ‘ সানাহ্ একগুঁয়ে ভাবে উত্তর দিলো।

‘ আরে না এখন আর কি কথা বলবো। এমনিতেও তুই না আসলেও আমি দশ মিনিটের মধ্যে ল্যাপটপ রেখে দিতাম। এখন যখন এসেই পড়েছিস চল একটা মুভি দেখি। বলা যায়না তুই আবার কখন হুট করে বেরিয়ে যাস….সুযোগের সৎ ব্যবহার করা ভালো। কী মুভি দেখবি ? Bhool bhulaiya চলবে না ? রাতের বেলা দেখতে ভালো লাগবে..… ‘ শায়খ বলতে বলতে উঠে দাড়ালো।

‘ হুম..… ‘ কথাটা বলেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সানাহ্। মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললো ‘ তুমি তাহলে bhool bhulaiya ছাড়ো……আমি আসছি ‘ ।

শায়খ সানার কথায় কোনো উচ্চবাচ্য না করেই সরাসরি নিচে চলে গেলো। এইদিকে শায়খ ঘর ছেড়ে বের হতেই সানাহ্ ওর ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা খাম বের করে সেটা শায়খের ল্যাপটপের নিচে রেখে দিল। তারপর ঘরের দরজা চাপিয়ে সেও নিচের দিকে হাঁটা দিলো।

—-

পূর্বে সূর্য উঠেছে কিছুক্ষণ আগেই। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইদানিং মিস্টার আশরাফের বাড়ির বাগানে নতুন এক পাখির উদ্ভব হয়েছে। পাখির গায়ের রঙ উড়তে সময় নীল দেখালেও কোথাও বসলে সেটা বাদামি রঙ হয়ে যায়। মিস্টার আশরাফ এই ধরনের পাখি আগে দেখেননি।

প্রথম দিন যেদিন এই পাখির আনাগোনা দেখেছিলেন তখন অজান্তেই অবাক হয়েছিলেন। উনার যাবতজীবনে এরকম পাখি আগে দেখেননি কিংবা দেখলেও খেয়াল নেই। পরে নেটে সার্চ দিয়ে জানলেন ওটা বাজরিগার পাখিরই একটা জাত,শুধু গায়ের রংটাই ভিন্ন এই যা। তবে অন্য বাজরিগার পাখির থেকে উনার কাছে এই নীল বাদামি রঙা বাজরিগার পাখিই বেশি ভালো লেগেছে।

একবার মনে হয়েছিল দু তিনটে পাখি ধরে নিয়ে সুন্দর গোল্ডেন কেজে রেখে ভাগ্নি অতসীকে দিবেন, তার পাখি অনেক পছন্দ। পরে কি মনে হতেই সেই চিন্তা বাদ দিলেন। শুধু শুধু ওই বাড়িতে পাখি দিয়ে নিজের বিপদ বাড়িয়ে কি লাভ ? সানাহ্ যদি জানতে পারে যে এই পাখি উনি দিয়েছেন তাহলে উনাকে উদ্ধার করে ফেলবেন। অজানা এক কারণে মেয়েটার কোনো প্রাণীর সঙ্গেই সখ্যতা নেই। এমনকি নিজের কাছের মানুষদের সঙ্গেও না। এত বছরের জীবনে এখনও একটা ফ্রেন্ড জুটেনি।

তাছাড়া বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। তাই উনি চাইলেই পাখিকে তার মুক্তি দশা থেকে বন্দী জীবনে আবদ্ধ করতে পারেন না। সেটা হবে পাখি জাতির প্রতি অন্যায়। উনার ছোট ভাগ্নি অতসী হলো একদমই তার মত, পশু-পাখি প্রেমিক। পক্ষান্তরে সানাহ্ প্রকৃতি প্রেমিক, যে শুধু জানে নীরবে নিভৃতে প্রকৃতি উপভোগ করতে। সানাহ্ একদমই তার মায়ের মত। আমরিনেরও প্রকৃতি পছন্দ ছিলো। মা মেয়ে দুটোই প্রকৃতি বিলাসিনী।

নীল বাদামি রঙ্গা বাজরিগার পাখি দেখতে রোজ বাগানে আসাটাই মিস্টার আশরাফের এখন নিত্য দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাখিগুলোও অদ্ভুত ভাবে এখন আর ওনাকে দেখে দৌড়ে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোয় না। স্বানন্দে গুটুর গুটুর করে একে অপরের মাঝে প্রেম নিবেদন করে, একে অপরকে খাইয়ে দেয়। এদের দেখে মিস্টার আশরাফের মাঝে মাঝে আফসোস হয় কেন এত জীবন একটা মেয়ের জন্য আবেগ পুষে রেখে বিয়ে করলেন না। বিয়ে করলে হয়তো আজ তার পাশেও তার প্রিয়তমা থাকতো, যে রোজ সকালে তার সঙ্গে দাড়িয়ে এমন বাজরিগার পাখি দেখতো।

মিস্টার আশরাফ পাখিই দেখছিলেন পরে কি মনে হতে উপরের দিকে তাকালেন। উপরে এক নজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। ছাদে উনার মেঝ ভাই আর তার স্ত্রী দাড়িয়ে আছে যে এক সময় তার অঘোষিত প্রেমিকা ছিল। মিস্টার আশরাফ কখনও ভাবেননি এভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দিনের পর দিন দেখতে হবে। তবে সেসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর কষ্ট লাগে না। আর কতই বা কষ্ট সহ্য করবে এই মন ? পঁচিশটা বছর তো হলো….

—-

এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো শায়খের। ঘুমঘুম চোখে একবার এলার্মের দিকে তাকালো। ঘড়িতে এখন ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ। তার অফিস সাড়ে আটটায়, এখনই উঠে ফ্রেশ হতে হবে। শায়খ আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। কাল রাতে মুভি দেখে এসে শুতে শুতে রাত তিনটে বেজে ছিলো। মুভি দেখার পরেও দুই মামা ভাগ্নিতে মিলে গল্প করেছিল বলেই এত দেরি। সানাহ্কে এতদিন পর দেখে শায়খ সামলাতে পারেনি। এতদিন ধরে জমানো সব গল্প উগড়ে দিয়েছে । কথার শোনার ক্ষেত্রে সানাহ্ মনযোগী শ্রোতা, কথার মাঝে কথা বলে বক্তাকে বিরক্ত করে না।

শায়খ বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরদোর যথা সম্ভব গুছিয়ে বাথরুমে ছুটলো গোসলের জন্য। গোসল সেরে রেডি হয়ে অফিসের ব্যাগ গুছানোর পাঁয়তারা করলো। ফাইলগুলো ব্যাগে নিয়ে ল্যাপটপটা যখন ঢোকাতে যাবে তখনই চোখে পড়লো ল্যাপটপের নিচের সাদা খামটা। ল্যাপটপ ব্যাগে রেখে অবাক হয়ে সাদা খামটা হাতে নিল। খাম হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে আলতো হাতে খাম খুলে সাদা কাগজ বের করলো। সাদা কাগজ খুলতেই তাতে ফুটে উঠলো আনাড়ি হাতে লেখা বাংলা চিঠি।

চিঠির লেখা দেখে শায়খের বুঝতে কষ্ট হলো না ওটা সানার লেখা। এমন বাজে আর বিচ্ছিরি বাংলা লেখা একমাত্র সানার পক্ষেই লেখা সম্ভব। কিন্তু সানাহ্ চিঠি লিখেছে ? কী এমন দরকার পড়লো যে মুখে না বলে চিঠি লিখলো ? কৌতূহল দমাতে চিঠি পড়তে শুরু করলো….

প্রিয় মামা,

আমার মামণির জীবনে সব থেকে বড় পাওয়া যে তুমি সেটা কি তোমার জানা আছে ? জানা থাকার কথা কারণ মামনি সবকিছুতে সবসময় তোমার নাম আগে নিত। ঈদের জামা কেনা থেকে শুরু করে উইন্টার কালেকশন, সামার কালেকশনে জামা থেকে শুরু করে বুরুশ অব্দি সবকিছুই তুমিময় ছিল। তারপর আমার নাম আসতো। এই নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার কত বাকবিতণ্ডা চলতো তাইনা ?

তোমাকে আমি কোনদিনও সহ্য করতে পারতাম না কারণ আমার সবকিছুতে তুমি অজান্তেই ভাগ বসাতে। আমার পছন্দের খাবার পর্যন্ত মামনি তোমাকে আগে দিত তারপর আমাকে। এ নিয়ে মামণির সঙ্গেও কম ঝগড়া হয়নি আমার। তবে এতকিছুর পরও তুমি আমায় খুব ভালোবাসতে। আমায় আগলে রাখতে। কেন তোমার পিঠাপিঠি বলে ? নাহ প্রথম ভাগ্নি বলে….মানুষের প্রথম সবকিছুর প্রতি একটা আলাদা ধরনের মায়া থাকে।

আমার মামণির কাছে তার প্রথম সন্তান তুমি আর দ্বিতীয় সন্তান আমি। আচ্ছা ভাই বোনদের মধ্যে এজ ডিফারেন্ট যত বেশি থাকে ভালোবাসাও কি ততই বেশি থাকে ? আমার জানা নেই কারণ অতসী আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট। আমাদের মধ্যে ভালোবাসার প্রকাশটা বরাবরই কম কারণ না সে আমাকে কখনও মন খুলে কিছু বলেছে আর না আমি কখনও তার সঙ্গে কিছু শেয়ার করেছি। কারণটা হয়তো আমিই ইনিশিয়েটিভ নেইনি বলেই।

মামণির পর আমার সব থেকে কাছের মানুষ বলতে তুমিই আছো। নাহ মাও আমার খুব কাছের কিন্তু সে মা হিসেবে আমার বন্ধু কম গার্ডিয়ান বেশি। তুমি আমার কাছের মানুষ বলেই বলছি। কথাটা তেতো হলেও আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি সবসময়ের জন্য, আর কখনও ফিরবো না সেখানে। কারণ কি ভাবছো ?

কারণ কিছুই না তবে অনেক কিছু। তুমি কি জানো এত বছরে মা বাবা অজান্তেই বারবার আমাকে বুঝিয়েছে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আমার কেউ নেই ? ওদের এক্সট্রা কেয়ার আমায় বিরক্ত করে। কথায় কথায় মায়ের প্রশ্নভাব আমাকে ফুঁসে তুলে। বাবার আমাকে নিয়ে সারাদিন ভয়ে থাকাটা আমায় বিষণ্ণ করে তুলে। আর…. এখন ফারহানের রিজেকশনও আমায় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তার এক্সেপশনও আমায় নিজেকে নিজের কাছে দয়ার পাত্রী করে তুলে। তুমি জানো আমি ভীষন রকমের ইমোশনাল ইন্ট্রোভার্ট জেদী… যেই জেদ প্রকাশ পায়না কিন্তু সহজে নেমেও যায়না।

আমার জেদ, আমার ইগো আমায় বলে দিয়েছে এই চেনা পৃথিবীতে আমার জায়গা নেই। আমার জায়গা অচেনা পৃথিবীতে যেখানে থাকবে না পরিচিত কেউ। সেই পৃথিবীতে আমার দুনিয়ার রানী আমি। আমার মর্জির মালিক আমি। সেখানে আমার কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না, কাউকে আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। কারোর রিজেকশন আমায় গুড়িয়ে দেবে না।

তাছাড়া আমার অতীত আর অসুস্থতার কথা জেনে কেউই আমাকে বিয়ে করবে না তাই সারাজীবন মা বাবার উপর বোঝা হয়ে থাকতে হবে। কারোর উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা আমি। অনার্স অব্দি আমি এই বাংলাদেশেই আছি তবে অনার্সের পর কোথায় যাবো সেটা আমার জানা নেই… ইচ্ছা আছে ক্যালিফোর্নিয়া যাবো। IELTS করেছিলাম, সেখানে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার মত স্কোর পয়েন্ট ছিল। তাছাড়া ভিসার জন্য এপ্লাই করেছি। অনার্স শেষ হতে তো আর কিছু দিন বাকি। শেষ করে খানিকটা রেস্ট নিয়েই রেজাল্ট নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মাটিতে পা রাখার ইচ্ছা আমার আছে।

আমার প্রিয় মামা হিসেবে তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ। আমি চাই অন্তত আর কেউ নাহোক তুমি যেন আমার অবস্থান জেনে শান্তি পাও। আমি সিলেট উঠবো… জাপান ভাইয়ের হেল্প নিয়ে ওখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছি। জাপান ভাই বলেছে আমার যা কোয়ালিফিকেশন তাতে একটা ভালো নাচের স্কুলে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। তুমি তো জানো আমি ছোটো থেকেই নাচে তালিম নিয়েছি তাই ওটাই আমার জন্য আপাতত সহজ হবে। আমি চাই তুমি আমার অবস্থান জানো। এসবের মাঝে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা কারণ তুমি আমার মামণির প্রথম সন্তান…

দয়া করে এই কথাগুলো যে আমি তোমাকে বলেছি সেটা কাউকে বলো না। এই চিঠিও কারোর হাতে পড়তে দিও না… পড়া হলেই পুড়িয়ে দাও। চিন্তা করোনা আমি যেখানেই থাকি না কেন সুখে থাকবো। অন্তত এত মানসিক অশান্তি থেকে দূরে থাকবো। মামা তুমি আমার বাল্য সখা… আমার মামণির ছোট্ট আদুরে ভাই তুমি। আমাকে তোমার বন্ধু মনে করে আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।

ইতি,
সানাহ্

চিঠি পড়ে স্তম্ভিত শায়খ। সে ভাবতে পারেনি তার ভাগ্নিটা এভাবে তাদের অজান্তে এত বছর ধরে ভিতর ভিতর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে। এভাবে তরপেছে জানলে কখনোই এসব হওয়ার অবকাশ রাখতো না। সানার চিঠি পড়ে শায়খ অন্তত এটা শিওর যে সানাহ্কে ফারহানের রিজেকশন বড়ই কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু ফারহানকে কি সানাহ্ ভালোবাসতো ? ভালো না বাসলে সানাহ্ যেমন শক্ত মেয়ে তাতে এমন তুচ্ছ কারণে এত বছরের ধৈর্য্য ভেঙে বেরিয়ে পড়ত না।

ফারহানকে শায়খ এত বছরে যা চিনেছে তাতে ফারহান চমৎকার একটা ছেলে। বিহেভিয়ার খুবই ভালো আর মিশুকেও… শুধু সানার কথা শুনলেই পালাই পালাই করে। তাহলে ফারহান কি করে রিজেক্ট করলো সানাহ্কে ? সে কি সানাহ্কে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ?

নাহ্ শায়খ কিছু ভাবতে পারছে না। মন চাইছে ছুটে গিয়ে আদরের ভাগ্নির কান ধরে নিয়ে আসতে ? কিন্তু সেটা পারছে না। ভাগ্নি যে তাকে বড়ই বিশ্বাস করে সবটা বলেছে। সানাহ্কে ফিরিয়ে আনলে কি তার বিশ্বাস ভাঙ্গা হবে ? তাকে কি কষ্ট দেওয়া হবে ? অনেক বড় দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগছে শায়খ।

অফিসে যেতেও মন চাইছে না। আবার না গেলে বসকে ইমেইল করে, ভার্চুয়ালি ফোন করে, হেড ডিপার্টমেন্টেও ম্যাসেজ করতে হবে। ধুর এত ঝামেলা ভালো লাগছে না। পারবে না সে এতকিছু করতে… চাকরি গেলে যাবে। বয়স তো আছে চাকরি করার। চাকরি গেলে আসবে কিন্তু ভাগ্নি গেলে আসবে না। নিজের ভাগ্নি আগে….

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(১৪)

মিস্টার আশরাফ যখন তার পুরনো অতীতের স্মৃতিতে পুরোপুরি বিভোর তখনই বাড়ির সামনে এসে ভিড় করলো দুটো প্রাইভেট কার। শব্দ পেয়ে মিস্টার আশরাফের ঘোর ভেঙে গেলো । উনি ছুটলেন কে এসেছে দেখতে। বাড়ির ছাদ থেকে মিসেস রাহেলা আর মিস্টার আমানও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন বলে উনারাও ছুটে এলেন। সানাহ্ ঘরে নেই খবরটা সবাইকে দিতে ছুটে এসে শায়খ নিজেই গাড়ি দেখে অবাক হয়ে গেলো। তারা ঠাওর করে উঠতে পারল না এত সকালে কে এসেছে।

একটা গাড়ি খুলে মিস্টার কবির,মিসেস কায়নাত আর অতসী বেরিয়ে এলো। আরেকটা কালো গাড়িতে করে মিসেস আশা আর ফারহানও এসে পৌঁছল। দুজনেই গাড়ি রেখে বেরিয়ে এলো। সকলে একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে। সকলের মনেই এক চিন্তা…. কোথায় সানাহ্……

—-

‘ এসব কি মজা চলছে ? সানাহ্ তোমাদের বাড়ি এসে রাতের আঁধারে আবার পালিয়েও গেলো অথচ তোমরা ধরতেই পারলে না…. ইজন’ট ইট এ ওরস্ট জোক ? ‘ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলে উঠলেন মিস্টার কবির।

রাগে কথাগুলো বলেও ক্ষ্যান্ত হলেন না মিস্টার কবির। এবার মিসেস কায়নাতের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন কিছু কড়া বাক্যবাণ ‘ হাজারবার বলেছিলাম মেয়েটাকে একটু নজরে নজরে রাখো। ওর দিকে চোখ রাখো যেন কোনো বিপদ না বাঁধায়। কিন্তু তুমি শুনলে তো। তোমার তো নিজের উপর খুব কনফিডেন্স না ? এই তোমার আদর্শ মা হওয়ার নমুনা। নিজের প্রবল আত্ম বিশ্বাসের জোরে আমার মেয়েটার জীবনই নষ্ট করে দিলে। তুমি মা ডাকার যোগ্য না…. এ ব্লাডি উইচ লেডি। ইউ রুইন্ড ইউর ওউন ফ্যামিলি ‘।

মিস্টার কবিরের এহেন রুঢ় কথাও যেন মিসেস কায়নাতের উপর কোনো প্রভাব ফেললো না। উনি বসে আছেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। মুখে কোনো অনুভুতি নেই। ঠিক যেন অনুভূতিহীন জড় বস্তু। মেয়ের শোকে তার এই অবস্থা হলেও তার নিজেরই এসব কথায় অভ্যাস আছে। মেয়ে এরকম হুট করে হারিয়ে গেলেই তার স্বামী রেগে গিয়ে এসব বলে।

মিস্টার কবিরের এহেন ব্যবহারে ফারহান যেন অবাক না হয়ে পারল না। সে ভাবেনি মিস্টার কবিরের মতো এত ঠান্ডা মাথার মানুষও এভাবে রাগারাগি করতে পারে। কিছুক্ষণ পর নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে বিড়বিড় করে বললো ‘ সানাহ্ ওয়াজ রাইট…. শি টোটালি মেইড ইট ‘।

তবে কথাগুলো নিরুচ্চারে বললেও সম্মুখে মিস্টার কবির এবং সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘ আঙ্কেল এখন এভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার কোনো মানেই হয়না। যা করার সানাহ্ ফিরে এলে করবেন। কিন্তু এখন আগে ওকে খুঁজে বের করাটা দরকার। যা বুঝলাম সানাহ্ কিছুতেই চায়না আমরা ওকে ধরে ফেলি তাই এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে ধরতে হলে আমাদের গামছা বেধে নামতে হবে। সব থেকে ভালো হয় ওর লোকেশন ট্রেস করতে পারলে। ‘

ফারহানের কথায় হার মানলেন মিস্টার কবির। তাৎক্ষণিক মুহূর্তের জন্য নিজের ভিতর জমে থাকা রাগটা চেপে গিয়ে বললেন ‘ তাহলে আমি জাবেদকে ফোন দিচ্ছি। ও আমার ফ্রেন্ড এবং একজন পুলিশ অফিসার। এই বরিশালেই থানার বড় একটা পোস্টে চাকরি করে। সানার লোকেশন বের করা ওর জন্য দুধ ভাত। ‘

ফারহান যেন এই অপেক্ষায় ছিল। মিস্টার কবিরের কথায় খুশি হয়ে বলল ‘ তাহলে আর অপেক্ষা কিসের ? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করুন। এই কাজটা আমাদের আরও আগেই করা উচিত। আপনি উনাকে ফোন দিন তারপর লোকেশন ট্র্যাক হলে আপনার বন্ধু আর আমি মিলে সানাহ্কে খুঁজতে বের হবো। আপনারা সেই ফাঁকে সবাই একটু রেস্ট নিন। ‘

—-

‘ আঙ্কেল সানার লোকেশন কি ট্রেস করা গেছে ? ও কোথায় ? ‘ উদ্বিগ্ন গলায় বললো ফারহান।

ফারহানের কথায় মনে হলো মিস্টার জাবেদ খানিকটা নিরাশই হয়েছেন কারণ ওনার চেহারায় ফুটে উঠেছে ফ্যাকাসে ভাব। উনি আমতা আমতা করে বললেন ‘ লোকেশন ট্রেস তো করেছি…. কিন্তু ‘

‘ কিন্তু কি আঙ্কেল ? ‘ ফারহান অবাক হয়ে বললো।

‘ ওর লাস্ট লোকেশন পাওয়া গেছে সিলেটে যেখানে ও পৌঁছেই ওর ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে। আই থিঙ্ক ও ধরতে পেরেছে আমরা ওকে ট্রেস করছি। ‘ হতাশ গলায় বললেন মিস্টার জাবেদ।

মিস্টার জাবেদের কথায় যেন মিস্টার কবির আরও ভেঙে পড়েছেন। উনি কপালে হাত রেখে ধপ করে বসে পড়লেন। মিসেস কায়নাত স্থানুর মতো বসে আছেন আর মিসেস আশা উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। অতসী কি করবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে সে তিন চার দফা সবার জন্য কফি করে এনেছে।

সানার মামারাও নিজেদের মতো যথা সাধ্য চেষ্টা করছে সানাহ্কে খোঁজার। নিজেদের যত রকমের সোর্স আছে সব কাজিয়ে লাগিয়েছে তারা। সারাদিন খোঁজাখুঁজি করে যখন উনারা সকলে ফিরে রেস্ট নিচ্ছিলেন তখন মিস্টার জাবেদের এই কথা শুনে শায়খের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। তার মনে মনে আশঙ্কা হলো ফারহান যদি সানাহ্কে খুঁজে বের করে ? মেয়েটা বেরিয়েছে দুদিনও হয়নি। সানার চিঠি পড়ে শায়খ অন্তত এটা বুঝতে পেরেছে সানার কিছুদিন মেন্টাল পিস দরকার আর এর জন্য ওর একা থাকা খুব দরকার,কাইন্ড অফ ওয়েদার চেঞ্জ।

মিস্টার জাবেদের কথায় এবার খানিকটা অসহায় হয়ে পড়লো ফারহান। সানাহ্কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই ভেবে কাল থেকে তটস্থ তার উপর দিয়ে সানার এসব পাগলামি তাকে সানার উপর আগ্রাসী করে তুলছে। ফারহান আগ্রাসী গলায় বিড়বিড় করে বললো ‘ ইউ হ্যাভ টু রিপেন্ট ফর ইট উডবি মিসেস ফারহান…. ভেরি সুন। আই উইল নট স্পেয়ার ইউ…. ফর গড সেক আই অ্যাম নট গোইং টু স্পেয়ার ইউ ফর দিস টাইম ‘ ।

কথাগুলো নিরুচ্চারে বললেও ফারহান সম্মুখে বললো ‘ তাহলে যতটুকু পেয়েছি তাকেই কাজে লাগাবো। পুলিশ সোর্স তো আছেই….দরকার পরে সিলেটের অলিগলি চেক করবো তবুও সানাহ্কে আমার চোখের সামনে চাই। ‘

‘ তুমি আমার কথা বুঝতে চাইছ না ফারহান। সিলেট কি তোমার ছোট জায়গা মনে হয় ? তুমি ওকে সারাদিনেও খুঁজে বের করতে পারবে না। ‘ মিস্টার জাবেদ বললেন।

‘ আপনি আমার কথা বুঝতে চাইছেন না স্যার। সিলেট বড় বলে কি আমি আমার ওয়াইফকে খোঁজা বন্ধ করে দিব ? শি ইজ গোইং টু বি মাই ওয়াইফ অ্যান্ড আই ওয়ান্ট হার এট এনি কস্ট। একদিনে খুঁজে বের করতে হবে এমন কোনো কথা আছে ? আমরা দরকার পড়ে ওকে কয়েক দিন লাগিয়ে খুঁজব কিন্তু খুঁজব। আপনি চিন্তা করবেন না….আমি সিলেট পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে নিবো। আপনাকে সানাহ্কে খুঁজতে হবে না ‘ ফারহান রাগী গলায় বললো।

‘ সানাহ্ শুধু তোমার উড বি ওয়াইফ নয় আমারও বন্ধুর মেয়ে তাই ওর প্রতি আমার কিছু দায়িত্ত্ব আছে। আর জাবেদ আলী কখনও নিজের দায়িত্বে আপোস করেনা। আই এম গোইং উইথ ইউ…… ‘ থমথমে গলায় বললেন মিস্টার জাবেদ।

‘ এজ ইউর উইশ ‘ বলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফারহান। সে ভাবেনি এভাবে সানাহ্কে পেয়েও হারাতে হবে। ভুলটা তারই..…সে যদি বিয়ে নিয়ে আপত্তি না করতো তাহলে এসব হতো না। তবে নিজের ভুল শুধরে নেয়ার সময় এখন এসে গেছে।

—-

Saanson mein saanson mein
Teri sargamein hai ab rat din
Zindagi meri toh kuch naa
Ab tere bin

Teri dhadkanon ki sargoshi
Meri dhadkanon me bajti hain
Meri jagti nigaahon me

Khwahish teri hi sajti hain
Mere khayal mein har pal
Tere khayal shaamil hain

Lamhe judaiyon waale
Mushkil bade hi mushkil hain
Oh piyaa….

ছাম ছাম ঘুঙুরের শব্দে মুখরিত পুরো হলঘর। অনবরত বেজে চলেছে সেই মিষ্টি মধুর শব্দ। বিশাল হলঘরের মাঝে হাত পা গানের তালে নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনবরত নেচে চলেছে সানাহ্। মুখে তার মিষ্টি মধুর হাসি আর ঠোঁটও নড়ছে গানের তালে । তাকে ঘিরে খানিকটা দূরেই দল বেঁধে দাড়িয়ে আছে এক রাশ যুবতী। তারা সকলেই মুগ্ধ সানার নাচ দেখে। তারা ভাবেনি যেই মেয়েটাকে দেখতে এত স্থির, অচঞ্চল মনে হয় সে নাচের সময় এভাবে প্রাণবন্ত হয়ে নাচতে পারে।

সানাহ্ তার প্রাণবন্ত হাত পা ছড়িয়ে নেচে চলেছে পুরো ঘরময়। একসময় নাচতে নাচতেই সে তার আজকের তালিম শেষ করলো। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মাঝে নাচ করতে গিয়েও সে ঘেমে একাকার। কাউচে বসে মিলাকে বললো এসির টেম্পারেচার আরও কমিয়ে দিতে। তারপর পাশ থেকে নিজের ওয়াটার পটটা নিয়ে গলায় পানি ঢাললো। খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে এবার বললো ‘ যেহেতু আমার আগেও একজন এক্সপেরিয়েন্সড টিচার তোমাদের নাচ শিখিয়েছেন সেহেতু আমি মনে করি এই নাচ তুলতে তোমাদের তেমন সমস্যা হবে না। আজ ডেমো দেখিয়েছি…. কাল থেকে নাচ তোলার প্রয়াস চলবে। ঠিকাছে ? আর আগের নাচটা নিয়মিত প্রাকটিস করবে নাহলে মনে থাকবে না। ঠিকাছে ? ‘

সকলে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল সানার কথায়। তারা সকলেই হতভম্ব সানার নাচ দেখে। তাদের মনে হলো এতটা ভালো নাচ তাদের প্রিভিয়াস টিচারও পারতেন না। সানাহ্ যেই গানে নেচেছে সেই গানে সে খুব ভালো করেই নিজের ব্যালান্স মেইনটেইন করেছে। এই ধরনের নাচ করাটা অনেকটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার কারণ এই নাচ যত দ্রুত নাচা যায় ততই সুন্দর যার কারণে প্রায় সময় ব্যথায় পা টনটন করে। তবে সানাহ্ সেসবের ধারের কাছেও নেই কারণ এসব তার বহু বছরের সাধনার ফসল।

—-

‘ মিস সানাহ্ আপনি দেখছি অল্প সময়েই স্টুডেন্টদের মন জয় করে নিয়েছেন। সকলে এখন আপনার কাছেই নাচ শিখতে চাইছে। প্রথমে তো বাচ্চারা মানতেই চাইছিল না নতুন টিচারকে কিন্তু এখন তারা অবাক আপনার নাচ দেখে। ‘ মিসেস শকুন্তলা বললেন।

মিসেস শকুন্তলা নাচের স্কুলের একজন পুরোনো শিক্ষক। এই স্কুলের সঙ্গে সে জড়িত আছে একদম প্রথম থেকে যখন স্কুলটা একটা কামরার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। উনার আর গুরুজীর যৌথ চেষ্টায় আজ নাচের স্কুল অনেক বড় হয়েছে।

মিসেস শকুন্তলার কথা শুনে আলতো হাসলো সানাহ্। হালকা হেসে জরুরি কথাবর্তা শেষ করে কাধে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। একজন নিউ কামার হিসেবে সে ভালই উন্নতি করেছে সিলেটে এসে। একটা ভালো নাচের স্কুলে চাকরি সেই সঙ্গে কিছু টিউশনি। এর থেকে যা আর্ণ হয় তাতে আরামসে চলে যাবে সানার। এখানে এসে সানার বরং সুবিধাই বেশি হয়েছে।

জাপানের সাহায্যে একটা দুই রুম,একটা বারান্দা আর এক বাথরুমের ফ্ল্যাট পেয়েছে খুবই স্বল্প ভাড়ায়। তার উপর চাকরির ব্যবস্থাও জাপানই করেছে। সব মিলিয়ে হয়তো মাস শেষে হাজার দুয়েক টাকা সেভিংসও করা যাবে। তারপর অনেকগুলো টাকা জমলে সেটা দিয়ে কোথাও ইনভেস্ট করে ভালোই কামাই করা যাবে।

ভবিষ্যৎ চিন্তা ভাবনা করতে করতেই এগোচ্ছিল সানাহ্। মনে পড়লো বাড়ি ফিরে ফারহানকে একটা চিঠি লেখা দরকার। বেচারা হয়তো চিন্তায় আছে। সানার খানিকটা খারাপই লাগছে এভাবে সবাইকে ছেড়ে এসে থাকতে। সবাই হয়তো ওকে নিয়ে টেনশন করছে। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে চোয়াল শক্ত করে ভাবলো খারাপ লাগলেও সেই খারাপ লাগা কাটাতে হবে। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সবাই নিজের কথাই ভাবে তাই সে যদি নিজেকে নিয়ে ভাবলে তাতে কোনো অপরাধ নেই।

ফ্ল্যাটে ফিরেই চুলায় রান্না চরাল সানাহ্। এই ক্ষেত্রেও জাপানকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। সে না থাকলে সানাহ্ একলা এতকিছু সামলে উঠতে পারত না। ফ্ল্যাটের টুকিটাকি যা লাগবে তার সবই জোগাড় করে দিয়েছে জাপান। তেল থেকে শুরু করে হাড়ি সবই। সানাহ্ এই প্রথম কারোর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করছে।

রান্না শেষ করে ঘর পরিস্কার করে ফ্যান ছেড়ে ফ্যানের নিচে বসলো সানাহ্। এই শীতকালেও কাজ করায় সে ঘেমে একাকার। সে সিলেট এসে উঠেছে তার প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো। প্রথম প্রথম বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করবে। মনে হচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে এসে ভুল করেছে। সেই সময় দেবদূত হয়ে এলো জাপান আর ফারাইরা নামের সেই মেয়েটা যে ওকে বাসে হেল্প করেছিল। আসলে মেয়েটা জাপানের উডবি ওয়াইফ। সে প্রথম দিন সানাহ্কে দেখেই চিনতে পেরেছে আর সানাহ্ নিজেও। অবাক হয়েছিল এটা জেনে যে ওই পিচ্ছি মেয়ে জাপানের বাগদত্তা।

সানাহ্ যখন ফ্যানের নিচে বসে নিজেকে ঠান্ডা করতে ব্যস্ত তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। সানাহ্ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুচকে চিন্তা করলো কে আসতে পারে। জাপান নাকি পাশের ফ্ল্যাটের জয়িতা বৌদি ? তবে দরজা না খুললে তো জানা যাবে না তাই সানাহ্ গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলেই বাইরে দাড়িয়ে থাকা জয়িতা বৌদিকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে আপনিতেই হাসি ফুটে উঠল।

জয়িতা মিত্র হলেন সানার নেইবার। উনার সঙ্গে উনার স্বামী হরিহরও থাকেন। এই হিন্দু দম্পত্তি নিজেদের বিশাল বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে ছোটো বাড়িতে থাকতে এসেছেন শুধুমাত্র জীবনের শেষ বয়সে একটু একসঙ্গে আলাদা সময় কাটাবেন বলে।

মিসেস জয়িতা সেই সূত্রে বড়ই মিশুক। উনাদের পাশের ফ্ল্যাটে যেই আসে তার সঙ্গেই বন্ধুত্ত্ব করে ফেলেন তবে উনার এই বন্ধুত্ত্ব কারোরই ভালো লাগে না বলে কয়েকদিন পরই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এক্ষেত্রে সানাহ্ খানিকটা অন্যরকম। সে শত ইন্ট্রোভার্ট হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দিনেই মিসেস জয়িতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে।

‘ আরে জয়িতা বৌদি তুমি ? বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? ঘরে এসো…… ‘ বলে সানাহ্ মিসেস জয়িতার হাত টেনে তাকে ঘরে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে বারান্দায় বসলো। বারান্দায় জাপান দুটো বেতের সোফা আর একটা কাচের ছোটো টি টেবিল লাগিয়েছে তাই সেখানেই বসেছে ওরা।

‘ তুমি একা কেন ? হরি দা কোথায় ? উনি কি আজও বাজার গেছেন ? কাল না তোমরা বাজার করলে ? ‘ সানাহ্ জিজ্ঞেস করলো।

‘ আরে না না আজ ও বাজার যায়নি। আসলে ও একটু বেরিয়েছে। ওর পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে কদিন ধরে কিন্তু আমায় কিছুই বলেনি। আজ হঠাৎ করে কথায় কথায় বলে ফেললো। তাই আমি বললাম আমি গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসি ফার্মেসি থেকে কিন্তু সে শুনলে তো। সে বলে সে থাকতে আমি কেন বের হবো ? তাই সে একাই বেরোলো… ‘ মিসেস জয়িতা বললেন।

‘ ওহ্ আচ্ছা…… তা তুমি কি খাবে বলো। আমি চা করে আনবো ? তারপর দুজনে মিলে বিস্কিট ডুবিয়ে খাবো। চলবে না ? আসলে ঘরে তেমন কিছু নেই। আজ বাজার শেষ। আবার বেরিয়ে আনতে হবে…. ‘ সানাহ্ বললো।

‘ আরে না না ওসবের দরকার নেই। আমি ভাবছি আজ তোকে নিয়ে একবার আমার মেয়ের বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসবো। তুই যাবি আমার সাথে ? ‘ মিসেস জয়িতা আলতো হেসে বললেন।

মিসেস জয়িতার কথা শুনে মনে হয় একটু অসস্তিতে পড়লো সানাহ্। আমতা আমতা করে বলল ‘ না মানে আমি…. আমি কি করে যাবো ? তোমার মেয়ে আমাকে চিনে না আর আমিও তাকে চিনি না। ‘

‘ আরে চিনাচিনি করা লাগবে কেন ? তুই যখন এসেছিলি তখন কি আমাকে চিনতি ? তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে না ? তাহলে ওর সঙ্গেও হবে। আমি কোনোকিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুই আমার সঙ্গে যাবি ব্যাস…. তোর দাদা আজ যেতে পারবে না। তার পায়ে ব্যথা। ‘
অগত্যা সানাহ্ আর কি করবে। তার রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ….